রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মুদ্রানীতি বিষয়ক বিবৃতি যার কারণে শিরোনাম দখল করে তা হল—‘পলিসি রেপো রেট’। রেপো রেট হল সেই সুদের হার যার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক (আরবিআই) দেশের বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে টাকা ধার দেয়। আরবিআই তাদের অর্থ ধার দেয় সিকিউরিটিজের বিনিময়ে, যেগুলি পরবর্তী কোনও একসময়ে পুনরায় কিনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। রেপো রেট কমলে খুশি হন ঋণগ্রহীতারা। কারণ ব্যাঙ্কগুলি কম সুদের হারে ঋণ নিতে পারলে তারা কম সুদের হারে ঋণ দিতেও পারে। অন্যদিকে, রেপো রেট বাড়ানো হলে খুশি হন মুদ্রাস্ফীতি পর্যবেক্ষকরা। কারণ উচ্চ রেপো রেটকে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার বলে মনে করা হয়। আর অপরিবর্তিত রেপো রেট সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই ফেলে দেয় জল্পনার মধ্যে।
গভর্নর এবং রেপো রেট
২০২০ সালের ২৭ মার্চ রেপো রেট ৫.০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪.০ শতাংশ করা হয়। এটি ছিল রেপো রেটের একটি বড় রকমের হ্রাস এবং ন্যায্য পদক্ষেপ। কেননা, কোভিড-আক্রান্ত অর্থনীতি তখন মন্দার বিরুদ্ধে লড়ছিল। ৪.০ শতাংশের রেপো রেট স্থায়ী ছিল টানা ২৬ মাস। কোভিডের দাপট কমার পর অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনের লক্ষণ ফিরে পায়। অতঃপর ২০২২ সালের মে মাসে রেপো রেট এক ধাক্কায় বাড়িয়ে ৪.৪০ শতাংশ করা হয়। পরিষ্কার যে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবকে বাগে আনতেই তা করা হয়েছিল। রেপো রেট ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে ৬.৫০ শতাংশে উঠে যায়। এটি ২০ মাস যাবৎ ওখানেই রয়েছে। আরবিআই গভর্নর শক্তিকান্ত দাস ২০২২ সালের মে মাস থেকে মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছেন। সেখানে অপরিবর্তিত রেপো রেট এটাই বুঝিয়ে দেয় যে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এখনও সফল হয়নি।
কোনও আরবিআই গভর্নর সব পক্ষকে খুশি করতে পারেন না। গভর্নরের এই বোঝা ভাগ করে নেওয়ার জন্য ইউপিএ সরকার অবশ্য একটি আর্থিক নীতি কমিটি (এমপিসি) গঠন করেছিল। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব এখনও গভর্নরেরই কাঁধে। গভর্নরকে বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে ভারসাম্য আনতে হবে এবং নিতে হবে সময়োচিত সিদ্ধান্ত।
মুদ্রাস্ফীতি ৪ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রার পথে এখনও নেই। বিষয়গুলিকে জটিল করে তোলে খাদ্য এবং জ্বালানির দাম। সুদের হার পরিবর্তনে এই দুটি জিনিস সাড়া দেয় না। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে টোম্যাটো (৪২.৪ শতাংশ), পেঁয়াজ (৬৬.২ শতাংশ) এবং আলুর (৬৫.৩ শতাংশ) দাম গত বছরের একই সময়ের তুলনায় অনেকখানি বেড়ে গিয়েছে। বৃদ্ধির হারটি পণ্যের ডান পাশের বন্ধনীতে দেওয়া হল। রেপো রেট অপরিবর্তিত রাখাই যুক্তিযুক্ত হয়েছে বলে সওয়াল করেছেন আরবিআই গভর্নর। তবে পাল্টা যুক্তি এটাই যে, উচ্চ রেপো রেট অর্থনীতির বৃদ্ধির হার কমাবার প্রবণতা গড়ে দেয়।
বৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতি
বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি হল আরবিআই ও সরকারের উদ্বেগের দুটি প্রাথমিক বিষয়। চলতি বছরের জন্য প্রত্যাশিত বৃদ্ধির হার (প্রজেক্টেড গ্রোথ রেট) ৭.৫ শতাংশ জানিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন শক্তিকান্ত দাস। একইসঙ্গে তাঁর অনুমান, মুদ্রাস্ফীতিও হবে ৪.৫ শতাংশ। মুদ্রাস্ফীতি এখনও সেই পর্যায়ে পৌঁছয়নি, বরং গত সেপ্টেম্বরে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৫.৪৯ শতাংশ, যা বেশ বেশি। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে খাদ্য মূল্য সূচক (কনজিউমার ফুড প্রাইস ইনডেক্স) ৯.২৪ শতাংশে পৌঁছেছে।
গত মাসে (অক্টোবরে) প্রকাশিত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মানিটারি পলিসি রিপোর্টের দুটি বিষয়ে আরও কিছু বলার আছে। রিপোর্টে সরকারি পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে ‘আউটলুক ফর গ্রোথ’ শিরোনাম অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, ‘অনিশ্চিত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, দীর্ঘস্থায়ী ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, সাপ্লাই চেইনের উপর বেড়ে চলা চাপ এবং বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতা, পরিস্থিতিকে বিরূপ করে তুলেছে।’ রিপোর্টে অন্যান্য কারণগুলিকেও চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন ‘ভূ-অর্থনৈতিক বিভাজন, বিশ্বজুড়ে চাহিদার পতন এবং ঘন ঘন আবহাওয়ার উপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব।’ আরবিআই রিপোর্টের ‘আউটলুক ফর ইনফ্লেশন’ অধ্যায়ে ঝুঁকিগুলিকে এইভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে—‘বিশ্বব্যাপী সরবরাহের চাপ বৃদ্ধি, প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে নানা বিপদ, বৃষ্টিপাতের অসম বণ্টন, দীর্ঘায়িত ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত এবং ফলস্বরূপ সাপ্লাই চেইনে বিঘ্ন ঘটা, খাদ্য ও ধাতব দ্রব্যের দামবৃদ্ধি, অপরিশোধিত তেলের দামের অস্থিরতা এবং প্রতিকূল আবহাওয়ার ঘটনাবলি।’ তারা ওইসঙ্গে দশটি পর্যন্ত পৃথক অপ্রত্যাশিত ঝুঁকির কথাও যোগ করেছে।
সোজা ঝাপটা
অর্থমন্ত্রকের মাসিক অর্থনৈতিক পর্যালোচনাতে একটি স্পষ্ট মূল্যায়ন রয়েছে। এটি ভারতীয় অর্থনীতির পারফরম্যান্সকে ‘সন্তোষজনক’ হিসেবে বর্ণনা করেও এই বলে সতর্ক করে দিয়েছে যে, ‘প্রাথমিক চাহিদার শর্তগুলির উপর নজর থাকছে। তদুপরি, ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক বিভাজনের গভীরতা বৃদ্ধি এবং অর্থের বাজারকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো—এসব থেকে কিছু উন্নত অর্থনীতিতে বৃদ্ধির সামনে ঝুঁকি উপস্থিত হয়।’
এনসিএইআর-এর মাসিক অর্থনৈতিক পর্যালোচনা ভারসাম্যপূর্ণ। উজ্জ্বল দিকগুলি চিহ্নিত করার পর ওই রিভিউতে খারাপ দিকগুলির প্রতিও অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়েছে: ব্যাঙ্কঋণে লাগাম; ব্যক্তিগত ঋণ, পরিষেবা, কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে মন্দা; ভারতীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন; এবং বিদেশি লগ্নি (ফরেন পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট বা এফপিআই) আসা কমে যাওয়া।
আমার দৃষ্টিতে, পক্ষীর দর্শন আর কীটের দর্শন একেবারে এক নয়, ভীষণই আলাদা। ম্যাক্রো-ইকনমি বা সামষ্টিক-অর্থনীতির দৃষ্টিভঙ্গির জন্য প্রথমোক্তটি গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, দ্বিতীয়টি সাধারণ মানুষের সমস্যার সুরাহা এবং জীবনমানের উন্নয়নকে প্রতিফলিত করে। জনগণের উদ্বেগের বিষয়গুলি হল—বেকারত্ব, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, অনড় নিম্নহারের মজুরি, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বেড়ে চলা বৈষম্য, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ ও জিএসটি এবং কঠোর জিএসটি প্রশাসন, নিম্নমানের শিক্ষা, মানুষের নাগালের বাইরে চিকিৎসা পরিষেবার দাম, হৃদয়হীন আমলাতন্ত্র এবং সেই সরকারি ব্যয়নীতি যা ধনীর স্বার্থরক্ষা করে এবং দুয়ে নেয় গরিবকে।
উপর্যুক্ত বিষয়গুলির পাশাপাশি, আরও কিছু জিনিস থেকে খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে: মধ্য-প্রাচ্যের নৃশংস যুদ্ধের ভিতরে জড়িয়ে পড়তে পারে আরও একাধিক দেশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ন্যাটো দেশগুলির জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। মণিপুরে প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে আর একটি অশান্তি। চমক দিতে পারে মহারাষ্ট্র নির্বাচন। চীন-তাইওয়ান কিংবা দক্ষিণ কোরিয়া-উত্তর কোরিয়া উত্তপ্ত ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাই, দয়া করে আপনার সিটবেল্ট বেঁধে রাখুন, সামনে জোর ঝাঁকুনি অপেক্ষা করে আছে কিন্তু।
লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত