বিশেষ নিবন্ধ

‘থ্রেট সিন্ডিকেট’ কী, টের পেলেন কিঞ্জল
তন্ময় মল্লিক

অভয়ার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় যুক্তের সংখ্যা এক না একাধিক, এই প্রশ্নের উত্তর ইতিমধ্যেই মিলেছে। সিবিআইয়ের প্রাথমিক চার্জশিটে একটা বিষয় পরিষ্কার, এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়। ফলে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিসে’র স্লোগানে গলা মেলানো অনেক সাধারণ মানুষও মনে করছে, অভয়ার খুন এবং ধর্ষণ পাশবিক শক্তি ও ব্যক্তি লালসার নির্মম পরিণতি। কোনও পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র নেই। স্রেফ অভয়ার জাস্টিসই আন্দোলনের লক্ষ্য হলে এতদিনে সব স্বাভাবিক হয়ে যেত। পরিসমাপ্তি ঘটত অনশন আন্দোলনের। কিন্তু সেটা হয়নি। কারণ এই আন্দোলনের মুখ জুনিয়র ডাক্তাররা হলেও আড়কাঠিটা নাড়ছেন রাজনীতির কারবারিরা। আর এখন এটা অনুমান নয়, প্রমাণিত সত্য।
অভয়ার জাস্টিসের দাবিতে যখন আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তখন তা ছিল একেবারেই অরাজনৈতিক। দল, মত, ধর্ম নির্বিশেষে রাজ্যের মানুষ এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছিল। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছিল। তাই চিকিৎসকদের আন্দোলন হয়ে উঠেছিল গণআন্দোলন। সেই কারণেই বেশিরভাগ জুনিয়র ডাক্তার এই আন্দোলনকে ‘অরাজনৈতিক’ রাখার পক্ষে। তাঁরা প্রাণপণে রাজনৈতিক ছোঁয়াচ এড়িয়ে চলার চেষ্টা চালিয়েছেন। তার প্রমাণও মিলেছে। সন্দীপ ঘোষকে সিবিআই গ্রেপ্তার করার কিছুক্ষণের মধ্যেই আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের ‘পাশে আছি’ বার্তা দিতে গিয়েছিলেন বিজেপি সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। শুনেছিলেন ‘গোব্যাক’ স্লোগান। একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পলেরও। 
জুনিয়র ডাক্তাররা বিজেপি নেতৃত্বকে বারবার প্রত্যাখ্যান করায় আম জনতার চোখেও এই আন্দোলন ছিল ‘অরাজনৈতিক’। ফলে সমর্থন বেড়েছিল লাফিয়ে লাফিয়ে। কিন্তু তাল কাটে অপরাধীর শাস্তির চেয়েও পুলিস ও স্বাস্থ্য কর্তাদের সরানোর দাবি উচ্চকিতে উচ্চারিত হতেই। তখন অনেকে বলেছিলেন, ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’। তবুও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পাঁচ দফার মধ্যে তিন দফা দাবি মেনে নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাতে অধিকাংশ চিকিৎসক সন্তুষ্ট হয়ে কাজে যোগ দিলেও খুশি হননি রাজনীতির কারবারিরা। মূলত তাঁদের উস্কানিতেই পুজোর ভরা মরশুমে শুরু হয়েছিল আমরণ অনশন। 
ধর্মকে আফিম মনে করা কমিউনিস্টরা পুজোর সময় বইয়ের স্টল দিলেও তারা পুজোয় বিশ্বাসী নয়। তাই ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকলেও সরকারিভাবে পুজো বা উৎসবকে প্রোমোট করেনি। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসেই সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষকে নিজ নিজ ধর্ম এবং উৎসব পালনে উৎসাহিত করেছেন। পুজোর পথে অর্থ যাতে অন্তরায় না হয়, তারজন্য অনুদান দিয়েছেন। কার্নিভালের আয়োজন করে দুর্গোৎসবকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। অনেকেই বলছেন, জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনকে সামনে রেখে বাঙালির প্রাণের উৎসব দুর্গাপুজোকে ঘেঁটে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘শিক্ষা’ দিতে চেয়েছিল সিপিএম। 
তবে, এসব করে সিপিএমের কতটা লাভ হল, সেটা সময় বলবে। কিন্তু জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন নিয়ে সিপিএমের অতি সক্রিয়তায় ঝুলি থেকে বেড়ালটি বেরিয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন পর্দার আড়ালে থেকেই সিপিএম এই আন্দোলনে অক্সিজেন জোগাচ্ছিল। কিন্তু বিজেপির মতো তারা সামনে আসেনি। পুজোর সময় সেলিম সাহেবদের ভুল চালে পর্দার আড়ালটা সরে গিয়েছে। 
উৎসবপ্রিয় বাঙালি পুজোর সময় আন্দোলনে পাশে থাকবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। অনশনস্থলে ভিড় কমছিল। তাই জুনিয়র ডাক্তাররা মানুষকে পাশে থাকার ডাক দি঩তেই সিপিএমের ঘোষণা, দলীয় পতাকা ছাড়াই কমরেডরা থাকবেন ডাক্তারদের পাশে। তাতে আন্দোলনস্থলে কিছুটা প্রাণের সঞ্চার হলেও ‘গণআন্দোলনে’র গায়ে পাকাপাকিভাবে লেগে যায় রাজনীতির রং। 
জুনিয়র ডাক্তারদের একটা বড় অংশ সিপিএমের সঙ্গে মাখামাখির বিষয়টি মানতে পারেনি। এই নিয়ে তীব্র মতভেদ হয়। সেই ক্ষোভেরই বিস্ফোরণ ঘটে ডাঃ কিঞ্জল নন্দের ভাষণে। আন্দোলনের অন্যতম মুখ কিঞ্জল অনশনের মঞ্চে বলেন, ‘একটি কথা খুব দৃঢ়তার সঙ্গে আমরা ডব্লুবিডিজেএফের পক্ষ থেকে বলতে চাই, আমাদের এই কর্মসূচিকে কিছু রাজনৈতিক দল নিজেদের কর্মসূচি বলে প্রচার চালিয়েছে। তাদের এই প্রচেষ্টাকে আমরা তীব্র ধিক্কার জানাই।’
কিঞ্জলের এই কথার মধ্যে কোনও অন্যায় ছিল না। তিনি কেবল আন্দোলনের ‘অরাজনৈতিক’ ইমেজটা বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। কারণ তিনি জানেন, রাজনীতির রং লাগলে তা আর ‘গণআন্দোলন’ থাকে না। তাই তিনি জুনিয়র ডাক্তারদের ‘স্ট্যান্ড’ স্পষ্ট করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমাদের ভাই-বোনেরা মানসিক দৃঢ়তার সঙ্গে আমরণ অনশনে বসে আছে। সেই অনশনকে কাজে লাগিয়ে যদি কোনও রাজনৈতিক দল নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির কথা ভাবতে চায়, তাহলে ডব্লুবিডিজেএফ হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখছে, যে বা যারা এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক রঙে রাঙানোর চেষ্টা করছে তাদের তীব্র ধিক্কার জানাচ্ছে।’ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়টি হল, কিঞ্জল কিন্তু একটিবারের জন্যও সিপিএমের নাম মুখে আনেননি। 
গ্রাম বাংলায় একটা প্রবাদ চালু আছে, ‘পড়ল কথা হাটের মাঝে/ যার কথা তার বুকে বাজে।’ কিঞ্জল নন্দ হুঁশিয়ারি দেওয়া মাত্র সিপিএমের লোকজন রে রে করে মাঠে নেমে পড়ল। সোশ্যাল মিডিয়ায় কিঞ্জলবাবুর ভূত, ভবিষ্যৎ নিয়ে টানা হেঁচড়া শুরু হয়ে গেল। নীচে নামানোর জন্য কেউ কেউ তাঁর শ্বশুরকে নিয়েও টানাটানি শুরু করে দিলেন। তবে, তাতে এতদিন জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের পিছনে যে বাম এবং অতি বামেদের উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ উঠছিল, তা প্রমাণ হয়ে গেল। অনেকে মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের গাড়ি আটকানোর ছবি পোস্ট করে বোঝাতে চাইলেন, সিপিএমের জন্যই জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন এই উচ্চতায় পৌঁছেছে। সিপিএম পাশে না থাকলে নাকি জুনিয়র ডাক্তারদের ফুটেজ জুটত না। আবার কেউ কেউ ডব্লুবিজেডিএফ প্যাডে কিঞ্জলকে লিখিতভাবে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়ে বসলেন। কদর্য ভাষায় ব্যক্তিগত আক্রমণও চলল। 
কিঞ্জলের কথায় শুধু সিপিএমের ইয়ং ব্রিগেডই চটেনি, দলের প্রাজ্ঞ, প্রবীণরাও রুষ্ট হয়েছিলেন যথেষ্ট। প্রয়াত বিনয় কোঙারের বড় ছেলে সুকান্ত কোঙারও সোশ্যাল মিডিয়ায় উগরে দিলেন তাঁর ক্ষোভ। তাঁর করা দু’টি পোস্টে মিশেছিল ব্যঙ্গ ও আক্রমণ। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘কোন আন্দোলনে কে অংশগ্রহণ করবে, তা ঠিক করার অধিকার আন্দোলনকারীদের নেই।’ এই পোস্ট করে প্রবীণ সিপিএম নেতা কী বোঝাতে চাইলেন? জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা যতই আপত্তি করুন না কেন, গণআন্দোলনের কৃতিত্বে তাঁরা ভাগ বসাবেনই।
জুনিয়র ডাক্তাররা ‘থ্রেট সিন্ডিকেটে’র বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে কারা থ্রেট সিন্ডিকেট চালাত তার তালিকা আন্দোনলকারীরা জমা দিয়েছেন। তার ভিত্তিতে রাজ্য সরকার তদন্ত চালাচ্ছে। ইতিমধ্যেই বহু মেধাবী ছাত্রছাত্রীর কলেজে ঢোকার ও ক্লাস করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। অনেকে সাসপেন্ডও হয়েছেন। এই সব সিদ্ধান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে চাপের মুখে নেওয়া হয়েছে, নাকি অভিযোগের সত্যতার ভিত্তিতে, তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। তবে, সেই সব বিতর্ক দূরে সরিয়ে রেখেও একটা প্রশ্ন অনায়াসেই তোলাই যায়, কিঞ্জল কি ‘থ্রেট সিন্ডিকেটে’র শিকার হলেন না?
আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা কেন রাজনৈতিক দলকে এড়িয়ে চলতে চাইছেন, তার ব্যাখ্যাও কিঞ্জল দিয়েছিলেন। তাঁর কথায়, মূল লক্ষ্য ছিল ন্যায় বিচার। প্রত্যেকটি মানুষ নিজেদের দলীয় রং-কে বাইরে রেখে এক হয়ে আওয়াজ তুলেছিলেন। এরপর আমাদের আন্দোলন জনসাধারণের আন্দোলন হয়ে ওঠে। সেই বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের একটাই রং ছিল...সত্য।  
এই ‘সত্যে’র জোরেই চিকিৎসকদের আন্দোলন ‘গণআন্দোলন’ হয়ে ওঠে। কিন্তু ক্ষীর খাওয়ার লোভে ‘অরাজনৈতিক’ আন্দোলনের গায়ে রাজনীতির রং লাগাতে মরিয়া হয়ে ওঠে সিপিএম। তাতে ঘরে-বাইরে প্রবল চাপের মুখে পড়ে কিঞ্জল ক্ষমা চাইতে বাধ্য হলেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমার কোনও কথা যদি কাউকে আঘাত দিয়ে থাকে, আমি ক্ষমাপ্রার্থী। সোশ্যাল মিডিয়াতে এতদিন একদল আক্রমণ করেছে, এখন আর এক দল করছে, বাকিরাও বাদ রাখবেন কেন?’ কিঞ্জলের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি গোপন নেই। কারণ সিপিএমের এক সিনিয়র চিকিৎসক তাঁর ক্ষমা চাওয়ার কথা ফলাও করে প্রচার করেছেন। 
‘থ্রেট সিন্ডিকেটে’র বিরুদ্ধে লড়তে নেমেছিলেন কিঞ্জল। এখন তিনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন, সিপিএমের ‘থ্রেট’ কী! একথা তিনি প্রকাশ্যে বলতে পারবেন না, কিন্তু মরমে মরমে হয়তো উপলব্ধি করবেন আজীবন।
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

আইনজীবীদের কর্মের প্রসার ও ব্যস্ততা বৃদ্ধি। ব্যবসাদি পরিচালনার জন্য নতুন পরিকল্পনা রচনা।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৪ টাকা৮৪.৯৮ টাকা
পাউন্ড১০৭.৬৪ টাকা১১১.৪৩ টাকা
ইউরো৮৯.৪৭ টাকা৯২.৮৭ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা