‘‘যখন নেতৃত্ব দিচ্ছ তখন সেবা করো, স্বার্থশূন্য হও।’’ এই উপদেশ তিনি দিয়েছিলেন স্বাধীনতার অর্ধশতক আগে। আজ যখন আমরা উন্নত ভারতের স্বপ্ন দেখি, সংবিধানের ৭৫ বছরে নানা বর্ণাঢ্য উৎসব করি, তখন তাঁর ওই ছোট্ট অথচ মহান উপদেশটা কি মনে রেখেছি? আজ নেতা থেকে আমলা, সরকারি চাকুরে, পুলিস, কপট সাধুসন্ত অনেকে পদে পদে ক্ষমতাকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করছেন। কেউ বাদ নেই! আখের গোছানো, দখলদারি এবং ক্ষমতার উচ্চকিত আস্ফালনই এই সংসারের একমাত্র ধর্ম! তবু তিনি আছেন উৎসারিত আলো হয়েই। আজ ১২ জানুয়ারির উদ্দীপনাই তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
স্বামী বিবেকানন্দের হিন্দুধর্ম কোনওদিন ক্ষমতা দখলের অস্ত্র ছিল না। হানাহানির মন্ত্র তিনি বিতরণ করেননি অকাতরে। তাই সহজেই বলতে পেরেছিলেন, “আমি যা বলব তা তোমাদের অবাক করবে।’’ পরের কথাগুলি সত্যি চমকে দেওয়ার মতোই, ‘‘গীতা পড়ার চেয়ে ফুটবল খেলে অনেক সহজে স্বর্গের কাছাকাছি যাওয়া যায়। তুমি শক্তিশালী হলে তবেই গীতার বাণী বুঝতে পারবে।’ তিনি গীতার মাহাত্ম্যকে অস্বীকার করেননি। কিন্তু সবসময় চেয়েছেন ভিতরের শক্তি জাগ্রত হোক। মন্দির নয়, গির্জা নয়, বাইবেল-কোরানও নয়, আত্মবল ও বিশ্বাসই ছিল তাঁর ধর্মের মূল কথা। যা আজকের নেতানেত্রী, সাধারণ মানুষ কেউ অনুসরণ করি না, ভক্তির নামে ভড়ং রপ্ত করি! ডিজে বাজিয়ে কীর্তন শুনি। বিশ্বাস বলতে একগুঁয়েমি বুঝি। মন্দিরে গিয়েও পরের অনিষ্ট চিন্তা করি। সেই কারণেই আজ শিক্ষিত, অশিক্ষিত, উকিল, ডাক্তার সবার নৈতিক চরিত্রের এমন অবনমন ঘটে গিয়েছে। ১২ জানুয়ারি ১৮৬৩ থেকে ৪ জুলাই ১৯০২। ৩৯ বছরের জীবনযাত্রায় বারবার তিনি আত্মশক্তি এবং নিজের উপর বিশ্বাসের কথাই বলেছেন। আমরা দুর্ভাগা জাতি, তাই তাঁকে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে হারিয়েছি। আর এগারোদিন পর যে মহামানবের জন্মদিন সেই নেতাজি সুভাষের অন্তর্ধান ঘটেছে ১৯৪৮ সালে। ৫১ বছর বয়সে। দু’জনেই যদি পূর্ণজীবন কাটাতেন তাহলে আজ বাঙালির ইতিহাস নতুন করে লিখতে হতো! জাতীয় রাজনীতির গতিপথও অন্যখাতে প্রবাহিত হতো। তাঁর কাছে মন্দির নয়, মানুষ, সর্বোপরি দেশই ছিল প্রথম। তাই তিনি আহ্বান করেছিলেন, ‘‘হে বীর, সাহস অবলম্বন কর; সদৰ্পে বল—আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই। বল—মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই।’’
১২৩ বছর আগে ইহলোক ত্যাগ করেন স্বামী বিবেকানন্দ। তারও প্রায় একদশক আগে শিকাগোয় প্রকৃত ধর্মের আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। আধুনিক হিন্দুধর্মের অবতারণা করতে গিয়ে তিনি বারবার জয়গান গেয়েছেন ভারতীয়ত্বের। ভোট কেনার পোস্টার বয় নন, মানবিক এক সর্বজয়ী জেদি সন্ন্যাসী। তাই অহরহ তাঁর বাণী আজও এমন এক ধর্মের কথা বলে যার নিউক্লিয়াস জুড়ে শুধুই জীবে প্রেম। ঠাকুরের যেমন সর্বজনীন ‘যত মত তত পথ’। এত সহজ অথচ সরাসরি বুকে সজোরে ঢেউ তোলা আর কোনও বাক্য হাজার ধর্মের চৌহদ্দি চষে ফেললেও মিলবে না। তাঁর তেমনি ‘জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’। এর চেয়ে উদার, সহজ অথচ অন্ধকারে ধ্রুবজ্যোতির মতো নির্দিষ্ট আর কিছু হতে পারে?
ঘৃণা নয় ভ্রাতৃত্ব, অজ্ঞানতা নয়, বৈজ্ঞানিক চিন্তার স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ। সাম্প্রদায়িকতা নয়, বহুত্ববাদ, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বিপরীতমুখী চিন্তার নিরাপদ সহাবস্থান। তিনি যে হিন্দু ধর্মের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং আজীবন লালন করেছিলেন তা ভোট কেনার উপকরণ ছিল না। তাই মাত্র ৩০ বছর বয়সে শিকাগোর ধর্মসভায় উপস্থিত সকলকে চমকে দিয়েছিলেন একটিমাত্র সরল ও সহজ বাক্যে—‘সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স অব আমেরিকা।’ বিশ্বমঞ্চে হিন্দুধর্মের কোনও কঠিন তত্ত্বের অহঙ্কারী উচ্চারণ নয়, স্থিতধী অথচ জেদি এক যুবকের উজ্জ্বল অভিব্যক্তি। তিনি ধর্মের নামে ভাগাভাগির কথা বলেননি। আজকের পদ্মাপারের হিন্দু নির্যাতন কিংবা তেইশ বছর আগে গুজরাত দাঙ্গার অভিঘাত যখন আমাদের ধর্মকে সঙ্কীর্ণ বেড়াজালে বাঁধতে মরিয়া, তখন তাঁর আদর্শই হিন্দুত্বের উত্তরণের একমাত্র পথ।
গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ১৮৮৭ সালের ১ মে বেলুড়ে যে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা, তা দক্ষ সংগঠক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পুঁজি শুধু সত্যকে আঁকড়ে থাকার অদম্য ইচ্ছা। কাশীপুর উদ্যানবাটি থেকে ‘রামকৃষ্ণ ফৌজ’-এর এই ১৩৬ বছরের ধারাবাহিক জয়যাত্রার সঙ্গে আজ গোটা দেশের আধ্যাত্মিক চেতনা জড়িয়ে গিয়েছে। ১৯৮৫ সাল থেকে ১২ জানুয়ারি ‘যুবদিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। যুবকদের উদ্দেশে তাঁর সরল ও সহজ উপদেশ, ‘‘যদি সত্যি মন থেকে কিছু করতে চাও তাহলে পথ পাবে, আর যদি না চাও তাহলে অজুহাত পাবে।’’ তাঁর উপদেশ, ‘‘জীবনে বড় হতে গেলে যে কোনও ব্যক্তির তিনটি জিনিস প্রয়োজন। এক শিক্ষা, দুই ইচ্ছাশক্তি, তিন বুদ্ধি।” ‘‘সাফল্য পেতে হলে নিজের উপর বিশ্বাস রাখো, তোমার দ্বারাই সব সম্ভব। সংকল্প নিয়ে এগিয়ে যাও, সাফল্য আসবেই। লক্ষ্য অর্জনের আগে থেমো না। যতক্ষণ বেঁচে রয়েছ শিখতে থাকো। কারণ অভিজ্ঞতা আর অনুভবই সবথেকে বড় শিক্ষক।” যুবসমাজের জন্য আর কে এমন পথের দিশা দিয়ে গিয়েছেন!
জন্ম থেকেই বিবেকানন্দ কখনও পরাজয় স্বীকার করেননি। পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্রীদের চরিত্রহননের চক্রান্তের বিরুদ্ধে তাঁকে কঠিন লড়াই করতে হয়েছিল। নিবেদিতাকে লিখেছিলেন, এই সংগ্রাম তাঁর আয়ু কুড়ি বছর কমিয়ে দিয়েছিল। তবু আপস করেননি। বিবেকানন্দ জন্মগত যোদ্ধা। কিন্তু এই যুদ্ধ কার জন্য? কীসের জন্য? ভোগসর্বস্ব উদ্ধত জড়বাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সভ্যতাকে বাঁচানোর তাগিদে। সেই ছিল ‘ক্রুশবিদ্ধ’ বিবেকানন্দের একক সংগ্রাম। গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘‘তুই যে বীর রে।’’ কারণ শ্রীরামকৃষ্ণকেও পরীক্ষা না করে তিনি গুরুর আসনে বসাতে রাজি হননি। আবার ঠাকুরও তাঁকে মা কালীর কাছে বর চাইতে পাঠিয়ে চরম পরীক্ষা নিয়েছিলেন। ম্যাসাচুসেটসের এক ছোট সভাগৃহে যখন মিশনারিরা যথেচ্ছ অপমান করে, ভয় দেখিয়ে হিন্দু সন্ন্যাসীকে জয় করার চিন্তা করেছিল, সেই রাত্রে বিবেকানন্দ হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর চোয়াল শক্ত। মিশনারিরা অনুভব করলেন ইনি তো অনন্ত শক্তির জীবন্ত প্রতিমূর্তি। কীসের জন্য এবং কার বিরুদ্ধে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর যুদ্ধ? উত্তর সহজ, ধর্মের নামে চালাকি, বুজরুকি, ভিত্তিহীন প্রচারের বিরুদ্ধে। বিবেকানন্দর লড়াই ছিল আহাম্মকি ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধে। এতে শত্রু বেড়েছিল, পথ কঠিন হয়েছিল। তবু তিনি পিছিয়ে যাননি। জানতেন সত্যই চিরজীবী। মেরি হেলকে লিখেছিলেন, ‘‘একমাত্র সত্যের সন্তানরাই চিরজীবী।’’ ভক্তদের উদ্বুব্ধ করতেন, ‘‘সত্যের জন্য সবকিছুই ত্যাগ করা চলে, কিন্তু কোনও কিছুর বিনিময়েই সত্যকে ত্যাগ করা চলে না।’’
ছেলেবেলায় বাবার বৈঠকখানায় সব কিসিমের গড়গড়ার নল মুখে নিয়ে জাত যায় কী করে, পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। বাবা বিশ্বনাথ দত্তের বাবুর্চিটিও ছিলেন মুসলিম। হিন্দু-মুসলিমকে এক বৃন্তে মালা করে গেঁথে তোলার পাঠ সেই থেকেই। শ্রীরামকৃষ্ণও জানতেন, তাঁর প্রিয় শিষ্যের খাদ্যতালিকা থেকে মুরগি-পাঁঠা-মাছ বাদ যায় না কিছুই। জাতপাতের ভাগাভাগি ভেঙে দেওয়াই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। একবার এক শিষ্য নরেনের নামে নালিশ জানান শ্রীরামকৃষ্ণকে। জবাবে ঠাকুর বলেন, ‘‘খেয়েছে বেশ করেছে। তুই যদি হবিষ্যিও খাস, আর নরেন হোটেলে খায়, তাহলেও তুই কোনওদিন ওর সমান হতে পারবি না।’’
বিবেকানন্দ লিখেছিলেন, ‘‘প্রত্যেক সম্প্রদায় যেভাবে ঈশ্বরের আরাধনা করে, আমি তাহাদের প্রত্যেকের সঙ্গে বসে ঠিক সেইভাবেই তাঁহার আরাধনা করি। আমি মুসলমানদিগের মসজিদে যাইব, খ্রিস্টানদিগের গির্জায় প্রবেশ করিয়া ক্রুশবিদ্ধ ঈশার সম্মুখে নতজানু হইব, বৌদ্ধদের বিহারে প্রবেশ করিয়া তাঁহার ধর্মের শরণ লইব, এবং অরণ্যে গমন করিয়া সেইসব হিন্দুর পার্শ্বে ধ্যানে মগ্ন হইব।’’ স্বামীজি বলেছিলেন, ‘‘মানবজাতিকে সেই স্থানে লইয়া যাইতে চাই—যেখানে বেদও নাই, বাইবেলও নাই, কোরানও নাই, অথচ বেদ, বাইবেল ও কোরানের সমন্বয় দ্বারাই ইহা করিতে হইবে। মানবকে শিখাইতে হইবে যে, সকল ধর্ম ‘একই ধর্মে’র বিবিধ প্রকাশ মাত্র, যাহার যেটি উপযোগী সেটিকেই বাছিয়া লইতে পারে।’’
আর মন্দির প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘‘কোটি টাকা খরচা করে, কাশী-বৃন্দাবনের ঠাকুর ঘরের দরজা খুলছে আর পড়ছে। এই ঠাকুর কাপড় ছাড়ছেন তো ওই ঠাকুর ভাত খাচ্ছেন। আর এক ঠাকুর আঁটকুড়ির ব্যাটাদের গুষ্টির পিণ্ডি করছেন। এদিকে আসল জ্যান্ত ঠাকুর অন্ন বিনা, বস্ত্র বিনা মরছে।’’ বিবেকানন্দ বলছেন, ‘‘সো লং অ্যাজ ইভন আ সিঙ্গল ডগ ইন মাই কান্ট্রি হ্যাজ নো ফুড, মাই হোল রিলিজিয়ন উইল বি টু ফিড দেম।’’ এই স্বামীজির সঙ্গে বর্তমানে নির্বাচন পার করা ধর্মের স্বঘোষিত কেষ্টবিষ্টুদের দূরত্ব বিরাট। এই দেশে ভোট এলেই ধর্মের বাড়বাড়ন্ত হয়। ভাগাভাগি প্রাণ কেড়ে নেয়। গণতন্ত্রের মঞ্চে হয়তো এটাই অবশ্যম্ভাবী—কারণ যেখানে গণতন্ত্র মানে ভোট, আর ভোট মানে পাটিগণিতের খেলায় গদি দখল। তিনি বলেছেন, ‘‘চাইলে, তুমি নাস্তিক হও। কিন্তু কোনও কিছুকেই সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বাস কোরো না।’’ তাঁর এই বক্তব্যের সবচেয়ে বড় প্রমাণ দক্ষিণেশ্বরে এ যুগের শ্রেষ্ঠ গুরু শ্রীরামকৃষ্ণকেও তিনি পরখ করতে ছাড়েননি। তাঁর কথায়, ‘‘জীবনে ঝুঁকি নিন। জিতলে নেতৃত্ব দিতে পারবেন। আর পরাজিত হলে গাইডের ভূমিকা নিতে পারবেন। আমি বিশ্বাস করি যে কেউ কিছু পাওয়ার উপযুক্ত হলে, জগতের কোন শক্তিই তাকে বঞ্চিত করতে পারে না।” তিনি বলে গিয়েছেন, ‘‘এমন কাজ করো যাতে তুমি হাসতে হাসতে মরবে, আর জগৎ তোমার জন্য কাঁদবে। সারাদিন চলার পথে যদি কোনও সমস্যার সম্মুখীন না হও, তাহলে বুঝবে তুমি ভুল পথে চলেছ।’’
মাত্র ৩৯ বছরের অসম্পূর্ণ জীবন। তবু তাঁর এই বিশাল কর্মকাণ্ড থেকে একটা প্রশ্নই বারে বারে আঘাত করে, তিনি কি শুধুই সন্ন্যাসী ছিলেন, না সমাজ সংস্কারক, পরিব্রাজক, দেশপ্রেমিক, দক্ষ সংগঠক, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানবিক নেতা এবং প্রেমিক পুরুষ। ধূপের ধোঁয়া কিংবা ফুলের গন্ধের আতিশয্য নয়, তাঁর স্মরণ হোক কর্মযোগে।