বিশেষ নিবন্ধ

আর জি কর: বিজেপির প্রাপ্তি শূন্য
তন্ময় মল্লিক

‘এতদিন ধরে কেন মানুষকে নাকাল করা হল? মানুষকে খেপিয়ে কী লাভ হল? তাঁরা সমস্যায় পড়লেন। এর জবাব জুনিয়র ডাক্তারদের দিতেই হবে।’ এই বক্তব্যটা রাজ্যের শাসক দলের কোনও নেতার নয়, প্রবীণ বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষের। আর জি কর ইস্যুতে আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের উদ্দেশে করা দিলীপবাবুর এই মন্তব্যে স্পষ্ট, জুনিয়র ডাক্তাররা কর্মবিরতি তুলে নেওয়ায় বিজেপি নেতৃত্ব বেজায় ক্ষুব্ধ। তাও সেটা হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদক্ষেপে। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের ময়নাতদন্তে বঙ্গ বিজেপি বুঝে গিয়েছে, ঐতিহাসিক গণআন্দোলনে তাদের নিট প্রাপ্তি শূন্য।
অভয়ার জাস্টিসের দাবিতে জুনিয়র ডাক্তাররা আন্দোলনে নামতেই লোকসভা ভোটে তৃণমূলের কাছে ১২-২৯ গোলে নাস্তানাবুদ বঙ্গ বিজেপি বুকে পেয়েছিল হাতির বল। মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে বিজেপির ধর্নামঞ্চে হাজির হয়েছিলেন দলের সব গোষ্ঠীর নেতা। নির্বাচনের আগে অমিত শাহের এক হওয়ার হুইপেও বঙ্গ বিজেপির নেতাদের মধ্যে অটুট ছিল ‘সাপে-নেউলে’ সম্পর্ক। কিন্তু জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে ‘অনুপ্রাণিত’ বিজেপি নেতারা বাংলাকে ‘বাংলাদেশ’ বানানোর অভিপ্রায়ে ধর্নামঞ্চে বসেছিলেন পাশাপাশি। এখন কি না সেই জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের বিরুদ্ধেই শুরু হয়েছে বিজেপির তোপ দাগা!
‘ঠোঁটকাটা’ হিসেবে দিলীপ ঘোষের সুনাম আছে যথেষ্ট। স্পষ্ট কথায় তাঁর কষ্ট নেই। তিনি একা জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন তুললে সেটা তাঁর ‘ব্যক্তিগত অভিমত’ বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু বিজেপি বিধায়ক অশোক দিন্দাও একই রাস্তায় হেঁটেছেন। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনকে ‘স্বার্থপর আন্দোলন’ বলে কটাক্ষ করেছেন। অভয়ার জাস্টিসের জন্য নয়, চিকিৎসকদের নিজেদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যেই এই আন্দোলন। 
কর্মবিরতি প্রত্যাহারের শর্তের তালিকা ক্রমশ লম্বা হওয়ায় অনেকেই চিকিৎসকদের আন্দোলনের পিছনে ‘রাজনীতি’র গন্ধ পেয়েছিলেন। কিন্তু এর আগে কেউই বিজেপি বিধায়কের মতো চিকিৎসকদের জাস্টিসের দাবিতে আন্দোলনকে ‘স্বার্থপর আন্দোলন’ বলে দাগিয়ে দেননি। গেরুয়া শিবিরের নেতাদের চোখা চোখা মন্তব্যে বোঝা যাচ্ছে, এই গণআন্দোলন থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তারা ঘরে তুলতে পারবে না। সেটা বুঝেই শুরু হয়েছে জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতি আক্রমণ। 
দিলীপবাবু আবার আন্দোলনকে ‘নাটক’ বলে বিদ্রূপ করেছেন। তাঁর মতো চাঁচাছোলা ভাষায় জুনিয়র ডাক্তারদের এমন আক্রমণ রাজ্যের শাসক দলের নেতারাও করেননি। দিলীপবাবু প্রশ্ন তুলেছেন, ‘মানুষ খেপিয়ে আন্দোলন করে কী লাভ হল? এত নাটক করে কী হল? ক’জন সাজা পেয়েছে? অনুব্রত মণ্ডলের মতো সন্দীপ ঘোষও ছাড়া পেয়ে যাবে।’ 
জুনিয়র ডাক্তারদের উপর ঝাল ঝাড়তে গিয়ে দিলীপবাবু কেন্দ্রীয় এজেন্সির দিকেই আঙুল তুলে বসেছেন। সিবিআই, ইডির বিরুদ্ধে এতদিন যেসব কথা কংগ্রেস ও তৃণমূলের নেতারা বলতেন এখন সেটাই বলছেন বিজেপির বর্ষীয়ান নেতা। তিনিও প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিলেন, কেন্দ্রীয় এজেন্সি ‘রাজনৈতিক প্রভু’দের নির্দেশে শুধু ঝাল মেটাতে পারে, কিন্তু কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা।
অনেকে অবশ্য বলছেন, জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন নিয়ে দিলীপবাবুদের রাগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আন্দোলন ‘হাইজ্যাক’ করতে গিয়ে বিজেপি নেতানেত্রীরা রীতিমতো ‘ঘাড়ধাক্কা’ খেয়েছেন, ‘গো ব্যাক’ স্লোগানও শুনেছেন। সেটাও তাঁরা মেনে নিতেন যদি তাঁদের ‘দফা এক দাবি এক, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ’ স্লোগানটা একটিবারের জন্যও আন্দোলন মঞ্চে উচ্চারিত হতো। কিন্তু হয়নি। আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা আর জি কর কাণ্ডে প্রশাসন ও সরকারকে তুলোধোনা করেছেন। নানান ত্রুটির দিকে আঙুল তুলেছেন। কিন্তু কখনওই স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেননি। আর সেটা বিজেপির প্রত্যাশার বাড়া ভাতে ছাই ফেলার জন্য যথেষ্ট। সেইজন্যই তো দিলীপবাবুর প্রশ্ন, কেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ হবে না? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিসমন্ত্রী। তাঁর কোনও সাজা হবে না কেন? ডাক্তাররা তো সরকারের বিরুদ্ধে কিছুই বলছে না।
গণআন্দোলনের পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে বিজেপি নেতারা বুঝেছেন, চিকিৎসকদের মূল ক্ষোভটা ‘সিস্টেমে’র বিরুদ্ধে। তাঁরা সিস্টেমের বদল চেয়েছেন, সরকারের নয়। আর দাবি পূরণের জন্য তাঁরা বারবার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই বৈঠক করতে চেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাননি। এমনকী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদক্ষেপেই তাঁরা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করেছেন। তারউপর সিজিও কমপ্লেক্সে অভিযান করে জুনিয়র ডাক্তাররা বুঝিয়ে দিয়েছেন, অভয়ার জাস্টিস দেওয়ার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবেই কেন্দ্রীয় এজেন্সির। তদন্তের খাতিরে সিবিআই যাকে খুশি যখন ইচ্ছা ডাকতেই পারে। তা নিয়ে নানান সম্ভাবনা ও আশঙ্কার নিত্যনতুন গল্প ডানা মেলতেই পারে। কিন্তু শেষপর্যন্ত অঙ্কটা কেন্দ্রীয় এজেন্সিকেই মেলাতে হবে। আর এই তদন্তের ‘প্রধান পরীক্ষক’ সুপ্রিম কোর্ট। সেখানে গোঁজামিল দিয়ে উত্তর মেলানোর চান্স নেই। 
অনেকে মনে করছেন, রাজনীতির সমীকরণ বদলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বঙ্গ বিজেপিকে ভাবিয়ে তুলেছে। অভয়ার জাস্টিসের দাবিতে বাংলা এককাট্টা। তবে, গণআন্দোলনে আলোড়িত হয়েছে মূলত কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন শহর এলাকা। আন্দোলনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। কিন্তু তাদের একত্রিত করার কাজটা করেছে বাম ও অতিবামেরা। কোথাও কোথাও এসইউসি। ফলে বাম কর্মী সমর্থকরা অনেকটাই উজ্জীবিত। বিজেপির ভয়টা সেখানেই। 
লোকসভা নির্বাচনে অধিকাংশ শহরেই তৃণমূলের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে বিজেপি। সিপিএম-কংগ্রেস জোটের ভোট একেবারে তলানিতে। এখন গণআন্দোলনের প্রভাবে রামে যাওয়া ভোট বামে ফিরলেই বিজেপির বিপদ। আর তাতে আখেরে লাভ হবে তৃণমূলের। পুজোর মরশুম শেষ হলেই এরাজ্যের ছ’টি বিধানসভার উপনির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়বে। সেই ভোটেই বোঝা যাবে, অভয়ার মৃত্যুকে সামনে রেখে রাজনীতির কারবারিরা পরিকল্পিতভাবে বাংলার গায়ে কালি লাগানোর যে চেষ্টা চালিয়েছে, সেটা মানুষ কতটা খেয়েছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই আন্দোলনে সরকার সমালোচিত হলেও ভোটের অঙ্কে শাসক দলের তেমন কোনও ক্ষতি হয়নি। কর্মবিরতি প্রত্যাহারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী বারবার অনুরোধ করলেও বিরোধীরা চিকিৎসকদের কাজ না করার পক্ষেই ছিল। কর্মবিরতিতে প্রায় প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল। তাতে প্রচণ্ড দুর্ভোগের শিকার হয়েছে গরিব মানুষ। অনেকে চিকিৎসা না পেয়ে মারা গিয়েছেন। সেই অবস্থায় চিকিৎসকদের আন্দোলনকে মুখ্যমন্ত্রী সমর্থন করেও স্বাস্থ্য পরিষেবা স্বাভাবিক রাখার সবরকম চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। অপমান সহ্য করেও সমাধানসূত্র বের করার চেষ্টা করেছেন এবং পেরেছেন। তাতে হয়তো ‘মমতা হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’ স্লোগান ওঠেনি, কিন্তু তাঁকে ঘিরে গরিব মানুষের আস্থা ও ভরসা আরও দৃঢ় হয়েছে। 
এই মুহূর্তে বঙ্গ বিজেপির পাখির চোখ ছাব্বিশের বিধানসভা নির্বাচন। বিজেপি বুঝেছে, আর জি কর ইস্যুতে গোটা দেশের সামনে বাংলাকে হেয় প্রতিপন্ন করা গেলেও ভোটে ফায়দা উঠবে না। তাই তারা অন্য ইস্যুতে দ্রুত শিফ্ট করতে চাইছে। বিজেপি এমন কিছু ইস্যু ধরতে চাইছে যেটা তাদের রাজনৈতিক জমি শক্তি করবে। সেই লক্ষ্যেই তারা শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টিকে ফের সামনে আনতে চাইছে। তাদের বিশ্বাস, এই ইস্যুটা কাজে লাগাতে পারলে যুবসমাজের একটা অংশকে তারা পাশে পাবে।
বিজেপির অনেকের মতে, আর জি কর ‘ডেড’ ইস্যু। তাদের বক্তব্য, এখন যেসব দাবি জুনিয়র ডাক্তাররা তুলছেন তারসঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনও সম্পর্ক নেই।  সেগুলি একান্তই তাঁদের চাওয়াপাওয়া ও ক্ষমতা দখলের বিষয়। কারা মেডিক্যাল কলেজ নিয়ন্ত্রণ করবে, কোন গোষ্ঠী আইএমএ দখল করবে, কারা মেডিক্যাল কাউন্সিলে যাবে, সেই নিয়েই চলছে লড়াই। লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য অনেক চিকিৎসক সংবাদমাধ্যমে ট্রেড ইউনিয়ন নেতার মতো বক্তব্য রাখছেন। ‘সার্ভিস রুলে’র তোয়াক্কা করছেন না। উদ্দেশ্য স্পষ্ট, সরকার ব্যবস্থা নিক। তারপর তাকে সামনে রেখে ফের শুরু হবে আন্দোলন। তাতে লাভবান হবে বামেরা। তাই বিজেপি সাধারণ মানুষের সমর্থন পাওয়া যাবে, এমন আন্দোলনে মন দিতে চাইছে।
এখানে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটা হল, জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে বিজেপির কি কোনও লাভ হয়নি? তাদের প্রাপ্তি কি সত্যিই একেবারে শূন্য? উত্তরটা হল, না। কেননা আর জি কর কাণ্ড ঢেকে দিয়েছে কেন্দ্রের নিট কেলেঙ্কারির কলঙ্ক। অভয়ার জাস্টিসের দাবির নীচে চাপা পড়ে গিয়েছে সর্বভারতীয় ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষার পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি। তাই আর জি কর ইস্যুতে বঙ্গ বিজেপির প্রাপ্তি শূন্য হলেও দিল্লি বিজেপির ফায়দা ষোলোআনা।
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

শেয়ার মেয়াদি সঞ্চয়সহ একাধিক ক্ষেত্র থেকে অর্থাগম যোগ। ব্যবসায় কেনাবেচা বাড়বে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮২.৮৩ টাকা৮৪.৫৭ টাকা
পাউন্ড১১০.২৬ টাকা১১৩.৮৫ টাকা
ইউরো৯১.৭১ টাকা৯৪.৯১ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা