বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ

নীতিহীন সমাজে নৈতিকতার আস্ফালন
সন্দীপন বিশ্বাস

একটি মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। তার পাশে একটি ডায়েরি পাওয়া যায়।  সেই কেসের তদন্তে পদ্মপুকুর থানা থেকে আসেন সাব ইনসপেক্টর তিনকড়ি হালদার। চন্দ্রমাধব সেনের অভিজাত পরিবারের কেউ কেউ অসহায় মেয়েটির আত্মহত্যার ঘটনার সঙ্গে পরোক্ষভাবে যুক্ত কি না, তারই তদন্তে এসেছেন তিনকড়ি। একে একে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, সেই পরিবারের প্রত্যেকেই কমবেশি মেয়েটির আত্মহত্যার পিছনে প্ররোচনার কাজ করেছেন। তিনকড়ি হালদার চলে যান তাঁর তদন্তের কাজ শেষ করে। সেন পরিবার থেকে ফোন করা হয় পদ্মপুকুর থানায়। সেখান থেকে বলা হয় ওই নামে কোনও ইনসপেক্টর তাঁদের ওখানে নেই। তাহলে ওই লোকটা কে? প্রত্যেকটি চরিত্রই উপলব্ধি করতে থাকেন, আসলে তিনকড়ি হালদার হলেন তাঁদের প্রত্যেকের বিবেক। নিজেদের অজান্তে আমরা প্রতি মুহূর্তে যে অন্যায় করে চলেছি, তিনকড়ি হালদার আমাদের বিবেকি সত্তাকে জাগ্রত করে সেই অপরাধ মনস্কতাকে চিনিয়ে দিয়ে যায়। জে বি প্রিস্টলির ‘অ্যান ইনসপেক্টর কলস’ নাটকের বাংলা রূপান্তর ‘থানা থেকে আসছি’ সিনেমার কাহিনি উপরের অংশটি। তিনকড়ি হালদারের ভূমিকায় চলচ্চিত্রে উত্তমকুমার এবং মঞ্চে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। 
আর জি করের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত বিচার করে ‘থানা থেকে আসছি’র প্রসঙ্গটা মনে এল।  কেননা আর জি করের ঘটনা মোটেই কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দেশজুড়ে অসুস্থ সংস্কৃতি ও দুর্বিনীতদের যে দাপট চলছে, এই ঘটনা তারই একটা ফল। এই ঘটনাকে শুধু পশ্চিমবঙ্গের ঘটনা বলে চিহ্নিত করলে হবে না। এমনই ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে দেশের নানা প্রান্তে।  কখনও হাতরাসে,  কখনও কাঠুয়া, উন্নাওয়ে কিংবা বদলাপুর, কনৌজ, দিল্লি, হায়দরাবাদ, গুজরাতের নারোদা পাটিয়া, গোধরা, এমনকী প্রধানমন্ত্রীর কেন্দ্র বারাণসীতেও। ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর রেকর্ড বলছে, ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে সারা দেশে ১৫৫১ জনকে ধর্ষণের পর খুন করা হয়েছে। সুতরাং এই দেশ আজ যেন ধর্ষকদের এক উল্লাসভূমি। সর্বত্র তারা আজ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কেন অপরাধীদের এমন বাড়বাড়ন্ত? আসলে সরকার যদি নিজেই ধর্ষকদের প্রশ্রয় দেয়, তাদের মাথায় বরাভয়ের হাত রাখে, তবে কে কাকে পরোয়া করবে! গোধরায় বিলকিস বানো ধর্ষণ মামলায় সাজাপ্রাপ্তরা সমাজে যদি ঘুরে বেড়ায়, ব্রিজভূষণের মতো অভিযুক্তরা যদি রাজনৈতিক ঘেরাটোপে নিশ্চিন্তে বাস করেন, তবে কে আটকাবে? আইআইটি বেনারস হিন্দু ইউনির্ভাসিটি ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীকে গণধর্ষণ মামলায় দু’জন জামিন পাওয়ার পর তাদের মালা দিয়ে সংবর্ধনা দেন বিজেপি ছাত্রনেতারা। আইন সর্বত্র পৌঁছতে পারেনি। সুতরাং শাসকের প্রশ্রয়ে এই দেশ হয়ে উঠেছে ধর্ষক এবং নিপীড়কদের মৃগয়া ক্ষেত্র। কলকাতা জুড়ে যে বিচারের দাবি, তা সঙ্গত। সেটা একই সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ুক মণিপুর, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, হিমাচল প্রদেশেও। মানুষ চান, সব ঘটনাকে ধিক্কার জানিয়ে বিবৃতি দিন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। দেশের অভয়াদের জন্য তাঁর প্রাণ অবশ্যই কেঁদে ওঠে। আমাদের প্রার্থনা, কান্না ও তার প্রকাশে যেন ভেদ-ভাবনা না থাকে।  
আজ সত্যিই আমরা খুব উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছি।  চারিদিকে তাকালেই আমরা শুধু দেখি নারীত্বের অবমাননা। বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, কর্মক্ষেত্রে, স্কুল-কলেজে এবং বলতে লজ্জা হয় রাজভবনেও মেয়েরা আজ নিরাপদ নন। অভিযোগ, কলঙ্কের কাদা লেগে গিয়েছে এ রাজ্যের রাজ্যপালের পোশাকেও। অভিযোগকারিণী সেখানে অসহায়, কেননা অভিযুক্ত রাজ্যপাল মশাই রাষ্ট্রের রক্ষাকবচ নিয়ে বসে আছেন? অভিযোগ মিথ্যা হতে পারে বা সত্যি হতে পারে, কিন্তু তার বিচার হবে না? কিংবা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের বিরুদ্ধেও উঠেছিল এমন অভিযোগ। সমাজের উপরতল থেকে নিচুতল পর্যন্ত আজ কলুষিত। শূন্য হয়ে গিয়েছে আমাদের নৈতিক বোধ। সমাজে অসুস্থদের দাপাদাপি। 
বলিউডের দিকে তাকান, বড় বড় অভিনেতা কিংবা পরিচালকরা শ্লীলতাহানির ঘটনায় অভিযুক্ত। মধুর ভাণ্ডারকর, সাইনি আহুজা, রাজেশ খান্না, আদিত্য পাঞ্চোলি, ওম পুরী সহ আরও অনেকের নাম জড়িয়েছে। টালিগঞ্জের অনেক অভিনেত্রী তো স্বীকারও করেছেন, তাঁরা নানা সময়ে কাস্টিং কাউচের শিকার। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁদের অনেকেই কাজের লোভে এটাকে প্রশ্রয় দিয়ে গিয়েছেন। এটা অন্যায় নয়? সেই অভিনেত্রীরা সেদিন প্রকাশ্যে অপরাধীর বিরুদ্ধে ‘বিচার’ চাননি। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, বহুদিন পর শ্লীলতাহানির অভিযোগ তোলা হচ্ছে। কেন?
মানুষ অধ্যাত্মপথের সন্ধানে ধর্মগুরুর কাছে যান। কিন্তু ক’জন পারেন সেই পবিত্র মার্গের সন্ধান দিতে? উল্টে সেই গুরুই হয়ে ওঠেন ভক্ষক। আশারাম বাপু, রাম রহিম, স্বামী চিন্ময়ানন্দ, দাতি মহারাজ, আশুভাই গুরুজি সহ অন্তত পঞ্চাশ জন হিন্দু সাধুসন্ত  এই ধরনের মামলায় অভিযুক্ত। তাঁদের অনেকেই জেল খাটছেন। এঁরা তাঁদের ভক্তদের কাছে ‘গডম্যান’ বলে পরিচিত। কিন্তু তাঁরা কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে রাক্ষসেরও অধম।   
বহু রাজ্যের এমএলএ এবং এমপি নারী নির্যাতনে অভিযুক্ত।  নির্বাচনে প্রার্থীদের জমা দেওয়া এফিডেভেট থেকে জানা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে সারা দেশে মোট ১৫১ জন বিধায়ক এবং এমপির বিরুদ্ধে নারীনিগ্রহ ও যৌন লাঞ্ছনার অভিযোগ আছে। এঁদের মধ্যে সব থেকে বেশি প্রতিনিধি আছে বিজেপির। তাদের দলের অভিযুক্ত জনপ্রতিনিধির সংখ্যা ৫৪ জন। কংগ্রেসের ২৩ জন, তেলুগু দেশম পার্টির ১৭ জন। ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত আছেন বিজেপির পাঁচজন এবং কংগ্রেসের পাঁচজন।  হে পাঠক, একবার চোখ বুজে কল্পনা করুন, দেশে নারীর নিরাপত্তা আনার জন্য বিল তৈরি হচ্ছে, সেখানে এঁরাই সংসদে দাঁড়িয়ে সমাজে নারী মাহাত্ম্যের ব্যাখ্যা দেবেন! 
পিছিয়ে নেই শিক্ষক বা অধ্যাপকরাও। তাঁদের অনেকেই ছাত্রীদের শ্লীলতাহানির ঘটনায় অভিযুক্ত। স্কুলে নাবালিকাকে যৌন লাঞ্ছনার অভিযোগে বহু শিক্ষক অভিভাবকদের হাতে গণপিটুনি খেয়েছেন, এমন ঘটনাও আমাদের দেশে বিরল নয়।  যাদবপুর, কলকাতা বা কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাঙ্গনেও ছাত্রীদের দিকে নোংরা, লোলুপ হাত বাড়িয়ে দিতেও কোনও কোনও অধ্যাপকের শিক্ষিত হৃদয় কাঁপেনি!  
আসলে সর্বত্রই এক নীতিহীন শিক্ষার সম্প্রসারণ চলছে। আর আমরা প্রকাশ্যে নৈতিকতার আস্ফালন করে নিজেদের সাধুপুরুষ প্রমাণ করার চেষ্টা করে চলেছি। আমাদের দেশে প্রতি ১৬ মিনিটে একটি করে মেয়ে ধর্ষিতা হন। তাহলে ভরসাযোগ্য কারা? এই সমাজে মেয়েদের সম্মান রক্ষা করবে কে? পরিবার? সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ৬০ শতাংশ শিশুকন্যা ও কিশোরী পরিবারের সদস্যদের থেকেও নিরাপদ নন। হিন্দি ছবি ‘দামিনী’র কাহিনিটা কি মনে পড়ছে? আজ যা অবস্থা, রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটকে রঘুপতির সংলাপটা একটু বদলে দিয়ে বলা যায়, ‘এ জগৎ মহা ধর্ষশালা।  জানো না কি প্রত্যেক পলকপাতে ধুলায় লুটায়ে যায় অজস্র নারীর সম্মান, সে কাহার খেলা?’ 
অভয়া কাণ্ডে আন্দোলন চলছে। চলছে সিবিআই তদন্তও। আসলে আমাদের দেশে বিচার প্রক্রিয়া অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ। তবু আমাদের ভরসা রাখতেই হবে। সুস্থ মাথায় ভাবতে হবে আন্দোলনের আবেগে যেন একজন রোগীরও প্রাণ না যায়। আন্দোলন যেন আমাদের বিবেকহীন না করে তোলে। একটা মৃত্যুর পরোক্ষ বদলা আর একটা মৃত্যু হতে পারে না। আমাদের নিজেদের বিচারক সাজলেও হবে না, সেটা বিচার ব্যবস্থার হাতেই ন্যস্ত করতে হবে। 
সেই সঙ্গে মনে রাখা দরকার, আজ আমাদের ছোটবড় সকলের হাতে হাতে ঘুরছে স্মার্টফোন। সব ফোনেই আছে ইন্টারনেট কানেকশন। সেই স্মার্ট ফোন থেকে নীল ছবির জগতের দূরত্ব মাত্র কয়েক সেকেন্ডের। এই সুলভ প্রাপ্তি আমাদের মধ্যে বিকৃতি বাড়াচ্ছে, উদ্ধত ও বেপরোয়া করে তুলছে। এই অনায়াস অশ্লীল ছবির জগৎ আমাদের মধ্যে অপরাধ তৃষাকে অনিবার্য পরিণতির দিকে যেন সম্মোহনের মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সরকার কি এইসব পর্নসাইট বন্ধ করতে পারে না? যে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় স্কুলস্তরে যৌন শিক্ষা দিতে গেলে ‘গেল গেল’ রব ওঠে, নীতিবাগীশরা লাফিয়ে ওঠেন, ‘না না না’ বলে, যে দেশে নাবালিকা বিয়ের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, যে দেশে নাবালিকা ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটে চলেছে, সেখানে সরকারকে সমস্ত পর্নসাইট বন্ধ করতেই হবে। এই সব কিছু আমাদের পাপাচারের ফল। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘এ আমার পাপ, এ তোমার পাপ।’ অর্থাৎ যে সমাজে আমি আছি, সেই সমাজের ভালো-মন্দ সব কিছুর দায় কণিকা মাত্র হলেও আমার উপরে বর্তায়। শুধু বিচারের দাবি করলেই আন্দোলন শেষ হয়ে যায় না। তারপরেও থেকে যায় অনেক কিছু।  শেষের পরেও থাকে আর একটা শুরু। এবার আন্দোলন হোক দেশে পর্নসাইট বন্ধ করার জন্য। তাতে বিকৃতি কমবে, অসুস্থ সংস্কৃতির মাত্রা কমবে। আগামী প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে আমরা সকলেই যেন সুস্থ সংস্কৃতির উপভোক্তা হয়ে উঠতে পারি।
4Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি প্রচেষ্টায় সাফল্যের সম্ভাবনা। ন্যায্য অর্থ সঠিক সময়ে নাও পেতে পারেন।  অর্থপ্রাপ্তির যোগ...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৫.৮৩ টাকা৮৭.৫৭ টাকা
পাউন্ড১০৪.০৫ টাকা১০৭.৭৪ টাকা
ইউরো৮৭.৩০ টাকা৯০.৬৫ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা