বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ

বিচার ছেড়ে লাশের রাজনীতি কি অভয়ার প্রাপ্য!
হিমাংশু সিংহ

শুরু থেকেই যে আশঙ্কাটা করছিলাম তাই সত্যি হল। এখন খুন হওয়া চিকিৎসকের বাবা-মাও বোধকরি একমাত্র কন্যার মৃত্যু নিয়ে এই রাজনীতিতে অনুতপ্ত। কারণ একটাই, তাঁদের বিচারের দাবি পথ হারিয়েছে রাজনীতির কর্দমাক্ত কানাগলিতে। লাঠি, আগুন আর অশান্তির ত্র্যহস্পর্শে। কর্মনাশা বন্‌঩ধের ভুলভুলাইয়ায়। আর অভয়া? যতদূর জানি সে কোনওদিন রাজনীতির ধারেকাছে ছিল না। নিষ্পাপ কর্তব্যপরায়ণ রোগীর স্বার্থে নিবেদিত আপসহীন এক ডাক্তার। তিন সপ্তাহ ধরে গরিব মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা পাচ্ছেন না, এই অসহনীয় অবস্থা তাঁর ভালো লাগছে কি? অভয়া বিচার চায়, দোষীদের শাস্তি চায়, হাসপাতাল বন্ধ করে গরিবের লাশের পাহাড় দেখতে চায় না নিশ্চয়ই।
অভয়ার দুঃখের আর একটা কারণ সিবিআইয়ের ব্যর্থতা। একটাও প্রশ্নের মীমাংসা করতে পারেনি আড়াই সপ্তাহের তদন্তে। উল্টে শুধু বিভ্রান্তি বাড়িয়েছে হাজারো অপ্রমাণিত সম্ভাবনার ভাসা ভাসা ইঙ্গিত দিয়ে। কয়েকশো ঘণ্টা জেরা করে দেড় ডজন জায়গায় তল্লাশি চালিয়েও গ্রেপ্তার করতে পারেনি আর একজনকেও। হাইকোর্ট সহ সব মহল থেকে প্রশ্ন উঠছে, সন্দীপ ঘোষ এখনও গ্রেপ্তার হলেন না কেন? সিবিআই কর্তারা নির্বাক। তাহলে কি কলকাতা পুলিসের পর বাড়তি আর কোনও প্রমাণ পাওয়াই গেল না? এখনও একজনই মাত্র ধৃত, তাও কলকাতা পুলিসের হাতে। ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। ডিএনএ রিপোর্টও বলছে, সঞ্জয় নাকি একাই ধর্ষক। তবে সেমিনার রুমই প্লেস অব অকারেন্স (পিও) নাকি অন্য কোথাও—তার নিষ্পত্তি দেশের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থা এখনও করতে পারেনি! কেন্দ্রীয় সরকারও রাজ্যের প্রস্তাব মেনে সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকে দোষীর কঠোরতম শাস্তি ফাঁসির আইন পাশ করায়নি। তেমন কোনও উদ্যোগও চোখে পড়ছে না। প্রশ্ন একটাই, বিচারের বাণী কি তবে নীরবে, নিভৃতে মিছিলে আর পথসভাতেই থেমে যাবে? যত দিন যাচ্ছে, সংশয় কিন্তু বাড়ছে নাগরিক সমাজের। কবে সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে, জানতে চায় ৩১ বছরের দু’চোখে স্বপ্নমাখা সেই খুন হওয়া ডাক্তারও। তাঁর কাছে এখন বিচার মানে তদন্তের জট খোলা, যা করতে আজ পর্যন্ত ব্যর্থ দেশের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থা।
দেশের বৃহত্তম গোয়েন্দা এজেন্সি সিবিআই যত ব্যর্থ হবে, ধান্দাবাজ রাজনীতিকরা তত মিথ্যে ছড়িয়ে সমাজে অশান্তি ডেকে আনার চেষ্টা বাড়াবে। এটাই নির্মম সত্য। সাধারণ মানুষের নরম মন এবং বাঁধ না-মানা আবেগই ঘোলা জলে মাছ ধরার আদর্শ পরিবেশ। রাজনীতিতে এটাই দস্তুর। তাই লোকবল, সংগঠন থাকুক না থাকুক এই মধ্য ভাদ্রেই রাজনীতির কারবারিদের অকাল বসন্ত! বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, তাঁরাও কি ধর্ষকের চেয়ে কম বড় অপরাধী? এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা নিয়ে সঙ্কীর্ণ রাজনীতি বরদাস্ত করা যায়? ৯ আগস্টের পৈশাচিক খুন ও ধর্ষণ এবং তার অভিঘাতে স্বাধীনতা দিবসের আগের রাতের ফুঁসে ওঠা নাগরিক আবেগ আজ ভারাক্রান্ত স্বার্থপর রাজনীতির কুটিল অনুপ্রবেশে। উঠতি সম্ভাবনাময় এক ডাক্তারের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডকে এভাবে কলুষিত করা যায় তাঁর বাবা-মার সামনে? দেখেশুনে মনে হচ্ছে, বিচার নয়, বারেবারে ভোট পাটিগণিতে বিফল হওয়ার পর তালেগোলে ক্ষমতা দখলই লক্ষ্য। বাংলাদেশের স্লোগান চুরি করে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ পর্যন্ত দাবি করা হচ্ছে কোন আক্কেলে? এই বীরপুঙ্গবরা ঢাকার বুকে ঘটে যাওয়া গত ৫ আগস্টের পালাবদলের রিপ্লে চাইছে পশ্চিমবঙ্গের বুকে! এ তো দুঃস্বপ্ন! স্বপ্নে হাজার কোটির পালঙ্কে শোয়ার ইচ্ছা কার না হয়? কিন্তু সেই নিষ্পাপ মেয়েটা কি চায় তাঁর উপর নির্যাতন ঘিরে এত পঙ্কিল রাজনীতি ডানা মেলুক? নাকি সে সোচ্চারে বলছে, ‘ঢের হয়েছে, এবার আপনারা থামুন। আমার সারা গা জ্বলে যাচ্ছে।’
ব্যর্থ বিরোধীদের কেন এত গাত্রদাহ বলতে পারেন? প্রথমে একুশ সালের বিধানসভা ভোট, অমিত শাহরা শপথের প্রস্তুতি পর্যন্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। পকেটে পকেটে মন্ত্রিসভার সদস্যদের তালিকা পর্যন্ত ঘুরছিল। এক্সিট পোল এই বলেছে, এক্সিট পোল ওই বলেছে, কতশত ফিরিস্তি। ফল বেরতেই তা শতাব্দীর সেরা ফ্লপ শো’তে পর্যবসিত হয়। সেটা ছিল ২ মে ২০২১। আর মাত্র আড়াই মাস আগে লোকসভা ভোটে এরাজ্যে ৩০ আসন জেতার খোয়াব শেষপর্যন্ত থামে মাত্র ১২টিতে। একটা বেলুনকে আড়াই গুণ ফোলালে কী হয়? সশব্দে ফেটে যায়। বঙ্গ বিজেপিরও সেই দশা। গত ৪ জুন অষ্টাদশ সাধারণ নির্বাচনের ফল ঘোষণার ট্র্যাজেডি এখনও খুব একটা অতীত হয়ে যায়নি। পরপর হারের সেই হতাশা কাটাতেই এক তরুণী ডাক্তারের মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়েও রাজনীতির বেসাতি দিল্লির নির্দেশে। এবিভিপির সাহস নেই, মুরোদও নেই। বঙ্গ বিজেপিও বারবার ব্যর্থ। পাছে নাগরিক সমাজ নাম শুনেই প্রত্যাখ্যান করে, তাই রাতারাতি জন্ম নিল ভুঁইফোড় ছাত্রসমাজ। পিছনে কারা? সেই বিজেপি, এবিভিপি। নবান্ন অভিযানের নামে পুলিসের উপর আক্রমণে কি সায় থাকতে পারে সুস্থ নাগরিক সমাজের? অভয়ার?
এমন এক হৃদয়বিদারক ঘটনায় কে বিচার চায় না বলুন তো! তাহলে কেন এত সন্দেহের জাল বোনা। আমরা-ওরা ভাগ করা। মৃত্যু নিয়েও মেরুকরণ। বিচার চাওয়ার আড়ালে গত মঙ্গল ও বুধবার (২৭ ও ২৮ আগস্ট) বাংলাকে অশান্ত করারই মরিয়া চেষ্টা চলল দিনভর। মুখ্য হয়ে উঠল দলীয় এজেন্ডা। একটা লাশ চাই, লাশ, যেন তাহলেই মোক্ষলাভ! উপোসী বেড়ালরা মাছের গন্ধে বেরিয়ে পড়ল স্বার্থসিদ্ধির আশায়। বেআব্রু হল বাংলার বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্রের ব্লুপ্রিন্ট। বিচার চাওয়ার চেয়েও বড় হয়ে সামনে এল অরাজকতা সৃষ্টির হীন চক্রান্ত। পথে ঘাটে আগুন জ্বললে ঘোলা জলে মাছ ধরার স্বপ্ন আপনা থেকেই চেগে যায়। ওটাই ব্যর্থ রাজনীতিকদের জেগে ওঠার অক্সিজেন। কিন্তু সেই পরিকল্পনাও ফ্লপ করেছে। সাড়া মেলেনি আম জনতার। দু’দিনই সর্বসাকুল্যে পাঁচ-দশ হাজারের বেশি লোক রাজপথে নামেনি। কারণ, বাংলার মানুষ সেই ফাঁদে সাড়া দেয়নি। পুজোর মুখে ব্যবসায়ীরা হাঙ্গামা চায় না। তাহলে তাদের পেটে লাথি পড়ে যাবে। বাংলার নাগরিক সমাজ কি বামপন্থীদের ফাঁদেও পা গলিয়েছে? বোধহয় না। সেই হতাশা ঢাকতেই এক সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক বিচ্ছিন্ন মর্মান্তিক ঘটনাকে সরকার ফেলে দেওয়ার চক্রান্তে পরিণত করার চেষ্টা চলছে প্রাণপণে। কিন্তু সেই মেয়েটির আত্মা, তাঁর বাবা-মায়ের আহত অনুভূতি এই ঘটনাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার কি মেনে নিতে পারছে? নবান্ন অভিযান ও ১২ ঘণ্টার বাংলা বন্‌঩ধে সেই নিষ্পাপ বিচার চাওয়ার আকুতি তো কোথাও তেমন টেরই পাওয়া গেল না। উল্টে রাজ্যটাকে অশান্ত করো, লাশ ফেল এবং ফায়দা লোটো। রাজপথে রক্তাক্ত হল পুলিস। কলকাতা পুলিসের সার্জেন্ট দেবাশিস চক্রবর্তীর একটা চোখ মারাত্মকভাবে জখম। সেইসব জখম পুলিস কর্মীদের জন্যও কি জাস্টিস চাইব না? দেবাশিস তো গরিব মানুষই, ঘরে তাঁর বাবা মা স্ত্রী আছে। তাঁর চোখটা নষ্ট হলে অভয়া তো বিচার পাবেই না, বরং আর একটা অবিচার জন্ম নেবে এই সমাজে? রোজ অবিচারের শিকার সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না পাওয়া গরিবরাও। তাঁদের বিশ, তিরিশ লাখের বিমা করা নেই যে বেসরকারি হাসপাতালে ছুটবে অসুস্থ হলেই।  
আসলে এটা হওয়ারই ছিল। প্রথমটায় গোপনে গোপনে আলগোছে। যদিও সে আগল ভাঙল যখন নবান্ন অভিযান ব্যর্থ হওয়ার হতাশা ঢাকতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বন্‌ধ ডাকতে বাধ্য হল গেরুয়া শিবির। সামনে চলে এল গোটা চক্রান্ত। বিচার নয়, ওরা লাশ চেয়েছিল। দোষীর ফাঁসি নয়, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও নয়, ফুঁসে ওঠা নাগরিক আবেগকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক বিশ্বাসের দিকে টানতে চেয়েছিল। বাংলার সর্বস্তরের মানুষ বিচারের পক্ষে আছে, কিন্তু রাজনীতির রং-বেরংয়ের শামিয়ানা টাঙিয়ে রাম-বাম শক্তিকে পথ করে দেওয়ায় জন্য নয়।
আর গরিব মানুষ? জেলায় জেলায় সরকারি চিকিৎসার উপর নির্ভরশীল সাধারণ মানুষের জন্যও তো জাস্টিস চাই। গত তিন সপ্তাহ ধরে সরকারি হাসপাতালের কত মানুষ ন্যূনতম পরিষেবা না-পেয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন, তার হিসেব কে রেখেছে? বারবার বলছি, এঁদের বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার আর্থিক সামর্থ্য নেই। এই বিরাট অংশের মানুষকে ভুলে গেলে সামগ্রিকভাবে সমাজ কি বিচার পাবে? ভুললে চলবে না, হাসপাতাল ও চিকিৎসা ব্যবস্থা এমন এক জরুরি পরিষেবার অঙ্গ যেখানে কর্মবিরতি, বন্‌ধ একঘণ্টার জন্যও চলে না। সেনাবাহিনী যদি অভিমান করে সীমান্ত খুলে দিয়ে দু’ঘণ্টার জন্য ভিতরে ঢুকে আসে, তাহলে কী হবে? সেখানে হাসপাতালে তিন সপ্তাহ বড্ড লম্বা সময়, নিশ্চয় বেঁচে থাকলে অভয়াও এতদিন একটানা কর্মবিরতি চাইতেন না। 
হালে একের পর এক ‘ডাবল ইঞ্জিন’ রাজ্যে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটেছে। উত্তরপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রে একাধিক। পিছিয়ে নেই রাজস্থানও। গাছ থেকে আদিবাসী দুই মেয়েকে ঝুলতে দেখা গিয়েছে। যোগীরাজ্যে ধর্ষণের পর বাবাকে পুলিসে অভিযোগ পর্যন্ত করতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু কোথাও তো সরকার বদলে দেওয়ার দাবি ওঠেনি। বাংলায় মুখ্যমন্ত্রী গদি ছাড়লে তবেই বিচার মিলবে, এই সরলীকরণ কেন? একথা যাঁরা বলেন তাঁরা নিশ্চিতভাবে অন্য উদ্দেশ্যে চালিত হচ্ছেন। তাঁদের বিচার পাওয়ার আর্তিকে ছাড়িয়ে গিয়েছে রাজনীতির বাধ্যবাধকতা। এতে রাজ্যটারই ক্ষতি হবে। উৎসবের একমাস আগে এই অশান্তি রাজ্যের সামগ্রিক অর্থনীতির পক্ষে মোটেই সহায়ক হতে পারে না। সবাইকে বুঝতে হবে, বিচার চাওয়া মানে অতিরঞ্জিত মিথ্যা ছড়িয়ে সমাজে অশান্তি ও উত্তেজনা সৃষ্টি নয়। লাশের ধ্বংসাত্মক রাজনীতি বন্ধ হোক। আমাদের বোন অভয়া সত্যিকারের বিচার পাক। কিন্তু তা রাজনীতির বিনিময়ে হলে আরও একটা বড় অন্যায় মাথাচাড়া দেবে। তখন তার বিচার করবে কে?
4Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি প্রচেষ্টায় সাফল্যের সম্ভাবনা। ন্যায্য অর্থ সঠিক সময়ে নাও পেতে পারেন।  অর্থপ্রাপ্তির যোগ...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৫.৮৩ টাকা৮৭.৫৭ টাকা
পাউন্ড১০৪.০৫ টাকা১০৭.৭৪ টাকা
ইউরো৮৭.৩০ টাকা৯০.৬৫ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা