বিশেষ নিবন্ধ

এসো মা লক্ষ্মী, বসো ঘরে
মৃণালকান্তি দাস

বৈদিক যুগে তাঁর নাম ছিল শ্রী। তখনও তিনি ঐশ্বর্যের দেবীই ছিলেন। তবে সেখানে তিনি চিন্ময়ী দেবী হিসেবেই পুজো পেতেন, মৃন্ময়ী ছিলেন না। পুরাণের যুগে এসে অন্যান্য দেব-দেবীর মতো তিনিও মৃন্ময়ী হলেন। আমরা বিশ্বাস করি তাঁর কৃপাতেই আমাদের সুখ সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়। তাই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— ‘লক্ষ্মী আমায় বল দেখি মা/ লুকিয়ে ছিলি কোন সাগরে/ সহসা আজ কাহার পুণ্যে/ উদয় হলি মোদের ঘরে।’
মহাভারতের শান্তিপর্বে বলা হয়, একবার দেবতাদের কিছু আচরণে (অতি অহংকার, মদমত্ততা, আলস্য প্রভৃতি) অসন্তুষ্ট হয়ে স্বর্গলোক ত্যাগ করেছিলেন দেবী লক্ষ্মী। স্বর্গপুরী ত্যাগ করে শ্রী চলে গিয়েছিলেন পাতাললোকে। দৈত্যপুরীতে। স্বর্গ থেকে চলে গিয়ে দেবী লক্ষ্মী অধিষ্ঠান করেছিন সমুদ্রের অতল গহ্বরে। মুহূর্তের মধ্যে স্বর্গ লক্ষ্মীছাড়া। চারদিক শ্রী-হীন, ছন্নছাড়া। শেষ পর্যন্ত শ্রী বিষ্ণুর পরামর্শ মেনে, দেবতা, অসুর একজোট হয়ে সমুদ্রমন্থন করেছিলেন। দৈত্যপুরী থেকে স্বর্গে ফিরে আসার শর্ত দিয়েছিলেন দেবী। বলেছিলেন, যখনই কেউ ঐশ্বর্য-ধন-ক্ষমতা বলে অহংকারী হয়ে উঠবে, আলস্য যাকে গ্রাস করবে, লক্ষ্মী তাকে ত্যাগ করবেন।
বাংলার মায়েদের কাছে লক্ষ্মীপুজো যেন এমনই ছোট ছোট গল্প। কোজাগরী পূর্ণিমার আগের দিন কিছুতেই কুলপুরোহিতকে কাছছাড়া করতে চাইতেন না হেমবরণী। যশোরের সরকার বাড়ির প্রধান কর্ত্রী আশ্বিনের শুক্লা চতুর্দশীর দিন সতর্ক থাকতেন যাতে ‘ব্রাহ্ম মুহূর্ত’ ফস্কে না যায়। চতুর্দশী যত ফুরিয়ে আসত, ততই ব্যস্ততা বাড়ত তাঁর। পুরোহিতকে তাড়া দিতেন, ‘ঠাকুরমশাই, সময় হল?’ বাড়ির বউ মেয়েরা শাঁখ নিয়ে তৈরি থাকতেন। পঞ্জিকা হাতে নিয়ে বালিঘড়িতে সময় দেখে পুরোহিত মশাই সঙ্কেত দিতেই একসঙ্গে বেজে উঠত অনেক শাঁখ। স্মৃতি খুঁড়ে শ্বশুরবাড়ির কোজাগরীর কথা এমন ভাবেই বলেন প্রভাবতী দেবী। অর্ধশত বছর আগে যশোর ছেড়ে এসেছিলেন নদীয়ায়। ভুলতে পারেননি সেই দিনগুলি। ছড়া কেটেই মা লক্ষ্মী আবাহন করতেন বাড়ির মেয়েরা। করজোড়ে বাড়ির মহিলারা একসঙ্গে বলতেন, ‘আঁকিলাম পদ দু’টি, তাই মাগো নিই লুটি। দিবারাত পা দু’টি ধরি, বন্দনা করি। আঁকি মাগো আলপনা, এই পুজো এই বন্দনা।’ সেই সঙ্গে থাকে মন শুদ্ধ করার বার্তাও। ‘আঁকিলাম আলপনা, দূরে ফেলি আবর্জনা। শুভ শুদ্ধ মন নিয়ে, করি তব আরাধনা।’
আর্যাবর্তের দেবী লক্ষ্মী কখন যে বঙ্গে এসে ঘরের মেয়েটি হয়ে গেলেন তার এক কল্পবর্ণনা আছে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ প্রবন্ধে। লিখেছিলেন, ‘বাঙলা নামে দেশ, তার উত্তরে হিমাচল, দক্ষিণে সাগর। মা গঙ্গা মর্ত্ত্যে নেমে নিজের মাটিতে সেই দেশ গড়লেন।... বাঙলার লক্ষ্মী বাঙলাদেশ জুড়ে বসলেন। মাঠে মাঠে ধানের ক্ষেতে লক্ষ্মী বিরাজ করতে লাগলেন। ফলে-ফুলে দেশ আলো হল। সরোবরে শতদল ফুটে উঠল। তাতে রাজহংস খেলা করতে লাগল। লোকের গোলা-ভরা ধান, গোয়াল-ভরা গোরু, গাল-ভরা হাসি হল। লোকে পরম সুখে বাস করতে লাগল।’ এই সুখকল্পনার ছোঁয়াচ পেতে ছাপোষা নিম্নবিত্ত ঘরণীরও সম্বল হল ‘লক্ষ্মীব্রত’। নতুন শস্যের উদ‌যাপন।
‘বাংলার ব্রত’ প্রবন্ধে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘আশ্বিন পূর্ণিমায় যখন হৈমন্তিক শস্য আসবে, তখনকার ব্রত এটি। সন্ধ্যার সময় লক্ষ্মীপূজা। সকাল থেকে মেয়েরা ঘরগুলি আলপনায় বিচিত্র পদ্ম, লতাপাতা এঁকে সাজিয়ে তোলে। লক্ষ্মীর পদচিহ্ন, লক্ষ্মীপেঁচা এবং ধানছড়া হল আলপনার প্রধান অঙ্গ।’ আলপনার সঙ্গে পুজো বা ব্রতকথার সম্পর্কটি বোঝাতে গিয়ে অবন ঠাকুর বলেছিলেন, আলপনা আসলে ‘কামনার প্রতিচ্ছবি।’ আলপনা মানেই মাঙ্গলিক— অন্তরের সৌন্দর্য দিয়ে রেখার পর রেখা তুলে, তাতে সুন্দরের প্রতিষ্ঠা করা। আলপনা মানেই কাজের প্রতি ভক্তি ও সমর্পণ। ঘরের দরজা থেকে শুরু করে লক্ষ্মীর আসন এবং ধান-চালের গোলা পর্যন্ত ছোট-ছোট পদচিহ্ন এই আলপনার অন্যতম অনুষঙ্গ। আলপনা একাগ্রতা ও সমর্পণের প্রতীক। মা-বোনেরা এক মনে, মনের সবটুকু ভক্তি ও সৌন্দর্য দিয়ে এই আলপনা আঁকেন, ঘরে তাঁর লক্ষ্মী আসবে বলে। চালের গুঁড়ো জলে ভিজিয়ে তা দিয়ে ঘরের মেঝেতে হাতের নিখুঁত টানে আঁকা ধানের শিষ, গাছ কৌটো, শঙ্খ-পদ্ম-চক্র, পেঁচা, লতা-পাতা আর মা লক্ষ্মীর পা। প্রচলিত বিশ্বাস, লক্ষ্মীপুজোর রাতে মা লক্ষ্মী সবার অলক্ষ্যে গৃহস্থের চৌকাঠ পেরিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করেন। তাই তাঁকে স্বাগত জানাতে বাড়ির চৌকাঠ ও দরজার সামনে আঁকা হয় আলপনা। আর এই আলপনায় মায়াবী হয় কোজাগরী পূর্ণিমার রাত। ‘নিশীথে বরদে লক্ষ্মী, কোজাগর্তী মহীতলে।’
কোজাগরী অর্থ— কে আছো জেগে? প্রাচীন বিশ্বাস অনুযায়ী, মা এই দিন গৃহে গৃহে গিয়ে ভক্তকে দর্শন দেন। তাঁর গৃহে শ্রী প্রদান করে আসেন। তাই গৃহের দরজা খুলে মায়ের আসার অপেক্ষায় জেগে থাকতে হয়। যে জাগ্রত থাকে, তাকে তিনি শস্যে-সম্পদের ভরিয়ে দেন। বছরভর তার আর কোনও অন্নকষ্ট থাকে না। তাই পুজোর পরে বাড়ির মেয়ে-বৌরা রাত জেগে লক্ষ্মী পাঁচালি পাঠ করেন। ছড়া কেটে, গুণগান করে দেবীকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। লক্ষ্মীর পাঁচালির শুরুতেই নারায়ণ চিন্তিত, কলিতে পাপে পূর্ণ ধরা। ‘যাগ-যজ্ঞ ক্রিয়া অবহেলা করে সবে।’ তখন লক্ষ্মী বলেন, ‘ভয় নাই, সমাধান সত্বর করিব। লক্ষ্মীছাড়া নরলোক আমি উদ্ধারিব॥’ কী ভাবে? সেই পদ্ধতি পাঁচালিতে বর্ণিত আছে। 
কে লিখেছিলেন এই পাঁচালি? কবে থেকে শুরু 
হল হাতে লেখা পুঁথির বদলে এই ছাপা পাঁচালি কেনা ও পড়া? বহু লোকশিল্প বা লোককথার মতোই এ নিয়ে গবেষণার চিহ্ন খুঁজতে বসা মানে খড়ের গাদায় সূচ খোঁজা। 
কেউ বলেন, এই পাঁচালির উৎপত্তি ১৯৪২-এর আগে পরে। কারণ, সেখানে চরকা কাটার কথা আছে। কেউ বলতেও পারেন, তেতাল্লিশের মন্বন্তরের পরের লেখা। কারণ, বার বার দুর্ভিক্ষের কথা আছে। বছরের পর বছর ধরে বদলে গিয়েছে বাঙালি মেয়ের মুখের ভাষা। বদলে গিয়েছে ব্রত পালন আর পুজো করার রীতি। পাল্টায়নি শুধু লক্ষ্মীর পাঁচালির মূল সুর। কোনও এক কাল্পনিক অবন্তীনগরের এক ব্যবসায়ীর বৃহৎ সংসারে গোলমাল লাগা ও তার সমাধান হবে এই পাঁচালিতেই। কী কী করলে লক্ষ্মী কুপিতা হন আর কী কী করতে থাকলে লক্ষ্মীকে ঘরে ধরে রাখা যায়— তারও কথা।
কোনও কৃচ্ছ্রসাধন করে দিনের পর দিন কঠোর তপস্যা নয়, লক্ষ্মী তাঁর ইচ্ছামাফিক এই জাগ্রত ব্যক্তিদের কাউকে বিত্তলাভের বর দেবেন। প্রাত্যহিকতায় অবিচল থাকতে পারাই আসলে বাঙালির লক্ষ্মী-সাধনার মূল কথা— বাড়িঘর পরিষ্কার রেখে, প্রিয়জনের জন্য অন্নের সংস্থান করে শুধু লক্ষ্মীর প্রতীক্ষা করলেই দেবী সন্তুষ্ট। লক্ষ্মীকে ঠাঁই দেওয়ার পদ্মটি শুধুমাত্র অন্তরেই বিকশিত হয়। ক্লেদহীন, নিষ্কলুষ অন্তর, যেখানে অপরকেও ঠাঁই দিতে দ্বিধা হয় না। 
এই বাংলার মাটিতে দেবতা চিরকালই প্রিয় হয়েছেন। কিন্তু বাঙালির ধর্মে তরবারির ঝনঝনানি নেই, আকাশ কাঁপিয়ে হুঙ্কার নেই— যা আছে, তা এক নিরবচ্ছিন্ন শান্তশ্রী। লক্ষ্মীর কাহিনিকে আসলে বঙ্গজীবনের আখ্যান হিসেবেই পাঠ করা যায়। সংসারে কোণঠাসা অবন্তী রাজ্যের রানিকে নারদ উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘লক্ষ্মীবারে সন্ধ্যাকালে যত নারীগণ। পূজিবে লক্ষ্মীরে হয়ে একমন॥’ 
সেই পূজায় আয়োজনের বাহুল্য নেই, এমনকী পুজোয় যে মূর্তি থাকতেই হবে, সেই বিধানও নেই। পটের ছবি, সরা, ঘট, কড়ি, সিঁদুরের কৌটো, পেঁচার মূর্তি থাকলেও হবে। দেবী চঞ্চলা হতে পারেন, কিন্তু তিনি অন্তঃপুরিকাদের এই সামান্য উপকরণেই তুষ্ট। বাঙালির কাছে লক্ষ্মী মোহিনী। কিন্তু ব্যাভিচারিণী নন। ঘরের চার দেওয়াল আর পাঁচালিটুকু। তাই শাঁখ বাজে। উলুধ্বনি হয়। কিন্তু ঘণ্টার দরকার হয় না। শৈবশক্তি ও বৈষ্ণবশক্তির ঘনঘটা ও সংঘর্ষ যখন ঘণ্টাধ্বনিতে মুখর, তখন লক্ষ্মীপুজোতে ঘণ্টার প্রয়োজন হয় না। তিনি তো সাবিত্রী। শ্রীদাত্রী। কুললক্ষ্মী। ভোগবতী। ক্রোধহীনা...।
নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙালির ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আমাদের লক্ষ্মীর পৃথক মূর্তিপূজা খুব সুপ্রচলিত নয়। ...আমাদের লোকধর্মে লক্ষ্মীর আর একটি পরিচয় আমরা জানি এবং তাঁহার পূজা বাঙালি সমাজে নারীদের মধ্যে বহুল প্রচলিত। এই লক্ষ্মী কৃষি সমাজের মানস-কল্পনার সৃষ্টি; শস্য-প্রাচূর্যের এবং সমৃদ্ধির তিনি দেবী। এই লক্ষ্মীর পুজা ঘটলক্ষ্মী বা ধান্যশীর্ষপূর্ণ চিত্রাঙ্কিত ঘটের পূজা...। বাঙালি হিন্দুর ঘরে ঘরে নারীসমাজে সে পুজা আজও অব্যাহত। ...বস্তুত, দ্বাদশ শতক পর্যন্ত শারদীয়া কোজাগর উৎসবের সঙ্গে লক্ষ্মীদেবীর পূজার কোনও সম্পর্কই ছিল না।’ এ কথার প্রমাণ মেলে যখন দেখা যায় বৈদিক মন্ত্রে নয়, ছড়াতে দেবীলক্ষ্মীর আরাধনা করতেন ওপার বাংলার ঘরের লক্ষ্মীরা। সেই ছড়ায় দেবীর রূপ ফুটে উঠত। বৈদিক দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে সেই দেবীর মিল কতটা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, কিন্তু আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্নের কোনও অবকাশই নেই। কারণ, ধনীর ঘরের দেবী লক্ষ্মী গরিবেরও ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, জীবনে শান্তি তখনই বিরাজ করে, যখন লক্ষ্মী থাকেন সাথে সাথে। পেটের অন্ন, পরনের বস্ত্র ও মনের শান্তিই তো মানুষের প্রথম ও প্রধান কাম্য। কবি বিশ্বাস করতেন, গ্রামই হল প্রাণের নিকেতন— গ্রামই আমাদের দেশের ধাত্রী এবং গ্রাম না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না।
কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো মানেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে ফিরে পাওয়ার দিন। ১৯৭৪-র ‘দেবী’ সিনেমার সেই গানের সুরকার ছিলেন হেমন্তের ছোট ভাই অমল মুখোপাধ্যায়। মিল্টু ঘোষের লেখা সেই গান আজও গ্রামগঞ্জের ঘরে ঘরে বেজে ওঠে গীতশ্রীর কণ্ঠে: ‘শঙ্খ বাজিয়ে মা কে ঘরে এনেছি, সুগন্ধি ধূপ জ্বেলে আসন পেতেছি।/ প্রদীপ জ্বেলে নিলাম তোমায় বরণ করে, আমার এ ঘরে থাকো আলো করে।’
1d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে বাধায় চিন্তা ও উদ্বেগ। বেকারদের ভালো প্রতিষ্ঠানে কর্মপ্রাপ্তির প্রবল যোগ।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৩ টাকা৮৪.৯৭ টাকা
পাউন্ড১০৮.০৬ টাকা১১১.৮৬ টাকা
ইউরো৮৯.৯১ টাকা৯৩.৩২ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
17th     October,   2024
দিন পঞ্জিকা