বর্ধমান, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ বা বীরভূমের ঢাকিপাড়ায় ইতিমধ্যে বোধন হয়ে গিয়েছে। বসন্ত, রসিক কিংবা শ্যামাপদর ঢাকের আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামের বুকে। আর দিনকয়েক পরেই কাঁধে ঢাক নিয়ে ওঁরা বেরিয়ে পড়বেন বিভিন্ন মণ্ডপে। ইতিমধ্যেই ছাউনি পরিয়ে ঢাক বাঁধা হয়ে গিয়েছে। এখন সকাল বিকেল চলছে তারই মহড়া। সেই মিষ্টি সুরই যেন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে আগমনি গান হয়ে।
নদীয়া, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদের খাল বিল থেকে সনৎ, আবদুল, কাদের সহ অনেকেই ইতিমধ্যেই পদ্মফুল সংগ্রহ করেছেন। মহাজনরা সেগুলি কিনে পাঠিয়ে দিয়েছেন হিমঘরে। আসন্ন দুর্গাপুজোয় সেগুলি বিক্রি হবে। ১০৮টা পদ্ম ছাড়া অষ্টমীর সন্ধিপুজো হতে পারে নাকি!
জোর ব্যস্ততা বিভিন্ন জেলার তাঁতিপাড়ায়। শিল্পীর হাতের বুননে ফুটে উঠছে নানা নকশা। কলকা, চাঁদমালা, রাজমহল, রতনচোখ ইত্যাদি। নানা ডিজাইনের শাড়ি বুনে তাড়াতাড়ি সেগুলি বাজারে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ধীরে ধীরে জমে উঠছে পুজোর বাজার। বিভিন্ন কাপড়ের বাজারে ভিড় বাড়ছে। তাগাদা দিচ্ছেন মহাজন, পাইকাররা।
শাঁখারিরাও ব্যস্ত নতুন ডিজাইনের শাঁখা বানাতে। পুজোর সময় এয়োতিরা নতুন শাঁখা পরে মাকে বরণ করেন, সিঁদুর খেলেন। এসব পুজোর সময় আমাদের বঙ্গজীবনের অঙ্গ।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই মুহূর্তে চরম ব্যস্ততা কুমোরপাড়ায়। ব্যস্ত শোলাশিল্পীরা। প্রতিমার গয়না বা চালচিত্র নির্মাণের কাজে তাঁদের এখন দম ফেলার সময় নেই। থিমশিল্পীরা তাঁদের শিল্পকর্ম সময়ে শেষ করার জন্য রাতদিন এক করে কাজ করছেন।
ব্যস্ততা চলচ্চিত্র শিল্পেও। ছবির নির্মাণ কাজ শেষ। পুজোয় যে ছবি মুক্তি পাবে, তার প্রচারে নেমে পড়েছেন শিল্পী ও পরিচালকরা। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এবার আর জি কর কাণ্ডকে কেন্দ্র করে পুজোর বাজার কিছুটা অন্যখাতে বইছে। একদল বলছেন, তিলোত্তমা-আবহে আমরা উৎসব চাই না। অন্যদল বলছেন, অবশ্যই তিলোত্তমা কাণ্ডের বিচার চাই, তবে উৎসব বন্ধ করতে হবে কেন? এই নিয়ে নানা দ্বিচারিতাও দেখা যাচ্ছে। যেসব অভিনেত্রী ও পরিচালক আন্দোলনে নেমে উৎসবের বিরোধিতা করেছেন, তাঁদেরই কেউ কেউ আবার নিজেদের ছবির প্রচার করে বলছেন, ‘পুজোয় আমার ছবিটা রিলিজ করছে, দয়া করে আপনারা দেখুন।’
এই মুহূর্তে দ্বন্দ্বটা সেখানেই। টু বি অর নট টু বি। নানা মুনির নানা মত শোনা যাচ্ছে। এখন স্মার্ট ফোনের দৌলতে সবাই বিচারক, ভিআইপি, মাতব্বর। বিভিন্ন পক্ষ একে অপরকে তেড়ে গালাগাল করছে। সোশ্যাল মিডিয়াকে একটা ক্লাস নরক করে তুলেছে। অথবা বলা যায় ফুল বিনোদন, ফ্রি মস্তি।
কিন্তু দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদটা যে রয়েই গেল! কোথায় দ্বন্দ্ব? যেমন ধরুন, অনেকেই বলছিলেন, তিলোত্তমার আগে বিচার হোক, তারপর উৎসব। অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত আর্জি। যত দ্রুত সম্ভব সিবিআই অপরাধীদের খুঁজে বের করে তদন্ত শেষ করুক। কিন্তু কেউই বলছেন না, আগে তিলোত্তমার বিচার হোক, তারপর বিরিয়ানি খাব, এখন রেস্তরাঁ বন্ধ থাক। কেউ বলছেন না, তিলোত্তমার বিচার না হওয়া পর্যন্ত মদের দোকান, গাঁজার দোকান, হেরোইনের গোপন ব্যবসা, সিগারেটের দোকান বন্ধ থাক। কেউ বলছেন না, এই যে ভাই, ‘এখন প্রতিবাদের সময়, ওইসব নাটক, সিনেমার বিনোদন বন্ধ হোক।’ আমরা দেখেছি বহু নামী শিল্পীর ফাংশান বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অনেকেই সহমর্মিতা দেখিয়ে অনুষ্ঠান বাতিল করেছেন। বাকিদেরও কিন্তু দ্বিচারিতার পথ থেকে সরে আসা দরকার। কেউ যদি সিনেমা দেখতে বা থিয়েটার দেখতে হলে যান। সেই প্রেক্ষাগৃহকে করে তুলুন প্রতিবাদের মঞ্চ। প্রেক্ষাগৃহে আওয়াজ তুলুন। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস।’ মুখ্যমন্ত্রীর আলোচনার সদিচ্ছাকে যেমন খুদে ডাক্তাররা বার দুয়েক আড়কাঠিদের হাতে তামাক খেয়ে ভেস্তে দিয়েছেন, তেমনই এখন বন্ধ থাক এই সব বিনোদন চর্চা। বলুন, ‘চোপ এখন প্রতিবাদ চলছে!’
আর এই প্রতিবাদের মধ্যে হাসপাতালের দরজায় একটু চিকিৎসার জন্য হত্যে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। প্রতিবাদের ধামাকায়, জাস্টিস কার্নিভালে চাপা পড়ে যাচ্ছে প্রিয়জন হারানোর কান্না। সবাই যে চিকিৎসাহীন তা নয়, কিন্তু যাঁরা ডিউটি করছেন, তাঁদের পক্ষে এত রোগী সামলানো সম্ভব নয়। অথচ এই সাধারণ রোগীদেরই করের টাকায় সস্তায় ডাক্তারি পড়া যায়। আবার পরে ডাক্তার হয়ে এই সাধারণ মানুষের মাথায় কাঁঠাল ভেঙেও খাওয়া যায়।
শেষ পর্যন্ত যে খুদে ডাক্তাররা বৈঠকে বসেছেন, সেটা ভালো কথা। তবে শিয়রে সুপ্রিম কোর্টের জুজু না থাকলে তড়িঘড়ি তাঁদের মতি ফিরত কি না সন্দেহ। সবক্ষেত্রেই দেখা যায় গুঁতোর নাম বাবাজি! মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মিটিংয়ে বসার আগে বারবার স্বচ্ছতার প্রসঙ্গ তুলে আনছিলেন আন্দোলনকারীরা। বারবার লাইভ স্ট্রিমিংয়ের কথা বলছিলেন। পরে অবশ্য তাঁরা সেই দাবি থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, ডাক্তারি পেশায় একশো শতাংশ স্বচ্ছতা রয়েছে তো? এখানে চিকিৎসা ব্যবস্থার সবটাই তো রোগীর বিশ্বাসের ওপর। ভাবুন তো, ডাক্তারবাবু তাঁর চেম্বারে বসে চিকিৎসা করছেন। রোগীপিছু ভিজিট পাঁচশো, আটশো বা হাজার টাকা। সেই পরিষেবা কেনার জন্য ডাক্তারবাবুরা রশিদ কেটে দেন? রোগীরাও তো চিকিৎসা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে লাইভ স্ট্রিমিং চান। অর্থাৎ প্রতিটি পরিজন যাতে দেখতে পান, হাসপাতালে বা নার্সিং হোমে তাঁর প্রিয়জন কতটা চিকিৎসা পাচ্ছেন। কতটা তিনি অবহেলিত থাকছেন মোটা টাকা মেটানোর পরেও। যে ওষুধ লেখা হচ্ছে, তার সবটুকু রোগী পাচ্ছেন? তার কিছু অংশ পিছনের দরজা দিয়ে আবার হাসপাতাল বা নার্সিং হোমের নিজস্ব ফার্মেসিতে চলে যাচ্ছে না তো? এই যে বহু ডাক্তারের বিরুদ্ধে প্যাথলজি সেন্টার বা ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে কাটমানি খাওয়ার অভিযোগ ওঠে, সে ব্যাপারেও তো স্বচ্ছতা থাকা দরকার! সিবিআইয়ের দাবি, এরকম অজস্র দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে গ্রেপ্তার হওয়া প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে। ব্যাপারটা তো এমন নয় যে, চিকিৎসা পরিষেবার ক্ষেত্রে সন্দীপ একাই নকড়া ছকড়া করেছেন। আরও আছে। ঘুঘুর বাসা ভাঙুক। স্বচ্ছতা আসুক চিকিৎসা পরিষেবায়। সাধারণ মানুষ চাইছেন, চিকিৎসা ব্যবসায় একশো শতাংশ স্বচ্ছতা আসুক। তাহলে আর তাঁদের জমি বাড়ি, গয়না বিক্রি করে চিকিৎসা করাতে হবে না। চিকিৎসা ক্ষেত্রে বহু মানবিক ডাক্তার দেখেছি, যাঁদের দেখলে মনে হয়, তাঁদের থেকে দেবতাদের দূরত্ব বেশি নয়। আবার শাইলক ডাক্তারও দেখেছি। সমাজে তাঁদের সংখ্যা বেড়ে গেলে সেবা ধর্মটাই যে অচল পয়সা হয়ে যাবে।
আন্দোলন হয়েছে। অচিরে তা মিটেও যাবে। অভয়ার মায়ের কোল খালি যেমন থাকবে, তেমনই এই আন্দোলনের জেরে যে সব পরিবারের মানুষ তাঁদের স্বজনদের হারিয়েছেন বিনা চিকিৎসায়, তাঁরাও কিন্তু আর পরিজনদের ফিরে পাবেন না। তাঁদেরও চোখের জল এবং অভিসম্পাতের ধার কম নয়! একটা মৃত্যুর বিচারের দাবি সভ্য সমাজে আর একটা মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে না!
রাজ্যের মানুষ জেনে গিয়েছেন, আন্দোলনের সামনে বিচারের দাবি থাকলেও অন্তঃসলিলার মতো বয়ে চলেছে একটা রাজনৈতিক লোভ। সেটা হল, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সব ঘেঁটে দিয়ে আন্দোলন জারি রাখো। শান্তি ফিরে এলে ক্ষমতা দখলের সুযোগ মাঠে মারা যাবে। তাই কাঠি হাতে অবিরাম জল নাড়িয়ে চলেছে, সোজা বাম, ব্যাঁকা বাম, লাল বাম, অতিবাম, সক্রিয় বাম, নিষ্ক্রিয় বাম সকলেই। বাম জোট ঘোঁট চাইছে, উস্কানি দিয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি হোক, যাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিস বাধ্য হয় জ্যোতি বসুর পুলিসের মতো লগুড় ধর্ম পালন করতে। ১৯৮৩ সালে জ্যোতিবাবুর পুলিস আন্দোলনরত ডাক্তারদের পিটিয়ে ছাতু বানিয়ে দিয়েছিলেন। মমতা সে পথে যাননি। নজির সৃষ্টি করেছেন আন্দোলনকারীদের মঞ্চে ‘দিদি’ হয়ে এসে। এখানেই ঘোর সঙ্কটে পড়ে গিয়েছেন বাম নেতারা। মার্ক্স বা লেনিনের পঞ্জিকায় তো এর বিহিত করার ব্যাপারে কিছু লেখা নেই। সুতরাং ঘুলিয়ে দাও!
আন্দোলনের অভিমুখ একেবারে গোড়ার দিকে যা ছিল, সত্যি কথা বলতে কী, সেই তেজ আর নেই। অনেকেই সরে গিয়েছেন। অনেকেই মনে করছেন, আন্দোলন এবার ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। রাতদখলেও সেই স্বতঃস্ফূর্ত ভিড় নেই। তাকে নিছকই মুভমেন্ট ফেস্টিভ্যাল বললে অত্যুক্তি হয় না। কেননা ধীরে ধীরে বিচারের দাবি হারিয়ে তা পাঁচ কাসুন্দিতে পর্যবসিত হয়েছে। রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বাম আমলের থেকে অনেক উন্নত হয়েছিল। এই আন্দোলন সেই পরিকাঠামো ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল। সেই অবস্থানে ফিরতে আবার অনেকটা সময় লাগবে। তার মূল্য দিতে হবে সাধারণ মানুষকে, সেটা খুদে ডাক্তারদের বোঝা উচিত। পাঁচ কাসুন্দির উস্কানিতে তা যেন ফের দিশাহীন না হয়ে যায়। বাংলাজুড়ে উৎসবের চালচিত্রে সার্থক হোক সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। অঙ্গনজুড়ে আঁকা হোক সকলের বিবেকী আলপনা।