আকাশজুড়ে যখন ফুটে ওঠে উৎসবের অলৌকিক আলো, ব্রাহ্মমুহূর্তের সেই নৈঃশব্দের মধ্যেই সূচনা হয়ে যায় দেবীপক্ষের। আর তখনই আগমনির সুরে বেতারে বেজে ওঠে আমাদের হৃদয় উৎসারিত শাশ্বত মন্ত্র। শুরু হয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ, ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে, বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর। ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা, প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্ময়ীর আগমন বার্তা।’ এই বার্তার সঙ্গে বাঙালির অন্তরের যোগ। সেই যোগটুকু স্থাপনের জন্য বাঙালি সংবৎসর উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করে। বঙ্গজীবনের শ্রেষ্ঠ মহোৎসবের আঙিনায় প্রবেশ করার প্রথম সিংহদুয়ার হল ‘মহালয়া’।
অথচ একেবারে গোড়ায়, ১৯৩২ সালে যখন অনুষ্ঠানটি বেতারে সম্প্রচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখন আপত্তি উঠেছিল ভিতর থেকেই। তখন ‘মহালয়া’র প্রস্তুতি চলছে। বাণীকুমারের রচনাটি দেখে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র স্তোত্র পাঠ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন নাট্যকার ও অভিনেতা। আকাশবাণীর প্রথম পর্বের তিনি এক ঋত্বিক। উচ্চারণ শুদ্ধ করার জন্য তিনি চণ্ডীপাঠ, গীতাপাঠ করতেন। বাণীকুমার বললেন, ‘ঠিক আছে তুমিই কোরো।’ সেই সময় আকাশবাণীর কয়েকজন একটু মিনমিন করে বললেন, ‘ব্যাপারটা কি ভালো হবে?’ সেই সময় অনুষ্ঠান পরিচালক ছিলেন নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বললেন, ‘কেন খারাপ হবে কেন?’ কয়েকজন বললেন, ‘আসলে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ হলেন কায়স্থ। চণ্ডীপাঠ তো ব্রাহ্মণদেরই কাজ। সাধারণ শ্রোতা কি ব্যাপারটা ভালোভাবে নেবে?’
নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ তাঁদের ধমকে দিয়ে বললেন, ‘এর মধ্যেও তোমরা বামুন-কায়েতের হিসেব করতে বসেছো? রেডিওতে চণ্ডীপাঠ হবে। আমরা তো আর মন্দিরে গিয়ে পুজো করছি না। তাছাড়া আমাদের এই টিমে যাঁরা যন্ত্রী আছেন, তাঁদের মধ্যে তো বেশ কয়েকজন মুসলমানও আছে। তাহলে কি তাদের বাদ দিতে বলছো?’ সকলের মুখে কুলুপ। চণ্ডীপাঠ করা নিয়ে আর কেউ কোনও কথা বলেননি। উল্টে প্রথম অনুষ্ঠানের পর অনেকেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলেছিলেন, ‘দাদা, এ আপনি কী করলেন? বাঙালিকে আপনি একটি অসাধারণ শাশ্বত শারদ উপহার দিয়ে গেলেন।’ সত্যি, ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানে বাদ্যশিল্পীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন মুসলমান। যেমন সারেঙ্গি বাজিয়েছিলেন মুন্সি, তাঁর ভাই আলি বাজিয়েছিলেন চেলো আর হারমোনিয়াম বাজিয়েছিলেন খুশি মহম্মদ। কই, কোথাও তো তার বিশুদ্ধতা ক্ষুণ্ণ হয়নি। সংশয় তৈরি হয়নি শ্রোতাদের মনে! আসলে আমরাই বোধহয় নানা সংকীর্ণ মানসিকতা নিয়ে ক্ষুদ্র ধর্মবোধ নিয়ে কূপমণ্ডুকের মতো বিচার করতে বসি।
প্রথমে অবশ্য এর নাম ছিল ‘মহিষাসুর বধ’। কিন্তু ১৯৩৭ সাল থেকে এই অনুষ্ঠানটির নাম হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। প্রতিবছরই অনুষ্ঠানটির নানা ধরনের পরিবর্তন করা হতো। তাই এই প্রভাতী অনুষ্ঠানটির নানা রকম ভার্সান আছে। একটা সময় অনুষ্ঠানটির সরাসরি সম্প্রচার হতো। প্রত্যেকে ভোরবেলা স্নান করে শুদ্ধ চিত্তে পাঠ বা গান করতে বসতেন। প্রথম দুই বছর এই অনুষ্ঠান হয়েছিল
ষষ্ঠীর ভোরে। পরে সিদ্ধান্ত হয় মহালয়ার দিন এই অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত করা হবে।
আজও যখন ভোরের পার্থিব আলো আঁধারির রহস্যময়তায় সুর ছড়ায়, ‘বাজল তোমার আলোর বেণু, মাতল রে ভুবন’, তখন মনের মধ্যে যেন পুষ্পরেণু হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ঈশ্বরের অদৃশ্য এক অনুভূতি। মনে হয়, ওই আকাশ চুঁইয়ে নেমে আসা আলোর মধ্য দিয়ে নেমে আসবেন এক আলোকবর্ণা ঈশ্বরী, যিনি আমাদের ঘরের মেয়ে, অসীম শক্তি তাঁর। পৃথিবীর তাবড় শক্তি তাঁর পায়ের তলায় নতজানু হয়ে লুটিয়ে পড়ে। ইথার তরঙ্গের মধ্য দিয়ে যেন দেবীর দৈববাণী ছড়িয়ে পড়ে আলো ফোটা আকাশে। ‘ইত্থং যদা যদা বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি।। / তদা তদাবতীর্যাহং করিষ্যাম্যরিসংক্ষয়ম।।’ যখনই দানব জাতির উৎপাত শুরু হবে, আমি আবির্ভূত হয়ে সেই অসুরদের বিনাশ করব। এই প্রত্যাশা নিয়েই তো বাঙালি পুজোর আঙিনায় গিয়ে সন্ধিপুজোর অঞ্জলি দেয়।
প্রত্যেকের বুকেই রয়েছে মহালয়ার সকালের এক নরম ভালোলাগার স্মৃতি। প্রতি বছর পুজো এলেই সেটা মনে পড়ে, আমাদের নস্টালজিক করে তোলে। আমাদের শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলিও সেই অলৌকিক রঙে রাঙানো। মহালয়ার ভোরে চারিদিকে যেন ছড়িয়ে পড়ত এক পবিত্র গন্ধ। বুক ভরে শ্বাস নিলে সেই অনুভূতির আলো ও গন্ধ সরাসরি পৌঁছে যেত মনের ভিতরে। ভালোলাগার এই সালোকসংশ্লেষ আজও যেন উজ্জ্বল হয়ে আছে। রেডিওয় মহালয়া শুরু হওয়ার আগে মা, ঠাকুমা ডেকে দিত। ঘুম থেকে উঠে দেখতাম ঠাকুমা, মা কাচা কাপড় পরে ঘরের চারিদিকে গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিচ্ছে। তারপর ধূপ জ্বালিয়ে চারিদিকে দেখানো হতো। মহালয়া শুরুর আগে শঙ্খধ্বনি হতো। অনেকের বাড়ি থেকেই ভেসে আসত শাঁখের শব্দ।
‘জাগো তুমি জাগো, জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী’ গানটি শুনলেই মনে হতো ভোরের স্নিগ্ধতার মধ্যে সত্যিই এক আধ্যাত্মিক অনুভূতির প্রকাশ আছে। তাকে দেখা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। মহালয়ার অনুষ্ঠান আমাদের সেই অনুভূতিকে এক পবিত্র মাত্রায় পৌঁছে দেয়। এখানেই অনুষ্ঠানটির সার্থকতা। ‘জাগো দুর্গা’ গানটির সুর পঙ্কজ মল্লিক দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কথা মাথায় রেখে। পাঁচের দশকের গোড়ার দিকে হেমন্ত তখন বলিউডের সুরকার হিসাবে প্রচণ্ড ব্যস্ত। তিনি রিহার্সালে আসতে পারলেন না। সেই জায়গায় ঠিক হয়, শচীন
গুপ্ত গাইবেন। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে সেই গান দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় গেয়েছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার ওপর মা দুর্গার দয়া না থাকলে ওই গান আমি গাইতে পারতাম না। এ আমার পরম সৌভাগ্য।’ এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘চণ্ডীপাঠ করার সময় একটা জায়গায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র কেঁদে ফেলতেন। সেটা কি সত্যি, নাকি একটু নাটকীয় পরিবেশ তৈরির জন্য অমন করতেন।’ দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘বীরেনদা যখন চণ্ডীপাঠ করতেন, তখন যেন তাঁর অন্যমূর্তি। শুদ্ধ হয়ে পট্টবস্ত্র পরে যেন সাধনায় বসেছেন। বাহ্যিক জ্ঞান বিলুপ্ত। মন্ত্রশক্তি ভর করত তাঁর ওপর। চণ্ডীপাঠ করতে করতে ঝরঝর করে কাঁদতেন।’
আসলে যাকে মহালয়া বলা হয়, তার একটা পুরাণের দিকও আছে। মহালয়া হল পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনা। মহালয়া আসলে এক কল্পিত পিতৃলোক। স্বর্গ ও মর্ত্যের মধ্যবর্তী স্থানে তার অবস্থান। যেখানে আমাদের স্বর্গত পিতৃপুরুষরা অবস্থান করেন। বলা হয়, জীবিত ব্যক্তির তিন পুরুষ এই পিতৃলোকে অবস্থান করেন। মহালয়ার দিন তর্পণ করে সেই পিতৃপুরুষদের তিল সহ জল অর্পণ করতে হয়। রামায়ণে দেখি রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার আগে রামচন্দ্র অকালবোধন করেছিলেন। তার আগে তিনি রাজা দশরথ ও পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে জলদানের মাধ্যমে তাঁদের শ্রদ্ধা জানিয়ে আশীর্বাদ প্রার্থনা করেছিলেন। মহাভারতেও আমরা দেখি তর্পণ প্রসঙ্গটি জড়িয়ে রয়েছে কর্ণের সঙ্গে। দাতা হিসাবে কর্ণের খুবই সুনাম ছিল। মৃত্যুর পর তিনি স্বর্গে গেলে তাঁকে খাদ্যহিসাবে দেওয়া হতো নানা ধরনের স্বর্ণ, রৌপ্য, রত্নসম্ভার। অবাক হয়ে কর্ণ এর কারণ ইন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘আপনি মর্ত্যে অবস্থানকালে কেবল স্বর্ণ, রৌপ্যই দান করেছেন। কখনও আপনার পিতৃপুরুষের উদ্দেশে জলদান করেননি।’ কর্ণ বলেন, ‘আমার পিতৃপুরুষ সম্পর্কে আমি জ্ঞাত নই। তাই তাঁদের উদ্দেশে আমি কখনও অন্নদান বা জলদান করতে পারিনি।’ তখন কর্ণকে বলা হয়, ‘আপনাকে এক পক্ষকাল সময় দেওয়া হল, আপনি ফের মর্ত্যে গিয়ে পিতৃপুরুষের উদ্দেশে জলদান করে আসুন।’ এই পক্ষকালকেই বলা হয় পিতৃপক্ষ। কর্ণকে এই পক্ষকাল মর্তলোকে অবস্থান করতে হয়েছিল।
শাস্ত্রমতে প্রতি বছর দেবী দুর্গা মূলত চারটি বাহনে আসেন এবং প্রত্যাবর্তন করেন। যেমন দোলা, ঘোটক, গজ ও নৌকা। প্রতিটি বাহনে চড়ে আগমন ও প্রত্যাবর্তনের পৃথক অর্থ আছে। সেই বিষয়টি প্রকৃতি এবং আমাদের জীবনযাপনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এবার যেমন দেবীর দোলায় আগমন ও ঘোটকে গমন। শাস্ত্রে বলে দোলায় আগমনের অর্থ হল চারিদিকে অশুভ লক্ষণের প্রকাশ। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ‘মকরং ভবেৎ’। অর্থাৎ এতে মড়ক বা মহামারীর ইঙ্গিত মেলে। খরা, ধ্বংস, মহামারী, রক্তক্ষয়, হানাহানি, অশান্তির মতো ঘটনা ঘটতেই থাকে।
আবার ঘোটকে গমন প্রসঙ্গে পণ্ডিতরা বলেন, এর ফল ছত্রভঙ্গ বা ছত্রভঙ্গস্তরঙ্গমে। অর্থাৎ দেবীর বিদায়ের পর নানাধরনের ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটতে পারে। যেমন বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা ইত্যাদি। আমরা চারিদিকে দেখতে পাচ্ছি, ভয়ঙ্কর এক শক্তি আমাদের উৎসবের চালচিত্রকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চাইছে, অন্যদিকে সামাজিক অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক চেতনাকে ক্ষতবিক্ষত করার নিরন্তর চেষ্টা চলছে। তবে, এটাই শেষ কথা হতে পারে না। মায়ের কাছে আমাদের প্রার্থনা, ‘রূপং দেহি, জয়ং দেহি, যশো দেহি, দ্বিষো দেহি।’ অর্থাৎ আমি যেন জীবন সত্যের রূপটিকে উপলব্ধি করতে পারি, লোভ-মোহ ইত্যাদি রিপুগুলিকে জয় করতে পারি, সমস্ত বাধাকে আমি যেন বিনাশ করে সত্যের পথে এগিয়ে চলতে পারি।