ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি, যাই ঘটে যাক মাধ্যমিক পরীক্ষা, দুর্গাপুজোয় মিটিং মিছিল অবরোধ অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ। এই সময়টা সাধারণ মানুষের সঙ্গে রাজনীতিকদেরও দু’দণ্ড অবকাশের সময়। আন্দোলনের নামে রাজনৈতিক কূটকচালিরও ছুটি। চড়া নিন্দার সুর, পারস্পরিক আক্রমণ, তোপ দাগা, উতোরচাপান, দাবিদাওয়া মেটানোর জন্য তো পড়েই আছে সারাটা বছর। তখন ক্ষোভ-বিক্ষোভ, প্রতিবাদ উগরে দাও যত পার। ভোটের বছরেও এর অন্যথা হতে দেখিনি কখনও। কিন্তু এবার? উৎসবকে ভিলেন বানিয়ে বিচারের নাম করে আড়াল থেকে রাজনীতির নখদাঁত বের করার আয়োজন দেখে অবাক হচ্ছি। আশ্চর্য হচ্ছি, নাগরিক সমাজকে ব্যবহার করে বাম ও অতিবামদের নিজেদের প্রাসঙ্গিক করে তোলার মরিয়া প্রয়াস দেখে। এমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতে বাংলার আকাশে আগে পুজো এসেছে কখনও, মনে পড়ে না। মহালয়ার মাত্র ৭২ ঘণ্টা আগে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব ঘিরে এমন সংশয় ও সন্দেহ তৈরির চেষ্টা কি ষড়যন্ত্র নয়? এরা সত্যি অভয়ার বিচার চায়, না অশান্তি চায়! বিধানসভা ভোট কিন্তু এখনও ১৮ মাস দূরে।
একদিকে প্রকৃতির রোষ। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের বিস্তৃত অঞ্চল বন্যার কবলে। পরপর নিম্নচাপের ভ্রুকুটি। মানুষের মন এমনিতেই ভালো নেই। গোদের উপর বিষফোঁড়া, উৎসবকে বানচাল করতে ফেসবুকে বাম ও অতিবামেদের বিপ্লব। কিছু ডাক্তারের পোস্ট করা বক্তব্য দেখলে মনে হচ্ছে, উৎসব করলেই আপনি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, বিচারের বিরোধী। এসবই বামপন্থীদের পুরনো ফর্মুলা। পুজোর ক’টা দিন ছেড়ে দিলে কী বিচার পালিয়ে যেত! মাত্র কয়েকবছর আগে এরাজ্যেরই গেরুয়া শক্তি অভিযোগ করেছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি পুজোয় বাধা দিচ্ছেন। আর আজ বামঘেঁষারা বলছেন, মমতার পুজো অনুদান বয়কট করুন। পুজো অনুদানের সঙ্গে অভয়ার বিচারের কী সম্পর্ক? অথচ কুৎসিত প্রচার চলছে তা নিয়েও। নিঃসন্দেহে দু’টো পরস্পর-বিরোধী অভিযোগ। তাহলে কাদের অভিযোগ সত্যি— বামেদের না বিজেপির? বিরোধীরা বারবার নির্বাচনী রাজনীতিতে ব্যর্থ হয়ে কাণ্ডজ্ঞানটাই হারিয়ে ফেলেছেন। তাই পুজো ঘিরেও এমন ভয়ঙ্কর চক্রান্ত!
নিঃসন্দেহে একটা দুঃখজনক খুন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে গিয়েছে সরকারি হাসপাতালের অন্দরে। পুজোর মাত্র দু’মাস আগে যাঁরা সেই কাণ্ড ঘটিয়েছেন তাঁদের জন্য কোনও ধিক্কার কিংবা শাস্তিই যথেষ্ট নয়। গাফিলতিও অমার্জনীয়। সবাই একবাক্যে বিচার চাইছেন। এমন একজনও সুস্থ মানুষ নেই, যিনি বলবেন বিচার চাই না। কিন্তু একইসঙ্গে এটাও ঠিক, বিচারেরও তো একটা প্রক্রিয়া থাকে। এবং ভারতীয় আইন মেনে চললে তা যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। রাস্তায় মোমবাতি জ্বালিয়ে বসলে আর পুজো প্যান্ডেলের সামনে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বললেই কি অপরাধীদের ভোররাতে ফাঁসি হয়ে যাবে, অভয়া বিচার পাবেন? চার্জশিট, তদন্ত রিপোর্ট, নিম্ন আদালত থেকে ধাপে ধাপে সুপ্রিম কোর্টের রায়, শেষে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন, কিছুই লাগবে না! তাহলে তো সৌদি আরবের মতো প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করতে হয়। প্রকৃত বিচার বলতে অতিবামেরা কি সেটাই বোঝাচ্ছেন?
এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার চেষ্টাই চলছে সব মহল থেকে। আর জি কর কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ এবং স্থানীয় টালা থানার ওসি গ্রেপ্তার হয়েছেন। কয়েক ডজন ডাক্তার, পুলিস, নেতা, বিধায়ককে একাধিকবার জেরা করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে নিয়মিত তদন্তের স্টেটাস রিপোর্টও জমা দিচ্ছে সিবিআই। ছাত্রদের দাবি মেনে কলকাতার পুলিস কমিশনার সহ একাধিক সরকারি কর্তাকেও সরানো হয়েছে। সরকারি হাসপাতালের নিরাপত্তা ঢেলে সাজায় ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। কাল সোমবারও শুনানি আছে। কিন্তু যেটা উদ্বেগজনক তা হচ্ছে, বিচারকে শিখণ্ডী করে আড়াল থেকে রাজনীতির ইতিউতি উঁকি। আসল উদ্দেশ্য বিচার না চেয়ার? রাতদখল না ক্ষমতা দখল? সামনাসামনি না পেরে, নাগরিক আবেগকে ব্যবহার করে ঘোলাজলে মাছ ধরার এই ভড়ং কিন্তু ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।
চার বছর আগে পুজো পণ্ড হওয়ার কারণ ছিল কোভিড প্যান্ডেমিক। প্রাণভয়ে লোকে বেরতেই পারেনি। আর এবার এক আশ্চর্য পরিস্থিতি। কী
সেই পরিস্থিতি? আওয়াজ তোলা হচ্ছে, শুধু পুজো হবে, কিন্তু আনন্দ নৈব নৈব চ। স্বাস্থ্য ভবনের
সামনে বিরিয়ানি, চাউমিন, চিকেন, মাটন, ফিশফ্রাই, প্যাটিস, ফ্রুট জুস, উদ্দাম নাচ, গান কিছুই বাকি ছিল না। কিন্তু পুজোয় আনন্দ করলেই অপরাধ!
পুজো থেকে দূরে থাকলেই অভয়া বিচার পাবে। আর বৎসরান্তে আনন্দে মেতে কেউ প্যান্ডেল হপিং করলেই চূড়ান্ত অনাচার। এই সরলীকরণ
আপামর বাঙালি মেনে নেবে কি? বাংলার দুর্গাপুজোর দিকে চেয়ে থাকে গোটা বিশ্ব। বহু বিদেশি পর্যটক আসেন ঠাকুর, প্যান্ডেল, শিল্পের উৎকর্ষ দেখতে। আর গরিব চেয়ে থাকে দু’টো পয়সার মুখ দেখবে বলে। এই উৎসবের উপরই আমাদের সমাজ ও অর্থনীতি দাঁড়িয়ে।
সবচেয়ে যেটা দুঃখের তা হচ্ছে, এই মুহূর্তে পুজোকে কেন্দ্র করেও এক আশ্চর্য সামাজিক মেরুকরণের চেষ্টা হচ্ছে। বাঙালি সমাজকে বিজেপি হিন্দু-মুসলমানে ভাগ করার চক্রান্ত করে আসছে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। সেই ক্ষত দগদগে ঘা হয়ে বুকে জ্বলছে, যা সহজে শুকোবার নয়। আর এবার শহুরে এলিটস ও গ্রামের প্রান্তিক মানুষদের মধ্যেও একটা সূক্ষ্ম অথচ তীব্র বিভাজনের চেষ্টা চলছে। সামনে অস্ফুটে বলা হচ্ছে বিচারের কথা, কিন্তু আড়ালে কবরে সেঁধিয়ে যাওয়া এরাজ্যের বাম ও অতিবামেরা যেনতেন প্রকারে আবার নিজেদের প্রাসঙ্গিক করে তোলার মরিয়া চেষ্টায় ব্যস্ত।
অভয়া ইস্যু দূরবর্তী জেলাগুলিতে তেমন প্রভাব ফেলেনি। তাই বারবার শহরে রাত থেকে ভোর দখলের ডাক। এমনও বলা হচ্ছে, অষ্টমীর সন্ধ্যা থেকে নাকি ঘরে ঢুকে যেতে হবে—পরদিন সকাল পর্যন্ত। এ কেমন ফতোয়া! মহালয়ার আগের রাতে বাঙালি রেডিও সারিয়ে আগে আগে শুয়ে পড়ে। পরদিন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনী শুনবে বলে। এবার মহালয়ার আগের দিনও রাত থেকে ভোর দখলের ডাক দেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্যটা কী? শুধুই বিচার তো নয়! কেউ কেউ আবার বলছেন, এটাই নাকি বামেদের ঘুরে দাঁড়ানোর শেষ সুযোগ। তাতেও তেমন কাজ হচ্ছে না বুঝে তাঁরা আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরতে চাইছেন একটা মর্মান্তিক খুনের ঘটনাকে।
এসবের চেয়েও ভয়াবহ—‘মন চায়, এবার পুজোয় নেমে আসুক দুর্যোগ। নেমে আসুক তিলোত্তমার অভিশাপ, ধ্বংস হোক পৃথিবী। প্রলয়ের পর আরও একবার নতুন করে শুরু করি।’ এই পোস্ট এক প্রথিতযশা বামঘেঁষা ডাক্তারের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত। কী চাইছেন তিনি? পৃথিবী ধ্বংস হলে অভয়া বিচার পাবে তো! আরও আশ্চর্যের, আবহাওয়া দপ্তর নানা আশঙ্কার কথা শোনাতেই এই শ্রেণির উৎসাহ এবং বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আরও তেজি হয়েছে। এঁদের আমি ডাক্তার কিংবা মানবতাবাদী বলে মনে করি না। এঁরা চরম সুবিধাবাদী। নাহলে কেউ বলে, ‘জীবনের সব ক্ষোভ আজ বিদ্রোহে রূপান্তরিত হোক।’ সুবিধাবাদী বলেই এঁরা জন্মলগ্ন থেকে যে নার্সিংহোমের সঙ্গে যুক্ত তার বিরুদ্ধে আঙুল উঠলেই তৃপ্তির হাসি দিয়ে বলেন, ‘সে কী, এগারো সালের পর থেকে তো ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার কোনও যোগ নেই।’ তাই বিচারও চাওয়া যাবে না। কিন্তু বাংলাকে যে কোনও মূল্যে অচল করতেই হবে। ভোটে যখন হচ্ছে না তখন নাগরিক আন্দোলনের নামে পুজো বানচালই এদের মূল এজেন্ডা।
মাত্র ৭২ ঘণ্টা দূরে মহালয়া। দেবীপক্ষের শুরু। মহালয়ার আগের এই রবিবারটায় মনটা আর খাঁচাবন্দি থাকতে চায় না। জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি, এই সময়টাকে শুম্ভ-নিশুম্ভের লড়াইয়ের ক্ষণ হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। এক কথায়, অশুভ শক্তির বিনাশ এবং শুভ শক্তির আত্মপ্রকাশের ক্ষণ এটা। এই সময়টা নিশ্চিতভাবে বিচার পাইয়ে দেওয়ার, কিন্তু দ্রোহকালের নয়।
ডাক্তারদের টানা কর্মবিরতিতে ধাক্কা খেয়েছেন কারা, তার বিস্তারিত লিখেছিলাম গত সপ্তাহে। ফের যদি উৎসবকে ভিলেন বানানোর কায়েমি স্বার্থ এবার সফল হয়, তাহলেও পেটে লাথি পড়বে গরিব রোল বিক্রেতা, রেস্তরাঁ মালিক, ট্যাক্সি চালক এবং পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত সকলেরই। মাস মাইনের লোকজনের পকেটে নয়, টান পড়বে রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো গরিব ঘুগনি বিক্রেতাদের। বেলুনওয়ালাদের। সেইসব বিবেকবান যাঁরা অষ্টমীর সন্ধ্যা থেকে দরজায় খিল দেবেন বলে হুঙ্কার ছাড়ছেন তাঁদের সবিনয়ে বলি, পুজো আপনারা পণ্ড করতে পারবেন না। মহামারী চার বছর আগে হেরেছে। এবারও বাঙালি নিজের মতো করেই উৎসবে মাতবে। কিন্তু একটা বিষয় দেখছি। এই বিচার পাওয়ার চক্করে এরাজ্যের বামপন্থীরা ক্রমেই গরিব প্রান্তিক কৃষক, শ্রমিক, সংখ্যালঘু মানুষদের থেকে আরও সরে এলিট ধনীদের পার্টিতে পরিণত হচ্ছে। এই পথে শূন্যের কলঙ্ক বাম শরীর থেকে ঘুচবে তো? নাকি এই আরোপিত ‘দ্রোহকাল’ তাদের আরও জনবিচ্ছিন্ন করবে?