বিশেষ নিবন্ধ

কোবিন্দ কমিটির রিপোর্ট প্রত্যাখ্যাত হবে
পি চিদম্বরম

একযোগে নির্বাচনের জন্য উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনে সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য তার টার্মস অব রেফারেন্স (টিওআর) থেকেই খোলসা হয়ে গিয়েছে। কমিটিকে প্রথম টিওআর ‘বলেছিল, একযোগে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য পরীক্ষার পর সুপারিশ করতে ...।’ লোকসভা ও ভারতের ২৮টি রাজ্যে এবং বিধানসভা আছে যেসব কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে—এই সমস্ত জায়গায় একযোগে নির্বাচনের সুপারিশ করাই ছিল কমিটির অন্তর্নিহিত রায়। 
কমিটি আরও মনে করে যে কাজটি সম্ভব এবং 
করাই বাঞ্ছনীয়। একযোগে নির্বাচন অনুষ্ঠানের 
ধারণার বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু সুপারিশ করার কোনও হুকুম তার ছিল না। কমিটি বিশ্বস্ততার সঙ্গেই তার দায়িত্ব পালন করেছে।
কমিটিতে উপযুক্ত ব্যক্তির অভাব
কমিটির চেহারা একেবারেই নিরপেক্ষ নয়। চেয়ারম্যান এবং অন্য আটজন সদস্যের মধ্যে মাত্র একজন কনস্টিটিউশনাল এক্সপার্ট বা সংবিধান বিশেষজ্ঞ। অন্য একজন সদস্য কনস্টিটিউশনাল প্রসিডিয়োর বা সংসদীয় রীতিনীতি সম্পর্কে জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব হলেও তিনি আইনজীবী নন কিংবা আইনের শিক্ষকও ছিলেন না কখনও। এই গুরুত্বপূর্ণ কমিটির সদস্যদের মধ্যে দু’জন হলেন রাজনীতিক এবং একজন আমলা থেকে পরে রাজনীতির কারবারি হয়ে গিয়েছেন। তিনজন সদস্য তাঁদের গোটা কর্মজীবন সিভিল সার্ভিসেই কাটিয়েছেন। রামনাথ কোবিন্দকে কমিটির শীর্ষে রাখার ব্যাপারটা নিতান্তই আলংকারিক। সম্ভবত, কমিটির গুরুত্ব বৃদ্ধি করতেই তাঁকে ওই চেয়ার দেওয়া হয়েছে। তা এই কমিটির চেহারা যেমনই হোক না কেন, এটাকে কোনোভাবেই সংবিধান বিশেষজ্ঞদের একটি ‘বডি’ বলা যাবে না। 
বিশেষভাবে প্রত্যাশিত সুপারিশই কমিটি করেছে যে, লোকসভা এবং রাজ্য বিধানসভাগুলির নির্বাচন পাঁচ বছর অন্তর একবার এবং একত্রেই হওয়া উচিত। আমার জানা মতে, কোনও বৃহৎ, ফেডারেল বা যুক্তরাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক দেশে এমন নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটিও নজির নেই। এই ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং জার্মানির সঙ্গে একটি তুলনামূলক আলোচনা করা যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দু’বছরে একবার তাদের প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট এবং গভর্নর পদগুলির জন্য ভোট নেওয়া হয় চার বছরে একবার। তবে শেষোক্ত নির্বাচনগুলি কিন্তু একত্রে অনুষ্ঠিত হয় না। এছাড়া সিনেটের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তিনটি দ্বিবার্ষিক চক্রে, মোট ছ’বছর ধরে। সম্প্রতি, ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানির থুরিংগিয়া এবং স্যাক্সনি নামক দুটি রাজ্যে তাদের নিজস্ব নির্বাচনী পর্যায় অনুযায়ী ভোট নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ করার মতো বিষয়টি হল, এই দুই রাজ্যের নির্বাচনের সঙ্গে কিন্তু সে-দেশের ন্যাশনাল পার্লামেন্ট বুন্দেস্তাগের ইলেকশন সাইকেলের কোনও মিল নেই, বরং একেবারেই আলাদা।  
তাহলে এটাই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে যে, কোবিন্দ কমিটি যেটির অনুসন্ধান করেছে সেটি যুক্তরাষ্ট্র এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারণার একটি বিরোধী-তত্ত্ব (অ্যান্টি-থিসিস)। সংসদীয় গণতন্ত্রে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিদিন জনপ্রতিনিধিদের কাছে দায়বদ্ধ এবং সেই সরকারের ‘এগজিকিউটিভ’ যিনি তাঁর জন্য কোনও মেয়াদ নিশ্চিত বা নির্দিষ্ট করা নেই।  আমাদের জন্য কোন রাজনৈতিক মডেল গ্রহণ সর্বোত্তম হবে, সেটা ঠিক করা হয়েছিল গণপরিষদে বিতর্কের মাধ্যমে। সংবিধান প্রণেতারা প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেম বা রাষ্ট্রপতি-প্রধান ব্যবস্থাকে চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁরা সর্বসম্মতিক্রমে বেছে নেন সংসদীয় ব্যবস্থাকে। তার কারণ তাঁদের বিশ্বাস ছিল যে, বৈচিত্র্যে ভরা ভারতের জন্য পার্লামেন্টারি সিস্টেমই হবে সবচাইতে ভালো ব্যবস্থা।
সূত্রগুলি এবং সেগুলির গঠন
কোবিন্দ কমিটির রিপোর্ট হল জটিল বীজগণিত সূত্র এবং সরলীকৃত আইনি সূত্রের মিশ্রণ। এই কমিটি স্বীকার করেছে যে, একযোগে নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রস্তাবটির ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। ৮২এ, ৮৩(৩), ৮৩(৪), ১৭২(৩), ১৭২(৪), ৩২৪এ, ৩২৫(২), ৩২৫(৩) প্রভৃতি নয়া অনুচ্ছেদ যোগ করতে হবে। তার পাশাপাশি সংশোধন করতে হবে ৩২৭ নম্বর অনুচ্ছেদটিকে। একটি রাজ্য বিধানসভার মেয়াদের শেষ তারিখ এবং লোকসভার অন্তিম তারিখের সঙ্গে সমন্বয় করাই হবে এই নতুন বিধান ও সংশোধনীর কাজ।
সরকারের তরফে দেওয়া ইঙ্গিত থেকে অনুমান করা যায় যে, সাংবিধানিক সংশোধনীগুলি আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরে পাস হবে। তাহলে প্রস্তাবিত একযোগের নির্বাচন হওয়ার কথা ২০২৯ সালে। তাতে ২০২৫, ২০২৬, ২০২৭ ও ২০২৮ সালে নির্বাচিত রাজ্য বিধানসভাগুলির (সর্বমোট ২৪টি রাজ্যে) মেয়াদের উপর এক ধাক্কায় এক থেকে চার বছরের কোপ পড়বে! ভাবুন ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে—২০২৭ সালে তৈরি সরকারটির আয়ু হবে মাত্র দু’বছর কিংবা ২০২৮ সালে মাত্র একবছরের জন্য একটি রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে! এমন এক-একটি রাজ্যের মানুষ ও রাজনৈতিক দলগুলি এই অদ্ভুত কারবার কেন মেনে নেবে? এই ব্যাপারে কিছু খারাপ সম্ভাবনার কথাও মাথায় রাখতে হবে। হতেই পারে একটি নির্বাচনে হাং বা ত্রিশঙ্কু বিধানসভা তৈরি হল অথবা কোনও নির্বাচিত রাজ্য সরকার বিধানসভার ভিতরে গরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে পারল না। আবার এমনও হতে পারে যে একজন মুখ্যমন্ত্রী কোনও কারণে পদত্যাগ করলেন কিন্তু অতঃপর অন্যরাও সংখ্যাগরিষ্ঠতা জোগাড় করতে ব্যর্থ হলেন। প্রস্তাবিত নয়া ব্যবস্থায় এসব পরিস্থিতিতে কী হবে? পাঁচ বছরের বাকি মেয়াদের জন্য নতুন করে ভোটের আয়োজন করতে হবে, কিন্তু সেই নবীন সরকারের হাতে কাজের সুযোগ থাকবে অল্প কিছুদিনই, হয়তো মাত্র কয়েকটি মাস! এসব তো হতেই পারে! এই ধরনের নির্বাচন স্রেফ প্রহসন নয় কি? এসব ভোটে কেবল সেইসব রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীরাই লড়তে পারবেন যাঁদের টাকাকড়ির মা-বাপ নেই! এই প্রসঙ্গে নির্বাচনী-বন্ডের অর্থে ধনাঢ্য দলগুলির কথাই মনে আসে বইকি। সুপারিশগুলি, বিক্ষুব্ধ বিধায়কদের একটি স্বল্পমেয়াদের জন্য নতুন নির্বাচনের হুমকি দিয়ে আটকে রাখার একটি সুযোগ অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীকে দেবে।
মুফতে কোনও পাস নয়
কোবিন্দ কমিটির সুপারিশ ইতিহাসের মুখে উড়ে যাবে। ১৯৫১ থেকে ২০২১ সাল—নির্বাচনের সাত দশকে স্থিতিশীলতার অভাব ছিল মাত্র দুটি দশকে (১৯৮১-১৯৯০ ও ১৯৯১-২০০০)। পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য স্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে ১৯৯৯ সাল থেকে টানা।
আরও উল্লেখ করা দরকার যে, বেশিরভাগ রাজ্য সরকার বা বিধানসভা তাদের পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করেছে। নড়বড়ে নির্বাচনেও আমাদের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি প্রভাবিত হয়নি: ইউপিএ’র দশ বছরে গড় বৃদ্ধির হার ছিল ৭.৫ শতাংশ। এনডিএ দাবি করেছে যে, তাদের দশ বছরে বৃদ্ধি নাকি আরও ভালো হয়েছে।  
সংবিধান সংশোধনী বিল এনডিএ সরকার সংসদে পাস করিয়ে নিতে পারবে, কোবিন্দ কমিটির এটাই একটি ভুল অনুমান। এর বিপরীতে, এই বিলগুলির পাস আটকে দিতে বিরোধীরা সহজেই লোকসভায় ১৮২ জন এবং রাজ্যসভায় ৮৩ জন সদস্যকে পাশে পেয়ে যেতে পারে। একটি বহুত্ববাদী এবং বৈচিত্র্যময় দেশের ঘাড়ে কোনও একমুখী মত (ওয়ান ন্যারেটিভ) চাপিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই ‘ওয়ান নেশন ওয়ান ইলেকশন’ ভাবনার আমদানি। আমার ধারণা, মোদিজিদের সাধের ‘ওএনওই’ শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়বে।  
• লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

বিদ্যায় অগ্রগতি ও নামী প্রতিষ্ঠানে বিদ্যা লাভের সুযোগ পেতে পারেন। ব্যবসায় শুভ ও আয় বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮২.৬৮ টাকা৮৪.৪২ টাকা
পাউন্ড১০৯.৫৩ টাকা১১৩.১১ টাকা
ইউরো৯১.৭৫ টাকা৯৪.৯৫ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
21st     September,   2024
দিন পঞ্জিকা