বিশেষ নিবন্ধ

দুই সমাজের দূরত্ব কমুক
সমৃদ্ধ দত্ত

সমাজে দুটি শ্রেণি আছে। একটি অংশের পরিবারে নবজাতক অথবা বালক বালিকাদের নাম আজও দেওয়া হয় চাঁপা, জবা, শেফালি, বকুল, কনক, মালতী, লতিকা, রতন, সনাতন, বিজয়, অমল, কানাই, কাশীনাথ, শম্ভুচন্দ্র, নিবারণ, উত্তম, সুবল...ইত্যাদি। অর্থাৎ যে নামগুলি বাঙালি সমাজে ছিল ৭০ বছর আগেও। আবার আজও আছে। সেই অতীত ঐতিহ্যটি অজান্তেই রক্ষিত হয় এই অংশটির পরিবারের সদস্যদের নামকরণে। আজও যখন এই নামগুলি আমরা শুনতে পাই, তখন বুঝতে পারি নামগুলি আদতে কালজয়ী হয়ে গিয়েছে। চিরন্তন একটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু নাগরিক এলিট সমাজের একাংশ আবার এই নামগুলিকে ব্যাকডেটেড আখ্যা দিয়ে থাকে। 
আর একটি শ্রেণির মধ্যে ক্রমেই দেখা যায় এসব নাম আর দেওয়া হচ্ছে না। তাদের পরিবারে স্মার্ট, আধুনিকা এবং মেধাবী নামের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই নামগুলিও চমৎকার হয়। উদ্ভাবনী এবং শিক্ষার ছাপও দেখা যায়। এর মধ্যে কোনও একটি প্রবণতা ভালো, আর অন্যটি খারাপ, একদল ধনী, অন্য দল দরিদ্র, এরকম কোনও জাজমেন্ট দেওয়া যায় না। এটা সমাজের নিজস্ব চলন প্রক্রিয়া। 
দুটি সামাজিক শ্রেণি প্রতিদিন বাঙালি সমাজে গা ঘেঁষাঘেঁষি করেই থাকে। চলাফেরা করে। যাতয়াত করে একই পাবলিক ট্র্যান্সপোর্টে। কেউ শহরে থাকে। কেউ গ্রামে। সমাজের দুই শ্রেণির মধ্যে একদল এলিট, শহুরে, আধুনিক, শিক্ষিত। আর অন্য দলকে ওই প্রথম শ্রেণিটি অতটা সাংস্কৃতিক, সামাজিক, চেতনাগতভাবে উচ্চমননের মনে করে না। 
এই দুই শ্রেণির মধ্যে আজ থেকে ৩০ বছর আগেও খুব বেশি সামাজিক চিন্তনের পার্থক্য চোখে পড়ত না। অনেকটাই একে অন্যকে চিনত। বুঝত। সেই কারণে দেখা যেত, সাংস্কৃতিক বোধের ক্ষেত্রেও অনেকটাই মিল পাওয়া যেত। একই বাংলা গান এলিট এবং নন এলিটের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছে। যেহেতু বাঙালিয়ানা মিশে ছিল পুরোদস্তুর। একই বাংলা সিনেমা শহর এবং গ্রাম উভয় ভৌগোলিক এবং সামাজিক স্তরেই সুপারহিট হয়েছে। 
বাংলার যাত্রাকে মনে করা হয় সম্পূর্ণ গ্রামীণ সংস্কৃতি। অথচ আটের দশকেও যাত্রা মফস্‌সল ও শহুরে সংস্কৃতিরও অঙ্গ ছিল। বিভিন্ন জেলা শহরের নিজস্ব ময়দানে যাত্রার আসর বসত নিয়ম করে। সার্কাস ছিল সর্বত্রগামী। 
মহুয়া রায়চৌধুরী, তাপস পাল, প্রসেনজিৎ, চিরঞ্জিৎ, দেবশ্রী রায়, শতাব্দী রায়, স্বপনকুমার, বীণা দাশগুপ্তাদের দুই সমাজের মানুষই মেনে নিয়েছে প্রিয় তারকা হিসেবে। পাশাপাশি চলেছে আর্ট ফিল্ম অথবা প্যারালাল সিনেমা, গ্রুপ থিয়েটার। কিন্তু দুই সমাজের পার্থক্যটা প্রবলভাবে প্রকট ছিল না। আজ যতটা হয়ে পড়ছে ক্রমাগত। 
ক্রমেই আরবান অটোক্রেসি গোটা সমাজকে দুই ভাগে বিভাজিত করে দিয়েছে অনেক বেশি প্রকারে। আমরা লক্ষ্য করলাম ধীরে ধীরে হাতিবাগান শ্যামবাজার পাড়ায় কমার্শিয়াল থিয়েটার বন্ধ হয়ে গেল। গিরীশ ঘোষ, অমৃতলাল বোস, বিনোদিনী দাসীরা যা জনপ্রিয় করেছিলেন, সেই কমার্শিয়াল থিয়েটারে উত্তমকুমার থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় অথবা অনুপকুমাররা অভিনয় করতেন। আম বাঙালি পুজোর বাজার এবং থিয়েটার একসঙ্গে উপভোগ করতেন উত্তর কলকাতার পাড়ায়। সেসব বন্ধ হল। তারপর বন্ধ হয়ে গেল তরুণ মজুমদার থেকে অঞ্জন চৌধুরী ধাঁচের আদ্যন্ত বাঙালির সিনেমা। আরবান এলিট থিয়েটার এবং সিনেমা ঢুকে পড়ল সংস্কৃতির চালিকাশক্তি হিসেবে। 
সমাজে যে দুই শ্রেণি বাস করে তাদের মধ্যে একটি শ্রেণি সরকারের উপর প্রবলভাবে নির্ভরশীল। চিকিৎসায় নির্ভরশীল। শিক্ষায় নির্ভরশীল।  যাতায়াতে নির্ভরশীল। কিন্তু অন্য অংশটি যারা মূলত আরবান মিডল ক্লাস ও এলিট, তারা সরকারের উপর নির্ভরশীল নয়। এই অন্য অংশটি প্রাইভেট ডাক্তারকে ভিজিট দিয়ে চিকিৎসা করে, স্বাস্থ্য বিমার মাধ্যমে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়। প্রাইভেট ক্লিনিকে ডায়গনস্টিক পরীক্ষা করায়। প্রাইভেট স্কুলে ছেলেমেয়েদের পড়ায়। সরকারি স্কুল হলে হাই প্রোফাইল বিখ্যাত স্কুলে। সাধারণ পুরসভা পরিচালিত স্কুলে পড়ে অন্য শ্রেণির ছেলেমেয়েরা। প্রাইভেট ট্রান্সপোর্টে সফর করতে পারে। অ্যাপ বেসড ক্যাব কিংবা এয়ারলাইন্স অথবা বন্দে ভারত। 
একটি শ্রেণি সরকারের থেকে যখন আর্থিক সহায়তা নেয় সেটিকে শহুরে এলিটের কিয়দংশ ভালো চোখে দেখে না। অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে এটা ভুল পদক্ষেপ, এরকম বলে থাকে। কেউ কেউ ভিক্ষা বলে বেশি ক্রুদ্ধ হয়ে। 
সমস্যা হল, সেই ৩০ বছর আগের মতো এখন আর গ্রাম শহর এলিট মিডল ক্লাস নিম্নবর্গ নির্বিশেষে সংস্কৃতির কোনও একটি অঙ্গ সকলের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এরকম আর হয় না। ভাগাভাগিটা প্রবল হয়ে গিয়েছে। আরবান এলিট ও মিডল ক্লাসের জন্য একরকমের সিনেমা তৈরি হয়। গান শোনা যায়। নাটক হয়। আধুনিক শহুরে সিনেমাকে ঝকঝকে নাগরিক তৈরি করার জন্য বাঙালি পরিবারের মেলোড্রামাকে বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু তাই বলে তো আর অঞ্জন চৌধুরী কিংবা সুখেন দাসদের সেই ফর্মুলা রাতারাতি  মন থেকে উধাও হয়ে গিয়ে নবজাগরণ আসেনি বৃহত্তর বাঙালি সমাজে!  সেই কারণেই কি বাঙালি ওই সমাজ দৈনিক টিভি সিরিয়ালে খু্ঁজে পেয়েছে হারানো মেলোড্রামাকে? ।  
এই কথাগুলি বলতে হল কেন? কারণ আর জি কর ইস্যুতে নাগরিকদের কাছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিচার চাওয়ার আন্দোলনে চমৎকার একটি সুযোগ এসেছিল এই আরবান মিডল ক্লাস ও এলিটদের সঙ্গে তুলনামূলক নিম্নবর্গের ভিন্ন সংস্কৃতির বাঙালি সমাজের একটি মেলবন্ধন ঘটানোর। অর্থাৎ এই আন্দোলনকে ভরকেন্দ্র করে সামগ্রিকভাবে বাঙালি সমাজের একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের রূপ দেখিয়ে দেওয়ার।  
অথচ হল না। হাজার হাজার নিম্নবর্গ এবং আরবান এলিট সমাজের বাইরের গ্রাম শহরের মানুষ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পেল না। তাদের পরিবারের সদস্যরা একে একে বিনা চিকিৎসায় মারা গেল। অপারেশন হচ্ছে না। এটা কিন্তু ঠিক উল্টো হতে পারত। এই মানুষগুলিকে আরও বেশি করে কাছে টানার সুবর্ণ সুযোগ ঘটেছিল। অর্থাৎ আন্দোলন চলুক। জুনিয়র ডাক্তারদের বিচারের দাবিতে কর্মসূচি একইরকম হোক। কিন্তু একইসঙ্গে সরকারি হাসপাতালে গরিবদের চিকিৎসা আরও বেশি করে করা যেত। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আরও বেশি বার্তা দেওয়া যেত যে, ডাক্তাররা সত্যিই কতটা মানবিক ও ঈশ্বরপ্রতীম। সেটা দেখে গরিব মানুষ দ্বিগুণ আশীর্বাদ ও আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে যেতেন। কেন হল না সেটা একটা রহস্য! 
সমাজের একটি অংশের জীবনে একটি শব্দ আছে। উইকএন্ড। ওই শব্দ যেদিন আসে, সেদিন অফিসে যেতে হয় না। কাজে যেতে হয় না। ছুটির দিন। নিজের মতো করে কাটানো যায়। সমাজের অন্য অংশ আছে, যাদের কাছে উইকএন্ড বলে কোনও শব্দ নেই। তাদের প্রতিদিন বেরনো এবং প্রতিদিন কাজ করে আয় করা। একটু চোখকান খোলা রাখলেই জানা যাবে আমাদের আশপাশে এরকম কী কী পেশা রয়েছে যেখানে এই উইকএন্ডহীন মানুষদের জীবন জীবিকা জড়িত। প্রতিদিন মিছিল, ধর্না, আন্দোলন হতেই পারে। কিন্ত নিয়ম করে রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে সর্বাত্মক একটি বন্ধ পরিষেবার চিত্র নির্মাণ করে নয়। 
 সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের যাতায়াতের অনিশ্চয়তায় প্রবল পেশাগত সঙ্কট সৃষ্টি না করেই আন্দোলন করা হলে সমর্থনের পরিধি কিন্তু আরও বাড়বে। নিম্নবর্গের মানুষও বেশি করে যোগ দেবে। নয়তো এই যে নন এলিট অংশ এরা ভাববে আমাদের জীবন সম্পর্কে এরা যেমন জানে না, আমাদের সমস্যা নিয়েও এদের মাথাব্যথা নেই। 
এই যে শোনা যায় একটি বাক্য, ‘যাই হোক না কেন, ডাক্তাররা যেন কর্মবিরতি চালিয়ে যায়। কিছুদিন চিকিৎসা না পেলে কিছু এসে যাবে না।’ এই বাক্যগুলি শুনলেই সৎ ও প্রকৃত বিচারপ্রার্থীদের কিন্তু সতর্ক হতে হবে। নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে যে, এটা কারা বলছে? কেন বলছে? তার উদ্দেশ্য আসলে কী? সে ঠিক কী চাইছে? গরিবের অসুবিধা করে, আমাদেরই রাজ্যবাসীকে প্রতিদিন বিপদে ফেলতে চাইছে কারা? ক্রমেই অচলাবস্থা সৃষ্টি হোক, এই ব্যাপারটা কাদের ঠিক কী ধরনের মুনাফা দেবে? সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা, গরিবের পরিবহণ ব্যবস্থা, এগুলো যদি দিনের পর দিন, মাসের পর মাসের বন্ধই থাকে কিংবা অনিশ্চিত হয়ে যায়, তাহলে সবথেকে বেশি প্রফিট হবে কাদের? 
নাগরিক আন্দোলন কীসের বিচার চাইছে? ঘৃণ্যতম অপরাধের। সিবিআই তদন্ত করছে। ধর্ষণ এবং হোমিসাইড। সবথেকে কঠিন একটি অপরাধের মামলা। অসংখ্য স্তর আছে তদন্তের। গ্রেপ্তার, চার্জ ফ্রেম, চার্জশিট, এক্সিবিট পেশ এবং এভিডেন্স। সেইমতো সিবিআই অগ্রসর হচ্ছে। সময়সাপেক্ষ। আইনে আছে এসব মামলায় দু মাসের মধ্যে চার্জশিট দিতে হবে। তারপর হবে শুনানি। সাক্ষ্য। বিচার। রায়। উচ্চ আদালতে যাওয়া। আইনের প্রক্রিয়াটি আমাদের বুঝতে হবে। তাহলে রাগ, আবেগের সঙ্গে আসবে বাস্তববোধ। আসবে ভাবনার সুস্থিতি। না জেনে নয়। আইনি প্রক্রিয়া জেনেই তদন্ত ও বিচারের দ্রুততার দাবিতে লাগাতার নাগরিক আন্দোলনের এই চাপ বজায় রেখে যেতে হবে। 
নাগরিক আন্দোলনের অভিমুখ হোক মানবিক। যারা আন্ডারপ্রিভিলেজড সমাজ, তাদের কাছে টেনে নিয়ে সবরকম সাহায্য দেওয়া হোক। নাগরিকরা যে তাদের পাশে আছে যে কোনও বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সেই বার্তা তাদের দেওয়া হোক। গরিব নিম্নবর্গকে যারা ঠকাচ্ছে, তাদের যারা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে, তাদের যারা প্রতারণা করছে সেইসব কিছুর প্রতিবাদ ও সুরাহার হাত বাড়িয়ে দিক নাগরিক সমাজ। বৈষম্য কাকে বলে, কারা করছে বৈষম্য এসব বোঝানো হোক তাদের। শামিল করা হোক অন্যায়ের প্রতিবাদে। তাদের কাছেও যেন আমরা শিখি জীবনবোধ এবং সংগ্রাম। আমরা সব জানি, তারা কম জানে, এরকম ভাবা নির্বুদ্ধিতা। তাই তাদের যেন বঞ্চিত করা না হয়। 
এসব না করে নিজেদের অজান্তেই তাদের কি দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না আরও? যেভাবে গত ৩০ বছর ধরে ক্রমেই তারা সরে গিয়েছে এলিট ও মিডল ক্লাস থেকে!  
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

ধর্মকর্মে সক্রিয় অংশগ্রহণে মানসিক তৃপ্তি ও সামাজিক সুনাম। পেশাদার শিল্পীদের শুভ সময়।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৫ টাকা৮৪.৮৯ টাকা
পাউন্ড১০৮.২৫ টাকা১১১.৮০ টাকা
ইউরো৯০.৭১ টাকা৯৩.৮৮ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা