বিশেষ নিবন্ধ

মুছে যাওয়া ট্রামলাইন
সোমনাথ বসু

‘ও   বাবা, বাড়ি থেকে আসার সময় জাহাজ দেখাবে বললে যে। কিন্তু এটা কী? ছোট ট্রেন?’
নিশ্চিন্দিপুরের গোলোক কর্মকার এবার বেশ সমস্যায় পড়লেন। ছেলে অলোককে খিদিরপুর ডক দেখাবেন বলে কলকাতায় নিয়ে এসেছেন। ধর্মতলা থেকে ৩৬ নম্বর রুটের ট্রামে বাবা-ছেলের ওঠা। ফার্স্ট ক্লাসেই। ফোর্ট উইলিয়ামের সামনে ট্রাম ইনসাইড-আউটসাইড ডজ দিতেই ছেলের এই প্রশ্ন। একটু ভেবে তাঁর উত্তর, ‘এটা তো ট্রাম। আমাদের মতো গরিব-গুর্বোদের যান। কেমন লাগছে তোর?’ ফার্স্ট ক্লাসের বাঁ দিকে সিঙ্গল সিটের প্রথমটা দখল করেছে ছেলে। বাবা ঠিক তার পিছনেই। ট্রাম ততক্ষণে রেসকোর্সের কাছে। একটু আগেই সে দেখেছে দূরে একটা সাদা বাড়ির মাথায় কালো পরী ঘুরছে। এই বড় বাড়িটার নাম নাকি ভিক্টোরিয়া। বাবাই বলেছে। শহরের হাওয়া খেতে খেতে এবার সে জানতে চায়, উঁচু উঁচু লোহার পাঁচিলগুলি কেন দেওয়া? রাজু গাইডের মতো বাবা চিনিয়ে দেয়, ‘এটা রেসকোর্স। মানে ঘোড়দৌড়ের মাঠ। এর থেকে বেশি কিছু মনে রাখার দরকার নেই।’
বর্ষার রাত। এসপ্ল্যানেডের এক হোটেলে রঙিন সন্ধ্যা কাটিয়ে ৫ নম্বর রুটের ট্রামে চেপে বসেছেন শ্যামবাজারের ভূপেনবাবু। চুনোট করা ধুতির কোঁচার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে আদ্যির পাঞ্জাবি। কাঁধ থেকে কব্জি পর্যন্ত চামচ দিয়ে গিলে করা। বাঁ হাতে বেলফুলের মালা। মুখে বেনারসি জর্দা পান। নেশায় টগমগ বাবু কালচারের শেষ প্রতিনিধির কণ্ঠে তখন শচীন কত্তার গান, ‘মন দিল না বধূ, মন নিল যে শুধু/আমি কী নিয়ে থাকি...’। কিছুক্ষণের মধ্যেই খাকি পোশাক পরিহিত কন্ডাক্টর তাঁর কাছে এসে টিকিট চাইলেই জড়ানো গলায় ভূপেনের মশকরা, ‘আরে মশায়, কার কাছে টিকিট চাইছেন জানেন? আমার ঠাকুর্দা চাইলে গোটা ট্রাম কোম্পানি কিনে ফেলতে পারতেন। ঠিক আছে, এসেছেন যখন নিয়েই যান।’
গোলোক, অলোক কিংবা ভূপেনের মতো অনেকের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ট্রাম ভ্রমণের স্মৃতিমেদুরতা। চোখে ভাসে এখনও ক্লড ওয়াডেলের সেই বিখ্যাত পুরনো কলকাতার ছবি... ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসের শেষের জানালা দিয়ে কোনওমতে পা গলিয়ে দিয়েছেন অফিসযাত্রী। শরীরটা তখনও বাইরে। আর ওইটুকু বাহনে উপচে পড়ছে ভিড়। কলকাতার ইতিহাসের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যাওয়া এক টুকরো ভালো লাগা। ঐতিহ্যের সেই ফুরফুরে প্রাকৃতিক হাওয়া, নাকি আধুনিকতার এসি মেশিন—এই চাপানউতোরের মধ্যেই অতীত হয়ে যাচ্ছে কল্লোলিনী তিলোত্তমার ট্রাম। থাকবে শুধু বইয়ের পাতায়, ইন্টারনেটে। আর বাঙালির মনে।
ট্রামের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। তবে তা ছিল ঘোড়ায় টানা। শিয়ালদহ থেকে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত ট্রাম সফর না করতে পারার আপশোস অনেকেই মিটিয়েছিলেন যাত্রাপথের দু’ধারে দাঁড়িয়ে। এই পরিষেবা কিন্তু বন্ধ হয়ে যায় সে বছরেরই ২০ নভেম্বর। ১৮৭৯ সালে ক্যালকাটা ট্রামওয়ে কোম্পানি ও কর্পোরেশনের চুক্তি হয়। আর তার ভিত্তিতে তার পরের বছর কলকাতায় ফের ট্রাম চলে। কিন্তু আবার বিপত্তি। যাত্রাপথে বড় বড় লোহার চৌবাচ্চা থাকলেও অত্যাধিক গরম এবং আর্দ্রতার জন্য অস্ট্রেলিয়ান ঘোড়াগুলি ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই খোঁজা হয় বিকল্প। অমৃতার মুখে এই ইতিহাস প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে শুনত আকাশ। শোনা ছাড়া উপায়ও ছিল না। কারণ, তার বান্ধবী ইতিহাসের ছাত্রী। আর ট্রামের প্রতি প্রেম কখনও-সখনও তাদের সম্পর্কের গভীরতাকেও ছাপিয়ে যেত। বালিগঞ্জ ডিপো থেকে বেরিয়ে ২৪ নম্বর ট্রাম যতক্ষণ না তাদের সামনে দাঁড়াত, বলেই যেত অমৃতা। আকাশও জানত, এই গল্পের মধ্যে দিয়েই যে বান্ধবীকে বেশিক্ষণ কাছে পাওয়া। অমৃতার কাছেই তার জানা... ১৯০২ সালে প্রথমবার চলে ইলেকট্রিক ট্রাম। সেই সময় কলকাতা আর হাওড়ার মধ্যে যাতায়াতের জন্য ভাসমান সেতু ছিল। দিনের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা সেতু খুলে দেওয়া হতো জাহাজ চলাচলের জন্য। কিন্তু এই সেতুর উপর দিয়ে ট্রাম চালানো সম্ভব ছিল না বলে হাওড়া ট্রাম পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল এমনও নয়। ১৯০৫ সালের অক্টোবরে হাওড়া শহরে প্রথম ট্রাম চলাচল শুরু হয়। প্রথম রুট, হাওড়া থেকে শিবপুর। এরপর ১৯০৮ সালের অক্টোবরের কোনও এক সময় আরও দু’টি রুট চালু হয়। অমৃতার কাছে রুট নম্বর নিয়ে জানতে চেয়েছিল আকাশ। নিজে থেকেই। হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো খুশিতে কলকল করে ওঠে বান্ধবী—‘প্রথমদিকে ট্রামের সামনে ঝোলানো থাকত বিশেষ রংয়ের বোর্ড। যাত্রীরা তা দেখেই বুঝে নিতেন তার যাত্রাপথ। রুট নম্বরের প্রচলন হয় ১৯৫৮ সালে।’ 
তার মধ্যে অবশ্য রাজনীতি দাবাখেলায় পা রেখে ফেলেছে ট্রাম। বাম বনাম কংগ্রেস চাপানউতোরের প্রধান চরিত্র যে এই একটি নির্বিবাদী-ধীরস্থির যান হতে পারে, তা দেখিয়েছে বাংলাই। ১৯৫৩ সালে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের সরকার সিদ্ধান্ত নিল, ১ জুলাই থেকে এক পয়সা বাড়বে সেকেন্ড ক্লাসের ভাড়া। প্রতিবাদে রাজপথে নামে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া। তারাই জনসাধারণের ক্ষোভে ঘৃতাহুতি দিল। প্রথম দু’দিন অর্থাৎ ১ এবং ২ জুলাই যাত্রীদের সঙ্গে কন্ডাক্টরদের অশান্তি ঠেকল চরমে। ৩ জুলাই পুলিস লাঠিচার্জ করতেই যেন বিস্ফোরণ। পোড়ানো হল বেশ কয়েকটি ট্রাম। এই আন্দোলনের জন্যই ভিয়েনায় নিজের চোখের অস্ত্রোপচার বাতিল করে ফিরে এসেছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। গণআন্দোলনে শেষমেশ ভাড়া কমাতে হয় সরকারকে। আম জনতার পরিবহণ পরিষেবায় রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটে গিয়েছিল সেদিনই। সেই ধারা চলছে আজও। ধুঁকতে থাকা ট্রাম কোম্পানি, একে একে কমে শূন্যে পৌঁছে যাওয়া রুট এবং রাজপথে পাতা লাইনে দু’চাকার দুর্ঘটনা। ট্রাম বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত শোনা মাত্র এখানেও নেমে পড়েছে বিরোধীরা। ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার দাবিতে পথে নাগরিকরাও। কিন্তু আঁকড়ে থাকার এই আব্দারের মধ্যেই আমরা আবিষ্কার করছি, কখন যেন ট্রাম শুধু আমাদের নস্টালজিয়াতেই স্থান পেয়ে রয়েছে। সেই আকাশ আর অমৃতা এখন স্বামী-স্ত্রী। পুঁচকে একটি মেয়ে রয়েছে। তার স্কুলও দক্ষিণ কলকাতায়। তবে এখন আর ট্রামে চড়া হয় না। অটোরিকশাই ভরসা। কিন্তু রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ও ল্যান্সডাউন রোডের ক্রসিংটা এলেই মাঝেমধ্যে মনটা হু হু করে দম্পতির। এই অনুভূতির সঙ্গেও যে ট্রাম জড়িয়ে। ১৯৫৪’র অক্টোবরে তো এখানেই দুর্ঘটনা ঘটেছিল জীবনানন্দ দাশের। আটদিন যমে-মানুষে টানাটানির পর শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে নিভে গিয়েছিল বনলতা সেনের স্রষ্টার জীবনদীপ। 
সত্যিই তো আমাদের অনেকের প্রথম অনেক কিছুর সাক্ষী এই ট্রাম। নয়ের দশক পর্যন্ত যা চলেছে রমরমিয়ে। গর্বের সঙ্গে মাথা উঁচু করে। বাদুড়ঝোলা বাস, ট্যাক্সির আর্থিক বাহুল্য থেকে বাঁচতে ভরসা ছিল ট্রামই। কিন্তু ঐতিহ্যের এই ট্রাম কেন উঠিয়ে দিতে বাধ্য হল পশ্চিমবঙ্গ সরকার? বিশ্লেষণে উঠে আসছে দু’টি বিপরীত মেরুর মত। গতিশীল শহরে ডেডিকেটেড লাইন না থাকায় দুর্ঘটনার বহর বাড়ছে। এছাড়া অধিকাংশেরই ট্রামে ওঠার মতো সময় হাতে নেই। শুধুই ঐতিহ্যের পিছনে ছোটার জন্য আধুনিকতাকে জলাঞ্জলি দিতে হবে, এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে? পাশাপাশি রয়েছে উল্টো মতও। বাবা-মা কর্মক্ষমতা হারালে কি তাঁদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো উচিত? প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। সবমিলিয়ে বাঙালির চায়ের কাপে তুফান উঠছে রমরমিয়ে। 
পায়ের তলায় রাখা লোহার শলাকায় ভারী বুট পরা ড্রাইভার চাপ দিতেই সেই ঘটাং-ঘটাং শব্দ, দড়ি ধরে মারো টানের সেই টিং টিং, অতি পাতলা টিকিট চার ভাঁজে ঘড়ির রিস্টব্যান্ডে আটকানো কিংবা সরু করে মুড়ে কানে দেওয়ার আরাম বাঙালি আর পাবে না। সামনের সিটে বসে আর দেখা যাবে না, স্টপ ছেড়ে ঘটাং করে রওনা দিতেই খুলে যাওয়া চালকের সঙ্গে সংযোগকারী দরজাটা। ব্রেক কষলেই আবার বন্ধ। আর যদি দরজা না খোলে? একটু ঝুঁকলে দেখা যাবে, ওখানে ডোরস্টপ হিসেবে কাজে নেমে পড়েছে নোনা ধরা একটি ইট। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধুই শুনবে এই যানের কথা। আজকের বাবা-মা’রা হয়তো ট্রামের গুরুত্ব বোঝাতে গুনগুন করে গেয়ে উঠবেন আনন্দ বকশির লেখা সেই বিখ্যাত গানের কলি, ‘জিন্দগিকে সফর মে গুজর যাতে হ্যায় যো মকাম, ও ফির নেহি আতে, ও ফির নেহি আতে...’।
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে মানসিক চিন্তা। সব কাজকর্মে অগ্রগতি ও অর্থকড়ি প্রাপ্তির যোগ।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার ৮১.৮৭ টাকা৮৫.৩১ টাকা
পাউন্ড১০৭.৪৯ টাকা১১৪.২২ টাকা
ইউরো৯১.২৬ টাকা৯৫.৪৬ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা