খুব দুঃখ হয়েছে মিনতির। ছোট্ট বছর সাতেকের মেয়ে। পুজো এলেই ওর মনে কেমন যেন রেলগাড়ি ছুটতে শুরু করে। পঞ্চমী এলেই ঢাকটাকে কাঁধে ফেলে বেরিয়ে পড়ে বাবা। মুখে একরাশ ভরসার হাসি। ফিরব যখন, নতুন জামা নিয়ে আসব। নতুনের সঙ্গে কিছু ভালো পুরনো জামাও পায় মিনতি। কিন্তু এবার অতটা হবে না। মাকে সেদিন চুপিচুপি বলছিল বাবা... আগের বারের থেকে নাকি পয়সা কম পাবে। যে বড় বাড়িটায় ঢাক বাজাতে যায়, সেখানে এবার পুজোর খরচ কম হচ্ছে। যে টাকাটা বাবা পাবে, তার বেশিটাই তুলে রাখতে হবে... খারাপ সময়ের জন্য। পরে থাকা ফ্রকটার দিকে তাকাল মিনতি। গতবার এনে দিয়েছিল বাবা। কাল মহালয়া। মনটা আরও খারাপ খারাপ হয়ে গেল...। এ বছরের পুজো কি ওর নয়?
নবান্নের ১৪ তলার ঘরটাতে অ্যাকোয়ারিয়মের সামনে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে মাছগুলোকে দেখছিল সাবির মল্লিকের একরত্তি মেয়েটা। এমন মাছ কখনও দেখেনি সে। মায়ের সঙ্গে এসেছে এখানে। এক দিদার কাছে। টিভিতে দেখেছে সে আগে। কেন এসেছে? জানে না। শুধু জানে, বাবাকে অনেকদিন দেখেনি ও। আজকাল মা খুব কাঁদে। বাবা কবে ফিরবে? বারবার জিজ্ঞেস করেও উত্তর পায় না সে। জানতে পারেনি সে... বাবাকে হরিয়ানায় পিটিয়ে মেরে ফেলেছে গো-রক্ষকরা। সেই মুহূর্ত থেকে শূন্য হয়ে গিয়েছে তার পৃথিবী। পুজো, আর ঈদের সময়টা তারাও খুব আনন্দ করে। কারণ, তখন বাবা ফিরে আসে কাজ সেরে। অনেক খেলনা, জামা পায় সে। এবার পুজো নেই? বুঝতে পারছে না ছোট্ট মেয়েটা।
মিনতিদের কাছে এবার তাই পুজোটা কেমন একটা ঠেকছে। তাদের বাবারা এই সময়ই কলকাতায় যায়। কেউ ঢাকি, কেউ মণ্ডপ বানায়, কেউ জামা-কাপড় বিক্রি করতে যায়, আবার কেউ ওই চারটে দিন কোনও প্যান্ডেলের সামনে খাবারের স্টল দেয়। কাল মহালয়া, অথচ তেমন তাড়াহুড়ো দেখতে পাচ্ছে না মিনতিরা। শহরে সবাই কেমন একটা আন্দোলনের মুডে আছে। পুজোটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছে কিরণ সাউয়েরও। তিনি দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি, পুজোটা এত মর্মান্তিক হয়ে আছড়ে পড়বে তাঁর কাছে। সামান্য জ্বর আর শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল মেয়েটা। হেঁটেই ঢুকেছিল। কিন্তু ফিরল না। টান উঠল। দু’ঘণ্টা ধরে ছটফট করল। তারপর সব শেষ। হাসপাতালের এক কর্মী অক্সিজেন লাগানোর চেষ্টা করল... হল না। নিথর হয়ে গেল মেয়েটা। কাল মহালয়া। মা আসছেন। অমাবস্যা কাটলেই শুরু হয়ে যাবে দেবীপক্ষ। তার ঠিক আগে চলে গেল মেয়েটা। খবরটা শুনে বিশ্বাস হয়নি। মেয়ের না থাকাটা মাথায় আঘাত করা মাত্র এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল সব। যন্ত্রণা ধরে রাখতে পারেননি। সেই ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন ডাক্তারদের উপর। মারধর করেছিলেন তাঁরা। তারপর থেকেই সাগর দত্তর ডাক্তাররা কর্মবিরতিতে চলে গিয়েছেন। বোঝেননি সদ্য কন্যাহারা মা। বোঝেননি, ডাক্তার-নার্সদের গায়ে হাত তোলা উচিত হয়নি তাঁদের। তাঁরা মানুষকে পরিষেবা দেন। প্রাণে বাঁচান। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করেন। কিরণ দেখেছেন, কত্ত লোক এই আন্দোলনে ডাক্তারদের পাশে দাঁড়িয়ে গিয়েছেন। ওই অভয়া মেয়েটার জন্য। কিন্তু তাঁর মেয়ে...?
কিরণ সাউ মা। নারী সমাজের প্রতিনিধি। অভয়াও তাই ছিলেন। আর মিনতি ভবিষ্যৎ। দেবীপক্ষ শুরু হলে যে মা মর্ত্যে আমাদের মধ্যে আসছেন, তাঁরই অংশ। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ইতিহাস সাক্ষী, যখন প্রয়োজন হয়েছে, পুরুষকুল নতজানু হয়েছে একজন দেবীর কাছে। নারীর কাছে। প্রবল পরাক্রমী মহিষাসুর যখন দৈব বলে দেবতাদেরই কাবু করে ফেলেছিলেন, তখন শরণ নিতে হয়েছিল এক নারীরই। মা দুর্গা। এই দেবীরই বরে রামচন্দ্রের সব মারণ অস্ত্র রাবণকে ছুঁতে পারেনি। স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মার পরামর্শে রাম তখন আরাধনা করেছিলেন দেবী দুর্গার। এই শরতে। মান সরোবর থেকে নিয়ে আসা ১০৮টি পদ্ম উৎসর্গ করছিলেন রামচন্দ্র। কিন্তু মা দুর্গা তার থেকে একটি লুকিয়ে ফেলেছিলেন। শেষ পদ্মটি খুঁজে না পেয়ে নিজের নীলবর্ণ পদ্মের মতো চোখ উৎসর্গ করতে গিয়েছিলেন রাম। দেবী নিজেই তখন তাঁকে বাধা দেন। সেই ছিল মায়ের অকাল বোধন। কখনও তিনি চণ্ডী, কখনও কালী, কখনও মা তারা। তিনি সর্বভূতেষু। মাটি, ইট, কাঠ, পাথর, বাতাস, ধুলিকণায়... আশ্বিনের হাওয়া গায়ে লাগলে যেন তাঁর অধিষ্ঠানের সেই গন্ধ আরও বেশি করে নাড়া দিয়ে যায়। মা আসছেন। মা আছেন। তিনি শক্তিরূপেণ, শান্তিরূপেণ, আবার লজ্জারূপেণও। তাঁকেই বর্ণনা করা হয়েছে জাতিরূপেণ, বুদ্ধিরূপেণ, বা ক্ষুধারূপেণ শব্দে। এরপরও কেন তাহলে নিরাপত্তার দাবিতে পথে নামতে হয় নারীদের? কেন চাইতে হয় অধিকার? কেন ‘রাত দখল’ করতে হয়? কেনই বা জন্ম নেয় এই শব্দবন্ধ? কারা নেয় রাতের দখল? এটা কি মেয়েদের জন্যও অসম্মানের নয়? নাকি দিন, রাত, ঘড়ির কাঁটার ফেলে যাওয়া প্রত্যেকটি মুহূর্তে নারীর অধিকার নেই? তাঁর গর্ভ থেকে যখন সন্তান জন্ম নেয়, সেটা একজন নারীর জীবনের ঐশ্বরিক মুহূর্ত। সেই সন্তান যদি গভীর রাতে ভূমিষ্ঠ হয়, তাহলে কি রাতটা ওই মায়ের নয়? নাকি নয় সেই কন্যাসন্তানের?
আসলে দৈন্য যে আমাদের ভাবনায়। আর এই ‘আমরা’র মধ্যে ছেলেদের সঙ্গে জমিয়ে বসে আছে মেয়েরাও। আজও কোনও না কোনও সংসারে গরিব ঘর থেকে আসা ‘নিরুপমা’কে প্রাণ দিতে হচ্ছে পণের জন্য। শিক্ষিতা-মেধাবী নববধূকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে স্বামীর মুখের দিকে, যদি তিনি চাকরি করার অনুমতি দেন। আর সেই অনুমতি না পেলে, তিনি সেটাও মেনে নিচ্ছেন। একবারও তাঁর মনে হচ্ছে না, কোনও স্বামী তাঁর ‘বউকে চাকরি করতে দেওয়ার’ সঙ্গে ‘চাকরি করতে না দেওয়ার’ কোনও ফারাক নেই। যে সমাজ আজ অভয়ার বিচার চেয়ে রাতের শহরকে বিনিদ্র করে তুলছে, তারাই ১২টার সময় কোনও মেয়েকে অফিস থেকে ফিরতে দেখলে চোখ কুঁচকাবে। বাড়ির ছেলে গভীর রাতের পার্টিতে যেতে পারে, মেয়ে নয়। নিরাপত্তার আশঙ্কা? সেটাই যে শেখানো হয় মেয়েদের। আমরা শেখাই। আমরা দেবীর বীরত্বের পুজো করি, আর কন্যাসন্তানকে বলি, বাড়ির ভিতর থাকো। সমস্যার মোকাবিলা কোরো না। কেউ কিছু বলতে গেলে পালিয়ে এসো। তাই সমাধানও অধরা থেকে যায়। বাড়তে থাকে আতঙ্ক। সেই সাহস ফিরে পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় আবার কোনও নির্ভয়া বা অভয়ার চলে যাওয়ার।
শ্রীরামপুর থেকে নিউ মার্কেটে শপিং করতে আসা তিন বান্ধবীও যে সে কথাই বলছিল। কলেজ পড়ুয়া। কেনাকাটা শেষে রেস্তরাঁয় খেয়ে বাড়ি ফিরবে। অত রাতে ফিরতে ভয় করবে না? একজন বলছিল, ‘না দাদা, করবে না। আমরা সাহস পেয়েছি কি না জানি না। তবে কিছু লোক ভয় পেয়েছে।’ জানতে ইচ্ছে করে, অন্যের ভয়ের আশায় আমাদের ঘরের দুর্গা, কালী, তারাদের কেন বসে থাকতে হবে? আর কতদিনই বা এই অপেক্ষা? এই মিছিল কাল শেষ হবে। কেউ প্রচার ঘরে তুলবে, কেউ অন্য কোনও স্বার্থ। সত্যিকারের বিচারের দাবিতে পথে দাঁড়িয়ে থাকা আম আদমি তখন আবিষ্কার করবে, সে বিলকুল একা। সে দেখবে, মানুষ, নেতা, মন্ত্রী, প্রশাসন... সব বদলে গেলেও সমাজটা বদলায়নি। যারা সেদিন ভয়ে মাথা নিচু করেছিল, তাদের দাঁত-নখ আবার বেরিয়ে এসেছে। অর্থাৎ, নিরাপত্তা আসেনি। আর হ্যাঁ, আসবেও না। তার জন্য সমাজকে বদলাতে হবে। একজন নারীর বিচার চাইতে গিয়ে আর একজন নারীকে হেনস্তা সমাধান নয়। কিংবা একজন কিশোরী বা যুবতীর প্রাণ চলে যাওয়াটাও জাস্টিস নয়। প্রতি ক্ষেত্রেই আমরা অস্বীকার করছি মাতৃসত্ত্বাকে। যে মায়ের সামনে বসে ভক্তিতে গদগদ হয়ে থাকছি, তাঁকেই সমাজের মাটিতে দাঁড়িয়ে অপমানিত করছি বারবার। কীসের সংরক্ষণ? কীসের ছাড়? অধিকার ছাড়া আর কোনও শব্দ কি নারী বা পুরুষ কারও জন্য যথাযোগ্য হতে পারে? সমাজের দুর্ভাগ্য, নারীদের আজও এই সমাজ পণ্য হিসেবেই দেখে চলেছে। রাস্তাঘাটে, সিনেমার স্ক্রিনে, বা সম্বন্ধ দেখতে গিয়ে। তাই অধিকার শব্দটা মাথাতেই আসে না। শুধু শোনা যায় মিছিল, মিটিং, রাজনীতির মঞ্চে।
ঠান্ডা মাথায় ভাবলে দেখতে পাবেন, অভয়া শেষ পর্যন্ত একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়েই থেকে যাচ্ছে। যত মানুষ ডাক্তারদের জন্য পথে নেমেছিলেন, তাঁরা এখন দেখছেন, এই আন্দোলনে সাধারণের জন্য কিছু নেই। সবটাই মূল আন্দোলনকারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সব ধরনের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার দাবি নয়, হাসপাতালে সুরক্ষা নিয়ে তাঁদের আন্দোলন। ওষুধ কোম্পানিদের চাপিয়ে দেওয়া অগ্নিমূল্য নয়, বিক্ষোভের লক্ষ্য স্বাস্থ্যসচিব। প্রতি বছর লাফিয়ে বাড়তে থাকা ডাক্তারদের ফি বা চিকিৎসা খরচ নয়, এই আন্দোলন হাসপাতালের নিরাপত্তারক্ষী এবং সিসি ক্যামেরা নিয়ে। অথচ অভয়ার মৃত্যুকে সামনে রেখে রক্ষণশীল এবং হিপোক্রিট সমাজের গোড়ায় ঘা দেওয়ার সুযোগ একটা ছিল। কিন্তু আন্দোলন সে পথে যায়নি। গেলে অভয়া বিচ্ছিন্ন হতেন না। প্রত্যেক মেয়ের মধ্যে থেকেই একজন অভয়া জন্ম নিতেন। বন্ধু বা সহকর্মী হয়ে যাঁরা পিঠে ছুরি মেরেছিল, চিনিয়ে দিতেন তাঁদের। কর্মক্ষেত্রে প্রত্যেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতেন। বদল আনতেন তাঁরা নিজের বাড়িতে, অফিসে, বাসে, রাস্তায়। নিঃশব্দে। আর সর্বত্র তাঁদের পাশে পেতেন পুরুষ সমাজকেও। তাহলে কিন্তু কিরণ সাউদের সন্তান হারাতে হতো না। মিনতিদেরও একবুক যন্ত্রণা নিয়ে পরের পুজোর অপেক্ষায় থাকতে হতো না।
বলছেন ‘তাঁরা’... উৎসব চান না। তাই খরচে কোপ। খানিক আনন্দ হতে পারে। সঙ্গে নতুন জামা, বাইরে খাওয়া, নিজের বুটিক-পার্লারের বিজ্ঞাপন, আর খুব বেশি হলে ঘুরতে যাওয়া। কিন্তু উৎসব নয়। এ এক অদ্ভুত ট্রানজিশনের মধ্যে দিয়ে চলেছে আমাদের সমাজ। সিবিআই যা করছে, তাতে যদি জাস্টিস না আসে, কী তাহলে ন্যায়বিচার? নতুন জামা, রেস্তরাঁয় খাওয়া, আর প্যান্ডেল হপিং যদি উৎসব না হয়... উৎসব তাহলে কী? প্রান্তিক মানুষের আনন্দে কোপ ফেলা? কেন তাঁরা বলতে পারছেন না যে—অন্যের ভয় নয়, নিজের সাহসের উপর ভর করে কোনও সদ্য যুবতী যেদিন একা বাড়ি ফিরতে পারবে, প্রকৃত উৎসব হবে সেদিন। একজন মেয়ের বাবা যেদিন সমাজের উপর, আপনাদের উপর ভরসা রাখতে পারবেন, উৎসব তোলা থাকবে সেদিনের জন্য। আর হ্যাঁ, ন্যায়বিচারের নামে স্বার্থ-সুযোগ ঝেড়ে যেদিন অভয়াকে কেউ আর রাজনীতির ঘুঁটি করবে না... প্রকৃত উৎসব হবে ওই দিনও।