বিশ্বজিৎ দাস ও শুভ্র চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা: চরম গাফিলতি যে হয়েছে, সেই ইঙ্গিত সোমবারই দিয়েছেন মুখ্যসচিব। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে আসার পর সন্দেহ দানা বাঁধছে স্যালাইনের পাশাপাশি অদক্ষ হাতে অস্ত্রোপচারের সম্ভাবনা নিয়েও। কারণ রিপোর্টে সাফ বলা হয়েছে, গড়বেতার ওই হতভাগ্য প্রসূতির দেহে তীব্র রক্তক্ষরণ হয়েছিল। অভিঘাত এতটাই ছিল যে, তাঁর পেট এবং বুকের চারদিকের ঝিল্লি বা প্লুরাল ক্যাভিটি ভরে গিয়েছিল রক্তে। পেটে জমেছিল ৭০০ মিলিলিটার (‘কন্টেইনস অ্যাপ্রক্সিমেটলি ৭০০ এমএল ব্লাড মিক্সড সেরাস ফ্লুইড’ বা রক্তমিশ্রিত দেহরস)। অন্যদিকে বুক বা থোরাক্সের প্লুরাল ক্যাভিটিতে ছিল দেড় লিটার রক্ত। হঠাৎ এত রক্তক্ষরণ কেন? সিজারিয়ান কেসে রক্তপাত হলেও, তা হতে পারে পেটে। তাহলে বুকের ভিতর এত রক্ত জমল কেন? অপটু হাতের জন্যই কি এত রক্তক্ষরণ? স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণভাবে সিজারিয়ান পদ্ধতিতে নিরাপদ প্রসব হলে পেটের ভিতর বা পেরিটোনিয়াল ক্যাভিটিতে বড়জোর ১০০ মিলিলিটার রক্ত জমে। বুকের ভিতর রক্ত জমার কথাই নয়। সেখানে দেড় লিটার? বড়সড় পথ দুর্ঘটনা ছাড়া যা সম্ভবই নয়। শুধু তাই নয়, মামনি রুই দাসের সন্তান প্রসবে দীর্ঘ সময় নিয়েও গভীর রহস্য দানা বেঁধেছে। কারণ, গড়পড়তা সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে স্ত্রীরোগ বিভাগের সার্জেনের ৪০-৪৫ মিনিট সময় লাগে। মামনির ক্ষেত্রে লেগেছে প্রায় দেড় ঘণ্টা। কোনও গুরুতর পূর্ব সমস্যা না থাকা সত্ত্বেও এত দীর্ঘক্ষণ ধরে কেন সিজার চলল? আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে এই ঘটনায়। যেমন, স্ত্রীরোগ বিভাগের যে আরএমও সেদিন দায়িত্বে ছিলেন, তাঁর অধীনে খাতায়কলমে সবশুদ্ধ ১৪টি অস্ত্রোপচার দেখানো হয়েছে। সবগুলিতেই অন্যান্য ওষুধ ও ইঞ্জেকশনের পাশাপাশি ব্যবহার হয়েছে রিঙ্গার ল্যাকটেট। এও জানা গিয়েছে, অপারেশনগুলিতে ওই আরএমও’র বকলমে কাজ করা পিজিটিদের সাহায্যকারী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তাঁদের থেকেও দক্ষতা ও অভিজ্ঞতায় আরও জুনিয়র—ইন্টার্নরা!
ময়নাতদন্তের রিপোর্টে উঠে আসা প্রশ্নগুলি যে অমূলক নয়, তার প্রমাণ কিন্তু মিলছে তদন্ত প্রক্রিয়াতেই। কারণ ইতিমধ্যেই সিআইডির জেরার মুখে পড়েছেন ওইদিন ডিউটিতে থাকা হাসপাতালের জুনিয়র চিকিৎসক, আরএমও, নার্সরা। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে রোগীর পরিবারকেও। মঙ্গলবার ডিএসপির নেতৃত্বে ঘটনাস্থলে গিয়েছিল তিন সদস্যের তদন্তকারী দল। ওই প্রসূতি কখন ভর্তি হন, কোন কোন ডাক্তার তাঁকে অ্যাটেন্ড করেছেন, কী কী ওষুধ দেওয়া হয়েছে, স্যালাইন কে চালাতে বলেন, আরএমও কোথায় ছিলেন—এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে সিআইডি। এমনকী স্যালাইন কোথা থেকে এসেছে, সেই তথ্য নেওয়ার পাশাপাশি রেজিস্টারও মিলিয়ে দেখা হয়। আজ, বুধবার সিআইডি যাবে ওয়েস্টবেঙ্গল ফার্মাসিউটিক্যালসের দপ্তরে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এমএসভিপি এবং জুনিয়র ডাক্তারদের জিজ্ঞাসাবাদের পর সিআইডি দাবি করেছে, সেদিন অপারেশন করেছেন জুনিয়র ডাক্তাররাই। কোনও সিনিয়র চিকিৎসক ছিলেন না। এমনকী আরএমও নিজেও আসেননি। জুনিয়র ডাক্তাররা অপটু হাতে ঠিকমতো অস্ত্রোপচার করতে পারেননি। শরীরে বহু অভ্যন্তরীণ ক্ষত তৈরি হয়, আর সেই কারণেই ব্যাপক রক্তক্ষরণ। তবে জুনিয়র চিকিৎসকরা বলেছেন, এটাই হাসপাতালের ‘কমন প্র্যাকটিস’। চার নার্সও জেরায় জানিয়েছেন, জুনিয়র ডাক্তাররাই এই ধরনের অপারেশন করেছেন। তাঁরা স্টোর রুম থেকে নিয়ে আসেন স্যালাইন। তাতে যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তা তাঁদের কেউ জানায়নি।