‘নেমে গেলেই তো হল না। সবাই নামছে তো। আমরা আছি। নেমে কেওস না হয়ে যায়। হিতে বিপরীত হয়ে গেলে তো হবে না। কেউ যদি ভাবে এটার সুযোগ নেবে, সুযোগ নিতে পারে।’ কথাগুলি অরিজিৎ সিংয়ের। প্রসঙ্গ আর জি কর। এমন হৃদয়বিদারক ঘটনার পর কেন অরিজিৎ কিছু বলছেন না, কেন তিনি পথে নামছেন না, এই নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্নের বন্যা বয়ে যাচ্ছিল। সাতদিনের মধ্যে জাস্টিস না পেলে পথে নামার ভুয়ো হুমকি পোস্টও তাঁর নাম করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাই আর জি কর ইস্যুতে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতি সকলকে জানাতে একপ্রকার বাধ্য হলেন। বলা ভালো, ‘জবাবদিহি’ করলেন।
আর জি কর হাসপাতালে বাংলার চিকিৎসক কন্যার ধর্ষণ ও নির্মম হত্যাকাণ্ড বাংলাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। বাঙালিকে করেছে এককাট্টা। ঘটি-বাঙালের লড়াইকে দূরে সরিয়ে জাস্টিসের দাবিতে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলও এসেছে কাছাকাছি। কর্মস্থলে তরুণী চিকিৎসকের এমন ভয়ঙ্কর পরিণতিতে বাংলার ঘরে ঘরে উঠেছে সন্তান হারানোর হাহাকার। অভয়ার মৃত্যু বাঙালিকে যেমন এককাট্টা করেছে, তেমনি প্রকট হয়েছে আমাদের দীনতা। তালে তাল না মেলালেই বিশ্ববন্দিতদের সম্মানও মাটিতে মিশিয়ে দিতে চাইছে। শুধু অরিজিৎ সিংকেই নয়, অমর্ত্য সেন, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়েও সোশ্যাল মিডিয়ায় টানাহ্যাঁচড়া চলছে সমানে। বার্তা স্পষ্ট, শুধু জাস্টিস চাইলেই হবে না। দিতে হবে সরকার বিরোধী বিবৃতি। তাহলেই খোঁজ পাওয়া যাবে মেরুদণ্ডের, না হলেই ‘চটিচাটা’। নিজের মত অন্যের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়াটাও এক ধরনের সন্ত্রাস। ‘মানসিক’ সন্ত্রাস।
তরুণী চিকিৎসকের মৃত্যুর ঘটনায় যুক্তদের কঠিন শাস্তির দাবিতে ডাক্তারদের আন্দোলন ছিল একেবারেই অরাজনৈতিক। সকলের একটাই চাওয়া, দোষীদের চরম শাস্তি। সেই দাবিকে দ্বিধাহীন চিত্তে সমর্থন জানিয়েছে পাহাড় থেকে সমুদ্র। তাই সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আন্দোলনের প্রতি মানুষের সমর্থন। আন্দোলনকারীদের আন্তরিকতা ও দৃঢ়তায় মুছে গিয়েছে দিনরাতের ফারাক। জাস্টিসের দাবিতে দল, মত, ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ নেমেছে রাস্তায়। রাস্তাই হয়ে উঠেছে মিলনক্ষেত্র। লক্ষ লক্ষ মানুষ পথে নামলেও বিশৃঙ্খলা হয়নি। এমন একটা শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলনকে রাজনৈতিক স্বার্থে ঘেঁটে দিতে মরিয়া রাজনীতির কারবারিরা। বিশৃঙ্খলা পাকিয়ে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে আন্দোলনের অভিমুখ।
গত পাঁচ বছর ধরে বিজেপি এরাজ্যের প্রধান বিরোধী দল। ২০১৯ সাল থেকে প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনে তারা সিপিএম এবং কংগ্রেসকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। তাই রাজ্যে অঘটন ঘটলে তা থেকে ফায়দা তোলার ‘নৈতিক অধিকার’ একমাত্র তাদের বলেই মনে করে বিজেপি। সেই অধিকারবোধ থেকেই আর জি করে ঘটা পৈশাচিক ঘটনা থেকেও তারা রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চাইছে। ২৭ আগস্ট ছাত্র সমাজের ‘শান্তিপূর্ণ’ নবান্ন অভিযান এবং পরের দিন ২৮ আগস্ট বাংলা বন্ধ ছিল সেই পরিকল্পনারই অঙ্গ।
দলীয় ছাত্র সংগঠনের পরিবর্তে ‘ছাত্র সমাজে’র নামে বিজেপির নবান্ন অভিযানের ডাক দেওয়ার কারণটা সকলেরই জানা। ছাত্র আন্দোলনের জেরেই বাংলাদেশে ঘটেছে গণঅভ্যুত্থান। বাংলায় বাংলাদেশের আন্দোলনের রিমেক করতে চেয়েছিল বিজেপি। ছাত্র আন্দোলন করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের ভিত টলিয়ে দেওয়ার দিবাস্বপ্ন দেখেছিল গেরুয়া শিবির।
সেই উদ্দেশ্যেই বিজেপি ছাত্র সমাজের নামে নবান্ন অভিযানের ডাক। বিশৃঙ্খলা পাকানোর চেষ্টায় কোনও খামতি ছিল না। পুলিসকে লাঠিপেটা করেছে। আন্দোলনকারী ‘ছাত্র’দের ছোড়া ইট-পাথরে কোথাও পুলিসের মাথা ফেটেছে, কেউ আবার দৃষ্টিশক্তি হারাতে চলেছেন। কিন্তু পুলিস লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাসের সীমা লঙ্ঘন করেনি। বাম আমলে পুলিস ছিল ‘ট্রিগার হ্যাপি’। কথায় কথায় গুলি চালাত। মমতার আমলে সেই পুলিসই মার খেয়েছে, রক্তাক্ত হয়েছে, কিন্তু গুলি চালায়নি। তারপরেও বিজেপি পরের দিনই বাংলা অচলের ডাক দিয়েছে।
তবে, এমনটা হওয়ারই ছিল। ২৮ আগস্ট তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবস। প্রতি বছর কলকাতায় ছাত্র সংগঠনের সমাবেশে তৃণমূলনেত্রী ভাষণ দেন। ২১ জুলাইয়ের মতো ২৮ আগস্টেও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগঠনের ও দলের সদস্যরা কলকাতায় হাজির হয়। জেলায় জেলায় পালিত হয় নানা কর্মসূচি। তাই ওই দিন বাংলা বন্ধ ডাকলে অশান্তি পাকাতে হবে সুবিধে। কলকাতার কর্মসূচিতে যাওয়া বাস আটকে দিলেই মারামারি অবধারিত। তাতে পুলিস গুলি চালিয়ে দিলেই কেল্লা ফতে। আর লাশ পড়লে তো কথাই নেই। জাস্টিসের লড়াইকে পিছনে ফেলে বিজেপির আন্দোলন ছুটবে টগবগিয়ে। সেই উদ্দেশ্যেই দু’দিন ধরে অশান্তি পাকানোর মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছে বিজেপি। প্ররোচনা ছিল অজস্র। কিন্তু পুলিস ফাঁদে পা দেয়নি।
রাজনৈতিক পালা বদলের বা পরিবর্তনের নির্দিষ্ট কোনও ছাঁচ নেই। প্রতিটি সফল আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও পদক্ষেপ হয় ভিন্ন। কিন্তু বঙ্গ বিজেপি সেটাই বুঝতে চাইছে না। বাংলাদেশকে টুকলি করে বাংলায় সাফল্য পেতে চাইছে। টুকলি করে পাশ করা গেলেও ফার্স্ট হওয়া যায় না।
দু’সপ্তাহ অতিক্রান্ত হতে চলল আর জি কর কাণ্ডের তদন্ত করছে সিবিআই। তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় আর কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। তাতে শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যেই নয়, প্রবীণ বিজেপি নেতা রাহুল সিনহার মনেও সিবিআই তদন্ত নিয়ে জেগেছে সংশয়। তা সত্ত্বেও সিবিআই ব্যর্থ, এমন কথা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে যদি সত্যিই ব্যর্থ হয়, তাহলে শুধু কেন্দ্রীয় এজেন্সিকেই নয়, সিবিআই তদন্তের দাবিতে যাঁরা সোচ্চার হয়েছিলেন, মুখ লুকাতে হবে তাঁদেরও।
এই পরিস্থিতিতে সিবিআইকে ‘অসহায়’ প্রমাণে কলকাতা পুলিসের ঘাড়েই দায় চাপাতে চাইছে বিজেপি। পুলিসকে অপদস্থ করতে গেরুয়া ব্রিগেড চুড়ি ও শাড়ি নিয়ে ঘুরছে। পুলিসকে তা পরার পরামর্শ দিচ্ছে। তাতে হয়তো বিজেপি কর্মী-সমর্থকরা হাসাহাসি করছেন, মজাও পাচ্ছেন। কিন্তু পুলিসকে চুড়ি ও শাড়ি পরার পরামর্শ দিয়ে বিজেপি বাংলার মা-বোনেদেরই অপমান করছে। এটা কি তারা বুঝতে পারছে না?
বিজেপি ও সিপিএমের জন্যই একটা আপাদমস্তক অরাজনৈতিক আন্দোলনেও লেগে যাচ্ছে রাজনীতির রং। তাতে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়ছেন। কিন্তু রাজনীতির কারবারিদের এই সুবিধাবাদী মানসিকতার জন্য জাস্টিসের লড়াই যেন থেমে না যায়। অপরাধীরা যতদিন না শাস্তি পাচ্ছে, ততদিন লড়াই জারি রাখতে হবে। বিজয়ী না হওয়া পর্যন্ত এই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। তা না হলে অভয়ার বাবা, মায়ের প্রতি চরম অবিচার করা হবে।
জাস্টিসের দাবিতে আন্দোলনের পাশাপাশি হাসপাতালগুলির চিকিৎসা পরিষেবাও স্বাভাবিক করতে হবে। তা না হলে গরিব মানুষ চরম বিপাকে পড়বে। বহু প্রাণ ঝরে যাবে অকালে। রামপুরহাট মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র ডাক্তাররা এই বাস্তবটা উপলব্ধি করে ইতিমধ্যেই কাজে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু অভয়ার খুনিদের শাস্তি এবং চিকিৎসকদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার দাবিতে তাঁরা রয়েছেন অটল। তাই পরিষেবা দেওয়ার পাশাপাশি জারি থাকবে তাঁদের আন্দোলন।
কিন্তু কলকাতার কিছু ডাক্তারবাবু এখনও কর্মবিরতি চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে। তাঁরা অভয়ার ধর্ষক ও খুনিদের শাস্তির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন কলকাতার পুলিস কমিশনার বিনীত গোয়েলের অপসারণের দাবি। তাতেই উঠছে প্রশ্ন, তাঁরা কি সত্যিই জাস্টিস চান, নাকি করতে চাইছেন রাজনীতি! কর্মবিরতির বয়স যত বাড়বে এই প্রশ্ন ততই জোরালো হবে।
আর জি কর কাণ্ডে গোটা বাংলা এককাট্টা। সেই কারণে বিভিন্ন পেশার মানুষ রাস্তায় নেমেছে। পদযাত্রায় পা মিলিয়েছে স্কুলের খুদে পড়ুয়ারাও। কারণ তারাও জাস্টিস চায়। সেই পড়ুয়ারাই বিজেপির ডাকা বাংলা বন্ধ উপেক্ষা করে স্কুলে গিয়েছিল। তারজন্য সহ্য করতে হয়েছে চোখরাঙানি। চোখ রাঙাল কারা? জাস্টিসের দাবিতে খুদেরা হেঁটেছিল যাদের সঙ্গে তারাই দিল হুঁশিয়ারি। স্কুল পড়ুয়ারাও কি বুঝে গেল, জাস্টিসের স্লোগানের আড়ালে শুরু হয়ে গিয়েছে পলিটিক্স!
আর জি কর কাণ্ডে সিবিআই তদন্তে সামনে আসছে নিত্যনতুন তত্ত্ব। বাড়ছে বিভ্রান্তি। একের পর এক পলিগ্রাফ টেস্টেও মিলছে না সমাধানসূত্র। আর তাতেই উঠছে প্রশ্ন, খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজা হচ্ছে না তো? অনুব্রত মণ্ডল মূল মামলায় জামিন পেয়েছেন। রেশন দুর্নীতি কাণ্ডেও জামিন পেয়েছেন শঙ্কর আঢ্য, বাকিবুর রহমানরা। তাই বাড়ছে সংশয়, অভয়া জাস্টিস পাবে তো?