সিবিআই, ইডি, ভিজিলেন্স এজেন্সিকে রাজনৈতিক দাসত্ব ছাড়তে হবে। বলেছিলেন দেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এন ভি রামান্না।
২০২২-এর এপ্রিলে ডি পি কোহলি মেমোরিয়াল লেকচার অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তৃতার বিষয় ছিল, গণতন্ত্র, তদন্তকারী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা এবং দায়িত্ব। সেখানেই বলেছিলেন, ‘এই মুহূর্তের দাবি, মানুষের ভরসা আর সামাজিক বৈধতা ফিরে পাওয়া। আর তার জন্য প্রথমেই রাজনৈতিক বন্ধন ছিন্ন করাটাই প্রথম পদক্ষেপ।’ এইটুকু বলেই থামেননি। বলেছিলেন, সিবিআই তার ‘সক্রিয়তা ও নিষ্ক্রিয়তা’-র ফলে নিজের ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ নিয়ে নিজেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। আগে নিরপেক্ষতার জন্য সিবিআইয়ের হাতে তদন্তের ভার দেওয়ার জন্য আদালতে আর্জির পাহাড় জমত। এখন সময়ের সঙ্গে সিবিআই নিজেই আতশকাচের তলায় চলে এসেছে। প্রধান বিচারপতির বার্তা, ‘রাজনৈতিক সরকার সময়ের সঙ্গে বদলে যাবে। আপনাদের প্রতিষ্ঠান পাকাপাকি থাকবে। আপস করবেন না, স্বাধীন হোন। নিয়মের বই মেনে চলুন।’ শুধু এন ভি রামান্নাই নন, এরপর একের পর এক ঘটনায় কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট ক্ষোভ উগরে দিয়েছে। বলেছে, সিবিআই, ইডি আসলে সরকারের তোতাপাখি...।
২০১৯ সালে মোদি দুর্নীতি-বিরোধী প্রশাসনের কথা বলেছিলেন, আর গোটা দেশ দেখেছিল, সিবিআই-এর নম্বর ওয়ান বনাম নম্বর টু-এর লড়াই! অলোক ভার্মার সঙ্গে রাকেশ আস্থানার সংঘাত। একে অন্যের বিরুদ্ধে এক গুচ্ছ অভিযোগ এবং তার জেরেই সিবিআই-এর অন্দরের সংঘাত চলে এসেছিল বাইরে। কানপুরের মাংস ব্যবসায়ী মইন কুরেশির বিরুদ্ধে আয়কর ফাঁকির মামলায় সতীশবাবু সানা নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত করছিল সিবিআই। এই সতীশের কাছ থেকে অলোক ভার্মা দু’কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ আস্থানার। আস্থানার দাবি, সতীশ সানাকে গ্রেপ্তার করে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চেয়ে ২০১৮-র ২০ সেপ্টেম্বর অলোক ভার্মাকে একটি প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু ভার্মা সেই ফাইল চার দিন আটকে রাখেন। সেই সুযোগে দেশ ছেড়ে পালানোর ছক কষতে শুরু করেন সতীশ। কিন্তু তার আগেই তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা লুক আউট নোটিস জারি করে ফেলায় পালাতে পারেননি সতীশ। আস্থানার আরও দাবি, এর পর ৩ অক্টোবর ফের ওই ফাইল পাঠানো হয় সিবিআই ডিরেক্টরকে। কিন্তু সেই ফাইল তিনি সময়ে ফেরত দেননি। মোদি-ঘনিষ্ঠ অফিসার রাকেশ আস্থানা ক্যাবিনেট সচিব আর সিভিসিকে চিঠি দিয়ে সিবিআই প্রধানের বিরুদ্ধে এরকম ১০টি দুর্নীতির অভিযোগ দায়ের করেছিলেন।
তার পাল্টা জবাবে সিবিআই প্রধান অলোক ভার্মা কোটি কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন রাকেশ আস্থানার বিরুদ্ধে। আস্থানার বিরুদ্ধে একটি এফআইআরও দায়ের করেছিল সিবিআই। ওই এফআইআর-এ স্টারলিং বায়োটেক নামে একটি সংস্থার কাছ থেকে কয়েক দফায় ৩ কোটি ৯২ লক্ষ টাকা বেআইনি লেনদেনের অভিযোগ তোলা হয়েছিল। মোট ২৩টি লেনদেন। এই বিপুল অঙ্কের টাকার প্রাপক ‘আরএ’। এফআইআর-এ যাঁকে রাকেশ আস্থানার নামের আদ্যক্ষর বলে উল্লেখ করা হয়। তাছাড়া যে সতীশ বাবু সানার কাছ থেকে অলোক ভার্মা দু’কোটি টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছিল, সেই একই অভিযোগ ছিল রাকেশ আস্থানার বিরুদ্ধেও। অর্থাৎ ঘটনাচক্রে এই সতীশের কাছ থেকে রাকেশ আস্থানাও দু’কোটি টাকা নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ।
এই লড়াইয়ে মোদি সরকারের কাছে পরাজিত হতে হয়েছিল অলোক ভার্মাকেই। তিনি ‘ডক্টর জেকিল’ না ‘মিস্টার হাইড’? রাফাল চুক্তিতে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করতে পারেন বলেই তাঁকে সিবিআই ডিরেক্টরের পদ থেকে সরানো হল? নাকি তিনি নিজেই কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিতে অভ্যস্ত এক দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসার? এই সব প্রশ্নের মধ্যেই অলোক ভার্মাকে ইন্ডিয়ান পুলিস সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছিলেন। বিরোধীদের দাবি, রাফাল চুক্তি তো বটেই, এমন মোট ৭টি ফাইল ভার্মার টেবিলে ছিল। যার তদন্ত হলে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্তাদের মাথায় টান পড়ত। সেই কারণেই তাঁকে সরানো হয়েছিল। শুধু তাই-ই নয়, রাতারাতি শুরু হয়েছিল ভার্মার আস্থাভাজন অফিসারদের বদলির ঝড়। সিবিআই অন্দরের এই কুনাট্যের কোনও কিছুই দেশবাসীর অজানা নয়। সিবিআই সর্বরোগহর, এমন ধারণাই আজ ভ্রান্ত। পেশাদারিত্ব নিয়ে পদে পদেই প্রশ্নের মুখে পড়েছে ‘খাঁচাবন্দি তোতা’!
আর জি কর হাসপাতালে ডাক্তার-ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনার তদন্তের ভার নিয়েছে সেই সিবিআই। কিন্তু প্রায় মাসখানেক ধরে চলা তদন্তে বিশাল কোনও সাফল্য মেলেনি। শুধু বাংলাতেই নয়, সিবিআইয়ের হাতে এমন কয়েক হাজার মামলা পড়ে রয়েছে যার সুরাহা করতে পারেনি দেশের এলিট তদন্তকারী সংস্থা। দেশে শিহরণ জাগানো বেশ কয়েকটি খুনের রহস্যভেদ এখনও করে উঠতে পারেনি সিবিআই। হাল আমলে সিবিআইয়ের ব্যর্থতার সেই তালিকা ক্রমশ বড় হচ্ছে।
ধরুন, ২০০৮ সালের আরুশি তলোয়ার এবং হেমরাজ জোড়া খুনের রহস্য। আরুশি এক চতুর্দশী নাবালিকা। হেমরাজ ছিলেন তলোয়ার পরিবারের পরিচারক। নয়ডার জোড়া হত্যাকাণ্ড বলে বিখ্যাত এই ঘটনায় দু’জনের দেহ বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়। সিবিআইয়ের প্রাথমিক সন্দেহ গিয়ে পড়ে আরুশির বাবা-মা রাজেশ এবং নূপুর তলোয়ারের উপর। নিম্ন আদালত তাঁদের দোষী সাব্যস্ত করে। কিন্তু পরে এলাহাবাদ হাইকোর্টে তাঁরা মুক্তি পেয়ে যান। কারণ হিসেবে আদালত বলেছিল, উপযুক্ত প্রমাণের অভাব। আসল অপরাধীদের আজও চিহ্নিত করা যায়নি। ভারতের অপরাধ ও আইনি ইতিহাসের বিরলতম এই মামলার প্রতিটি ছত্রে প্রমাণিত হয়েছে সিবিআই-এর ব্যর্থতা। ২০১১ সালের সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দে হত্যাকাণ্ড। মুম্বইয়ে অন্ধকার জগৎ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ এই সাংবাদিককে গুলি করে খুন করা হয়। মোটরবাইকে এসে দুষ্কৃতীরা খুব কাছ থেকে তাঁকে গুলি করে। এই খুনে উঠে আসে মুম্বইয়ে কুখ্যাত মাফিয়া ডন ছোটা রাজনের নামও। কিন্তু আদালত শেষমেশ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রমাণাভাবে সিবিআই তদন্তে ইতি ঘটায়।
২০১৩ সালের জিয়া খান মৃত্যুরহস্য। বলিউড অভিনেত্রী জিয়া খানকে তাঁর মুম্বইয়ের ফ্ল্যাট থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় পুলিস একে আত্মহত্যা বলে দাবি করে। কিন্তু জিয়ার মা খুনের অভিযোগ করেন। অভিযুক্ত করা হয় অভিনেতা সুরজ পাঞ্চোলিকে। মুম্বই পুলিস তদন্তে গাফিলতি করছে এই অভিযোগ ওঠায় মামলা পৌঁছায় সিবিআইয়ের হাতে। আজও সিবিআই খুনের দাবির সপক্ষে কোনও উপযুক্ত প্রমাণ তল্লাশ করতে পারেনি। মামলাটি অন্ধকারেই থেকে গিয়েছে।
২০২০ সালের ১৪ জুন বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের দেহ উদ্ধার হয় তাঁর মুম্বইয়ের ফ্ল্যাট থেকে। প্রাথমিক তদন্তে মুম্বই পুলিস জানায়, এটি একটি সাধারণ আত্মহত্যার ঘটনা। কিন্তু, দেশজুড়ে সমালোচনা এবং সংবাদমাধ্যমের শিরোনামের চাপে সেই তদন্তভার যায় সিবিআইয়ের হাতে। আর সেই তদন্ত আজও চলছে। এমনকী তদন্তকারী সংস্থা এখনও সরকারিভাবে জানাতে পারেনি যে, এই মৃত্যু হত্যা না আত্মহত্যা!
পরিসংখ্যান বলছে, বিভিন্ন তদন্তে পশ্চিমবঙ্গ এবং রাজ্যের বাইরে সিবিআই তদন্তের ব্যর্থতার নজির রয়েছে ভূরি ভূরি। ভারতের এই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার সাকসেস রেট মাত্র ৬৫ শতাংশ। তার ব্যর্থতার ইতিহাস বেশ লম্বা এবং হতাশাজনক। প্রতিটি ঘটনায় তদন্তের নামে ছড়িয়েছে একাধিক গল্প। একাধিক অনুমান। তদন্তের স্বার্থে জেলে কাটাতে হয়েছে বহু নিরপরাধ মানুষকে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
ধরুন, মনমোহন সিং সরকারের আমলে ঘটা টুজি দুর্নীতির কথা। ২০১১ সালে মামলা শুরু হয়। প্রাক্তন টেলিকম মন্ত্রী এ রাজা ও ডিএমকে নেত্রী কানিমোঝি-সহ একাধিক অভিযুক্তের বিরুদ্ধে চার্জশিট ফাইল করে সিবিআই। ২০১১ সালে দাখিল করা অভিযোগপত্রে সিবিআই জানায় নিয়মবহির্ভূতভাবে ১২২ স্পেকট্রাম বণ্টন করে ১২২টি লাইসেন্স প্রদান করা হয়। ফলে প্রায় ৩০ হাজার ৯০০ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়। আর তারপর? ২০১৭-র ডিসেম্বর আদালত তিনটে মামলায় ১৬ অভিযুক্তকেই বেকসুর খালাস করে। আদালত সাফ জানিয়ে দিয়েছে, টুজি স্পেকট্রাম বণ্টনে কোনও দুর্নীতিই হয়নি।
বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলায় ৩২ জন অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস করে দিয়ে লখনউয়ের বিশেষ আদালত কার্যত সিবিআইয়ের তদন্ত নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল। ওই মামলার বিচারক সুরেন্দ্রকুমার যাদবের মতে, সিবিআইয়ের যুগ্ম অধিকর্তা, বাবরি-কাণ্ডের প্রধান তদন্তকারী অফিসার মসজিদ ভাঙার পিছনে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র প্রমাণে বিশ্বাসযোগ্য তথ্যপ্রমাণই হাজির করতে পারেননি। শুধু সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাব নয়, ২৮ বছর ধরে সিবিআই তদন্ত ফৌজদারি দণ্ডবিধি মেনে হয়নি বলেও আদালতের রায়ে স্পষ্ট হয়েছিল। সিবিআই ওই দিনের ঘটনার অনেক ভিডিও ফুটেজ, ভিডিও ক্যাসেট সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে আদালতে পেশ করেছিল। কিন্তু নিয়ম মেনে তাতে কোনও সিলমোহর ছিল না। নিরপেক্ষ সাক্ষীর সইও ছিল না।
পশ্চিমবঙ্গে সিবিআইয়ের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পদক চুরির তদন্ত। ২০০৪ সালের ২৫ মার্চ শান্তিনিকেতন থেকে নোবেল চুরি হয়। একাধিকবার মামলার তদন্ত চালিয়েও একচুলও এগতে না পেরে ২০১০ সাল থেকে তদন্ত বন্ধই করে দিয়েছে তারা। একইভাবে কলকাতা জাদুঘর থেকে চুরি যাওয়া প্রাচীন বুদ্ধমূর্তিটিও তারা আজ পর্যন্ত উদ্ধার করতে পারেনি। এখানেই শেষ নয়, কর্ণাটকের বেল্লারিতে অবৈধ কয়লা কেলেঙ্কারি, গোরু পাচার, কয়লা পাচার কাণ্ড, সারদা, নারদা কেলেঙ্কারি, বগটুই— সিবিআইয়ের ব্যর্থতার তালিকা দীর্ঘ।
দেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এন ভি রামান্না চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন, ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সিগুলিকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। সিবিআই থেকে ইডি, এসএফআইও থেকে এনআইএকে সরাসরি রাজনৈতিক ফায়দার জন্যই ব্যবহার করা হচ্ছে। যার ফলে এই সব প্রতিষ্ঠানগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হচ্ছে। ঠিক নির্বাচনের আগে রাজ্যে রাজ্যে বিরোধীদের বা বিরোধী ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছে সিবিআই, ইডি। তাদের ডাক পাঠিয়ে জেরা করা হচ্ছে। এমন নয় যে তারা সেই অপরাধ, ষড়যন্ত্র ফাঁস করে অপরাধীদের চিহ্নিত করে, তাদের শাস্তি দিতে পারছে। সিবিআই কর্তারা শুধুমাত্র নিজের গদি সামলাতে ক্ষমতাসীনদের চাপের সামনে মাথা নোয়াচ্ছেন। আর সেই কারণেই অমিত শাহের পুত্রের ব্যবসা নিয়ে অভিযোগ উঠলেও তদন্ত হয় না, ব্যাপম কেলেঙ্কারি, নিট কেলেঙ্কারি নিয়ে তদন্ত ধামাচাপা পড়ে যায়। অথচ, লালুপ্রসাদ যাদব, হেমন্ত সোরেন, অরবিন্দ কেজরিওয়াল কিংবা পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতি নিয়ে সিবিআই খড়্গহস্ত!
আর জি কর কাণ্ডে সেই একই চিত্র। প্রতিদিন নতুন নতুন গল্প। হাজির হচ্ছে নানা প্লট। বাংলার মানুষ জানে না, এই তদন্তে আদৌ কোনও সমাধান সূত্র বেরবে কি না! নাকি এই তদন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া হবে বিধানসভা ভোট পর্যন্ত। বিচারের দাবি তুলে যে ভোটে প্রধান ইস্যু হয়ে উঠবে এই ধর্ষণ-খুন মামলা। সিবিআই কী চায়?