বিশ্বজিৎ দাস, কলকাতা: উই ওয়ান্ট জাস্টিস, রাত-দিন দখল আর ‘দ্রোহে’র ডাক দিয়ে যে বিক্ষুব্ধ সিনিয়র ডাক্তাররা এখন আসর গরম করছেন, ২৩ বছর আগে আর জি করের এক মেডিক্যাল পড়ুয়ার ‘রহস্যমৃত্যু’তে নাম জড়িয়েছিল তাঁদেরই বেশ কয়েকজনের। তাঁরা তখন লালপার্টির ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের কেষ্টবিষ্টু! বারাকপুরের বাসিন্দা চতুর্থ বর্ষের মেডিক্যাল পড়ুয়া ছিলেন সৌমিত্র বিশ্বাস। ২০০১ সালের ২৫ আগস্ট আর জি করের ললিত মেমোরিয়াল হস্টেলের ঘরে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল তাঁর মৃতদেহ। গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন তিনি? অভিযোগ কিন্তু ছিল। দাবি উঠেছিল, ডাক্তারি পড়ুয়ার গলায় বাঁধা দড়ি নাকি এতটাই ‘পোক্ত’ ছিল যে, পৃথিবীর সবচেয়ে রোগা লোকটাও ঝুলতে চাইলে মুহূর্তে তা ছিঁড়ে যাবে। হস্টেল রুমে সেই অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় এসএফআইয়ের কেষ্টবিষ্টুদের কয়েকজনকে জেরাও করেছিল সিপিএম জমানার সিআইডি।
মৃতের মা সবিতাদেবীর অভিযোগ ছিল, আর জি করের পর্নোগ্রাফি চক্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাতেই ‘খুন’ হতে হয়েছে তাঁর ছেলেকে। কারা এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত? ‘দুবেজি’, ‘ধরবাবু’ ও ‘গোঁসাই ঠাকুর’, এই তিনজন এসএফআই ‘মাতব্বর’-এর নামে সরাসরি যুক্ত থাকার অভিযোগ এনেছিলেন সবিতাদেবী। অসহায় সেই মায়ের আর্জিতে তখন হয়নি উই ওয়ান্ট জাস্টিসের মিছিল, হয়নি রাত-দিন দখল, প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়েননি কোনও স্বঘোষিত সমাজ সংস্কারক, এমনকী হয়নি কোনও দ্রোহ কার্নিভালও। রাস্তায় রং দিয়ে লেখা হয়নি কোনও প্রতিবাদী স্লোগান।
শিয়ালদহ আদালতের নির্দেশে তদন্তে নেমে আর জি করের হস্টেল থেকে পর্নোগ্রাফির শ্যুটিং সংক্রান্ত ট্রাইপড, লাইট রিফ্লেক্টার সহ নানা সরঞ্জাম উদ্ধার করেছিল সিআইডি। এমনকী সিআইডি তার রিপোর্টে লিখেছিল, যৌনকর্মী ভাড়া করে এনে শ্যুটিং হতো সেখানে। অভিযোগ, এতসব সত্ত্বেও লালপার্টি আর তার ছাত্র সংগঠনের ‘দাপটে’ ধামাচাপা পড়েছিল আর জি কর হাসপাতালের ওই কালো অধ্যায়। কলেজ কর্তৃপক্ষ কোনও সহযোগিতা করেনি—এই অভিযোগ আনার পরেও কলকাতা পুলিসের গোয়েন্দা শাখার মতোই নিছক ‘সুইসাইড’ রিপোর্ট দিয়ে কেস গুটিয়ে নেয় তদন্তকারী সংস্থা।
এরপরেও জাস্টিসের আশায় নানা দোরে দোরে ঘুরে হতাশ সবিতাদেবীকে চলে যেতে হয়েছে ধরাধাম থেকে। ছেলের মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত পর্বে সে বছরের ১২ নভেম্বর সাংবাদিক সম্মেলন করে সরাসরি এসএফআই নেতাদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ এনেছিলেন সবিতাদেবী। তাঁর অভিযোগ ছিল, ‘কলেজ ব্যাগের নাইলনের স্ট্র্যাপ দিয়ে ওকে ঝোলানো ছিল। মুখের মধ্যে ঠেসে রুমাল গোঁজা ছিল। দরজা খোলা। এভাবে কেউ আত্মহত্যা করে? ঘটনার পরদিন ২৬ আগস্ট চিৎপুর থানায় এফআইআর করি এবং তদন্তকারী অফিসারদের সমস্ত বিষয়টি জানাই। এরপর সুবিচারের জন্য কলেজ প্রিন্সিপাল, পুলিস কমিশনার, স্বাস্থ্যমন্ত্রী এমনকী মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও বারবার প্রার্থনা জানিয়েছি। মুখ্যমন্ত্রীর (প্রয়াত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য) অফিস থেকে পাঁচবার আমার জমা দেওয়া আবেদনপত্র হারিয়ে যায়। আজ পর্যন্ত ন্যায়বিচার পেলাম না।’
এখন অবশ্য যে বা যাঁরা অভয়ার মায়ের প্রতি নিজেদের সমস্ত সমবেদনা উজাড় করে দিচ্ছেন, তাঁরা কিন্তু সেই সময় কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ হেনেছিলেন সবিতাদেবীর বিরুদ্ধে। এমনকী অভিযোগপত্রে যে সবিতাদেবীই সই করেছেন, তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে লালপার্টির ছাত্ররা। আজও তার অন্যথা হচ্ছে না। আর জি করে তখনকার শীর্ষ এসএফআই নেতা ডাঃ সুবর্ণ গোস্বামী বলেন, ‘সবিতাদেবী সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন, ওই ঘটনায় টিএমসিপি নেতারা জড়িত। এসএফআই নয়। সিআইডি এবং বিচারবিভাগীয় তদন্ত হয়েছিল। ডিএসও’র তরফে আমাদের নামে মিথ্যা অভিযোগ করা হয়।’ নজর করার মতো বিষয় হল, এই সুবর্ণ গোস্বামীই এখন অভয়া আন্দোলনের অন্যতম হোতা এবং ‘নেতা’। তিনিই আবার ‘থ্রেট কালচারে’র বিরুদ্ধে প্রধান মুখও বটে। তৎকালীন ডিএসও নেতা তথা আজকের মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টারের রাজ্য সম্পাদক ডাঃ বিপ্লব চন্দ্র পাল্টা বলেন, ‘আজ থ্রেট কালচার বলে এত কথা বলছেন ডাঃ গোস্বামী! বিরোধী সংগঠন করেছি বলে আমাদের ছাত্রাবস্থায় যে ওঁরাই যে কত থ্রেট করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই।’
আজ যাঁরা অভয়ার হয়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলনে শামিল হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অপর্ণা সেন, মীরাতুন নাহারের মতো বিশিষ্টজনেরা সৌমিত্রের ন্যায়বিচারের দাবিতে বিবৃতি দিয়েছিলেন। কিন্তু আর জি করের সৌমিত্র’র অধ্যায় ধীরে ধীরে সময়ের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে। ভাগ্যের পরিহাসে, সে ঘটনায় নাম জড়ানো কয়েকজন এখন ‘প্রতিবাদী’ হয়ে অন্যের জন্য বিচার চাইছেন!