বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ

অচলাবস্থায় ক্ষতি সরকারের নয়, মানুষের
শান্তনু দত্তগুপ্ত

চিত্র ১: বিশ্বাসবাবু কাল মিছিলে গিয়েছিলেন। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই। বেসরকারি এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তিনি। না গেলে আর হচ্ছিলও না। কলেজের ছেলেমেয়েগুলো বাঁকা চোখে তাকাচ্ছিল। ওরা রোজই প্রায় হাজিরা দিচ্ছে স্বাস্থ্য ভবনের অবস্থানে। অবশ্য ক্লাস সেরে। এত কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা টিউশন ফি দিচ্ছে... ক্লাস না করে শুধু আন্দোলন করলে ওদের বাবা-মায়েরাও কি ছেড়ে দেবে? আরও কয়েকজনকে বিশ্বাসবাবু চেনেন... তাঁরাও আন্দোলনে যাচ্ছেন। একজন আবার তাঁদের মধ্যে সরকারি কর্মীও। সই করে চলে আসছেন অবস্থানে। পরে আবার ঢুকে মুখ দেখিয়ে কাজ সেরে ফেলছেন। মাসের শেষে এঁদের সবার মাইনে পাকা। পেটে কিল মেরে এঁদের কেউ আন্দোলনে নেই। পেট ভরছে, প্রতিবাদ হচ্ছে, আবার স্টেটাসও থাকছে। তাই বিশ্বাসবাবুও গিয়েছিলেন ‘আন্দোলনে’। বৃষ্টি ভিজে ফিরেছেন। তারপর থেকেই নাক ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ, আর গায়ে ঘুসঘুসে জ্বর।
চিত্র ২: রিনা সাউ আর যাবেন না মিছিলে। সেবার ওই লাল পার্টির লোকজন নিয়ে গিয়েছিল। বাড়ি বাড়ি কাজ করে, এমন অনেকেই ছিল ওদিনের মিছিলে। এমন একটা পোস্টারও বানিয়ে দিয়েছিল পার্টি থেকে। কিন্তু দুটো কাজের বাড়ি সেদিন যেতে পারেননি রিনা। খুব মুখ করেছিল। আর যাবেন না রিনা। যদি কাজ চলে যায়, টাকা কি ওরা দেবে?
চিত্র ৩: একের পর এক ফোন ঘুরিয়ে যাচ্ছেন ভদ্রলোক। বড়বাজারে তাঁর শাড়ির পাইকারি দোকান। দেড় লক্ষ টাকার মাল তুলেছেন। অন্য বছর এর থেকে বেশিই তোলেন। অন্তত আরও দু’বার স্টক ঢুকে যায় বিশ্বকর্মা পুজোর মধ্যে। এবার প্রথম লটের স্টকই শেষ হচ্ছে না। গোডাউন ভর্তি মাল। যারা শাড়ি নেয়, তাদের ফোন করেও লাভ হচ্ছে না। কেউ নিতে চাইছে না। কারণ, বিক্রি নেই। লোকে নাকি কিনতে চাইছে না। মাথা কাজ করছে না ভদ্রলোকের। গোটা বছর এই সময়টাই তো ব্যবসা হয়। আর কিছুটা পয়লা বৈশাখের আগে। কিন্তু পুজোর বাজার যদি এভাবে মার খায়, সারা বছর চলবে কীভাবে! এত টাকা দেনা... সুইসাইড করা ছাড়া গতি থাকবে না।
অভয়ার জন্য ন্যায় বিচার। পাঁচ দফা দাবি। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আমূল বদল। পুলিস কমিশনারের পদত্যাগ। এই সবই সমাজের ‘ভালোর জন্য’। মানুষের জন্য। আর এখানে মানুষ একটু ‘ত্যাগ’ করবে না? কী হয় এক বছর উৎসব না করলে? নতুন জামা না কিনলে? অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন। কিন্তু এই ত্যাগ কি আমাদের সমাজের সব শ্রেণির ‘অ্যাফোর্ড’ করার ক্ষমতা আছে? পারবে তো তারা বহন করতে? কোভিডের ঘা এখনও শুকায়নি। আমরা পদে পদে টের পেয়েছি কাজ না থাকার... ব্যবসা না থাকার যন্ত্রণা। অগ্নিমূল্য জিনিসপত্রের দাম, অবসাদ, আত্মহত্যা। আমরা কি সেগুলো এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলাম? যে ভদ্রমহিলা আন্দোলন মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছেন, এখন আমাদের অশৌচ। মাথায় তেল বা শ্যাম্পুও দেব না। তিনিই তারপর দেওয়াল ভরিয়ে দিচ্ছেন তাঁর পার্লারের বিজ্ঞাপনে। চেপে ধরলে বলছেন, ওটা তো আমার পেশা। ম্যাডাম এবং সেই সঙ্গে আম জনতার থেকে ত্যাগের প্রত্যাশী প্রত্যেক স্যারের জন্য একটা প্রশ্ন রইল, আপনাদেরটা পেশা। আর বাকিদেরটা? মাস গেলে আপনাদের বেতন বা ব্যবসা থেকে উপার্জন নিশ্চিত থাকবে, আর যাঁরা এই পুজোর সময়টাকে আঁকড়ে সারা বছরের জন্য বাঁচেন? তাঁদের দোষ কী? আপনি লক্ষ লক্ষ মানুষকে নতুন জামা কিনতে বারণ করছেন। কিন্তু সেই বারণের জন্য কত হাজার গরিব মানুষের পেটে লাথি মারা হচ্ছে, সেই হিসেব কে করবে? এই প্রশ্ন তোলার জন্য হয়তো এই অধম প্রতিবেদককে আন্দোলনের বিরোধী বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, আন্দোলনকারী এবং সরকার ছাড়াও এখানে আর একটা পক্ষ রয়েছে—সাধারণ গরিব মানুষ। এই পক্ষে থাকার জন্য যে কোনও বিশেষণই গায়ে মাখা যায়। অচলাবস্থার জন্য তাঁদের ভোগান্তি, যন্ত্রণা, হতাশা এবং দূর ভবিষ্যতের আশঙ্কায় তিলে তিলে মৃত্যুর অপেক্ষা... এটাই কিন্তু আজকের ছবি, যা দেখতে পাচ্ছি না আমরা। বা দেখেও দেখছি না। আন্দোলনকারীরা হয়তো ভুলে যাচ্ছেন, অচলাবস্থায় সরকারের ক্ষতি হয় না। ক্ষতি হয় সাধারণ গরিব মানুষের। সেটাই এখন চোখে আসছে না। তাই স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় যখন ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ প্ল্যাকার্ড হাতে আন্দোলনের মাঝে উপস্থিত হন, তখন তাঁর প্রতি উচ্ছ্বাসের বিস্ফোরণ ঘটছে। কিন্তু যখন তিনি তাঁর আসন্ন ছবির প্রচার করেন, সেই স্বস্তিকাই হয়ে ওঠেন ‘আন্দোলনের শত্রু’। কেন? কী অপরাধ করেছেন তিনি? সিনেমা তো তাঁর পেশা! তাঁর উপার্জনের পথ। ইমন, লোপামুদ্রা, সৃজিত... এঁদের সবার। এখন অশৌচ চলছে, তাই কাজ বন্ধ রাখুন... এটা কি বলা যায়? নাকি বলাটা মানবিক? স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় যদি তার জন্য বলেন, ‘খালি পেটে বিপ্লব হয় না সাথী! ভাতের জন্যও লড়তে গেলে স্বাদ জানতে হয়। তাই যদি বেঁচে থাকার পন্থাকে আপনারা নিন্দা করতে শুরু করেন, তাহলে খুনের জন্য বিচার চাওয়াটা হিপোক্রেসি নয় কি?’... কোন কথাটা ভুল বলেছেন তিনি। সমাজ এবং সরকারের পা যাতে নড়ে না যায়, তার জন্য প্রতিবাদ প্রয়োজন। জল মাথার উপর উঠে গেলে চাই আন্দোলনও। ঠিক যেভাবে ইন্দিরা গান্ধীর ইমার্জেন্সির বিরুদ্ধে খেপে উঠেছিল মানুষ। কিন্তু দেখতে হবে, আমার বিপ্লব যেন সমাজের খেটে খাওয়া, পিছনের সারির মানুষগুলোকে খাদের কিনারায় ঠেলে না দেয়। আন্দোলনে আমি যোগ দেব। কাজ করে, নাকি কাজ ফেলে... সেটা সম্পূর্ণ আমার নিজের সিদ্ধান্ত। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে আমি পারি না। মুখে আমরা গণতন্ত্রের কথা বলব। সিস্টেম নিয়ে মতামত জানাব। পুরসভায় বা সরকারি দপ্তরে কোনও কাজে গেলে আবার আমরাই অফিসারের হাতে কিছু গুঁজে দেব। কাজ মিটে গেলে বলব, সব দুর্নীতিবাজ। এখনই বিপ্লব চাই। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যে সব দাবি ছাত্রসমাজ তুলেছে, তার সমাধান প্রশাসনিক দিক থেকে‌ই সম্ভব। শুধুমাত্র রাজনীতি জিইয়ে রাখার জন্য সেই উদ্যোগ বারবার মাঠে মারা গিয়েছে। কাজে ফেরার কথা, আলোচনার কথা বহুদিন ধরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন। ৯ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর রাজ্য সরকার আরও বেশি নমনীয়তা দেখিয়েছে। বারবার চিঠি দিয়ে আন্দোলনকারীদের আসতে বলা হয়েছে। কখনও নবান্নে, কখনও কালীঘাটে। কিন্তু শর্তের ঠেলায় বারবার প্রশাসনের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এসেছে আলোচনার আবহ। কথায় বলে, অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট। তারপরও মুখ্যমন্ত্রী সোমবার জুনিয়র ডাক্তারদের ডেকেছেন বৈঠকে। ছাত্র হোক বা সমাজ, একটা বিষয় বুঝতে হবে—যে দাবি তাঁরা করছেন, তার কোনওটাই মিটে যাওয়া একদিনে সম্ভব নয়। শুরুটা করা যায়। আজ, এই মুহূর্তে। সেটা রাজ্য সরকার করেছে। আন্দোলনে গলা মেলানো এক সেলেবও কিন্তু বলেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে নমনীয়তার সঙ্গে আন্দোলনের সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছে, তা প্রশংসনীয়। অন্য কোনও রাজ্যে এমন হয় না।’ তাঁর মন্তব্য টেনেই বলা যায়, ঠিক এই কারণে কোথাও আন্দোলনও এভাবে দানা বাঁধে না। তার কোমর ভেঙে দেওয়া হয়।
লোকসমাজ থেকে উঠে এলেই একমাত্র প্রতিবাদ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ছাত্রদের মধ্যে গড়ে ওঠা প্রতিবাদ আজ সাধারণ মানুষের কণ্ঠ পেয়েছে। কারণ কিন্তু ওই মেয়েটা। আমার, আপনার, সবার ঘরে আছে অভয়া। তাঁর এই মর্মান্তিক মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি লোকসমাজ। তারা আজও আছে জুনিয়র ডাক্তারদের এই আন্দোলনে। ঩বিচার চাইছে তাঁর জন্য। গ্রামেগঞ্জে না হলেও, অন্তত কলকাতা শহরে তো বটেই। কিন্তু রাজনীতি, ক্ষমতার লড়াই, ডিএসও, পিডিএস... এসব দেখার পর তাঁরা থাকবে তো? যখন জানতে পারবে, কোনও আন্দোলনকারী মেডিক্যাল রাজনীতিতে পা মজবুত করার জন্য আবার কেউ আইএমএ’তে তাঁর পরম পরিজনের জায়গা পাকা করার জন্য লড়ছেন... এই ভালোবাসা বা শ্রদ্ধা থাকবে? বামেরা ভাবছে, দারুণ ইস্যু পেয়ে গিয়েছি। এটা হাতছাড়া করা যাবে না। সামনে বড়সড় নেতৃত্ব কেউ আসছে না। পিছন থেকে সাংগঠনিক সাপোর্ট দিয়েই বাজিমাত হবে। ভোট আসবে আমাদের ঝুলিতে। বিজেপি ভাবছে, যেমন চলছে চলুক। এতে তৃণমূলের ভোট কমবে। আর তখনই মেরুকরণটা হবে। কারণ, মুসলিম ভোট সিপিএমের দিকে যাওয়ার পরিস্থিতিই নেই। গেলে সামান্য অংশ। বাকি রইল হিন্দু ভোট! তৃণমূল থেকে সরলেও সেটা সিপিএমের দিকে যাবে না। কারণ, গত তিন বছর ধরে তাদের সাম্প্রদায়িক ঘেঁষাঘেঁষি। যদি দু’-তিন শতাংশ হিন্দু ভোটও গেরুয়া শিবিরে চলে আসে, তাতে কেল্লা ফতে বিজেপির। 
ভিড় বাড়ছে হাসপাতালের আউটডোরে। মরিয়া হয়ে উঠেছেন গরিব মানুষ। ৫ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে হলেও ডাক্তার দেখাতে হবে। ভর্তি না নিক, ওষুধ লিখিয়ে আনতে হবে। অবরোধ, রাস্তা বন্ধের ভয় কাটিয়ে যেতে হবে নিউ মার্কেট, হাতিবাগান বা গড়িয়াহাটে। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই। এটাই সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরের জগৎ। গণতন্ত্র মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয়, মত চাপানোর নয়। তাই প্রতিষ্ঠানের উপর, রাষ্ট্রের উপর ভরসা রাখতেই হবে। দু’বছর পর মানুষই দেখিয়ে দেবে, কে ঠিক ছিল, আর কে ভুল।
4Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পেশাগত উচ্চশিক্ষায় দিনটি বিশেষ শুভ। ধৈর্য ধরে মনোযোগ দিয়ে কাজ করুন সাফল্য পাবেন। অর্থ ও...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৫.৪৮ টাকা৮৭.২২ টাকা
পাউন্ড১০৫.০৯ টাকা১০৮.৮১ টাকা
ইউরো৮৮.৪৭ টাকা৯১.৮৫ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
25th     January,   2025
দিন পঞ্জিকা