সমাজে দুই রকম শক্তি আছে। ভিড়ের শক্তি। আর একক শক্তি। ভিড়ের শক্তির মধ্যে অনেক সময় মিশে থাকে একটি বিভ্রান্তি। সেটি হল, ওই দলবদ্ধ শক্তিকেই নিজের শক্তি হিসেবে ভেবে নেওয়া। এবং আমিও খুব শক্তিশালী, এই মনোভাবে নিজেকে নিজে তুষ্ট করা। এরকম শক্তির উদাহরণ অসংখ্য। যেমন লোকাল ট্রেনের ডেইলি প্যাসেঞ্জার। পার্কে দলবদ্ধ হয়ে আড্ডা দেওয়া বন্ধুর দল। পাড়ার ক্লাবের উচ্চকিত আচরণ। রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক মিছিল কিংবা সমাবেশ। দল বেঁধে বেড়াতে অথবা পিকনিকে যাওয়া। এই প্রতিটি ক্ষেত্রে ভিড় তথা সমষ্টির অংশ হয়ে গিয়ে একটি অনুভূতি হয় যে, আমিও আসলে শক্তিশালী। আমাকে বুঝি অন্যরা ভয় পায় খুব! সেই বিভ্রান্তি ভেঙে যায় যখন আবার একা একা ফিরতে হয় ঘরে অথবা কর্মস্থলে। একটু আগেই যে মানুষটিকে দেখা গিয়েছে প্রবল উদ্ধত এবং সাহসী শরীরী ভঙ্গিতে, সেই তাকেই একা ট্রেনে, বাসে, কর্মস্থলে, ঘরে দেখা যায় অত্যন্ত নিরীহ হয়ে থাকতে। একের বিরুদ্ধে এক অবস্থায় তাদের মেরুদণ্ডকে অতটা ঋজু দেখতে পাওয়া যায় না। একা হয়ে গেলেই এই মানুষেরাই আপস করে। মেনে নেয়। পিছিয়ে আসে। ভয় পায়। রুখে দাঁড়ায় না। প্রতিবাদ করে না। তার মানে কি ভিড়ের সমষ্টিগত শক্তি নেই? ১০০ শতাংশ আছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ভিড় আবশ্যক। যাতে অন্যায়কারী ভয় পায়। ভবিষ্যৎ অন্যায়কারীও আতঙ্কিত হয় মানুষের রোষে।
কিন্তু পাশাপাশি আত্মপ্রশ্নও করতে হয় যে, আমি এককভাবে কতটা শক্তিশালী? সামাজিকভাবে ঠিক কী অবদান রেখেছি? সমাজে আমার অস্তিত্বগত প্রভাব কতটা স্থাপন করতে পারলাম? আমি কি এমন কিছু করেছি যা সামাজিক অথবা পারিবারিকভাবে রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে থেকে যাবে? অর্থাৎ অন্যরা আমাকে নিয়ে কিছু একটা সাধনা অথবা অ্যাচিভমেন্টের জন্য শ্রদ্ধা করবে? আমাদের নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে আমরা কি সামাজিক ও পারিবারিকভাবে সমীহ এবং শ্রদ্ধা পাই? আমার মৌলিক স্কিল কোনটা? যদি না খুঁজে পাই তাহলে সেই লক্ষ্যে কিছু একটা করা উচিত কি? নাকি চিরদিন ভিড়ের অঙ্গ হয়েই কাটিয়ে দেব? আমি কি নিছকই একটি সংখ্যা। ভোটার কার্ড, আধার কার্ড এবং ভিড়ের মুখের?
নানাবিধ ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে আমাদের সকলের অলক্ষ্যে কয়েকটি একক শক্তিকে জয়ী হতে দেখে এক বিশেষ আশাবাদের জন্ম হয়। ভিড়ের মধ্যে থেকেও যে নিজেকে পৃথক এক শক্তির আধার হিসেবে প্রতিভাত করা সম্ভব এবং ভিড়ের মধ্যেই নির্জন এক সাধনায় সিদ্ধিলাভও হতে পারে এই উদাহরণগুলি থেকে সেটা যেন প্রতীয়মান। আমাদের আশপাশেই আপাত আনইমপ্রেসিভ কিছু মুখ নিজেদের একটি গোপন যুদ্ধ করে চলেছে। এবং সফল হচ্ছে। সম্প্রতি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে পাওয়া গেল এরকম কিছু আশ্চর্য তথ্য।
১৯ বছরের মঙ্গলা মুদুলি একটি বিপ্লব ঘটিয়েছে। ভারতের অন্যতম প্রাচীন উপজাতি সম্প্রদায় হল বোন্দা। সেই বোন্দা উপজাতির মধ্যে সর্বপ্রথম ডাক্তারি ছাত্র হতে চলেছে মঙ্গলা মুদুলি। ওড়িশার মালকানগিরি জেলার বাদবেল গ্রামটি জঙ্গল লাগোয়া। রাস্তাঘাটও নেই। সেই বাদবেল গ্রাম থেকে ৪৫০ কিলোমিটার দূরের বেরহামপুর এমকেজিজি মেডিক্যাল কলেজে এবার ডাক্তারি পাঠ শুরু করবে মঙ্গলা। ডাক্তারি পরীক্ষা অর্থাৎ ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি কাম এন্ট্রান্স টেস্টে (নিট) মঙ্গলা পাশ করে গত ৩০ আগস্ট ভর্তি হয়েছে এই কলেজে। কতটা অনগ্রসর বোন্দা উপজাতি? মাত্র ২০ বছর আগেও যাদের সঙ্গে বহির্জগতের প্রায় কোনও সম্পর্কই ছিল না। রেশনের জন্য বহু পথ হেঁটে নিকটতম কোনও গণবণ্টন কেন্দ্রে আসা ছাড়া ভারতের যে যে প্রান্তে এই সম্প্রদায় রয়েছে, তারা নিজেদের মতো এক বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবনই কাটায়। ধীরে ধীরে সেই প্রবণতা কমেছে। অরণ্য জীবন ছেড়ে কেউ কেউ অন্য শহর অথবা গঞ্জে কাজের খোঁজেও যায় ও চলে গিয়েছে। কিন্তু এই প্রথম বোন্দা সম্প্রদায়ের কেউ ডাক্তার হবে।
মুদুলিপাড়া স্কুলে যেতে হতো কীভবে? জঙ্গল ও চড়াই উতরাই পেরিয়ে ৬ কিলোমিটার হাঁটা। এভাবেই ম্যাট্রিকুলেশনে ৫০ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করেছিলেন মঙ্গলা। নিয়ম হল, এরপরই পড়াশোনা শেষ হওয়া। কারণ আশপাশে আর স্কুল নেই। পড়া চালানোর আর্থিক ক্ষমতাও নেই। মঙ্গলার নিজের দাদাও মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছে। কিন্তু যথানিয়মে তারপর স্কুল ড্রপআউট হয়েছে। আর রীতি অনুযায়ী চলে গিয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশে কনস্ট্রাকশন সাইটে কাজ করতে। কেন? কারণ ক্লাস টেনের পর পড়াশোনা করতে হলে ২৬ কিলোমিটার দূরে যেতে হবে।
মঙ্গলার স্বপ্ন পূরণ করতে এগিয়ে এসেছিলেন স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক উৎকল কেশরী দাস। তিনি নিজের গ্রামের বাড়ি বালেশ্বরে মঙ্গলাকে রাখার ব্যবস্থা করেন। মঙ্গলা সেখান থেকে স্কুলে যেত সাইকেল চালিয়ে ১৬ কিলোমিটার। আর একটি কোচিং সেন্টারে ৮ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে। মেডিক্যাল পরীক্ষার প্রশিক্ষণ নিতে। মঙ্গলা কত পেয়েছে নিট পরীক্ষায়? ৩৪৮। উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলির মধ্যে তার র্যাঙ্ক ২৬১। উপজাতিদের মধ্যে সবথেকে পিছিয়ে পড়া হিসেবে সরকারি তালিকায় যে কয়েকটি সম্প্রদায়ের নাম রয়েছে, মঙ্গলা সেই উপজাতির। মঙ্গলার এই সফল জার্নি নিছক ৪৫০ কিলোমিটার অতিক্রান্ত করল এমন নয়। আসলে কয়েক হাজার বছরের!
১৬ বছর বয়সে মহমম্দ আমন অনাথ হয়ে গেল। ২০২০ সালে মা সাইবা বেগমের মৃত্যু হয়েছিল কোভিড আক্রান্ত হয়ে। বাবা ট্রাক চালক। মেহতাব আলম। কোভিডের পর থেকেই রুগ্ণ হয়ে গেলেন। ২ বছর পর তাঁরও আকস্মিক ঘটল মৃত্যু। হঠাৎ ১৬ বছরের মহম্মদ আমন হয়ে গেল পরিবারের প্রধান অভিভাবক। কারণ তার ছোট তিন ভাইবোনও অনাথ। তারা আমনের মুখ চেয়েই রয়েছে। আমনের স্বপ্ন কী? ক্রিকেটার হওয়া। উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুরের বাসিন্দা আমনের ছিল আন্ডার নাইনটিন রাজ্য ক্রিকেট টিমে সুযোগ পাওয়া। সেসব হওয়ার আর সুযোগ রইল না। কোচ রাকেশ গোয়েলকে আমন বলেছিল, কোনও কাপড়ের দোকানে একটা কাজ জুটিয়ে দিন স্যার। বাড়িতে ভাইবোনকে খাওয়াতে হবে। রাকেশ গোয়েল রাজি হননি। তিনি এই ছেলেটার মধ্যে প্রতিভাব স্ফূরণ দেখেছেন। তাই তিনি বললেন, আমার অ্যাকাডেমিতে যে বাচ্চারা আসে তাদের তুমি ক্রিকেট প্রশিক্ষণ দাও। আমি তোমাকে বেতন দেব। দিনে আট ঘণ্টা সেই অ্যাকাডেমি মাঠেই কাটিয়ে দিয়েছে আমন। অতিরিক্ত আয়ের জন্য করেছে মালির কাজ। জল দেওয়া, ঘাস ছাঁটা। আর নিজের ট্রেনিং ভোরে।
কানপুরে যখন আন্ডার নাইনটিন কোয়ালিফাই রাউন্ড চলছে, তখন ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন থেকে কিছু টাকা দেওয়া হয়েছিল দৈনিক অ্যালাওন্স। আমন জেনারেল কামরায় বাথরুমের পাশে ক্রিকেট কিট নিয়ে যাতায়াত করেছে। আর সে প্র্যাকটিস করে নিয়েছিল একটি কঠিন জিনিস। একবেলা খাওয়া। সে একবেলা খেলে ভাইবোনেরা দু বেলা খাওয়া পাবে। অতএব ওই প্র্যাকটিস কাজে এসেছে। মহম্মদ আমন কে? এখন ভারতের আন্ডার নাইনটিন অর্থাৎ জাতীয় জুনিয়র ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন!
স্বামী পবন বলেছিল, এই বয়সে পড়াশোনা করে কি ডাক্তার হবি নাকি? এই ব্যঙ্গের কোনও জবাব দেয়নি রানি। বুঝেছিল যে লড়াইটা আসলে শুরু হল। স্বামী ভোপালে দৈনিক মজুরিতে কাজ করে। দিল্লির টিমারপুরে থাকা স্ত্রী ও দুই পুত্রকে দেখতে আসে মাঝেমধ্যে। যখন পবন আসে, তখনই রানির একটু সমস্যা হয়। কারণ ৪০ বছরের রানি যে সত্যিই স্কুলে ভর্তি হয়ে আসলে পড়াশোনা করছে সেটা স্বামী জানেই না। চার বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করা রানি যে পড়তে পারে না সেটা জানতে পেরে একদিন একটি সংবাদপত্রের ক্লিপিং দেখিয়ে বলেছিল, রানি, এই দ্যাখ, তুইও ইচ্ছা করলে ভর্তি হতে পারবি। এটা নিয়ে যায়। রানি নিজে পড়তে পারে না। তাই বাড়িতে সেই ক্লিপিং নিয়ে এসে ছেলেকে বলেছিল, এটা কী লেখা? ছেলে সমীর ক্লাস টুয়েলভ। সে বলেছিল, কিদওয়াই নগরে একটা স্কুলে বয়স্ক মহিলাদের ভর্তির ব্যবস্থা করছে। যারা স্কুলে বেশি পড়তে পারেনি। ছেলেই বলল, তুমি পড়বে? মা রাজি! ভয়ে ভয়ে।
সেই শুরু। ৪০ বছরের রানি এখন কিদওয়াই নগর সেকেন্ডারি স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। অন্য বালিকাদের সঙ্গে প্রতিদিন সে ক্লাস করে। পবন জানে যে সে ওখানে সাফাইয়ের কাজ করে। কিন্তু আসলে রানি ছাত্রী! কিন্তু স্কুলের পড়াই তো পরীক্ষা পাশের জন্য যথেষ্ট নয়। আলাদা টিউশন নিতে হবে। ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া রানি তো অনেক বছর পড়াশোনার বাইরে। তাই বুঝতে অসুবিধা হয়। রানি টিউটর পেয়েছে। কে? তার দুই ছেলে সমীর ও দীপক। দুজনেই কলেজে পড়ে। পেরেন্ট টিচার্স মিটিং-এ রানির হয়ে কে যায় স্কুলে? যে কোনও এক পুত্র! রানির জেদ ছিল, আমি স্কুলে ভতির হবই। পড়াশোনা শিখতেই হবে। সর্বশেষ বার্ষিক পরীক্ষায় রানি অঙ্কে কত নম্বর পেয়েছে? একশোয় ৭৮! সহপাঠীরা তাদের নতুন বন্ধুকে কী নামে ডাকে? রানি আন্টি!
মঙ্গলা, মহম্মদ আমন অথবা রানি। নিত্যদিনের ভিড়ের অলক্ষ্যে একক শক্তির সামাজিক রূপকথাগুলি এগিয়ে চলেছে।