বিশেষ নিবন্ধ

ক্ষুধা, বৈষম্য এবং সরকার
সমৃদ্ধ দত্ত 

যাদের সকালের জলখাবার, দুপুর আর রাতের খাবার নিশ্চিত, সারাদিনে একবারও ‘ওই খাবারগুলো আজ পাব তো?’—এরকম মনেই হয় না, তারা ঠিক বুঝতে পারবে না কেন এভাবে আসি আমরা! 
সোনভদ্রা জেলার বিরাউলা গ্রাম থেকে প্রতিদিন রবার্টসগঞ্জের জেলাশাসকের অফিসের সামনে রিলে অনশন করতে আসা আদিবাসীদের বিক্ষোভ আন্দোলনে যোগ দেওয়া উনা মাজি বলেছিলেন। 
আপনারা ১১ গ্রামের মানুষ নিজেদের কাজকর্ম ছেড়ে রোজ আসছেন জেলাশাসকের দপ্তরের সামনে? তাও আবার মাসের পর মাস? এটা কীভাবে সম্ভব? আয়ের ক্ষতি হচ্ছে না? এই প্রশ্ন শুনে  উনা মাজি তখন বলেছিলেন ওই কথাগুলো।  অর্থাৎ খাবার, রোজগার এবং বাসস্থানের নিশ্চয়তা নিয়ে যখন সংকট তৈরি হয়, তখন এছাড়া উপায় নেই। মরিয়া হয় মানুষ।  বললেন, আয় তো হয় জঙ্গল থাকলে। জমি থাকলে। নচেৎ নয়। আমরা খাবো কী জঙ্গল না থাকলে? আগে তো খাবার? তাদের বিক্ষোভ ছিল দেখতে নিস্তরঙ্গ। আন্দোলন ছিল জঙ্গলের এবং বহুকাল ধরে চাষ করা জঙ্গল লাগোয়া জমির অধিকার নিয়ে। হাতে হাতে ‘জান দেঙ্গে জমিন নেহি দেঙ্গে...জঙ্গল হামারা মা হ্যায়...’ ইত্যাদি প্ল্যাকার্ড লেখা। সেসব নিয়ে শুধু বসে থাকা। আবার সূর্যাস্তের আগে ফিরে যাওয়া। 
কিন্তু বুঝব না কেন আপনাদের এই সংগ্রাম? উনা মাজি বললেন, শহরের লোক অন্যদের বোকা ভাবে বেশিরভাগ সময়। আমাদের কত শুনতে হয় বনবাবুদের  কাছে যে , ‘তোরা সব ছোটা আদমি আর বুদ্ধু! কিচ্ছু বুঝিস না!’ বলেই হাসেন উনা মাজি! বনবাবু মানে হল ফরেস্ট গার্ড। অর্থাৎ এই নিম্নবর্গের কাছে যারা বাবুসমাজ। তারা নিম্নবর্গকে বোকাই ভাবে। তাদের জীবনকেও চেনে না। তাদের মনকেও জানে না। 
বস্তার জোনের দান্তেওয়াড়ার গীদম বাজারের কাছে বাসের অপেক্ষায় ছিলাম কয়েকজন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাস্তাতেই বসে। আমি বহিরাগত। বাকিরা বস্তার, সুকমা, জগদলপুরের। এক নারীকে হেসে প্রশ্ন করেছিলাম, তখন থেকে দেখছি,এক দৃষ্টিতে মাটিতে এতক্ষণ তাকিয়ে আছেন। কী ব্যাপার? পাল্টা বিষণ্ণ হেসে বললেন, আজ বাজারে তেঁতুল দিয়ে এসে টাকা পেলাম না। পরে দেবে বলল।  চাল কেনা হল না। তাই ভাবছি। কাল সকালে....। 
ওই দুটো বাক্যকে আমরা স্পর্শ করতে পারব না। ‘চাল কেনা হল না’ এবং ‘তাই ভাবছি’। ‘কাল সকালে’ বলে থেমে যাওয়ার অর্থ হল, কালও কি অনশন বাড়িতে? কাল কী খাবে ছেলেমেয়েরা? অর্থাৎ বাধ্যতামূলক অনশনের একটি আশঙ্কা থাকছে। মাঝেমধ্যেই হয়। কারণ বিনামূল্যের রেশন সর্বদা পাওয়া যাচ্ছে না। বিভিন্ন কারণে। 
মহারাষ্ট্রের অমরাবতী থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের জনপদ মোরশিতে যেতে হলে সারাদিনে দুটি মেমু প্যাসেঞ্জার আছে। তবে প্রধান অমরাবতী স্টেশন থেকে নয়। শহর থেকে দূরে বাদনেরা স্টেশনে। বাদনেরা থেকে নারখেড়া মেমু লোকালে সময় লাগল কয়েক ঘণ্টা। মে মাসের প্রবল গরম এবং দুপুর। স্টেশনে নামতেই একদিকে যেমন গরমের দাবদাহ, তেমনই আবার নয়নাবিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্যও। নির্জন স্টেশনের বাইরেই  জঙ্গল আর টিলায় ঘেরা মোরশি। ছোট কিটি রাস্তা জঙ্গলের মধেয থেকে যাবে হাইওয়ে। সেখান থেকে দক্ষিণে গেলে পৌঁছনো যাবে এই ক্ষুদ্র গঞ্জ মোরশিতে। 
এখানে আসার কারণ কী ছিল? লোকসভা নির্বাচন কভার করার সঙ্গে এই ক্ষুদ্র জনপদের সম্পর্কই বা কী? সম্পর্ক হল, অমরাবতী এমন একটি জেলা যা ভারতের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বারংবার। কোন খেলায়? খেলায় নয়। কৃষক আত্মহত্যায়। ২০২০ সাল পর্যন্ত কৃষক আত্মহত্যায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিল মহারাষ্ট্রের যাবতমাল জেলা। ২০২১ সালে তাকে টেক্কা দিয়েছে অমরাবতী। তারপর থেকে লাগাতার অমরাবতী ফার্স্ট। ২০২৩ সালে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা ৩২৩। মোরশি এহেন একটি আশ্চর্য আত্মহত্যার ঘটনার সাক্ষী হয়েছে। সেই খোঁজ নিতেই যাওয়া। 
মোরশি তহশিল অফিসে প্রবেশ করেই ডানদিকে একটি টিন আর বেড়ার ছাউনিতে বসা দলিললেখককে দেখা যাবে। তাঁর নাম  এ টি তাইদে। তাঁর চোখের সামনেই ঘটেছিল সেই ঘটনা। এই বছরই।  দময়ন্তী নদীর উপর বাঁধ নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। আর সেই কারণেই নেওয়া হয়েছিল জমি। একটি নয়। একের পর এক গ্রামের জমি সরকার নিয়ে বলেছিল ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। আটের দশক থেকে। অথচ এতকাল পরও পরিপূর্ণ ক্ষতিপূরণ অথবা কাজের প্রতিশ্রুতি পূরণ করা গেল না। অনেক সরকার এল এবং গেল। 
অতএব চলছিল অনশন আন্দোলন। তাঁদের একজন গোপাল বাজিরাও দহিবেড়ে। গোপাল কোনও স্লোগানে নেই। কোনও মিছিলে নেই। তিনি শুধু মঞ্চের সামনে নীরবে বসে থাকেন। কিন্তু কৃষকদের অনশন আন্দোলনে সরকার পাত্তাই দেয়নি। দু একবার অনুরোধ আবেদন করেছে। তারপর অন্য কাজের ভিড়ে ভুলে গিয়েছে তাদের। সরকারের নজর টানতে তাহলে কী করা যায়? পদযাত্রা? বিক্ষোভ মিছিল? কৃষকরা নিজেদের মধ্যে মিটিং করছিলেন। কিন্তু গোপাল অভাবিত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। হঠাৎ একদিন ভোরে দেখা গেল ওই অনশন মঞ্চেই গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন গোপাল। দলিললেখক এ টি তাইদে বলছিলেন, জমির ক্ষতিপূরণের জন্য অনশন আন্দোলন করছিল গোপাল। আর আজ তাঁর সন্তান নিয়ে স্ত্রী কী করবেন? কী খাবেন? আজও তিনি বিশ্বাস করতে পারেন না যে, তাঁর টাইপরাইটারের অদূরে রোজ বসে থাকা গোপাল নিজেকে এবং পরিবারকে এভাবে মুক্তি দেওয়ার কথা ভাবছে। তা‌ই঩দে বিষণ্ণ গলায় বলেছিলেন, আমাদের এখানে গোপালরা এভাবে খিদে থেকে মুক্তি পায়! ঠিক এই সময় মনে পড়ে ভারতে প্রতিদিন গড়ে ১৫৪ জন কৃষক এবং দিনমজুর আত্মহত্যা করে। 
এই যে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলির কথা এখানে বললাম, সেটির কারণ কী? কারণ  হল, অমরাবতীর মতো ভারতও আবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো পারফরম্যান্স করেছে। এই সপ্তাহেই জানা গেল, গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে ভারত ১০৫ তম স্থান পেয়েছে। ১২৭টি দেশের মধ্যে ১০৫ তম। অথাৎ ক্ষুধার বিশ্বে ভারত নেতৃত্বস্থানীয়। 
বৈষম্য শব্দটির অর্থ কী? অর্থ হল, ঠিক এই বছরই নতুন করে ভারতে ৯৪ জন বিলিওনার হয়েছে। অর্থাৎ ১০০ কোটি ডলার বা ইউরো কিংবা পাউন্ড যাঁদের আছে। বৈষম্য কাকে বলে? নীতি আয়োগের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ভারতের ৯ শতাংশ মানুষের গড় মাসিক আয় ১৭৮২ টাকা। বাকিটা তারা কীভাবে চালায় সেটা একটি রহস্যকাহিনি। বৈষম্যের উদাহরণ কী? ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি। ৩ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতির বৈষম্যের চিত্রটি কেমন দেখতে হয়? 
ইংরাজিতে একটি টার্ম ব্যবহার করা হয় শিশুদের খাদ্যাভাবকে। ‘জিরো ফুড চিলড্রেন’। অর্থাৎ ৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে যে অংশটি পর্যাপ্ত খাবার পায় না এবং নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে  যাদের অসুস্থতা এবং মৃত্যুর প্রবণতা ক্রমবর্ধমান। তাদের বলা হয় জিরো ফুড চিলড্রেন। ভারতে এই জিরো ফুড চিলড্রেনের পরিমাণ ১৯ শতাংশ। ল্যানসেট ডিসকভারি সায়েন্সের ই-ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, সবথেকে বেশি জিরো ফুড চিলড্রেন উত্তরপ্রদেশে। ২৮.৪ শতাংশ। আর ঠিক এই অবস্থায় উত্তরপ্রদেশ সরকার কী বিষয়ে অধিক মনোযোগ দিয়েছে? কারা খাবার তৈরি করছে এবং বিক্রি করছে সেই আইডেন্টিটি প্রকাশ করার আইন আনা হবে। অর্থাৎ খাদ্য বিক্রেতা কারা এবং খাদ্য তৈরি করছে যারা তাদের নাম পরিচয় প্রকাশ্যে দেখাতে হবে। এজন্য আইন। আপাতভাবে খাদ্যের বিশুদ্ধতা রক্ষাই উদ্দেশ্য এই কারণ দেখানো হলেও, আসল কারণ হল, ধর্ম। অর্থাৎ প্রকাশ্যে আইডেন্টিটি কার্ড কিংবা সাইনবোর্ড দিয়ে জানাতে হবে নাম পরিচয়। তাহলেই জানা যাবে কে হিন্দু, কে মুসলমান। এসবের লক্ষ্য কী? বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। প্রশ্ন হল, একটি সরকারের কাছে অগ্রাধিকার হওয়া উচিত ক্ষুধা নিবারণ। তা হচ্ছে না। ক্ষুধাকে ঢেকে রাখা হচ্ছে বিদ্বেষ আর বিভাজন দিয়ে। 
যে কোনও সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত অন্তত রোটি কাপড়া মকান দেওয়া। বিজলী পানি সড়ক দেওয়া। অর্থাৎ সর্বাগ্রে রোটি! কিন্তু গোটা দেশে কি সেরকম কোনও প্রকল্প দেখা যাচ্ছে? যাচ্ছে না। বিনামূল্যে রেশন দেওয়া হচ্ছে। অত্যন্ত জরুরি একটি প্রকল্প। কিন্তু খাদ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ক্রমেই সামাজিক অবস্থান হারানোর দিকে যাচ্ছে। মধ্যবিত্ত ধীরে ধীরে নিম্নবিত্ত হয়ে যাবে। নিম্নবিত্ত হবে দরিদ্র। সেই দিকেই হাঁটছে ভারত। 
আমরা লক্ষ্য করছি সবথেকে বেশি বাড়ছে খাদ্যের দাম। সেটা নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছি। নিজেদের সংসার চালাতে গিয়ে নাজেহাল হচ্ছি।  কিন্তু রাজনীতির ময়দানে এটা কোনও ইস্যুই নয়। কোনও ভোট মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে হচ্ছে না। আমাদের সকলের অলক্ষ্যে বিগত বছরগুলিতে সবথেকে বেশি দাম বেড়েছে কোন চারটি পণ্যের? চাল, ডাল, তেল, সব্জি। সবথেকে কম দাম বেড়েছে কোন তিনটি পণ্যের? এয়ার কন্ডিশনন্ডিং মেশিন, স্মার্টফোন এবং রেফ্রিজারেটর।  
দীপাবলি এবং ছটপুজোয় সবথেকে বেশি ট্রেনের টিকিট বিক্রি হয়। পরিযায়ী শ্রমিকেরা ঘরে ফেরে। ট্রেনযাত্রার উপর নির্ভরশীল আম জনতা। গত ১৫ বছরে সবথেকে দ্রুতহারে কমেছে কোন ক্লাসের কামরা? স্লিপার ক্লাসের। ২০১০ সালে ছিল ৭৩ শতাংশ। ২০২৩ সালে হয়ে গিয়েছে ৫১ শতাংশ। ২০২৩ সালের ঠিক উৎসবের মরশুমে ১ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ নির্ধারিত সময়ে টিকিট কাটতে গিয়ে কনফার্মড টিকিট পায়নি। কেন? কারণ স্লিপার ক্লাস কম। ঠিক এই সময়ই কোন টিকিটের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়? এয়ার টিকিটের। সব মিলিয়ে লাভ কার? সরকার ও কর্পোরেটের। ক্ষতি কার? সংবিধানে বর্ণিত উই দ্য পিপলের! 
3h 3m ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে বাধায় চিন্তা ও উদ্বেগ। বেকারদের ভালো প্রতিষ্ঠানে কর্মপ্রাপ্তির প্রবল যোগ।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৩ টাকা৮৪.৯৭ টাকা
পাউন্ড১০৮.০৬ টাকা১১১.৮৬ টাকা
ইউরো৮৯.৯১ টাকা৯৩.৩২ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
17th     October,   2024
দিন পঞ্জিকা