জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি মেনে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কি ভুল করলেন? গত কয়েকদিন ধরে এটাই ছিল মূল চর্চিত বিষয়। কলকাতা পুলিসের কমিশনার সহ স্বাস্থ্যকর্তাদের সরিয়ে দেওয়ার পরেও চিকিৎসকরা কর্মবিরতি তুলতে গড়িমসি করছেন। রাজনৈতিক নেতাদের মতোই দর কষাকষি করছেন। তাই অনেকে মনে করছিলেন, আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের অধিকাংশ দাবি মেনে নেওয়াটা ভুল হয়েছে। কিন্তু সত্যিই কি মুখ্যমন্ত্রীর ভুল হল, নাকি দাবি মেনে নিয়ে তিনি চিকিৎসক ও বিরোধীদের পালের হাওয়া এক ঝটকায় কেড়ে নিলেন? একথা ঠিক, জ্যোতি বসুর মতো আন্দোলনকারী ডাক্তারদের লাঠিপেটা করলে তিনি ‘কড়া প্রশাসকে’র তকমা পেতেন, কিন্তু কিছুতেই ‘অভিভাবক’ হয়ে উঠতেন না।
গণআন্দোলনের জেরে ৫আগস্ট বাংলাদেশের বুকে ঘটে গিয়েছে গণঅভ্যুত্থান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চোখের জল ফেলতে ফেলতে দেশ ছাড়তে হয়েছে। তার চারদিনের মাথায় আর জি করের নৃশংস হত্যাকাণ্ড। বাংলার চিকিৎসক কন্যার খুন ও ধর্ষণের প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছিল রাজ্য। জাস্টিসের দাবিতে চিকিৎসকদের আন্দোলন গণআন্দোলনের রূপ নিয়েছিল। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে সরকার বিরোধী প্রমাণে মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছে সিপিএম ও বিজেপি। কিন্তু পারেনি।
বিরোধীরা ভেবেছিল, চিকিৎসকরা লাগাতার কর্মবিরতি চালিয়ে গেলে মুখ্যমন্ত্রী ‘ফাউল’ করবেন। তারজন্য পরিবেশ তৈরির চেষ্টাতে কোনও খামতি ছিল না। বিশৃঙ্খলা পাকিয়ে পরিস্থিতি এমন দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল যাতে পুলিস গুলি চালাতে বাধ্য হয়। সেটা করাতে পারলেই বাংলাকে ‘বাংলাদেশ’ বানানোর দিবাস্বপ্ন সফল হতো। কিন্তু, মুখ্যমন্ত্রী
ফাঁদে পা দেননি। কড়া পদক্ষেপের বদলে আলোচনার মধ্যেই সমাধানের রাস্তা বের করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।
অভয়ার খুনি ও ষড়যন্ত্রকারীদের শাস্তির দাবিতে বাংলা এককাট্টা। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চিকিৎসকরা এমন সব দাবি করেছেন যার সঙ্গে অভয়ার জাস্টিসের তেমন কোনও সম্পর্কই নেই। তা সত্ত্বেও চিকিৎসকদের তোলা পাঁচটির মধ্যে মূল তিনটি দাবি মুখ্যমন্ত্রী মেনে নিয়েছেন। তবে অনেকেই মনে করেন, একতরফা চিকিৎসকদের মূল দাবিগুলি মেনে নেওয়া ঠিক হয়নি। তাঁদের বক্তব্য, এই সমস্যা সমাধানের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ পলিসিই বেশি কার্যকরী হতো। কারণ কড়া পদক্ষেপের ব্যাপারে রাজ্য সরকারকে দেশের প্রধান বিচারপতি ‘ফ্রি-হ্যান্ড’ দিয়ে দিয়েছিলেন। জানিয়ে দিয়েছিলেন, চিকিৎসকরা কর্মবিরতি চালিয়ে গেলে রাজ্য সরকারের পদক্ষেপে হস্তক্ষেপ করবে না আদালত। তারপরেও মুখ্যমন্ত্রী কঠোর হননি। উল্টে সবসময় বলেছেন, আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান চায় সরকার।
সেই বার্তা দিতেই মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং পৌঁছে গিয়েছিলেন চিকিৎসকদের আন্দোলন মঞ্চে। সন্তানসম চিকিৎসকদের সামনে হাতজোড় করে কর্মবিরতি তুলে নিতে অনুরোধ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘কোনও কড়া পদক্ষেপ নেব না। গরিব মানুষের কথা ভেবে দয়া করে কাজে যোগ দিন।’ নজিরবিহীন ঘটনা। এর আগে দেশের কোনও মুখ্যমন্ত্রী কি এভাবে গণআন্দোলনের মঞ্চে গিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলার সৌজন্য দেখিয়েছেন? নাকি দেখানোর মতো বুকের পাটা আছে?
মুখ্যমন্ত্রীর এই অভিভাবকসুলভ উদারতাই কর্মবিরতি প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে মাস্টার স্ট্রোক হিসেবে কাজ করেছে। আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রাজনৈতিক জমি শক্ত করেছেন। তাই লাটাইয়ের সুতো ছাড়া ও গোটানোর বিষয়টা তাঁর জানা। তিনি খুব ভালো করেই জানেন, ঘুড়িতে হাওয়া ধরলে সুতো ছেড়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তখন সুতো গোটাতে নেই। তাতে থাকে ছিঁড়ে যাওয়ার ভয়। তাই তিনি সুতো ছেড়েই গিয়েছেন।
সেই ফর্মুলাতেই তিনি আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের দাবিমতো কলকাতা পুলিস কমিশনারের পদ থেকে বিনীত গোয়েলকে এবং স্বাস্থ্যদপ্তরের দুই কর্তাকে সরিয়ে দিয়েছেন। প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি নারায়ণস্বরূপ নিগমের ভূমিকা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন। তাঁর ঘোষণার পর চিকিৎসক ও আন্দোলনকারীরা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছিলেন। খোল, করতাল, বাদ্যযন্ত্র সহকারে আন্দোলনকারীদের উদ্দাম নাচ ইতিমধ্যেই ভাইরাল। তা নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, অভয়ার জাস্টিসের দাবিতে গণআন্দোলনে এটা কি শোভা পায়? তবে, এসব যাঁরা করেছেন তাঁরা তাঁদের অন্তরের কদর্য রূপটাকেই প্রকাশ্যে এনে ফেলেছেন। কিন্তু গণআন্দোলন স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
চিকিৎসকদের আন্দোলনের জেরেই যে প্রশাসনের তিন পদস্থ কর্তার বদলি এবং পরিকাঠামো সংস্কারের উদ্যোগ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে, মুখ্যমন্ত্রী চাইলেই সিবিআই তদন্তের দোহাই দিয়ে চিকিৎসকদের দাবিগুলি এড়িয়ে যেতে পারতেন। এই দাবিগুলি কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে তোলা হলে হয়তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেটাই করতেন। চোখে চোখ রেখে লড়াইটা চালিয়ে যেতেন। কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা তিনি করেননি। কারণ আন্দোলনটা ছিল জুনিয়র ডাক্তারদের। তাঁরাই ভবিষ্যৎ চিকিৎসা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড। তাই তিনি মূল তিনটি দাবিই মেনে নিয়েছেন। আর তাতেই ঘুরে গিয়েছে ‘হাওয়া’।
মুখ্যমন্ত্রী মূল দাবিগুলি মেনে নিতেই দ্রুত বদলাতে থাকে পরিস্থিতি। শুধু আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের মধ্যেই মতভেদ হয়নি, এতদিন যাঁরা চিকিৎসকদের সমর্থনে রাস্তায় নেমেছেন, রাত জেগেছেন, তাঁদের অনেকেই কর্মবিরতি প্রত্যাহারের পক্ষে সওয়াল করেছেন। এমনকী সিনিয়র ডাক্তারবাবুরাও।
যাঁরা স্বাস্থ্যভবনের সামনে আন্দোলন করছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত মেধাবী। অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাঁরা চিকিৎসক হয়েছেন। এতদিন তাঁরা চিকিৎসা শাস্ত্রের বইয়ের পাতায় যা পড়েছেন এখন সেগুলিই তাঁদের বাস্তবে প্রয়োগ করার সময়। তাই জুনিয়র ডাক্তারদের কাছে এই সময়টা অত্যন্ত মূল্যবান। এই সময় অভিজ্ঞ সিনিয়র চিকিৎসকদের অধীনে কাজ করার মধ্যে দিয়ে তাঁরা প্রচুর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। অথচ আন্দোলনের জন্য একটার পর একটা অতীব মূল্যবান দিন চলে যাচ্ছে। তাতে তাঁদের ক্ষতি হচ্ছে প্রচুর। সম্ভবত সেটা বুঝেই জুনিয়র ডাক্তারদের একটা বড় অংশ কাজে যোগ দিতে চাইছে। চিকিৎসকদের ধীরে ধীরে কাজে ফেরার ঘোষণায় সাধারণ মানুষ খুশি। কিন্তু ইতিমধ্যেই কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, চিকিৎসকদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী ছিল? নিজেদের দাবিদাওয়া আদায়, নাকি অভয়ার জাস্টিস? এতেই বোঝা যাচ্ছে, রুষ্ট হয়েছেন আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢেলে যাওয়া ‘পুরোহিতে’র দল।
পরিকাঠামোগত সংস্কারের উপরেই আটকে ছিল চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহারের বিষয়টি। এব্যাপারে একটা কথা মনে রাখা দরকার, রাতারাতি কোনও পরিকাঠামো বদলে ফেলা বা তৈরি করা যায় না। তারজন্য দিতে হয় সময়। পাশাপাশি দেখতে হবে, তাঁদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে সরকার আন্তরিক কি না! সরকার প্রতিশ্রুতি পালন না করলে ফের আন্দোলনে বাধা নেই। কিন্তু বানভাসি বাংলায় মানুষের পাশে না থেকে রাস্তায় থাকলে ‘ভগবানে’র গায়েও লেগে যেত স্বার্থপরের ছাপ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পরিকাঠামোগত সমস্যা কি শুধু স্বাস্থ্যেই, অন্যত্র নেই? না, আছে সর্বত্র। আর এটা বিশেষ কোনও রাজ্যের খামতি নয়, গোটা দেশের। আরও স্পষ্ট করে বললে, এটা প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশের সমস্যা। পরিকাঠামোগত দুর্বলতা উন্নয়নশীল দেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কারণ প্রয়োজনের তুলনায় ‘রিসোর্স’ কম। তাই কোনও ক্ষেত্রেই আদর্শ পরিকাঠামো গড়ে তোলা একপ্রকার অসম্ভব। সেই পরিকাঠামোগত দুর্বলতাকে সামনে রেখে লাগাতার কর্মবিরতি সমর্থনযোগ্য নয়।
প্রায় প্রতি বছরই আমাদের দেশে রেল দুর্ঘটনায় বহু মানুষের প্রাণ যায়। দুর্ঘটনা ঠেকানোর জন্য ২০২০ সালে ‘কবচ’ চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রেলকর্তৃপক্ষ। বলা হয়েছিল, কবচ ব্যবস্থা চালু হলে সংঘর্ষের আগেই ট্রেন থেমে যাবে। চালক বা কেবিনম্যান ভুল করলেও ঘটবে না দুর্ঘটনা। কবচ লাগুর পরেও একের পর এক ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এখন ট্রেনের চালকরা যদি বলেন, ‘কবচ’ ত্রুটিমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা ট্রেন চালাবেন না। তাহলে কী হবে? তাঁদের দাবিকে কি মানুষ সমর্থন করবে, নাকি কেন্দ্রীয় সরকার ছেড়ে কথা বলবে?
একটা কথা মানতেই হবে, অভয়ার মর্মান্তিক মৃত্যু এবং তার তথ্য প্রমাণ লোপাটের অভিযোগকে ঘিরে চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে। সেই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে রাজ্যে পালা বদলের স্বপ্ন দেখেছিল বিরোধীরা। জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশকে সামনে রেখে চলছিল সেই লক্ষ্যপূরণের চেষ্টা। তোলা হয়েছিল স্লোগান, ‘দফা এক দাবি এক, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ।’ কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাস্টারস্ট্রোকে চুরমার হয়ে গেল বিরোধীদের বাংলাকে ‘বাংলাদেশ’ বানানোর খোয়াব।