জন্মদিন আসে, জন্মদিন যায়। কিন্তু তা মনে রেখে পালিত হয় খুব কম জনের। স্বামীজি, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজি, নেতাজি, নেহেরু, রাধাকৃষ্ণাণ-সহ হাতেগোনা কয়েকজনকেই আমরা সশ্রদ্ধায় স্মরণ করি। কিন্তু স্মরণীয় মনীষীর সংখ্যা আরও অনেক বেশি। কেননা তাঁদের অকল্পনীয় আত্মত্যাগের ফলেই এই বাংলা, এই দেশ বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। এই বিস্মৃতপ্রায় মনীষীদের মধ্যেই একজন ডাঃ রাধাগোবিন্দ কর। কলকাতায় আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালটি তাঁরই নামে। সেখানে অসংখ্য মানুষ চিকিৎসা পান, বহু মানুষকে পুনর্জন্ম দিয়েছে সেখানকার পরিষেবা। তবু কমজনই জানে এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পিছনে মূল অবদানটি কার। ডাঃ আর জি করের পুরো নামটিও সকলে অবগত নন। কিছু মানুষের মুখের কথায় ‘আর জি কল’ পর্যন্ত হয়ে আছে! সেখানে ডাক্তার রাধাগোবিন্দ করের জন্মদিবস পালনের কথা তেমন শোনা যায় না। গত ২৩ আগস্ট তাঁর জন্মদিন পালিত হল এবং কাগজে ছাপা হল তাঁর ছবি। উপলক্ষটি সুখস্মৃতি হিসেবে রয়ে যাবে না। এক বিষাদের আবহে এবারের এই মনীষীস্মরণ। ওই হাসপাতালের ভিতরে এক স্থানে কিছু প্রতিবাদী ডাক্তারের অবস্থান মঞ্চে জন্মদিনটি পালিত হল। সারা দুনিয়া ইতিমধ্যেই জেনে গিয়েছে কী জন্য এই প্রতিবাদ, কী কারণে এই অবস্থান। মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গে ৩৫, সারা ভারতে সাতশোর বেশি। কিন্তু এগুলি নিয়ে বহির্ভারতে কতটা আলোচনা হয়? বিশেষ একটা কানে আসে না। তবে সাম্প্রতিক ঘটনার প্রেক্ষিতে আর জি কর নামটি আন্তর্জাতিক পরিসরেই জায়গা করে নিয়েছে। প্রতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়েছে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বহু দেশে। ২২ আগস্ট ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ প্ল্যাকার্ড হাতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয় লন্ডন, বার্মিংহাম, মিল্টন, কেইনস, গ্লাসগো-সহ ব্রিটেনের ১৬টি শহরে। যাঁর নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠান ঘিরে এত কাণ্ড এবং যাঁকে স্মরণ করা হল একেবারেই এক ব্যতিক্রমী অবকাশে, তাঁর সম্পর্কেই আলোচনা করা যাক কিছু কথা, যদিও অংশবিশেষ অনেকের জানা। ডাঃ করের মানবসেবার স্বপ্ন যাঁদের অকুণ্ঠ সহযোগিতায় সাকার হয়ে উঠেছে এই উপলক্ষ্যে স্মরণীয় তাঁরাও।
১৮৮৬ সাল। চিকিৎসাশাস্ত্রে বিলাতি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরলেন রাধাগোবিন্দ কর। ১৮ অক্টোবর ডাকলেন একটি সভা। যোগ দিলেন মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার দত্ত, বিপিনবিহারী মৈত্র, এম এল দে, বি জি বন্দ্যোপাধ্যায়, কুন্দ ভট্টাচার্য-সহ অনেক সম্মাননীয় চিকিৎসক। তাঁরা একটি বেসরকারি মেডিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিলেন। কলকাতায় ১৬১ বৈঠকখানা বাজার রোডে গড়ে উঠল দেশের প্রথম নন-অফিসিয়াল মেডিক্যাল স্কুল—দ্য ক্যালকাটা স্কুল অফ মেডিসিন। পরে স্থানান্তরিত হল বউবাজার স্ট্রিটের দুটি (যথাক্রমে ১৫৫ এবং ১১৭) ঠিকানায়। ১৮৮৭-তে নতুন নাম পেল দ্য ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুল। সরকারি পাঠক্রম গ্রহণসহ চালু হল বাংলা মাধ্যমে তিনবছরের কোর্স। পরিচালনার জন্য ১৮৮৯ সালে গড়া হল একটি সোসাইটি। প্রথম প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি নির্বাচিত হলেন যথাক্রমে ডাঃ লালমাধব মুখোপাধ্যায় ও ডাঃ আর জি কর। চিকিৎসাশাস্ত্র তো পড়ানো হবে, কিন্তু হাতে-কলমে শিক্ষার কোনও হাসপাতাল যে নেই! সেখানকার ছাত্ররা ট্রেনিংয়ের অনুমতি পেলেন চাঁদনি অ্যান্ড মেয়ো হসপিটালে। শবব্যবচ্ছেদেরও অনুমতি মিলল শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থী সংখ্যা পৌঁছল ২৬০-এ। তাঁদের পড়াতেন লালমাধব মুখোপাধ্যায়, আর জি কর, নীলরতন সরকার এবং সুন্দরীমোহন দাসদের মতো প্রথিতযশা পণ্ডিতগণ।
১৮৯৫ সালে ‘কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস অফ বেঙ্গল’ নামে আরও একটি নন-অফিসিয়াল মেডিক্যাল ইনস্টিটিউশন কলকাতায় গড়ে ওঠে। ২৯৪ আপার সার্কুলার রোডে সেই প্রতিষ্ঠানের ১৪ বেডের একটি হাসপাতালও ছিল। তারা পড়াত চারবছরের কোর্স, কিন্তু তাদের ছাত্র ছিল মাত্র ১২ জন। অন্যদিকে, ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুল ১৮৯৭ সালে সরে গেল ২২৮ আপার সার্কুলার রোডের ঠিকানায়, জায়গাটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স কলেজ সংলগ্ন। পরের বছর ২৫ হাজার টাকায় কেনা হল বিঘে ১২ জমি এবং তার উপর ৭৫ হাজার টাকায় তৈরি হল ৩০ শয্যার একতলা হাসপাতাল বাড়ি। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজটির এখন ওই জমিতেই। ওই ভবন নির্মাণের জন্য ১৫ হাজার টাকা পাওয়া গিয়েছিল প্রিন্স আলবার্ট ভিক্টরের সফর উপলক্ষ্যে। এজন্য ভবনটি হয়েছিল তাঁরই নামাঙ্কিত। ১৯০২ সালে আলবার্ট ভিক্টর হসপিটলের (এভিএইচ বিল্ডিং) উদ্বোধন করেন বাংলার তৎকালীন গভর্নর স্যার জন উডবার্ন। অনেকখানি জায়গা পাওয়ায় ১৯০৩ সালে ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুলের বিভিন্ন বিভাগ উঠে যায় সেখানেই। পরের বছর যোগ হয় পান্নালাল শীল আউটডোর ব্লক। সেটি নির্মাণের জন্য ১২ হাজার টাকা দান করেন বাবু মানিকলাল শীল। বিল্ডিং ফান্ডের সমৃদ্ধির জন্য বহু টাকা দান করেন একাধিক দানবীর। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী বাহাদুর এবং বাবু রামচন্দ্র ভুর। বেশকিছু অর্থ দান করেছিল বাংলার সরকারও। ১৯০৪ সালেই ‘ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুল’ এবং ‘কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস অফ বেঙ্গল’ একসঙ্গে মিশে যায়। নতুন প্রতিষ্ঠান নাম নেয় ‘দ্য ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস অফ বেঙ্গল’। নতুন এই প্রতিষ্ঠানের স্কুল বিভাগে চালু হয় বাংলা মাধ্যমে চারবছরের কোর্স এবং কলেজ বিভাগে ইংরেজি মাধ্যমে পাঁচবছরের কোর্স। এভিএইচ বিল্ডিংয়ের দোতলা নির্মাণে ১৯০৯-এ অর্থ দান করেন পোস্তা রাজ পরিবারের রানি কস্তুরী। বেড সংখ্যা ৪০ থেকে বেড়ে ১০০ হয়ে যায়। নতুন ব্লকের উদ্বোধন করেন বাংলার তৎকালীন গভর্নর স্যার এডওয়ার্ড বেকার। ভবন উদ্বোধন করতে এসে তিনিও কিছু টাকা দেন। অর্থ সাহায্য দেন বাবু দেবপ্রসন্ন ঘোষও। পরের বছর বেশকিছু অর্থ সাহায্য করে মন্মথ ভট্টাচার্য মেমোরিয়াল কমিটি এবং কিং এডওয়ার্ড মেমোরিয়াল কমিটি। ১৯১১ সালে ভারতভ্রমণে এসে রাজা পঞ্চম এডওয়ার্ড এবং রানি মেরিও এই প্রতিষ্ঠানের পাশে দাঁড়ান।
দেশে ডাক্তারের সংখ্যা বাড়াতে বিভিন্ন বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানকে একত্র হওয়ার প্রস্তাব দেয় সরকার। ১৯১৪ সালে ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জেনস অফ বেঙ্গল এই ব্যাপারে বিশেষ দায়িত্ব পালন করে। তাদের এই কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর ১৯১৬ সালের ৫ জুলাই আত্মপ্রকাশ করে নতুন এক মেডিক্যাল কলেজ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সেটি নাম নেয় ‘বেলগাছিয়া মেডিক্যাল কলেজ’। উদ্বোধন করেন গভর্নর লর্ড কারমাইকেল। এমবি কোর্স করার জন্য প্রথম ব্যাচে ভর্তি সুযোগ পান ৪৮ জন। পরের বছর ১০০ জনকে ভর্তির অনুমতি দেয় বিশ্ববিদ্যালয়। মেডিক্যাল কলেজের সুষ্ঠু পরিচালনার উদ্দেশ্যে ১৯১৮ সালে তৈরি করা হয় মেডিক্যাল এডুকেশন সোসাইটি অফ বেঙ্গল। তার প্রথম প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি নির্বাচিত হন যথাক্রমে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস পি সর্বাধিকারী ও ডাঃ আর জি কর। দুর্ভাগ্য যে, ওই বছরই ১৯ ডিসেম্বর ডাঃ করের মৃত্যু হয়। ১৯১৯-এ বেলগাছিয়া মেডিক্যাল কলেজ ‘ফাইনাল এমবি স্ট্যান্ডার্ডে’ উত্তীর্ণ হয় এবং সেখানকার ল্যাবরেটরি ঢেলে সাজার জন্য অনুদান দেয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলার সরকার। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ প্রতিষ্ঠানটি লর্ড কারমাইকেলের নামাঙ্কিত হয়। এর পরবর্তী ইতিহাস ও পরম্পরা বাংলার চিকিৎসাশাস্ত্রের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। এখানে চালু হয় সার্জিক্যাল, প্যাথলজি, অ্যানাটমি, চিলড্রেন, মেটারনিটি প্রভৃতি ব্লক এবং টিবি স্যানাটোরিয়াম। এখানকার প্রাক্তনীরা উচ্চতর শিক্ষার জন্য পাড়ি দিলেন বিলেতে। তাঁরা দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়লেন সেবাকার্যে এবং শিক্ষকতায়। ১৯৩৩ সালে এখানে যুক্ত হয় সাইক্রিয়াট্রিক ওপিডি। এশিয়া মহাদেশে প্রথম কোনও হাসপাতালে এমন একটি বিভাগ চালু হল। এর পুরো কৃতিত্ব ছিল প্রফেসর গিরীন্দ্রশেখর বসুর (উল্লেখ্য, তিনি সাহিত্যিক রাজশেখর বসুর ভাই)। এশিয়ার প্রথম বেসরকারি চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাধীনতার পরপরই, ১৯৪৮ সালের ১২ মে গ্রহণ করল আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল নামটি। প্রতিষ্ঠানটির জন্য ডাক্তার রাধাগোবিন্দ করের যথাসর্বস্ব দানের পর, নিঃসন্দেহে, এটাই ছিল দেশবাসীর সেরা শ্রদ্ধার্ঘ্য। এখানকার প্রাক্তনীদের নাম যুক্ত হল লন্ডন এবং মেলবোর্ন ওলিম্পিকসের সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ করে ১৯৫৮ সালে। এখানকারই প্রাক্তনী ডাঃ প্রীতিকুমার রায়চৌধুরী কলকাতা পুরসভার মেয়র হন। এছাড়া একাধিক প্রাক্তনী হয়েছেন মন্ত্রী এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন নামী প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদাধিকারী। এই প্রতিষ্ঠানের পিছনে বিশেষ অবদান রয়েছে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়, ডাঃ নীলরতন সরকার, স্যার রাসবিহারী ঘোষ, স্যার তারকনাথ পালিত, ডাঃ কেদারনাথ দাস-সহ বহু মনীষীর।
তাই যখন এই হাসপাতালের দুর্নাম হয়, এখানকার চিকিৎসার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়, আর্ত অসহায় গরিব মানুষ দিনের পর দিন চিকিৎসা না-পেয়ে ফিরে যান, তখন শুধু একটি মেডিক্যাল কলেজ কিংবা সরকার অথবা শাসক কলঙ্কিত হয় না। বস্তুত স্বপ্নভঙ্গ হয় বহু দানবীর ও কৃতী মানুষের, যাঁদের অক্লান্ত দানে তিলে তিলে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল আজকের চেহারায় মাথা তুলে আছে। এই প্রতিষ্ঠানের একদা অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে যে দুর্নীতি এবং অমানবিকতার অভিযোগ উঠেছে, মানুষ এসব আর দেখতে চায় না। মানুষ শুনতে চায় না এখানে রোগী ভর্তি নিয়ে দালাল চক্র চলে। তারা বরদাস্ত করে না একজনও রোগীর প্রতি ডাক্তার কিংবা নার্সের অবহেলা। মানুষ দেখতে চায়—মানবদরদি রাধাগোবিন্দ করের স্বপ্ন তাঁরই প্রতিষ্ঠানে সবরকমে পূরণ হয়েছে; সার্থক হয়েছে বাকি স্বপ্নদ্রষ্টাদেরও ত্যাগের ব্রত, যাঁরা এই প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে শুধু মানবসেবারই স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁদের মূল স্বপ্ন ছিল, মানবিকতা ও সেবার পরীক্ষায় শীর্ষস্থান নেবে এই প্রতিষ্ঠান। ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে রোগীদেরও অধিকার ও পূর্ণ নিরাপত্তা সমানভাবে প্রতিষ্ঠিত হলেই তাঁদের সকলের স্বপ্ন সার্থক হবে একযোগে। এই দায়িত্ব কারও একার নয়, আমাদের সকলের।