স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য চারবার দার্জিলিং গিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। আতিথ্য নিয়েছিলেন মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বলেন ভিলা’য়, বর্ধমানরাজের প্রাসাদ ‘চন্দ্রকুঠী’তে। সেই ‘বলেন ভিলা’ আজ নিশ্চিহ্ন। কেমন আছে ‘চন্দ্রকুঠী’? খোঁজ নিলেন অনিরুদ্ধ সরকার
শিলিগুড়ি থেকে কার্শিয়াং হয়ে দার্জিলিং শহরে প্রবেশ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই নিচে পাহাড়ের ঢালে বিরাট পরিসর জুড়ে চোখে পড়ে এক বিরাট নীল গম্বুজওয়ালা প্রাসাদ। নাম ‘উদয়মহল’। বর্ধমান রাজাদের গ্রীষ্মকালীন আবাসভূমি। বর্ধমানের মহারাজা উদয়চাঁদের নামে নামকরণ হয় ‘উদয়মহল’।
মহারাজ উদয়চাঁদের পূর্বসূরী বিজয়চাঁদের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন স্বামীজি। দার্জিলিঙের রোজব্যাঙ্ক এলাকায় বর্ধমানরাজের প্রাসাদবাড়ির ঠিক উল্টোদিকে রাজবাড়ির অতিথি নিবাস ‘চন্দ্রকুঠী’তেই রাজ-আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন স্বামীজি। রাজপরিবারের উত্তরসূরী প্রণয়চাঁদ মহতাব এক লেখায় লিখছেন- “মহারাজ বিজয়চাঁদ একবার নিজের প্রাইভেট রিকশাতে স্বামীজীকে বসিয়ে নিজে স্বয়ং সেই রিকশা টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন।” তাহলেই বুঝুন, কি পরিমানে ভক্তি করতেন তিনি স্বামীজিকে।
এই বিজয়চাঁদ ছিলেন লর্ড কার্জনের ঘনিষ্ঠ। তাঁর ঘড়ি ঠিক করতে একবার সুইজারল্যান্ড থেকে মেকানিক এসেছিল। বিজয়চাঁদের সন্ন্যাসীদের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা ভক্তি ছিল। স্বয়ং ঘন্টার পর ঘন্টা ধ্যানে ডুবে থাকতেন। স্ত্রী রাধারাণী দেবীও সন্ন্যাসিনী হয়ে ঘর ছাড়েন। বেনারস কাটান শেষ জীবন।
রোজব্যাঙ্কের বর্ধমান হাউসের এই বাড়ি থেকে স্বামীজি একাধিক চিঠি লিখেছিলেন। যারমধ্যে অন্যতম ছিল ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদক সরলা ঘোষালকে লেখা চিঠি। সরলা ঘোষাল ছিলেন, রবীন্দ্রনাথের ভাগনি এবং স্বর্ণকুমারীদেবীর পুত্রী। স্বামীজি সরলা দেবীকে ‘ভারতী’ পত্রিকা প্রাপ্তির বিষয়টি স্বীকার করে একটি পত্র লেখেন এবং পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ নিয়ে মতামত ব্যক্ত করেন।
স্বামী বিবেকানন্দের হাজারো স্মৃতি বিজড়িত দার্জিলিংয়ের এই ‘চন্দ্রকুঠী’। দার্জিলিং শহরের ঐতিহ্যশালী বাড়ি হিসেবে ‘চন্দ্রকুঠী’তে আজও বসেনি ব্লু-প্লাক বা নীল ফলক! ইদানীং কালে গ্লেনারিসে’ সেলফি প্রিয় ‘আত্মবিস্মৃত বাঙালি’র খুব কমজনই হয়ত এই বাড়িতে উঁকি দিয়েছেন।
ইতিহাস বলছে, এই ‘চন্দ্রকুঠী’ তৈরি হয়েছিল ১৮৬০ সালে। এই চন্দ্রকুঠীর দোতলায় বিশাল হলঘরের ডান পাশের একটি ঘরে ১৮৯৭ সালের কয়েকটা দিন কাটিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। দোতলার সেই রাজকীয় অতিথিনিবাসের হলঘরে স্বামীজির একটি ছবি দেখতে পাওয়া যায়। পাশে দেখা মেলে একটি বাগছালের। ঘরে রয়েছে প্রচুর প্রাচীন আসবাবপত্র। এই হল থেকে বের হয়েই খোলা বারান্দা। যেখান থেকে আজও স্পষ্ট দেখা যায় দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘা। অসাধারণ সেই দৃশ্য।
স্বামীজি ২৮ এপ্রিল দার্জিলিং থেকে একটি চিঠি লিখছিলেন মিস মেরি হেলকে। যে চিঠি জুড়ে ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা আর দার্জিলিংয়ের নৈসর্গিক প্রকৃতির কথা। স্বামীজি চিঠিতে লিখছেন- “এই দার্জিলিং অতি সুন্দর জায়গা। এখান থেকে মাঝে মাঝে যখন মেঘ সরে যায়, তখন ২৮,১৪৬ ফুট উচ্চ মহিমামণ্ডিত কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় এবং নিকটের একটা পাহাড়ের চূড়া থেকে মাঝে মাঝে ২৯,০০২ ফুট উচ্চ গৌরীশঙ্করের চকিত দর্শন পাওয়া যায়।”
বর্ধমান রাজের অতিথি নিবাসের দোতলার বারান্দা থেকে স্বামীজি হয়ত কাঞ্চনজঙ্ঘার সেই দৃশ্য উপভোগ করেই এই চিঠি লিখেছিলেন! স্বামীজি এখানকার আদি অধিবাসী- তিব্বতী, নেপালী এবং সর্বোপরি সুন্দরী লেপচা মেয়েদের কথাও উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন লেখায়।
‘উদয় মহল’ ও ‘চন্দ্রকোঠীর’ বর্তমান মালিক সত্যেন গুরুংয়ের কথায়, “আমরা স্বামীজির চিঠিপত্র পড়ে জেনেছি বর্ধমান রাজবাড়ির চন্দ্রকুঠী অতিথিনিবাসের দোতলার ঘরে ছিলেন স্বামীজি। স্বামীজির স্মৃতিবিজড়িত ‘চন্দ্রকুঠী’র দোতলার সেই কক্ষটি ঐতিহাসিক। আমরা সংরক্ষণ করেছি৷ বর্তমানে বাড়িটি পুরোপুরিভাবে হেরিটেজ প্রাইভেট প্রপার্টি।”
সেবার স্বামীজী দার্জিলিং ত্যাগ করেন ২৮ এপ্রিল। কলকাতায় ফিরে মিসেস বুলকে লিখেছিলেন “ভগ্নস্বাস্থ্য ফিরে পাবার জন্য একমাস দার্জিলিং-এ ছিলাম। আমি এখন বেশ ভাল হয়ে গেছি। ব্যারাম-ফ্যারাম দার্জিলিং-এ একেবারেই পালিয়েছে।”
স্বামীজির দার্জিলিং যাওয়ার কারণ ছিল মূলত ভগ্নস্বাস্থ্য। ১৮৯৭ সালের শুরুর দিকে কলম্বোয় থাকাকালীন স্বামীজির ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। কলম্বো থেকে মাদ্রাজে হয়ে স্বামীজি কলকাতা ফেরেন। ডায়াবেটিস রোগিদের বেশি পরিশ্রম করতে নেই। সেসময় স্ট্রেপটোমাইসিন, ইনসুলিনের মত ওষুধ বের হয় নি। ফলে রোগ প্রতিরোধের জন্য নিয়মমাফিক জীবনযাপন ছিল বেশি জরুরি। এদিকে স্বামীজির গরম একেবারেই সহ্য হচ্ছিল না। এইসময় চিকিৎসকরা স্বামীজিকে দার্জিলিং যাওয়ার পরামর্শ দিলে স্বাস্থ্য ফেরাতে স্বামীজি দার্জিলিং যাত্রা করেন।
৮ মার্চ, ১৮৯৭ সাল। স্বামীজী সদলবলে প্রথম যাত্রা করেন দার্জিলিং অভিমুখে। সঙ্গী ছিলেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ, স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ, স্বামী জ্ঞানানন্দ, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, জে. জে. গুডউইন, ডাক্তার টার্নবুল এবং মাদ্রাজের ভক্ত আলাসিঙ্গা পেরুমল, জি. জি. নরসিংহাচার্য ও সিঙ্গারভেলু মুদালিয়র। ১০ মার্চ সদলবলে স্বামীজি দার্জিলিঙে পৌঁছলে তাঁদের অভ্যর্থনা জানান মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
বর্ধমান রাজবাড়ি ছাড়া দার্জিলিংয়ে দ্বিতীয় যে বাড়ির আতিথ্য স্বামীজি গ্রহণ করেছিলেন তা হল, মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বলেন ভিলা’। স্বামীজির সঙ্গীরা ওঠেন অন্যত্র।
মহেন্দ্রনাথ বাবু তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র বলেন্দ্রনাথের নামানুসারে তাঁর বাড়ির নাম রেখেছিলেন ‘বলেন ভিলা’। এই বাড়ির অবস্থান ছিল দার্জিলিঙের চকবাজার অঞ্চলে। তারই কাছেই ছিল ‘ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল’ ও ‘ব্রাহ্মসমাজ মন্দির’। খুব দু:খের বিষয় হল, ‘বলেন ভিলা’- সংলগ্ন অন্য দুটি অট্টালিকা টিকে থাকলেও ‘বলেন ভিলা’ আজ নিশ্চিহ্ন!
‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী - এই ‘বলেন ভিলা’র সামনেই চকবাজারের রাস্তা। বাড়িটি ছিল দ্বিতল। ওপরের তিনটি কুঠুরির শেষ কক্ষটিতে থাকতেন স্বামীজী, বাড়ির মধ্যে ছিল লাইব্রেরি আর সিঁড়ি বেয়ে উঠেই ছিল মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কক্ষ। এই বাড়িতে থাকাকালীন সময়ে স্বামীজী অধিক সময় কাটাতেন বাড়ির লাইব্রেরিতে।
মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সরকারি আইনজীবী। তাঁর মধ্যে একটা সাহেবি ব্যাপার থাকলেও তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে বাঙালি। স্ত্রী কাশীশ্বরী দেবী বাঙালি গৃহবধূ হলেও, সমাজের জন্য কাজ করতে ভালোবাসতেন।
মহেন্দ্রনাথ বাবুর সাথে স্বামীজির আলাপের যোগসূত্র প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ গবেষক তড়িৎ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ‘উদ্বোধন’ ( আশ্বিন, ১৪২১) পত্রিকায় লিখছেন, “বিশ্ববিজয় সেরে মাদ্রাজে পদার্পণ করলে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় দার্জিলিং থেকে মাদ্রাজে হাজির হয়েছিলেন। এছাড়া সম্ভবত স্বামীজির পরিবার যখন বিভিন্ন মামলায় জর্জরিত হয়েছিলেন তখন নরেন্দ্রনাথ সরকারি উকিল মহেন্দ্রনাথের সাথে যোগাযোগ করে থাকবেন।”
মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যম পুত্র ভূপেন্দ্রনাথ কর্মসূত্রে দার্জিলিংয়ের একটি চা-বাগানের সাথে যুক্ত ছিলেন। স্বামীজি তার সাথে তিন-চার মাইল ঘোড়ায় চড়ে একদিন গেলেন তাঁর চা-বাগান দেখতে। এই সূত্রে স্বামীজি এরপর দার্জিলিংয়ের আরও বেশ কয়েকটি চা বাগান পরিদর্শন করেন।
স্বামীজি যখন চা-বাগান পরিদর্শনে যেতেন তখন চা-বাগানের শ্রমিকরা ভিড় করত ‘তরুণ সন্ন্যাসী’কে দেখার জন্য। চা-বাগানের শ্রমিকরা তাঁদের দু:খ দুর্দশার কথা বলতেন স্বামীজিকে। স্বামীজি মন দিয়ে তাদের কথা শুনতেন। চা-বাগানের শ্রমিকদের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ছিল বাগানের ম্যানেজারদের দুর্নীতি নিয়ে। কারণ তাঁরা ছলে বলে কৌশলে মজুরদের ন্যয্য প্রাপ্য টাকা ছিনিয়ে নিত। স্বামীজি এই অন্যায়ের কথা শুনে গর্জে উঠলেন। তারপর চা বাগানের শ্রমিকদের একত্রিত করে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বললেন। তিনি সেখানেই থেমে থাকলেন না, স্বয়ং নিজে চা-বাগানের ইংরেজ মালিকদের সাথে এবিষয়ে কথা বললেন। শোনা যায়, স্বামীজির এই পদক্ষেপের ফলে অল্পসময়ের মধ্যে চাবাগানের শ্রমিকরা তাদের ন্যয্য অধিকার ফিরে পেয়েছিল।
স্বামীজি চাবাগানের শ্রমিকদের সমস্যা সমাধান করেই থেমে থাকেন নি। ‘বলেন ভিলা’র কাছেই ছিল চাঁদমারী বস্তি। স্বামীজি প্রায়শই দলবল নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাজির হতেন সেই বস্তিতে। বস্তিবাসীদের অধিকাংশই ছিলেন নেপালি ও ভুটিয়া। বস্তির মহিলারা চা-বাগানে কুলির কাজ করতেন। স্বামীজি তাদের অবস্থা দেখে খুবই ব্যথিত হন। তাঁর নির্দেশে মহেন্দ্রনাথ বাবু ওই বস্তিবাসীর খাওয়া পরার দায়িত্ব নেন।
ডাক্তারদের হাজারো নিষেধ সত্ত্বেও স্বামীজি একদিন গেলেন সিকিম সীমান্ত ঘুরে দেখতে। খাদ্যরসিক স্বামীজির জন্য বিদেশ থেকে একদিন এল রোস্টার মেশিন। আর তাতে কাটা হল কচি পাঁঠা। স্বামীজি নিজে উৎকৃষ্ট পোলাও-মাংস রেঁধে সবাইকে খাওয়ালেন।
স্বামীজীর সঙ্গে মহেন্দ্রনাথ বাবু ও কাশীশ্বরী দেবীর ঘন্টার পর ঘন্টা ধর্মপ্রসঙ্গে আলোচনা চলত। স্বামীজীকে তাঁরা খুবই ভক্তি করতেন। সেবার মহেন্দ্রনাথ বাবুর জ্যেষ্ঠ পুত্র বলেন্দ্রনাথ স্বামীজির কাছে দীক্ষা নেন। তিনমাসের মত স্বামীজি ছিলেন ‘বলেন ভিলায়’।
এরই মধ্যে স্বামীজি চিঠি পেলেন। চিঠির বিষয়, স্বামীজির ঘনিষ্ঠ বন্ধু খেতরি রাজ অজিত সিংহ কলকাতা আসছেন। আসার কারণ, মহারানী ভিক্টোরিয়ার ‘হীরক জয়ন্তী উৎসব’ পালন উপলক্ষ্যে অন্যান্য রাজার সঙ্গে খেতড়ির মহারাজ অজিত সিংহ বিলেত যাবেন। বিলেতযাত্রার প্রাক্কালে তিনি তাঁর বন্ধুসম ‘গুরু’র সাথে দেখা করবেন। স্বামীজি রওনা দিলেন দার্জিলিং থেকে কলকাতা। শিয়ালদহ স্টেশনে দেখা হল দুই বন্ধুর। স্বামীজী মহারাজাকে সঙ্গ দিলেন ২১ ও ২২ মার্চ।
এইসময় একদিন স্বামীজি হাজির হলেন বোসপাড়া লেনে। সারদা মা’র কাছে। সারাদা মা স্বামীজিকে জিজ্ঞেস করলেন “দার্জিলিং-এ কেমন ছিলে বাবা?”
উত্তরে স্বামীজী বলেন, “মা, সেখানে খুব যত্নে ভাল ছিলাম। আমার তো মনে হয় শরীর খুব ভাল আছে। এই গরমে দার্জিলিং বেশ ঠাণ্ডা এবং বেড়াতে বেশ আনন্দ বোধ হয়।”
১৮৯৭ সালের ২৩ মার্চ স্বামীজী দ্বিতীয় বার দার্জিলিং অভিমুখে রওনা দিলেন। পৌঁছলেন ২৫ মার্চ। এইসময় প্রায়রোজই সুট বুট পরে ‘প্রাত্যহিক ভ্রমণে’ বের হতেন স্বামীজি। একদিন তিনি দেখলেন, এক ভুটিয়া রমণী পিঠে ভারী বোঝা নিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ পায়ে হোঁচট লেগে পড়ে যান ও পাঁজরে ভীষণ ব্যথা পান। স্বামীজী সে-দৃশ্য দেখে হৃদয়ে অত্যন্ত ব্যথা অনুভব করেন। স্বামীজির কাছে একথা শুনে মহেন্দ্রনাথ বাবুর স্ত্রী ভুটিয়া বস্তিতে গিয়ে ওই রমণীর খোঁজ করেন ও তাঁকে সারিয়ে তোলেন। ভুটিয়া রমণীর নাম যমুনা তামাং।
স্বামীজি তৃতীয়বার দার্জিলিং যাত্রা করেন ১৮৯৮ সালের ৩০ মার্চ। সফরসঙ্গী ছিলেন স্বামী নির্ভয়ানন্দ ও নিত্যগোপাল বসু। কিছুদিন পরে দার্জিলিংয়ে হাজির হন স্বামী অখণ্ডানন্দ ও মিস মূলার।
সেবার দার্জিলিংয়ের ‘হিন্দু হল’-এ স্বামীজি একটি বক্তৃতা দেন। এই বক্তৃতা সম্বন্ধে তিনি একটি চিঠিতে লিখছেন- “দার্জিলিংয়ে হিন্দুদের কাছে একটা ছোট্ট বক্তৃতা করেছিলাম; ইচ্ছে করেই এবং তাদের সম্মতি নিয়ে তাদের সকল দোষত্রুটি বলেছিলাম। আশা করি এ নিয়ে তাদের তর্জন-গর্জন হবে।”
এই বক্তৃতার আয়োজক ছিলেন মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও কাশীশ্বরীদেবী। এই ‘হিন্দু হলে’র বর্তমান নাম ‘ভারতীভবন’। এই হলের দোতলায় আজও মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি পোর্ট্রেট দেখা যায়। স্বামীজি এইসময়ে ‘সান্দাকফু’ ভ্রমণ করেন।
মহেন্দ্রনাথ বাবুর ‘বলেন ভিলায়’ থাকাকালীন স্বামীজি হিল ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন। একজন নেপালি আয়া লক্ষ্মী রাই স্বামীজির দিনরাত সেবা করে সারিয়ে তোলেন। স্বামীজী তাঁকে ‘লক্ষ্মী মা’ বলে সম্বোধন করতেন। এই লক্ষ্মী’কে মানুষ করেছিলেন কাশীশ্বরী দেবী। আর তাঁকে আয়ার কাজ শিখিয়েছিলেন কাশীশ্বরী দেবীর বন্ধু দার্জিলিংয়ের ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের মহিলা চিকিৎসক ডাক্তার মিসেস এম যোশেফ। একদিন স্বামীজী লক্ষ্মী মা’কে বলেন, “জীবন কখনও বাধাবিহীন হয় না। বাধাকে অতিক্রম করিবার শক্তিই হল জীবন।”
‘বলেন ভিলায়’ অবস্থানকালে স্বামীজি খবর পান কলকাতায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। শোনামাত্রই অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন তিনি। ২৯ এপ্রিল এক ভক্তকে জানান, “আমি যে শহরে জন্মেছি, সেখানে যদি প্লেগ এসে পড়ে, তবে আমি তার প্রতিকার-কল্পে আত্মোৎসর্গ করব বলেই স্থির করেছি।” ২ মে স্বামীজি রওনা দেন কলকাতার পথে।
স্বামীজীর ইংরেজী জীবনীগ্রন্থ-মতে স্বামীজির শেষ দার্জিলিং সফর ছিল ১৯০১ সালে। সেবছর তিনি ৯ অগস্ট থেকে ২৪ অগস্ট পর্যন্ত প্রায় ১৬ দিন দার্জিলিংয়ের ‘বলেন ভিলায়’ অবস্থান করেছিলেন। স্বামীজির সেই যাত্রা প্রসঙ্গে জীবনীকার লিখছেন- “On August 7 (1901) he (Swamiji), his sister, and Mrs. Banerjee (of Darjeeling) went to Darjeeling by the mail train....”
১৯০১ সালে স্বামীজির দার্জিলিং সফরের ঠিক পরের বছর ১৯০২ সালে স্বামীজি দেহ রাখেন। ‘দেড়শো নট আউট’ যুগনায়কের দার্জিলিং স্মৃতির অধিকাংশ অধ্যায় আজও অজানা। তাঁর স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলিও প্রায় বিলুপ্তির পথে। যে কয়েকটি স্থান এখনও টিকে রয়েছে তা যেন অবহেলায় হারিয়ে না যায়। আর তা দেখার দায়িত্ব আমার, আপনার সবার...।
অঙ্কন : সুব্রত মাজী