অশ্বত্থতলার মোড়ে গেলে এখনও কি ওই নুড়িটা দেখতে পাওয়া যাবে? মাপ করবেন। শিবরাম চক্কোত্তি মহাশয় নিজেই শেষে মত বদল করেছিলেন, আর আমরা তো নেহাৎ ছারপোকা। মনে পড়ল? ওই যে লেখকের হোঁচট-সঙ্গী পাথরটি... উপড়ে একপাশে রেখেছিলেন লেখক। আর সেটিই পরে চন্দন, সিঁদুর-টিদুর লেপে বসেছিল। শিবরামবাবু বলেছিলেন, দেবতার জন্ম। সত্যি! জন্মই বটে। ছেলেবেলায় পড়ে মনে হতো, দেবতার জন্ম??? সেও কি হয়? চুল পাকানোর পর অল্পবিস্তর জ্ঞানবুদ্ধির ঠকঠকানিতে জানতে পেরেছি... সেটাও হয়। দেবতার জন্ম দেয় মানুষই। ঠাকুর বলতেন, ভগবান সর্বত্র আছেন। নরেনকে বলেছিলেন, ‘তোকে যেমন দেখছি, তেমনই ওনাকে দেখেছি।’ বিশ্বাস তৈরি করেছিলেন তিনি নরেনের মনে। সেই বিশ্বাস গড়ে তুলেছিল স্বামী বিবেকানন্দকে। স্বামীজি কি আমাদের কাছে দেবতা নন? আলবাৎ তিনি দেবতা। মনুষ্যত্ব, ধর্মচিন্তা, বিবেককে যিনি জাগ্রত করতে পারেন... বিশ্বাস করতে শেখান... তিনি দেব ছাড়া অন্য কিছু নন। দেবতার জন্ম তো হয় বিশ্বাসে। আমরা বিশ্বাস করেছি বুদ্ধে, শ্রীরামকৃষ্ণে। তাই তাঁরা দেবতা। তাঁদের দেখানো পথ মুক্তির। শান্তির। প্রাপ্তির। এছাড়া আর একটি কারণে দেবতার জন্ম হয়— ধান্দায়। ধর্মের থেকে বেশি ভালো ব্যবসা আর কিছু আছে নাকি? এই চিরন্তন সত্য বারবার প্রমাণিত। যুগে যুগে। বিনেপুঁজির এই ব্যবসায় মানুষের বিশ্বাসকে শুধু ব্যবহার করতে হয়। একবার ধোঁয়া দেখা গেলেই হল... কেল্লাফতে। দেবতার জন্ম তখন সময়ের অপেক্ষা। মানুষ ধরেবেঁধে আপনাকে দেবতা বানিয়ে দেবেই। কিন্তু আপনি নিজে যদি দেবতা সেজে মন্দিরে বসতে চান? আম জনতার ভুরু কুঁচকাবেই। প্রথমে তারা দেখবে, ঈশ্বর সাজতে চাওয়া লোকটার আদৌ কোনও পোটেনশিয়াল আছে কি না। তারপর দেখবে, তার ক্ষমতা কতটা। খুব প্রভাবশালী হলে ঢোঁক গিলে নেবে। অর্থাৎ, চূড়ান্ত আপত্তি সত্ত্বেও আপনাকে দেবতা বলে মেনে নেবে। কিন্তু যদি দেখে, আপনাকে দিয়ে দৈবকর্ম কিছুই হচ্ছে না এবং আপনার প্রভাব ফুরিয়ে আসছে? ছুড়ে ফেলে দিতে বেশি সময় লাগবে না। ঠিক এই কারণেই আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘উপলব্ধি’ দেখে হাঁফ ছাড়া যাচ্ছে। তিনি মোক্ষম সময়ে বুঝে গিয়েছেন, আর নিজেকে ঈশ্বর বা ভগবানের বরপুত্র বলে হাঁকডাক করাটা ঠিক হবে না। তার থেকে বরং এইবেলা মানুষ হয়ে যাওয়া ভালো। অথচ, মাস সাত-আষ্টেক আগেই একটি টিভি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোদিজি বলেছিলেন, ‘মা বেঁচে থাকার সময় মনে হতো, আমার জন্ম জৈবিকভাবে হয়েছে। তিনি মারা যাওয়ার পর সমস্ত অভিজ্ঞতা বিচার করে নিশ্চিত হয়েছি, আমাকে পাঠিয়েছেন স্বয়ং পরমাত্মা। ঈশ্বরই আমার জন্মদাতা। সাধারণ জৈবিক শরীরে এই শক্তি পাওয়া যায় না। ঈশ্বর আমাকে দিয়ে কোনও কাজ করাতে চান। সেজন্যই আমাকে এই শক্তি দিয়েছেন।’
অত্যন্ত বিনীতভাবে একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, মহাশয়, আপনার কাজ কি ফুরিয়েছে? তাই আবার মানুষ হয়েছেন? না হলে পডকাস্টে কেনই বা বললেন, ‘ঈশ্বর নই। আমিও মানুষ। আমারও ভুল হয়।’ কোথায়? এমন কোনও মারমার কাটকাট কাজ তো আমাদের চোখে পড়ল না? কাজের কথা বললেই মনে পড়ে ১৫ লক্ষ টাকার প্রতিশ্রুতি, নোট বাতিল, জিএসটি, জিডিপি, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্বের কথা। মনে পড়ে রামমন্দির, অভিন্ন দেওয়ানি বিধিও। আপনি নিশ্চয়ই কাজ বলতে এইসব বোঝাননি? আর জীবনের উদ্দেশ্য? সেটা প্রত্যেক মানুষেরই থাকে। ঈশ্বর আমাদের প্রত্যেককে কোনও না কোনও উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্যই নির্ধারিত করেছেন। এমন কোনও কাজ, যা ওই ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ করতে পারবে না। ফারাক একটাই, হাতেগোনা কয়েকজনের কাজ প্রচারে আসে। বাকিদেরটা থেকে যায় আড়ালেই। তবু কৃতজ্ঞ আমরা, উনি স্বীকার করেছেন। উনি মানুষ। দেবতা নন। সেটাই বা কম কী? ছেলেমেয়েদের আমরা আশীর্বাদ করি, ‘মানুষ হও।’ কেন করি? কারণ, আমরা বিলক্ষণ জানি, সত্যিকারের মানুষ হওয়া বড্ড কঠিন। মানুষ হতে গেলে মান এবং হুঁশ থাকা যে খুব দরকারি। মান অর্থাৎ আত্মসম্মান। আর হুঁশ? বিবেচনা, বিচক্ষণতা, বোধ এবং বিবেক। ঠিক তাই কাজী নজরুলের কথাগুলো যেন কিছুতেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তিনি বলেছিলেন, ‘বিবেকের ক্ষমতা অসীম। যাহারা পশুশক্তির ব্যবহার করিয়া বাহিরে এত দুর্বার দুর্জয়, অন্তরে তাহারা বিবেকের দংশনে তেমনই ক্ষত-বিক্ষত, অতি দীন। তাহারা তাহাদের অন্তরের নীচতায় নিজেই মরিয়া যাইতেছে, শুধু লোক-লজ্জায় তাহাকে দাম্ভিকতার মুখোশ পরাইয়া রাখিয়াছে। সিংহের চামড়ার মধ্য হইতে লুকানো গর্দভ-মূর্তি বাহির হইয়া পড়িবেই। নীল শৃগালের ধূর্তামি বেশি দিন টিকিবে না।’ পরাধীন ভারতে তাঁর লক্ষ্য ছিল ইংরেজ সরকার। চেয়েছিলেন তিনি মানুষের মনের স্বাধীনতা বোধকে জাগ্রত করতে।
পরাধীনতা কি শুধু ঔপনিবেশিক শাসনে আসে? পরাধীন হয় মানুষ তার অধিকার থেকে বিচ্যুত হলে। পরাধীন হয় কেউ তার মুখে কুলুপ এঁটে দিলে। পরাধীন হয় অক্লান্ত পরিশ্রমের পর দু’বেলা দু’মুঠো ভাত না জুটলে। মাথার উপর ছাদ না পেলে। মেয়ের বাবা বিয়ের গয়না কিনতে যেতে ভয় পান। ৮ হাজার টাকায় এক গ্রাম সোনা! কী দেব মেয়েকে? এই তো বছর দশেক আগেই ছিল আড়াই হাজার টাকা। চাল কিনতে গিয়ে নুন কেনার পয়সা ফুরোয় দশরথের মতো দিনমজুরদের। গ্র্যাজুয়েট প্রণব বসে থাকে চাকরির আশায়। বাবাকে বলে, একটা স্কুটি কিনে দেবে? তাহলে সুইগি বা জোমাটোর ডেলিভারি বয়ের কাজটুকু অন্তত জুটে যাবে। এও কি পরাধীনতা নয়? ডলারের নিরিখে টাকার দাম ৮৬ পার করে যায়। সর্বকালীন রেকর্ড। তারপরও আমাদের দেশের অর্থমন্ত্রী বলেন, টাকা দুর্বল হয়নি। ডলার সবল হয়েছে। ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালের ভোটে পর্যন্ত একের পর এক সভায় নরেন্দ্র মোদি তো এই ডলারের বিনিময়মূল্য নিয়েই সরব ছিলেন! বলেছিলেন, ‘রুপিয়া হাসপাতাল মে হ্যায়। আইসিউইতে পড়ে আছে।’ তখন ডলার ছিল ৫৬ টাকার আশপাশে। নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ‘ইউপিএ সরকার ভারতের উপর থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। টাকার দর যে হারে পড়ছে, তাতে মাঝে মাঝে মনে হয়, কেন্দ্র আর ডলারের বিনিময়মূল্যের মধ্যে কম্পিটিশন চলছে। কে আগে বেশি নীচে পড়বে। স্বাধীনতার সময় এক ডলারের বিনিময়মূল্য ছিল এক টাকা।’ কী হয় টাকার দর পড়লে? অশোধিত তেলের মতো বহু পণ্য ভারত বিদেশ থেকে আমদানি করে। আর তার মূল্য দিতে হয় ডলারে। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলার যত শক্তিশালী হচ্ছে, ততই দুর্বল হচ্ছে টাকা। অর্থাৎ একই পরিমাণ তেল কিনতে অনেক বেশি মূল্য চোকাতে হচ্ছে ভারতকে। ফল? বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার কমছে। সেইসঙ্গে আমদানি ও রপ্তানির মধ্যেকার ফাঁক বাড়ছে। মানে, যত টাকা আমদানির জন্য ভারত খরচ করছে, তার থেকে ঢের কম টাকা রপ্তানি বাবদ আসছে। আমেরিকাও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়াচ্ছে। ফলে ডলার প্রতিদিন চলে যাচ্ছে নাগালের বাইরে। আতান্তরে পড়ছে বহু ভারতীয় কোম্পানি। তথ্যপ্রযুক্তি থেকে খবরের কাগজ। প্রজেক্ট থেকে নিউজপ্রিন্ট, তাদের খরচ করতে হয় ডলারই। দশ বছর আগেও এক ডলারের জিনিস বিদেশ থেকে কিনলে তাদের ৫৬ টাকা খরচ হতো। এখন একই পরিমাণের জন্য ৮৬ টাকা ব্যয় হচ্ছে। তার প্রভাব পড়ছে কর্মীদের উপর। ইনক্রিমেন্ট বাজারদরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হচ্ছে না। বহু সংস্থায় ছাঁটাই চলছে লাগাতার। পাশাপাশি আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেশীয় বাজারে জিনিসপত্রের দাম চড়ছে হু হু করে। কিছু তথ্য-প্রযুক্তি সংস্থা, টেক্সটাইল বা ফার্মা কোম্পানি, যারা ডলারের হিসেবেই রপ্তানি করে থাকে, লাভ হচ্ছে শুধু তাদের। আম জনতার নয়। ফল? সমাজে অবসাদ এবং অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। এটাও কি পরাধীনতা নয়? আর এর জন্য কি সরকারের ব্যর্থতা দায়ী নয়? তারপরও ক্ষমতার দম্ভ কি মানায়? কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘শক্তি লাভ করিয়া যাহারা শক্তির এমন অপব্যবহার করিতেছে, কে জানে প্রকৃতি তাহাদের এই অপরাধের পরিণাম কত নির্মম হইয়া লিখিয়া রাখিয়াছে!’ অহঙ্কারের পতন হয়। সেটাই ভবিতব্য। নিপাট ভালোমানুষ ওই ভক্তের মুখেই যে শোনা... ‘ভগবানের সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য হল অহঙ্কার। ওইটা পেলে উনি আর কিছু চান না।’ তারপরও আমরা ভগবানই হতে চাই! অজ্ঞানতার কী ভয়ানক বিড়ম্বনা।
তবে হাঁফ ছাড়ার মতো কথা একটাই, নরেন্দ্র মোদি দেবত্ব ভুলে মানুষ বলে নিজেকে স্বীকার করেছেন। স্বস্তি পেয়েছে দেশবাসী। এবার হয়তো পরাধীনতার শৃঙ্খল ঘুচবে। এবার হয়তো অধিকারের মুখ দেখবে কাঙাল মানুষগুলো। এবার হয়তো আমরা মুখ তুলে বলতে পারব, ‘আমরা তোমাদের ক্ষমতায় এনেছি আমাদের পরিষেবা দেওয়ার জন্য। ক্ষমতার আস্ফালন দেখতে নয়।’ স্বামীজি বলেছিলেন, ‘ঘুরে দাঁড়াও। মুখোমুখি হও।’ তবেই না অন্ধকার ফুঁড়ে আলোর দিশা দেখা যাবে। তবেই না সমস্যার তালা ভেঙে সমাধানের গন্ধ আসবে নাকে। মনে পড়ে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সেই দু’টি লাইন... ‘মিত্র হোক- ভণ্ড যে- তাহারে দূর করিয়া দে’...। তার জন্য মুখ লুকোলে চলবে না। মাথা তুলতে হবে সাধারণকেই। ‘নির্বোধ মেষযূথের মতো এক স্থানে জড়ো হইয়া শুধু মাথাটা লুকাইয়া থাকিলে নেকড়ে বাঘের হিংস্র আক্রমণ হইতে রক্ষা পাইব না, তাহা হইলে আমাদের ওই নেকড়ে বাঘের মতো করিয়া কান ধরিয়া টানিয়া লইয়া গিয়া হত্যা করিবে।’ এটাই যে সারসত্য। পরাধীনতা ঘোচানোর। অধিকার অর্জনের। তবে যে আমরাও মানুষ হব।