বিশেষ নিবন্ধ

জাস্টিস চাই সমাজের সব স্তরে
শান্তনু দত্তগুপ্ত

গোপাল মণ্ডলের অপারেশনের দিন পেরিয়ে গিয়েছে। ১৬ তারিখ ডেট পড়েছিল। বড় ডাক্তারবাবুকে দেখিয়ে ছোটবাবু দুটো ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ব্যথা হলে খাবেন। কিন্তু ওর আগে ডেট পাওয়া যাচ্ছে না। মেনে নিয়েছিলেন গোপাল মণ্ডল। গাইঘাটার কাছে একচিলতে ঘরে বউ, আর দুই মেয়েকে নিয়ে থাকেন। দিনের রোজগার রাতেই শেষ হয়ে যায়। ভেবেছিলেন, একটা মাস ঠিক ব্যথা সয়ে যাব। ডাক্তাররা রোগী দেখছেন না... এই খবর পাওয়ার পর থেকেই বুক কাঁপতে শুরু করেছিল। অপারেশনটা হবে তো? যন্ত্রণায় এখন আর বসতে পারেন না গোপাল। কিছু পেটে সয় না। জল খেলেও বুক আর পেটের মাঝখানটা ভার হয়ে ভীষণ ব্যথা শুরু হয়। গলায় আঙুল দিয়ে বমি করেন। তারপর যন্ত্রণা একটু কমলেও শরীরটা এলিয়ে যায়। কোনওক্রমে ট্রেনে চেপে কলকাতায় এসে নেমেছিলেন ১৬ তারিখ। তারপর বাস ধরে বড় হাসপাতালে। ভর্তি নেয়নি। বলেছে, পরে আসুন। এখন গল ব্লাডার অপারেশন হবে না। কিন্তু ব্যথা যে মরে না? বলছিলেন, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড নিয়ে এবার বেরতে হবে। কিন্তু সব নার্সিংহোম যে ওতেও ভর্তি নিতে চায় না! বলে বেড নেই। জায়গা না পেলে কী হবে? অসহায় চেহারাটার পাশে দাঁড়িয়ে স্ত্রী মালতী কব্জি দুটো তুলে দেখালেন... ‘এই একগাছা চুড়ি আছে। কিছু সোনা আছে এতে। সোয়ামির অপারেশন হয়ে যাবে।’
গোপাল মণ্ডল এখানে নিছক প্রতীকী। এমন হাজার হাজার গরিব মানুষ বড় আশা নিয়ে গত কয়েকদিন এসেছেন হাসপাতালে। ভিক্ষার ঝুলি ফেলে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু চিকিৎসা মেলেনি। বড় ডাক্তারবাবুরা ছিলেন। কিন্তু তাঁরা কতদিক সামলাবেন? ভোরবেলা এসে যাঁরা টিকিটের জন্য লাইন দিয়ে কাউন্টারের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন, তাঁরাও জানেন সিস্টেমটা... প্রথমে দেখে দেওয়ার কাজটা ছোট ডাক্তারবাবুরাই করেন। তারপর প্রেসক্রিপশন যায় বড় ডাক্তারবাবুদের কাছে। এটা একটা চেইনের মতো। সেই চেইনের নীচের অংশটাই হাপিস হয়ে গিয়েছে। কারণ, আন্দোলন চলছে। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, কেন্দ্রীয় সরকার, এমনকী মুখ্যমন্ত্রীও বলেছেন... পায়ে ধরছি। কাজে ফিরে আসুন। তারপরও ছোট ডাক্তারবাবুরা শুনছেন না। আর জি কর হাসপাতালে যা হয়েছে, তার থেকে খারাপ আর কিছু হতে পারে না। গোপাল মণ্ডলের দুটো মেয়ে আছে। বড় হচ্ছে তারা। গোপালের দুশ্চিন্তা হয় তাদের জন্য। যে আন্দোলনে ডাক্তারবাবুরা নেমেছেন, তাতে সায় আছে গোপালেরও। তিনিও জানেন, একটা হেস্তনেস্ত দরকার। কীভাবে? জানেন না। ওই যে ওরা বলছে... বিচার চাই। ওটা পেতেই হবে। তাহলে কোনও মেয়ের আর ডাক্তার দিদিমণির মতো অবস্থা হবে না। স্বপ্ন দেখেন গোপালও। কিন্তু আর কোনও উপায় কি নেই? ডাক্তারবাবুরা রোগী না দেখলে কি সেই বিচার পাওয়া যাবে? আন্দোলন কি অন্য কোনওভাবে হতে পারে না? এই প্রশ্ন আজ গরিব মানুষের ঘরের কোণায় কোণায় ঘুরপাক খাচ্ছে। গরিব হওয়াটা আজ তাঁদের কাছে দোষের। বড় সরকারি হাসপাতালের ভরসায় বেঁচে থাকাটা তাঁদের কাছে অপরাধের। আজ না হয় কাল ডাক্তার দিদিমণির খুনির বিচার হবে। কিন্তু এই গরিব মানুষগুলোর বিচার?
জাস্টিস তো চাই গোপাল মণ্ডলদেরও।
হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এসে গিয়েছে মেসেজ। রাতে দেখা হবে। কোথায়? মিছিলে। আজ অমুক পাড়া থেকে তমুক বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত মিছিল। স্লোগান একটাই—উই ওয়ান্ট জাস্টিস। সন্ধ্যায় আড্ডা মেরে সময় কাটানোর থেকে এটা বেশি ভালো। বিচারের জন্য হাঁটা হয়ে যাবে, সঙ্গে আড্ডা, আর তার পাশাপাশি রিল আপলোড। এ যেন এক দারুণ নাইট আউটিং। ১৪ আগস্ট রাতে সমাজ, প্রশাসন এবং কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়ে যে স্রোত রাজ্যের আনাচে কানাচে ধাক্কা মেরেছিল, আজ সেটা কীভাবে যেন একটা স্টেটাস সিম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘তুই মিছিলে যাসনি?’... এই প্রশ্ন ধেয়ে আসা, আর একঘরে হয়ে যাওয়া যেন এক ব্যাপার। ওই মিছিলে হাঁটতে পারেননি মিনতি নস্করও। স্বামী ছেড়ে চলে গিয়েছে তিন বছর। ছোট্ট চার বছরের একটা ছেলে, আর সাত বছরের মেয়েটাকে বড় করতে সকাল থেকে রাত পরিশ্রম করতে হয় তাঁকে। মনে মনে ভাবেন, বিচার চাই। কিন্তু মিছিলে হাঁটতে গিয়ে কামাই করলে আয়ার কাজটা চলে যাবে। তার উপর বাড়ি ফিরে ওই রাতে ছেলেমেয়ের জন্য রান্না করতে হয়। না খেয়ে বসে থাকে ওরা। ইদানীং প্রায়ই মিছিলের জন্য বাস আটকে যাচ্ছে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেই ১১টা পার। ছেলেটা সেদিন খিদেয় কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। বড্ড রাগ হয় মিনতির। বিচার চাই। কিন্তু অন্য কোনও পথে কি সম্ভব নয়? বড়লোকে মিছিল করে মোবাইলে ছবি তোলে। ফেসবুকে দেয়। এটাই কি বিচার? বাসে সেদিন দেখছিলেন বছর পঞ্চাশের এক মানুষকে। রাগে ফেটে পড়েছিল। নাইট শিফ্টে গার্ডের ডিউটি দিতে যাচ্ছিলেন তিনি। মিছিলের জন্য বাস দাঁড়িয়ে প্রায় আধ ঘণ্টা। বলছিলেন, ‘এবার টাকা কেটে নেবে। সংসার চালাব কীভাবে?’
জাস্টিস যে চাই মিনতিদেরও!
এ সমাজের পোড়খাওয়া লোকজন জানতেন, আন্দোলনে রাজনীতির অনুপ্রবেশ সময়ের অপেক্ষা। সেটাই হয়েছে। দু’দিনে হয়নি, সাতদিনে হয়েছে। আর সেটাই ষোলো কলা পূর্ণ করতে চলেছে আজ। 
নবান্ন অভিযানে। ভারতটাকে এরা বাংলাদেশের ছকে ফেলতে চায়। নৈরাজ্য এদের লক্ষ্য। তাই তাদের মুখে ‘দফা এক, দাবি এক... মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ’। ঠিক যেন বাংলাদেশের পুনর্নির্মাণ। ছাত্রছাত্রীরা সমাজ এবং প্রশাসনের ভুল শুধরে দেওয়ার যে শপথ নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন, গড়ে তুলেছিলেন ধর্নামঞ্চ... সেখানে আজ উড়ছে দলীয় পতাকা। ন্যূনতম রাজনৈতিক বোধবুদ্ধিসম্পন্ন ডিওয়াইএফআই, কংগ্রেসের ছাত্র পরিষদ, কিংবা ডিএসও এই অভিযানে নেই। কারণ তারা জানে, ছাত্র আন্দোলনকে ক্ষমতার লোভে রাজনীতির রং দেওয়া মূর্খামি। আজ সেই ছকেই নেমেছে গেরুয়া শিবির। রাজ্যের সব মহলে এ নিয়ে বিরক্তি, হতাশা কিংবা আশঙ্কার ইঙ্গিত মেলা সত্ত্বেও অনড় বিজেপি-আরএসএসের এই ‘উদ্যোগ’। দলের ডাকসাইটে নেতা আগে থেকে বলে রাখছেন, গুলি চলবে। বডি পড়বে। জানতে ইচ্ছে করে, বুঝলেন কীভাবে তিনি? হাত গুনে? নাকি তেমন কোনও প্ল্যান ইতিমধ্যেই তৈরি? কাদের এগিয়ে দেওয়া হবে মিছিলে? ছাত্রদের নিশ্চয়ই? যাতে অশান্তির ঝাপ্টা সবার আগে তাঁদের উপর এসে পড়ে! একে কি রাজনীতি বলে? বিরোধীদের এটাই কি কর্তব্য? উস্কানি আসছে। লাগাতার। পুলিসকে যদি প্ররোচনা দেওয়া হয়, তারাও বসে থাকবে না। আর সেটাই চাইছে স্বার্থান্বেষী একটা মহল। আন্দোলনকারী ডাক্তার বা সমাজের শুভবুদ্ধিওয়ালা মানুষ কি এটা বুঝছেন না? তার প্রতিবাদ কেন তাহলে মঞ্চ থেকে শোনা যাচ্ছে না? কেন বলা হচ্ছে না, রাজনীতির কারবারিরা দূর হটো? আন্দোলনের মঞ্চে এখন নানা মুনি, নানা মত। তিনভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু তারপরও কেউ একবার বলছেন না, আমাদের শিখণ্ডী বানিয়ে এই রাজনীতি চলবে না। কেন সরব নন তাঁরা? ছাত্রসমাজের থেকে কি এইসব ক্ষমতালোভীর জোর বেশি?
ছাত্রছাত্রীদের কাছে আজ জাস্টিস চাইছে যে রাজনীতিও।
সত্যের দাবিতে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকা মনোবলের সঙ্গে হুজুগ যেন মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে। এটা হওয়ার ছিল না। গোপাল মণ্ডল বা মিনতি নস্করের মেয়েদের জন্যই হওয়ার ছিল না। নিঃশব্দ প্রতিবাদ সিস্টেমকেও বদলে দিতে পারে। সূচনা তো সেভাবেই হয়েছিল! সাধারণ মানুষ নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিল। এখন মিছিল ছুটছে, টিভি ক্যামেরা ঘিরে আছে তাদের, ছবি উঠছে পটাপট। স্লোগানে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ কখন যেন ‘জাস্টিক’ হয়ে যাচ্ছে। সেটাই আকাশ কাঁপাচ্ছে পুরোদমে। নন্দন চত্বর থেকে ডাক্তারদের ধর্নামঞ্চ—ধূসর হচ্ছে সমাজ বদলে দেওয়ার, সিস্টেম পরিবর্তনের রং। সোশ্যাল মিডিয়ায় বেরিয়ে যাচ্ছে সঞ্জয়ের সিসিটিভি-ছবি। ভাইরাল হচ্ছে সেমিনার রুমে ভিড় জমানোর ভিডিও। তাহলে সিবিআই করছেটা কী? আর আন্দোলনই বা কেন ওই ওভারহাইপড কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে চেপে ধরবে না? যদি ৩০-৪০ জন সেদিন ঘটনার পর সেমিনার রুমে জড়ো হয়ে থাকেন, সেই ডাক্তাররা কেন মুখ খুললেন না? তাঁরাই তো বসেছেন ধর্নামঞ্চে। লড়ছেন নিরাপত্তার জন্য, আদর্শের জন্য। কিন্তু প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, পাঁচ বছর পর তাঁরা যখন প্রাইভেট চেম্বার খুলে বসবেন, এই আদর্শ থাকবে তো? নাকি তখন তাঁরাও নাড়ি টিপে রোগ নির্ধারণের বদলে ১০ হাজার টাকার টেস্ট ধরিয়ে দেবেন? ১৫ টাকার ওষুধের বদলে প্রেসক্রিপশনে লিখবেন ১৫০ টাকার মেডিসিন?
নিরাপত্তা তাই শুধু অভয়ার চাই না, সমাজের সাধারণ মানুষেরও প্রয়োজন। দিনের শেষে যেন তাঁরা ডাক্তার, উকিল, নেতার কাছে যেতে ভয় না পান। একবারও যেন তাঁদের ভাবতে না হয়, নিঃস্ব হয়ে যাব না তো? তার জন্য শুধু ধর্নামঞ্চে বসলেই হবে না। কর্তব্য করেই উত্তর দিতে হবে সব অন্যায়ের। শিক্ষা দিতে হবে নতুন প্রজন্মকে। পাশের বাড়ির মেয়েকে পোশাক নিয়ে জ্ঞান না দিয়ে শেখাতে হবে নিজের ছেলেকে... তার নজর সুস্থ করার শিক্ষা। সেই শিক্ষা যেন পড়ার বই বন্ধ করার পরও বজায় থাকে। ডাক্তারদের ক্ষেত্রেও কিন্তু এই একই শর্ত প্রযোজ্য। তবেই বদল আসবে সিস্টেমে। সমাজে। 
অভয়ার পাশাপাশি জাস্টিস যেন পায় সমাজের সব স্তরই। 
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

বিদ্যা শিক্ষা ও কাজকর্মে দিনটি শুভ। বন্ধুসঙ্গে বিপদ হতে পারে। অধ্যাপনায় অগ্রগতি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৪ টাকা৮৪.৯৮ টাকা
পাউন্ড১০৭.৮৯ টাকা১১১.৮৫ টাকা
ইউরো৮৯.৯১ টাকা৯৩.৪৯ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা