রাত শুনশান। প্রেসিডেন্সি জেলের সব কুঠুরির আলো নিভে গিয়েছে। সেখানেই একটি কোণে তখনও বিনিদ্র জেগে বিমল (নাম পরিবর্তিত)। নিজের তুতো দাদাকে খুনের অপরাধে জেল খাটছে। যদিও জটিল এই খুনের কেসে বিমল ধৃত হওয়ায় অবাক হয়েছিল তার আত্মীয় পরিজন। ছোটবেলা থেকে শান্ত, নম্র, পড়াশোনায় মতি থাকা ছেলেটা খুনি, একথা কেউ ভাবতেই পারেনি! বিমলের নিজেরও অবাক লাগত খুনের পর পর। এখন আর লাগে না। এই দাদার ও খুবি ন্যাওটা ছিল। তারপর বড় হতে হতে ওর মাথার মধ্যে সব কেমন যেন গুলিয়ে যেতে লাগল। একটা অন্য মানুষ হয়ে উঠল বিমল। যদিও এই অন্য মানুষ হয়ে ওঠার পর্ব সচেতনভাবে টের পায়নি নিজেও। সকলের প্রতি একটা রাগ, ওর মায়ের প্রতি জ্যাঠা-কাকাদের অপমানজনক মন্তব্য, বাবার বাজে ব্যবহার, ঠাকুরমার অত্যাচার সব মিলিয়ে নিজেদের বাড়িটাকেই আর ভালো লাগে না! নিজের মনটাকেই আর চিনতে পারে না।
অপরাধীর মনের তল
একটা সময় ছিল যখন অপরাধবিজ্ঞানকে ‘সামাজিক’ কারণ বলে ধরা হতো। এতে যে জৈব বিষয়ও মিশে আছে, তা শিকার করা হতো না। ইদানীং সমাজতত্ত্ব ছাড়াও এটা যে জৈববিজ্ঞানেরও বিষয়, তা গুরুত্ব পাচ্ছে। পূর্ববর্তী সময়ে মনে করা হতো, অপরাধী সে-ই হবে, যার মনে এমপ্যাথির অভাব বা অনুভূতি বোঝার ক্ষমতা কম, সঙ্গে যোগ হবে সঙ্গদোষের প্রভাব। এছাড়াও থাকবে অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতা। এই তিনটি বৈশিষ্ট্যকেই অপরাধী তৈরির মূল ‘কারিগর’ বলে ধরে নেওয়া হতো। বেড়ে ওঠার পরিবেশ ও বাড়ির পরিস্থতিকে এই প্রক্রিয়ায় অনুঘটক বলে ধরে নেওয়ার চল ছিল। তার সঙ্গে আর কিছু জড়িত বলে ভাবা হতো না।
তবে এই ধ্যানধারণা বর্তমানে আমূল পাল্টেছে। সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার পাশে উঠে এসেছে বেশ কিছু গুরুতর বায়োলজিক্যাল কারণ। এর মধ্যে জিনের প্রভাব যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন মায়ের জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার প্রভাবও। আধুনিক অপরাধবিজ্ঞানের দাবি, কোনও মা যদি ধূমপায়ী বা মদ্যপায়ী হন বা অন্য কোনও মাদকের নেশা করেন, তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁর সন্তানের মস্তিষ্কের ওজন স্বাভাবিক হয় না। এর সঙ্গে যদি জিনগত প্রভাব থাকে, তাহলে সেই সন্তানের অপরাধপ্রবণ হওয়ার ঝুঁকি বেশি। দেখা গিয়েছে, এসব রোগীর অর্বাইটো ফ্রন্টাল কর্টেক্স বা ওএফসি দুর্বল হয়। তাই তাঁরা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এঁদের মস্তিষ্কের ডিএলপিএফসি অংশও দুর্বল হতে পারে। ফলে নীতিশিক্ষা গ্রহণের মানসিকতা কমে যায়। তাদের মনের মধ্যে সবসময় প্রতিশোধস্পৃহা, অল্পেই আহত হয়ে আঘাত করার প্রবণতা, অবাধ্যতা, দুর্বিনীতভাব ও অন্যের ক্ষতি করে বা তাকে মেরে ফেলে আনন্দ পায়।
জিনের খেলা
নানা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মাও-এ (এমএও-এ) জিনের একটি বিশেষ টাইপ মানুষের শরীরে থাকলে তার অপরাধী হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। তবে সে স্নেহ-ভালোবাসা ও ইতিবাচক পরিবেশে বড় হলে এই বিশেষ জিনের প্রভাব সে কাটিয়ে উঠতে পারে। আবার এই মাও-এ জিনেরই আর একটি টাইপের প্রকাশ কারও শরীরে অতিরিক্ত বেশি পরিমাণে থাকলে, সে যতই খারাপ পরিবেশে বড় হোক না কেন, অপরাধপ্রবণ হবে না। সুতরাং পরিবেশ ও জিন উভয়েই অপরাধী তৈরি করার নেপথ্যে ভূমিকা পালন করে।
পরিবেশে ভিলেন কারা
জিনগতভাবে অপরাধী হয়ে ওঠার ঝুঁকি রয়েছে, এমন কোনও ব্যক্তির বেড়ে ওঠার পরিবেশ তার জীবনে বড় ভূমিকা পালন করে। সেই পরিবেশে যদি এমন কিছু থাকে, যা তাকে মানসিকভাবে উত্যক্ত করে ভিতরের রিপুগুলিকে উসকে দেয়, তাহলে তারা অপরাধী তৈরি করার পথ আরও প্রশস্ত করে। যেমন— উপেক্ষা ও অবহেলা, শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার, হিংসা ও অশান্তি দেখতে দেখতে বড় হওয়া, মদ্যপ বা মাদকাসক্ত বাবা-মা। এছাড়াও কিছু অসুখ অপরাধ করার দিকে ঠেলে দেয়।
এছাড়া অ্যাটেনশন ডেফিসিট/ হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিজঅর্ডার (এডিএইচডি), অপারেশনাল ডিফিয়্যান্ট ডিজঅর্ডার (ওডিডি), কনডাক্ট ডিজঅর্ডার (সিডি), সিজোফ্রেনিয়া এসব অসুখ থেকেও অপরাধী হওয়ার প্রবণতা বাড়ে।
যখন অসুখ দায়ী
অ্যাটেনশন ডেফিসিট/ হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিজঅর্ডার (এডিএইচডি): পড়াশোনায় অমনোযোগের সঙ্গে অতিরিক্ত অ্যাক্টিভ (সক্রিয়) এবং অতি আবেগের মতো লক্ষণ কিছু শিশুর মধ্যে দেখা যায়। সমস্যাগুলি এডিএইচডি রোগে আক্রান্তর উপসর্গ হতে পারে। এসব শিশু বেশিরভাগ সময় ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ করে। চট করে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। যেহেতু রাগ, ক্ষোভ, দ্বেষ সবই একধরনের আবেগ, তাই এদের মধ্যে অপরাধী হয়ে ওঠার শঙ্কা থেকে যায়।
অপারেশনাল ডিফিয়্যান্ট ডিজঅর্ডার (ওডিডি): যেসব শিশুর এই সমস্যা আছে তারা প্রায়ই তাদের বাবা -মা, বন্ধু বা বাইরের কোনও ব্যক্তির প্রতি আক্রমণাত্মক এবং অসহযোগী মনোভাব পোষণ করে। প্রায়ই তাদের আচরণের কারণে তাদের চ্যালেঞ্জের কারণ হয়ে ওঠে। তাদের বৃদ্ধিও অন্যদের তুলনায় কম।
কনডাক্ট ডিজঅর্ডার (সিডি): শিশু অথবা বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর-কিশোরীর মধ্যে যখন প্রায় নিয়মিত মারাত্মক রকমের আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়, তখনই চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় তাকে কনডাক্ট ডিজঅর্ডার বলে। এই সমস্যায় বাড়ির সদস্য-সহ পোষ্যরাও শিশুটির দ্বারা অত্যাচারিত হতে পারে। খুব হিংস্র হয়। সামাজিক বেঁধে দেওয়া নিয়ম মানতে চায় না।
সিজোফ্রেনিয়া: প্রাথমিক পর্যায়ে সিজোফ্রেনিয়ার চিকিত্সা না করানো হলে তা ক্রনিক সমস্যা হয়ে উঠতে পারে। কোনও অভিজ্ঞতার ফলে অত্যধিক মানসিক চাপ থেকে এই রোগ হতে পারে বলে মনে করা হয়। এ ছাড়াও বংশগত কারণ, মস্তিষ্কে রাসায়নিকের ভারসাম্যের অভাব, অনেক সময় ভয়াবহ ভাইরাল ইনফেকশন থেকেও হতে পারে সিজোফ্রেনিয়া। রোগাক্রান্তদের কল্পমনে ভেসে ওঠে কারও অবয়ব বা কণ্ঠস্বর। তাঁরা হ্যালুজিনেট করতে থাকেন কারও চেহারা বা কণ্ঠস্বর। তাদের কেউ যেন হয় তাকে ভয় দেখাচ্ছে, নয়তো আঘাত করছে। রোগী মনে করে সবসময়ই তাঁকে নিয়ে কেউ ষড়যন্ত্র করছে। এমনকী, নিজের মানুষদেরও শত্রু ভাবতে পারে সে। রোগী কী করছেন, কেন করছেন কিছুই তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এঁরা প্রায়ই ভায়োলেন্ট বা হিংস্র হয়ে উঠতে পারেন। এছাড়া কোনও ব্যক্তি নেশাগ্রস্ত হলে, বৌদ্ধিক সমস্যায় আক্রান্ত হলেও অপরাধপ্রবণ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। একজন অপরাধীর মনের হদিশ লুকিয়ে থাকে এসব নানা ফ্যাক্টরের মধ্যেই। শুধুই জিন বা একা পরিবেশ কোনও অপরাধপ্রবণতাকে উসকে দিতে পারে না। বরং জিন ও পরিবেশ দুই মিলিয়ে অপরাধীর মনের ভিত তৈরি করে।
লিখেছেন মনীষা মুখোপাধ্যায়