বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ

গঙ্গাসাগর মেলার জাতীয় স্বীকৃতি ন্যায্য দাবি
হারাধন চৌধুরী

কূর্মপুরাণে বলা হয়েছে, ‘সর্বত্র সুলভা গঙ্গা ত্রিষু স্থানেষু দুর্লভা।/ গঙ্গাদ্বারে প্রয়াগে চ গঙ্গাসাগরসঙ্গমে।।’ অর্থাৎ গঙ্গা সর্বত্র সুলভা হলেও হরিদ্বার, প্রয়াগ ও গঙ্গাসাগর—এই তিন স্থানে অতিশয় দুর্লভা। দুর্লভ বস্তুর প্রতিই তো মানুষের আকর্ষণ সর্বাধিক। এছাড়া গঙ্গাই ভারতভূমির আত্মা। তাই গঙ্গার মতো নদী ‘দুর্লভা’ গণ্য যে স্থানগুলিতে, সেইসব জায়গার প্রতিই যে পুণ্যলোভী নরনারী সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ অনুভব করবে তাতে সংশয় কী! বিশ্বাসী মানুষের ভক্তিভাবই এমন বহু স্থানকে তীর্থক্ষেত্রে পরিণত করেছে। অবস্থানগত কারণে গঙ্গাসাগরের চেয়ে দুর্গম তীর্থ আর নেই। প্রাচীনকালে গঙ্গাসাগর তীর্থের দুর্গমতা প্রবাদে ঠাঁই পেয়েছে—‘সব তীর্থ বারবার গঙ্গাসাগর একবার’! 
এমন প্রবাদের ভিত্তি এটাই যে, বহু বাধা বিপত্তি এবং দীর্ঘ উত্তাল নদীপথ পেরিয়ে গঙ্গাসাগরে কোনোক্রমে পৌঁছনো গেলেও সেখান থেকে ঘরে ফেরার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে প্রকৃতির বিরূপতার সঙ্গী জলদস্যু এবং হাঙর, কুমিরের মতো ভয়ানক জলজ প্রাণীরাও। এরপর সুন্দরবনের উপকণ্ঠে সাগরদ্বীপে বিষধর সাপ এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দেখা মেলাও অসম্ভব নয়। তবুও মানুষ যুগ যুগ ধরে সাগরসঙ্গমে যোগীশ্রেষ্ঠ কপিলমুনির আশ্রম অব্দি পৌঁছনোর টান অনুভব করে এসেছে। এই প্রসঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় প্রকাশিত (২১ জানুয়ারি, ১৮৫৩) একটি খবর পড়ে দেখা যেতে পারে, ‘‘সাগর হইতে কোন প্রত্যাগত ব্যক্তির দ্বারা অবগত হইলাম যে অন্যান্য বৎসর মকর-সংক্রান্তির মেলায় তথায় যেরূপ সমারোহ হইত এবার তদ্রূপই হইয়াছে। আমাদিগের টোন মেজর সাহেব চারিটি তোপ ও একদল সৈন্য সহিত তথায় উপস্থিত হইয়া অবিশ্রান্তরূপে তোপধ্বনি করাতে ব্যাঘ্রের ভয় বড় দৃষ্ট হয় নাই। কেবল তিনজন নাবিক বনমধ্যে কাষ্ঠ কাঁটিতে গিয়া উক্ত জন্তুর দ্বারা হত হইয়াছে। এবারে সংক্রান্তির সময়ে গগনমণ্ডল নীরদজালে আবৃত থাকাতে শীত অধিক হয় নাই। দোকানদারগণ বিস্তর গিয়াছিল, ডাব-নারিকেল পয়সায় দুইটি করিয়া বিক্রয় হইয়াছে। সাগরেরও দুই ব্যক্তি পরস্ব-অপহরণ অপরাধে ধৃত হইয়া মিলিটারী কারাগারে বদ্ধ হইয়াছে। ৫০ জন গঙ্গাসাগরযাত্রী বাঘের উদরস্থ হইয়াছে এবং নৌকাডুবিতে অনেকের প্রাণনাশ হইয়াছে।” 
অশোকচন্দ্র মিত্রের পশ্চিমবঙ্গের ‘মেলা ও উৎসব’ গ্রন্থে (১৯৫১ সালে লেখা) ১৫১৯টি মেলার বর্ণনা পাওয়া যায়। তার মধ্যে ৩৩টিকে তিনি পৌষসক্রান্তির মেলা হিসেবে উল্লেখ করেন। বলা বাহুল্য, বাংলার বৃহত্তম পৌষসংক্রান্তির মেলার নাম গঙ্গাসাগর মেলা। 
পুরাণের কাহিনি বাদেও এই মেলার প্রাচীনত্ব প্রশ্নাতীত। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দেবতার গ্রাস’ শীর্ষক কবিতায় এই মেলার উল্লেখ পাওয়া যায়। এমনকী এর উল্লেখ রয়েছে মহাকবি কালিদাসের রচনাতেও। প্রাচীন সমাজে এই তীর্থকে ঘিরে যে ভয়াবহ কুসংস্কার ছিল তা মর্মান্তিক। পুণ্যলাভের আশায় কোনও কোনও দম্পতি সাগরে তাদের শিশুসন্তানকে বিসর্জন অথবা নিজেরাই আত্মাহুতি দিত। ১৮০২ সালে ইংরেজ শাসক লর্ড ওয়েলেসলি আইন করে এই কুপ্রথা বন্ধ করতে সফল হন। কিন্তু সাগরসঙ্গমে স্নান-তর্পণ এবং কপিলমুনি, সগর, গঙ্গা ও ভগীরথ বিগ্রহ দর্শন এবং অর্ঘ্য অঞ্জলি দেওয়ার আকর্ষণ রয়ে গিয়েছে অবিকল। ভাগীরথী যেখানে সাগরে গিয়ে মিশেছে তারই মুখে সাগরদ্বীপ। বস্তুত সেটা সাগরের মাথায় যেন মাটির মুকুট! গঙ্গার বদ্বীপগুলির মধ্যে এটাই বৃহত্তম। এর অবস্থানগত গুরুত্ব অপরিসীম। 
এর পূর্বদিক দিয়ে বয়ে গিয়েছে মুড়িগঙ্গা এবং পশ্চিমে ভাগীরথী। ভাগীরথীর নৌপথে সহজেই কলকাতায় পৌঁছানো যায়। ফিরিঙ্গি আমলে ইউরোপের বিভিন্ন বন্দর থেকে বড় বড় জাহাজ বঙ্গদেশে প্রবেশের আগে এই সাগরদ্বীপে নোঙ্গর করত। পণ্যবাহী নৌকা বা বজরা নিয়ে ঢুকতে হতো ভিতরে। সমুদ্রের দিক নির্ণয় করা কঠিন ছিল, তাই সাগরদ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি ‘লাইট হাউস’ তৈরি করা হয়। ইংরেজরা দাবি করে, এই দ্বীপে বনজঙ্গল কেটে চাষাবাদ এবং জনবসতির পত্তন তাদেরই হাতে। হাল আমলের নথিপত্র তেমনই সাক্ষ্য দেয় বটে কিন্তু তাদের এই দাবি অর্ধসত্য। কারণ পরবর্তীকালে এই অঞ্চলে প্রাচীন সভ্যতার অসংখ্য নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। সেই ইতিহাস আলোচনার পরিসর অবশ্য এটা নয়। 
পলাশির যুদ্ধজয়ের পর ইংরেজরা এদেশে পাকাপাকিভাবে ঘাঁটি গেড়ে বসে এবং তখন থেকেই সাগরদ্বীপসহ সুন্দরবন অঞ্চল নিয়ে একটি অর্থকরী ভাবনা এগিয়ে চলে। আর সেই সূত্রেই গঙ্গাসাগরে যাতায়াতের ব্যবস্থা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। গঙ্গাসাগর মেলার দখলদারি নিয়ে শুরু হয় বিবাদ-বিসম্বাদ। প্রাকৃতিক কারণে এই অঞ্চলের ভৌগোলিক পরিবর্তন ঘটেছে বহুবার। প্রকৃতির রোষের শিকার গঙ্গাসাগরে কপিলমুনির মন্দিরও। মন্দিরের স্থান পরিবর্তন ঘটেছে সাম্প্রতিক অতীতেই একাধিকবার। ১৮৬২ সালে উইলসন সাহেবের লেখা এক প্রবন্ধে গঙ্গাসাগরে কপিলমুনির মন্দির সম্পর্কে একটি বর্ণনা পাওয়া যায়: মন্দিরের সামনে ছিল একটি বটগাছ। নীচে থাকত রাম ও হনুমানের মূর্তি। পুণ্যার্থীরা মন্দিরের গায়ে তাঁদের নামধাম লিখে রাখতেন। মহর্ষির কাছে হাজারো প্রার্থনা লিখতেন তাঁরা খড়ি দিয়ে। কেউ কেউ বটের ডালে ইটপাথরের টুকরো ঝুলিয়ে দিতেন। মন্দিরের পিছনে অবস্থিত সীতাকুণ্ড সবসময় ভরা থাকত টাটকা জলে। পুণ্যার্থীরা গণ্ডূষ করে ওই জল পান করতেন। এজন্য পূজারিকে পয়সা দিতে হতো।
বলা বাহুল্য, গঙ্গাসাগরের এই ছবি বহুকাল আগেই ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে। তবু কৌলীন্য হারায়নি গঙ্গাসাগর মেলা। একসময় তো মেলা চলত একমাস যাবৎ—ডিসেম্বরে মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি, অর্থাৎ পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত। যাতায়াত ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ থাকা সত্ত্বেও মানুষ ছুটে যেত। কলকাতার প্রিন্সেপ ঘাট, আউটরাম ঘাট থেকে ছাড়ত যাত্রীবোঝাই স্টিমার। স্টিমারের দু’দিকে দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকত অনেকগুলি গাদাবোট ও নৌকা। বাঁশের কাঠামোর উপর কোনোরকমে তৈরি করা হতো ছাউনি। যাত্রীরা তার ভিতরে গাদাগাদি করে বসতেন, শুতেনও। মাঝি, সারেঙ্গাগুলোও থাকত আনাড়ি। ফলে দুর্ঘটনার অন্ত ছিল না। ওইভাবেই স্টিমার ও নৌকাগুলো একসময় মেলার কাছে গিয়ে ভিড়ত। সে এক অদ্ভুত শোভা—ফুলমালা, রঙিন কাপড় ও কাগজের শিকল দিয়ে সাজানো হতো পালতোলা নৌকা, মোটরলঞ্চ, স্টিমার প্রভৃতি। সেগুলি দুলত ঢেউয়ের তালে তালে। দূর থেকে দেখা যেত বহু রঙের নিশান সাঁটা জলযানগুলিকে। 
এই সম্পর্কে একটি প্রাচীন পত্রিকায় বর্ণনা পাওয়া যায়, “বর্তমান বৎসরের গত ডিসেম্বর মাসের শেষে উক্ত তীর্থ মেলারম্ভ হইয়া ১৬ই জানুয়ারি পর্যন্ত ছিল। ওই যাত্রাতে যত পিনিস ও ভাউলিয়া ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাড় একত্র হইয়াছিল তৎসংখ্যা ন্যূন নহে এমত অনুমান হইয়াছে। এবং ভারতবর্ষের অতিদূর দেশ অর্থাৎ লাহোর দিল্লী অযোধ্যা ও শ্রীরামপটন ও বোম্বাই হইতে যে বহুতর যাত্রী সমাগত হইয়াছিল সংখ্যা ৫ লক্ষের ন্যূন নহে এবং এই তীর্থযাত্রাতে ব্রহ্মদেশ হইতেও অধিক লোক আসিয়াছিল।” 
গঙ্গাসাগর মেলার ছবি প্রতিবছর বদলে যাচ্ছে। প্রয়াগতীর্থ, হরিদ্বার, নাসিক, উজ্জয়িনী প্রভৃতি কুম্ভমেলার সঙ্গে এর সাদৃশ্য নিবিড় হচ্ছে ক্রমে। ভারতের কোনও মেলা বা উৎসবকেই আর নিছক ধর্মের গণ্ডিতে বেঁধে রাখার অবকাশ নেই। বহু মানুষ সমাগমের প্রতিটি ক্ষেত্রই আজ অর্থকরী বা বাণিজ্যিক ভাবনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেখানে কুম্ভমেলা থেকে গঙ্গাসাগর মেলায় কোনও প্রভেদ নেই। যেমন কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি (সিআইআই) এবং কনফেডারেশন অফ অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্সের ইউপি শাখার তরফে এক সমীক্ষা রিপোর্টে আশাপ্রকাশ করা হয়েছে যে, এবারের প্রয়াগরাজ কুম্ভমেলায় অন্তত ২ লক্ষ কোটি টাকার বাণিজ্য হবে। এর কারণ হিসেবে যোগী সরকারের দাবি, পূর্ণকুম্ভে ৪০ কোটি মানুষের সমাগম হচ্ছে এবং মেলাটাই চেহারা নিচ্ছে এক মহানগরের। 
পুরাণ থেকে ইতিহাসের সড়ক ধরে আধুনিকতাকে ছুঁয়েছে গঙ্গাসাগর মেলা। তাই বাণিজ্যিক সম্ভাবনার প্রশ্নে গঙ্গাসাগর মেলা কোনও অংশেই পিছিয়ে নেই। তার সামনে মূল বাধা এখনও যাতায়াত। সড়ক, রেল, আকাশ তিনদিক থেকেই প্রয়াগ সংযুক্ত। ফলে পুণ্যার্থী থেকে সাধারণ পর্যটক—যে কেউ সেখানে মন করলেই পৌঁছে যেতে পারেন। গঙ্গাসাগর যাত্রা অনেকটাই সহজ এখন, তবুও কুম্ভমেলার তুলনায় দুর্গম। মুড়িগঙ্গার উপর একটি সেতু নির্মাণ হলে সাগরদ্বীপ বাংলার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জুড়ে যাবে। কেন্দ্রীয় সরকার কথা দিয়েও ব্রিজটি তৈরি করেনি। তাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্ত মতো রাজ্য সরকারই দেড় হাজার কোটি টাকায় ওই ব্রিজ নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছে। আকাশপথেও গঙ্গাসাগরের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি কাম্য। গঙ্গাসাগরের ‘জাতীয় মেলা’র স্বীকৃতি এবং পর্যাপ্ত কেন্দ্রীয় অনুদান প্রাপ্য। বাংলা এই প্রশ্নেও দিল্লির পক্ষপাতিত্বের শিকার। মুখ্যমন্ত্রী বারবার দাবি জানানো সত্ত্বেও মোদি সরকার মজে আছে কেবল কুম্ভমেলা নিয়ে। গ‍ঙ্গাসাগর মেলার জাতীয় স্বীকৃতি আদায়ের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বহুদূর পর্যন্ত যাবেন এবার দিয়ে রেখেছেন সেই বার্তাও। দ্বীপভূমির পরিকাঠামো বৃদ্ধিসহ গঙ্গাসাগর মেলার জাতীয় স্বীকৃতি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অর্থনীতি দ্রুত এবং আমূল বদলে দিতে পারে। বাংলার সঙ্গে জাতীয় অর্থনীতিও যে তার সুফল পাবে তা এক সহজ অনুমান।
4h 4m ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি প্রচেষ্টায় সাফল্যের সম্ভাবনা। ন্যায্য অর্থ সঠিক সময়ে নাও পেতে পারেন।  অর্থপ্রাপ্তির যোগ...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৫.৮৩ টাকা৮৭.৫৭ টাকা
পাউন্ড১০৪.০৫ টাকা১০৭.৭৪ টাকা
ইউরো৮৭.৩০ টাকা৯০.৬৫ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা