বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ

হিন্দুত্ব প্রজেক্ট এবং ভারত-ব্র্যান্ডের ক্ষতি
সমৃদ্ধ দত্ত

দেওয়ালজুড়ে সাজানো হয়েছিল লাল রঙের লাভ সাইন আকৃতির বেলুন। শিশু ও বালক বালিকার দল নিজেদের মতো করে এঁকেছিল যিশুর ছবি। সকলেই পরেছিল সান্টাক্লজের লাল সাদা পোশাক। দিদিমণি এবং বাচ্চারা মিলে গা‌ই঩ছিল ক্রিসমাস ক্যারল। আমেদাবাদের বাপুনগরে সাউথ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের কিন্ডারগার্টেন বিভাগে এহেন এক উৎসব পরিবেশ ব্যাহত হল। কেন? কারণ আচমকা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের একদল সদস্য স্কুলে ঢুকে প্রধান শিক্ষিকা এবং দিদিমণিদের ধমক, হুমকি দিয়ে বলল, এসব বিদেশি কালচার চলবে না। সব ডেকোরেশন খুলে ফেলতে হবে। বাচ্চারাও ভয় পেল। দিদিমণিরা তো বটেই। এরপর তাদের বাধ্য করা হয় সমস্ত দেওয়াল ফাঁকা করে দিতে। বাচ্চাদের আঁকা সব ছবি সরিয়ে ফেলা হয়। এই শেষ ওয়ার্নিং। আগামী বছর থেকে যেন এসব ক্রিসমাস পালন করতে না দেখি! এই হুঁশিয়ারি দিয়ে চলে যায় তারা। বিহ্বল এবং আতঙ্কিত দিদিমণি এবং বাচ্চারা সম্ভবত আগামী জীবনে আর কখনও এই আতঙ্ক ভুলবে না।
জোমাটো অথবা সুইগির ইউনিফর্ম আছে। সেইসব কোম্পানির নাম লেখা টি শার্ট পরেই ডেলিভারি পার্সনদের দেখা যায় শহরে শহরে বাইক অথবা স্কুটিতে চেপে অর্ডার করা খাবার পৌঁছে দেয় কাস্টমারের কাছে। ইন্দোরে ২৫ ডিসেম্বর অর্জুন কোম্পানির দেওয়া স্যান্টাক্লজের পোশাক ও টুপি পরে বাইকে চেপে খাবার ডেলিভারি করছিল একজন। হঠাৎ পথে তাকে আটকে দেওয়া হল। নামিয়ে প্রশ্ন করা হল, স্যান্টাক্লজের পোশাক পরেছো কেন? সে বলেছে, আজ ক্রিসমাস। কোম্পানির ক্রিসমাস ড্রাইভ চলছে। তাই..। হিন্দু জাগরণ মঞ্চের জেলা আহ্বায়ক সুমিত হারদিয়া তাঁকে বলেছে, এখনই খুলে ফেলতে হবে এই পোশাক। দিওয়ালির দিন যখন খাবার ডেলিভারি করিস, তখন কি রামচন্দ্র সেজে করিস? অর্জুন কাকুতি মিনতি করে বলে, স্যার আমি এই ড্রেস খুলে ফেললে কাজ হারাব। কারণ, আজ বলে দিয়েছে এটা পরেই খাবার ডেলিভারি করতে হবে। হিন্দু জাগরণ সেনা তাকে বলে, ওসব জানি না। তোর কাজ খাবার দেওয়া। এই পোশাক খুলতে হবে। অর্জুন বাধ্য হয় স্যান্টাক্লজের পোশাক খুলে ফেলতে।
ইস্ট খাসি হিলস জেলার মালিনং ভিলেজ চার্চের শান্ত আবহে আচমকা আকাশ সাগর ঢুকে পড়ল। এবং চার্চ অফ এফিমেনির অন্দরে যেখানে পাদ্রী  ও যাজকরা প্রার্থনা করেন ও বাইবেল পাঠ করেন, সেই অল্টারে দাঁড়িয়ে মা‌ই঩ক্রোফোন অন করে গাইতে শুরু করে রাম সিয়ারাম...সিয়ারাম জয় জয় রাম...। প্রার্থনা করতে আসা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষকে সে অল্টারে দাঁড়িয়ে ইশারা করে তার সঙ্গে গাইতে। জয় শ্রীরাম বলে সে তার কর্মসূচি সম্পন্ন করে।
এটা তো মেঘালয়ের প্রত্যন্ত কোনও জেলার একটি নির্জন চার্চের ঘটনা। হতেই পারে। মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু লখনউয়ের হজরৎগঞ্জ তো নির্জন এবং প্রত্যন্ত কোনও স্থান নয়। কলকাতার যেমন ধর্মতলা, দিল্লির যেমন কনট প্লেস, বেঙ্গালুরুর যেমন এম জি রোড তেমনই লখনউয়ের হজরৎগঞ্জ। এহেন হজরৎগঞ্জের চার্চের সামনে জড়ো হয়ে লখনউয়ের এক বিরাট জনতা শ্রীকৃষ্ণ সংকীর্তন করতে শুরু করলেন ক্রিসমাসের রাতে। 
চার্চের প্রবেশপথ বন্ধ হয়ে গেল। আনন্দ ও উচ্ছ্বলতা দেখে মনে হয়েছিল জন্মাষ্টমীর রাত পালন করা হচ্ছে। ক্রিসমাস পালনের আবহ ঢেকে গিয়েছিল ওই উচ্চকিত হিন্দুত্ব ফেস্টিভ্যালে।
মধ্যপ্রদেশের দামো জেলা শহরে আয়োজিত করা হয়েছে স্বদেশি মেলার। আয়োজক স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ। গত নভেম্বর মাসে। যারা অংশগ্রহণ করে নিজেদের পণ্য বিক্রি করবে, তাদের স্টল ভাড়া দিতে হবে। যারা ভিনরাজ্য থেকে আসবে তাদের নিজেদের আসা, থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা নিজেদের করতে হবে। সেইমতো কাশ্মীরের কোনও বিক্রেতা ৩০ হাজার টাকা খরচ করে কার্পেট নিয়ে এসেছে এবং স্টল দিয়েছে। আগ্রার কোনও বিক্রেতা ৮ হাজার টাকা খরচ করে এসেছে এবং আগ্রার হস্তশিল্প নিয়ে বসবে বলে স্টল নিয়েছে। কিন্তু ১০ জন দোকানিকে বলা হল তোমরা স্টল ছেড়ে দিয়ে চলে যাও। এই মেলায় তোমাদের স্থান হবে না। বাছাই করা ওই ১০ জনই মুসলিম সম্প্রদায়ের। তারা বাইরে থেকে এসেছে। স্থানীয় আয়োজকদের সঙ্গে তো আর ঝগড়া করতে পারবে না। অতএব সকলেই মুখ বুজে ফিরে গিয়েছে স্বদেশি মেলা থেকে।
কুম্ভ মেলায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হবে। নাসের পাঠান নিজের সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ঘোষণা করল। সাংঘাতিক ঘটনা। এ তো দাঙ্গা বেঁধে যেতে পারে, এরকম ঘোষণায়! পুলিস তদন্তে নেমে ওই ফেসবুক অ্যাকাউন্টের মালিককে গ্রেপ্তার করে হতবাক। নাসের পাঠান নাম দিয়ে যে ওই হুমকি দিয়েছে, সে আসলে আয়ুশ জয়সওয়াল। হিন্দু তরুণ। 
এসব ঘটনা কীসের ইঙ্গিত করে? তার থেকে বড় প্রশ্ন হল, এসব থেকে হিন্দুত্ব কতটা উপকৃত হল? বরং এই ঘটনাগুলি থেকে স্পষ্ট, অর্থনীতি, জিডিপি, উন্নয়ন, বাজেট, ওয়ান নেশন ওয়ান ইলেকশন, মহিলা সংরক্ষণ বিল, জি টুয়েন্টি, চন্দ্রযান, ১০০ দিনের কাজ এসব নিত্যদিনের হাজারো সিরিয়াস ইস্যুর আড়ালে একটি সুনির্দিষ্ট প্রজেক্ট চলছে। প্রজেক্টের নাম হিন্দুরাষ্ট্র। না, আনুষ্ঠানিকভাবে হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু লক্ষ করা যাচ্ছে, এমন একটি পরিস্থিতি এবং রাষ্ট্রীয় আবহ নির্মাণ করা হচ্ছে, যেটা কার্যত প্রমাণ করে দেয় যে, আদতে কিন্তু ভারত এখন হিন্দুরাষ্ট্রই। হিন্দুত্বই চালিকাশক্তি। সুতরাং মেজরিটির কথাই শেষ কথা।
নীতি নিয়ম বিধি এবং সামাজিক প্রথাকে নিয়ন্ত্রণ করবে ধর্মীয় মেজরিটি সংখ্যা। অন্যদের মেনে নিতে হবে। যা হওয়ার কথা ছিল পারস্পরিক সহাবস্থান, সেটি বদলে এখন করার চেষ্টা হচ্ছে একটি  বিভাজিত পরিবেশ নির্মাণের প্রকল্প। শাসক ও শাসিত। অর্থাৎ মেজরিটি শাসন করবে। মাইনরিটি মান্য করবে। ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি। রাষ্ট্রের চারটি প্রধান স্তম্ভকে প্রভাবিত করবে সংখ্যাগুরু শ্রেণি। সেটা চিরকালই হয়ে এসেছে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি। এখন যেন সেই আনুষ্ঠানিক বিবৃতি অনেক বেশি প্রকট করার একটি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। 
একজন হিন্দু কি অখুশি হয় হিন্দুত্বের বজ্রনির্ঘোষে? মোটেই নয়। মেজরিটেরিয়ান ডমিনেশনের অনুভূতি সর্বদা সব দেশেই সকল সম্প্রদায়ের কাছেই গোপন একটি তৃপ্তি। কিন্তু ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যে উপায়ে সেটি প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে, সেটি হিন্দুধর্মীয়দের কাছে বেশ কিছুটা লজ্জার। কারণ এসব ঘটনা থেকে দেশি-বিদেশি ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মনে হতেই পারে যে, হিন্দুরা এত ধর্মীয়ভাবে অসুরক্ষিত বোধ করে কেন? কে ক্রিসমাস পালন করল, কে নমাজ কবুল করল, কে বুদ্ধজয়ন্তীতে প্রার্থনা করল, সেটা হিন্দুধর্মকে আঘাত করবে কেন? হিন্দুধর্ম এতই ভঙ্গুর কে বলল? 
হিন্দু ধর্মের বয়স, ব্যাপ্তি, সভ্যতা, গভীরতা, অধ্যাত্মের সমুদ্র নিজেই এক মহাজগৎ! সেখানে অন্য কোনও ধর্ম পালিত হলে হিন্দুধর্ম ভয় পাবে কিংবা আশঙ্কা হবে ‘গেল গেল বলে’, এটা তো চূড়ান্ত ছেলেমানুষি এবং অশিক্ষার লক্ষণ। হিন্দুধর্ম স্বমহিমায় শ্রেষ্ঠ। তার কোনও প্রতিযোগিতায় নামার দরকারই নেই। সনাতন ধর্মচর্চার আরও উন্নতি করা হোক। সেটাই কাম্য। তাই বলে অন্য ধর্মকে কেন দমন পীড়নের দরকার বোঝা গেল না! 
প্রধানমন্ত্রী দিল্লিতে ক্যাথলিক বিশপস কনফারেন্সে যোগ দিয়ে শান্তি ও সমন্বয়ের বার্তা দিচ্ছেন। অথচ তারপরেও ক্রিসমাসে চার্চে হামলা হয়! রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের প্রধান ধমক দিয়ে বলেন, যত্রতত্র রামমন্দিরের মতো মন্দির মসজিদ ইস্যু তৈরি করা বরদাস্ত করা হবে না। এই দেশ সকলের। অথচ ঠিক বিপরীত কাজই করে সঙ্ঘ সদস্য সংগঠনগুলি রাজ্যে রাজ্যে। তাহলে কথাগুলো সত্যি? নাকি লোকদেখানো? আমাদের আড়ালে আসলে ঠিক কী খেলা চলছে? 
কারা চা‌ইছে এই দেশকে পাকিস্তানের মতো ধর্মোন্মাদী করে তুলতে? কারা চাইছে বাংলাদেশের মতো খাদের কিনারায় নিয়ে যেতে? কারা চাইছে শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া করে দিতে? এসব অস্থিরতাকে প্রশ্রয় দেওয়া আসলে কাদের প্রজেক্ট? 
সর্বোচ্চ জনসংখ্যা।। প্রাচীনতম গণতন্ত্র। সফলতম সংসদীয় সাধারণতন্ত্র। পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি। আজ পর্যন্ত সামরিক শাসনে না আসা। বিশ্বের বৃহত্তম বাজার। এবং ৭৮ বছর ধরে ধর্মনিরপেক্ষ! ‘ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ ভারত’ নামক এই ব্র্যান্ডের তুলনা হয় নাকি? অথচ এই ব্র্যান্ড ধ্বংস করতে উদ্যত কোন আত্মঘাতীরা?
6h 6m ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

কাজকর্মে নতুন সুযোগ আসতে পারে। কর্ম সাফল্যে আনন্দ লাভ। ব্যবসায় উন্নতি। গবেষকদের পক্ষে শুভ।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৫.১০ টাকা৮৬.৮৪ টাকা
পাউন্ড১০৪.৪১ টাকা১০৮.১১ টাকা
ইউরো৮৭.০৫ টাকা৯০.৪০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা