কোনও একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে পারিপার্শ্বিক সমাজ এবং সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে প্রবেশ করলে জানতে পারি সকলেই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন। প্রত্যেকেই ন্যায়বিচারের পক্ষে। প্রত্যেক নারী পুরুষ সৎ। সকলেই নিজেদের কর্মক্ষেত্রে সর্বোচ্চ যোগ্য এবং প্রশংসিত। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রী শিক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ। বাবা মায়ের সামান্য অবাধ্য নয় কেউ। কেউ সমাজের কোনও ব্যাধিতেই আক্রান্ত নয়। ঘরে বাইরে যার যে দায়িত্ব সেটা সে অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে সম্পন্ন করে। সামান্যতম নীতিভ্রষ্টতা যাদের চরিত্রে নেই। কেউ দায়িত্বজ্ঞানহীন নয়। সকলেই নারীদের প্রতি সম্ভ্রমশীল। আজ পর্যন্ত কেউ নারীর প্রতি কুদৃষ্টি দেয়নি। অপমান করেনি। আবার নারীরাও সকলেই পুরুষকে সমান মর্যাদা প্রদান করে। কেউ কখনও কাউকে সামান্য অসম্মানজনক কথা বলেনি। কেউ নীতির সঙ্গে আপস করেনি। কেউ ঘুষ খায় না। কেউ কর্মস্থলে বা পাড়ার পুজোয় অথবা ক্লাবের রাজনীতিতে চক্রান্ত করে না। ঈর্ষা দ্বেষ স্বার্থপরতা কারও মধ্যেই নেই। সকলের সব আত্মীয় খুব ভালো। প্রত্যেকেই সর্বদা মানুষের উপকারের জন্য সদা প্রস্তুত। আজ পর্যন্ত কেউ অন্যের ক্ষতি করেনি। সকলেই গোয়েন্দা। সকলেই পুলিস। সকলেই প্রশাসক। সকলেই সমাজসংস্কারক। সকলেই সাংবাদিক। সকলেই ডাক্তার। সকলেই বিজ্ঞানী।
সকলেই দর্শক। সকলেই টিভি চ্যানেল। সকলেই শেয়ার। সকলেই ফরওয়ার্ড। সকল বিষয়ে সকলের অগাধ জ্ঞান। সবথেকে যেটা ভালো লাগছে সেটা হল, সকলেই পরামর্শদাতা। নিত্যদিন একে অন্যকে হাজার হাজার পরামর্শ দিচ্ছে এই সময় কী করা উচিত, কী করা উচিত নয়। যে কোনও ঘটনা অথবা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত হলে প্রত্যেকে জানে সেই সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হল। নিজেদের মতামত জানাতে কেউ সামান্য দ্বিধা করে না। কারও মধ্যেই সামান্য দ্বিধাও নেই নিজের অভিমতই যে শ্রেষ্ঠ অভিমত এটা অবিরত প্রকাশের। এতকাল জেনেছি সকলেই সাহিত্য বোঝে, সঙ্গীত বোঝে, রাজনীতি বোঝে, নির্বাচন বোঝে। কিন্তু এখন অসম্ভব ভালো লাগল যে কঠিন ও জটিল বিষয়েও সকলে চমৎকার পারদর্শী। এভিডেন্স জানে। পোস্টমর্টেম জানে। ভিসেরা জানে। ফরেনসিক জানে। এফ আই আর জানে। কেস ডায়েরি জানে। হোমিসাইড জানে। কোর্ট হিয়ারিং জানে। জুডিশিয়ারি জানে।
আমাদের নিশ্চিত বিশ্বাস যে, আমরা যাকে খারাপ মনে করি, সে খারাপ। শুধু আমরাই ভালো। আমার সহমত যারা তারাই ভালো। আমি ঠিক করব কে ভালো এবং কে খারাপ। জর্জ বুশ থিওরি। আইদার ইউ আর উইথ আস। অর এগেইনস্ট আস!
সব ডিকটেটরকে সর্বদা দেখা যায় না। কেন? সে আড়ালে থাকে। কোথায়? নিজের মধ্যে! তাই ন্যায়বিচার চাওয়ার মরিয়া তাগিদের পাশাপাশি নিজের মধ্যে কী কী দোষ আছে সেটা খুঁজি না। নিজের মধ্যে কী কী বদল দরকার, জানার চেষ্টা করি না। ভুলে যাই, ব্যক্তি বদলালে, সমাজ বদলাবে। আমাদের সবথেকে বড় মহামারী কী? আমি ভালো, অন্যরা খারাপ। আমি ঠিক, তুমি ভুল। এই অসুখ সর্বব্যাপী।
আর জি করের নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ এবং বিচার চাওয়ার আগুন যেন সামান্যতম না নিভে যায়। এটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। ঠিক একইসঙ্গে আমরা যেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই যে সিস্টেমের উপর তৈরি হওয়া প্রবল রাগ, এটা নিজেরাই হালকা, সস্তা, নরম, হাস্যকর আচরণ ও মন্তব্যে দুর্বল করে না দিই। যা ক্রমেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাজনৈতিক যে বিশ্বাস সেই আবেগ ও মতবাদ জায়গা করে নিচ্ছে প্রতিবাদের ভাষ্যে। আর তাই হত্যার তদন্ত, ধর্ষণের তদন্ত ক্রমেই পিছনের সারিতে চলে যাচ্ছে। সামনে চলে আসছে বেশি বেশি করে প্রিন্সিপালের দুর্নীতি, সরকারের অস্বস্তিতে পড়া, ভবিষ্যতে কারা কারা বিপদে পড়তে পারে সেই জল্পনায়। এসব তদন্তেও অবশ্যই প্রত্যেক দোষীর কঠোরতম সাজার প্রতীক্ষায় আছে মানুষ।
কিন্তু ৩১ বছরের নির্যাতিতাকে কে বা কারা সরিয়ে দিল পৃথিবী থেকে? সিবিআই এখনও বলছে না যে, ঘটনার দিন কী হয়েছিল? কারা জড়িত ছিল? সিবিআইয়ের তদন্ত এবং নাগরিকদের আলাপ আলোচনা চর্চা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর কী কী হয়েছে এবং ঘটনার আগে কী কী দুর্নীতি হয়েছে, সেটাতে ক্রমেই আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এরকম অসহনীয় ঘটনা কেন ঘটল? তার ক্রনোলজি অফ ইভেন্টস কী? কীভাবে এতবড় নারকীয় ঘটনা ঘটতে পারল? এবং সর্বোপরি একজন? নাকি একাধিক জন? দোষীর সংখ্যা কত? এই প্রশ্নগুলির উত্তর নেই।
সিবিআই কি নিয়মিত তদন্তের আপডেট দেয়? না, দেয় না। দেওয়ার কথাই নয়। কিন্তু সিবিআই কর্তারা মাঝেমধ্যে ব্রিফিং করে নাগরিকদের আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি দিতেই পারেন যে, তদন্ত ঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছে। আপনারা বিশ্বাস রাখুন। কই সেরকম তো কিছু শোনা যাচ্ছে না। আমরা জানি, তদন্ত রিপোর্ট তো সুপ্রিম কোর্টে জমা পড়বেই। ৫ সেপ্টেম্বর। সেখানে কী হবে? আবার একটি তারিখ? হতেই পারে। কারণ, সেটাই নিয়ম। আমাদের সমস্যা হল, আমরা রাষ্ট্র, আইন, সিস্টেম, প্রশাসন, জুডিশিয়ারি, তদন্তপ্রক্রিয়া কীভাবে চলে, সেটা অনেকে জানিই না। তাই হালকা হালকা কথা বলি। আমাদের রাগ বেশি হলেও আইন নিজের মতোই চলবে। কম হলেও তাই। তাহলে এই অবকাশে কী করা উচিত? সমাজের সব অন্যায়ের বিরুদ্ধেও এবার থেকে সরব হওয়া।
এই নাগরিক আন্দোলন এক মস্ত বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। আর জি করের প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, বিচার চাওয়ার দাঁতে দাঁত চাপা দাবির পাশাপাশি এবার নিজেদের দুর্বলতা, নিজেদের দোষত্রুটি, নিজেদের অপরাধপ্রবণতা, নিজেদের দুর্নীতির অভ্যাস, নিজেদের দুর্ব্যবহার, নিজেদের ঘুষ খাওয়া, নিজেদের কাজে ফাঁকি দেওয়া, নিজেদের অন্যায় দেখেও এড়িয়ে যাওয়া, চোখের সামনে পাড়া বা কর্মস্থলে নীতিহীনতার রমরমা দেখেও নীরব হয়ে থাকা, কোনও একটি অঞ্চলে অথবা প্রাত্যহিক জীবনে শাসক অথবা বিরোধী দলের দাদাগিরি সহ্য করে যাওয়া, এসব এবার বন্ধ করার সময় এসেছে।
কারণ কী? কারণ, আমরা যখন বিচার চাইতে রাস্তায় নামছি, স্লোগান তুলছি, সমাজকে অপরাধমুক্ত করতে দাবি জানাচ্ছি, সেই সময় আমাদের যেন শাসক অথবা রাষ্ট্র পাল্টা অপ্রস্তুত করতে না পারে যে, তুমি ব্যক্তিগত জীবনে কতটা সৎ? কতটা ন্যায়পরায়ণ? কত অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছো? তোমার পাড়ায় কিংবা তোমার পথচলতি ক্লাবে জমায়েতের ইভটিজিং-এর বিরুদ্ধে কতবার রুখে দাঁড়িয়েছ? অফিসে তোমার কুকীর্তি তো আমরা জানি! তোমার নামেও তো নারী নির্যাতনের অভিযোগ আছে পাড়ায় ও থানায়! তাই আমাদের এবার নিজেদের ছোটবড় দুর্বলতাগুলোকে মেরামত করতে হবে। হতে হবে ইস্পাতকঠিন। অনেকেই আজকাল বলে থাকে পক্ষ নাও। সেটার থেকেও বেশি জরুরি পক্ষ নিয়েও পক্ষপাতহীন থাকা। অর্থাৎ সব অন্যায়ের সমানভাবে প্রতিবাদ।
এখন থেকেই ছোট এবং বড় সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য যতদূর যেতে হয় সেটা যেন আমরা যাই। রাজ্য হোক, কেন্দ্র হোক। যে অন্যায় করবে, তারই প্রতিবাদ করব। একা একা তো সম্ভব নয়! দরকার সমষ্টির শক্তি। এই তো নাগরিক আন্দোলনে সমষ্টির শক্তি দেখা যাচ্ছে। এবার তাহলে পাড়া, মহল্লা, কর্মস্থলে কোনও অন্যায় দেখলে শুভবুদ্ধিসম্পন্নরা একজোট হতে অসুবিধা কোথায়? যদি দেখা যায়, আর জি কর নিয়ে ভিড়ের অংশ হয়ে একদল প্রতিবাদে এসেছে, অথচ স্থানীয় স্তরে কোনও প্রতিবাদে বিক্ষোভে কিছু মানুষ একজোট হলেও অন্যরা আসছে না, পিছিয়ে যাচ্ছে, তাহলে কিন্তু বুঝতে হবে তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ব্যাপারটা লোকদেখানো! আর দ্বিচারিতায় আক্রান্ত। স্থানীয় স্তরে দাদাগিরি, গুন্ডামি, নোংরামি, অন্যায়, নীতিহীনতা নির্মূল করার অভিযানে সংঘবদ্ধ হয়ে না নামলে, বৃহত্তর অন্যায়কারীরা ভয় পাবে না।
আমরা চুপ করে থাকব কেন ডিজে বাজিয়ে হাজার হাজার মানুষকে অসুস্থ করে দেওয়ার সংস্কৃতি সহ্য করে? কেন সারা বছর ধরে একটা না একটা কারণ সামনে রেখে তারস্বরে মাইক চলবে পাড়ায় পাড়ায়? কেন সরকারি দপ্তরে কাজ করাতে গেলে পরোক্ষে ঘুষ দিতে হবে? দিই কেন? আমাদের কাজে যাওয়া পণ্ড করতে অথবা একদিনের রোজগার ধ্বংস করতে রাজনৈতিক স্বার্থে কারা রেল অবরোধ করে? কারা পথ অবরোধ করে? সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করলে সরকারের কিছু এসে যায়? সরকার কাদের টাকায় ওসব কেনে? আমাদের ট্যাক্সের টাকায়। তাহলে ওসব ভেঙে কী লাভ হয়? সরকারি দপ্তর অথবা ব্যাঙ্ক, ডাকঘর অথবা গ্যাসের এজেন্সি। যে দুর্ব্যবহার করবে তাকেই পাল্টা ভয় দেখাতে হবে। আমরা সাধারণ পাবলিক। পরিষেবা নিতে এসেছি। চোখ রাঙিও না। এই রক্তচক্ষু দেখাতে হবে।
অটোচালক, টোটোচালকদের মধ্যে অনেকেই মানুষের জন্য প্রচুর উপকার করে। প্রাণ বাঁচায়। আবার তাদের মধ্যেই বহু এমন আছে যারা কাদের প্রশ্রয় পেয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করে? প্রতিবাদ করতে হবে। আমাদের নারীরা তো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে বুঝতে পারে পথচলতি অথবা কর্মস্থলে কিংবা আত্মীয়সমাজে অথবা বন্ধুবান্ধবদের ভিড়ে কোন চোখ তাদের দিকে কীভাবে তাকাচ্ছে। বুঝতে পারে অশালীন স্পর্শের ভাষা। কুপ্রস্তাবের আভাস। এবার থেকে কোনওরকম মুখ বুজে সহ্য করার যেন আর অবকাশই দেওয়া না হয়। এদের মুখোশ খুলতে হবে। নারীদের যেন এই সাহস আমরাই সমাজ থেকেই প্রদান করি।
এই নাগরিক আন্দোলনকারীরা হঠাৎ করে হা হুতাশ করছে যে, রাজনৈতিক দলগুলি হাইজ্যাক করে নিল আন্দোলন। এটা হল দুর্বলের হাহাকার। রাজনৈতিক দলগুলি তাদের স্বার্থসিদ্ধির কাজ করবেই। অন্যায়ভাবে করবে। ন্যায়সঙ্গতভাবেও করতে পারে। নবান্ন অভিযান টাইপের গুন্ডামির প্রকাশ ঘটাবেই। আবার শান্ত দৃপ্ত মিছিলও হবে। কিন্তু তাই বলে নাগরিকরা ভাবতে শুরু করছে কেন যে তাদের হাতে আর আন্দোলন নেই? তাহলে কি নাগরিকরা মিডিয়ার উপর অতি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে প্রথম থেকে? অর্থাৎ মিডিয়ায় তাদের মিটিং মিছিল কভার করা না হলেই সেটা আর গুরুত্বপূর্ণ থাকছে না? প্রচার না হলেই আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়বে? সকলকে মনে রাখতে হবে তদন্ত করছে সিবিআই। তাদের উপরও চাপ রেখে যেতেই হবে। রাজ্য সরকারকেও দাবি করতে হবে নিরাপত্তা বাড়াতে। নয়তো বাড়িতে বসে আগামী দেড় বছর রাজনীতির স্বার্থগুলিকে দেখতেই হবে এই তদন্তকে সামনে রেখে। ফেক নিউজ ছড়াতে নেই। অটল থাকতে হয় নিজেদের দাবি ও লক্ষ্যে। সর্বাগ্রে দ্রুত তদন্ত ও দ্রুত শাস্তি।
ন্যায় সংহিতা আইনে ধর্ষণের সাজায় ফাঁসিই নেই। একমাত্র নাবালিকাকে গণধর্ষণ ছাড়া। কেন নেই? আমাদের দাবি তুলতে হবে ধর্ষণ প্রমাণিত হলেই ফাঁসি! এই দাবি তোলা কেন জরুরি! কারণ প্রবল ভয় এবং মৃত্যু আতঙ্ক ঢোকাতে হবে। অপরাধীদের মনের মধ্যে এরকম একটি ঘৃণ্য ইচ্ছার উদ্রেক হলেই যেন সর্বাগ্রে নিজের মৃত্যুর সম্ভাবনাও ঝলসে ওঠে চোখের সামনে! সে যেন সামনের নারীশরীরকে দেখলেই চকিতে দেখতে পায় একটি অদৃশ্য ফাঁসিকাঠও! সম্ভাব্য ধর্ষণকারীর শিউরে উঠে মনে করা দরকার যে, নারী নয়, আমি আসলে এই মুহূর্তে স্পর্শ করতে যাচ্ছি নিজের মৃত্যুকেই!