বিশেষ নিবন্ধ

ধর্ম আগে, নাকি দেশ? জানে না বাংলাদেশ
মৃণালকান্তি দাস

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির হলে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছিল ‘বাংলাদেশ পলিসি ডিসকোর্সের (বিপিডি)’ ব্যানারে। ১ সেপ্টেম্বর সেই আলোচনা সভার শিরোনাম ছিল ‘পিলখানা হত্যাকাণ্ড: হাসিনা ও ভারতের ষড়যন্ত্র’। তবে এই শিরোনামের উপর আলোচনা হয়েছে সামান্যই। পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে বক্তারা যতটুকু আলোচনা করেছেন, তার সারমর্ম এখন কারও অজানা নয়। ‘দেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে ওই হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল। এর পিছনে শেখ হাসিনা ও ভারতের ষড়যন্ত্র ছিল। এই হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার হয়নি।’ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এইসব বয়ান সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল দ্রুত।
আলোচনাসভার আসল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে ‘ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা’-র প্রচার। মূল আলোচক মহম্মদ জোবায়েরের পরিচয় দেওয়া হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং হিজবুত তাহরিরের সদস্য হিসেবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে এই হিজবুত তাহরির মতো নিষিদ্ধ জেহাদি সংগঠনের পুনঃপ্রবেশ এক অশুভ লক্ষণ তো বটেই। এই হিজবুত তাহরির ৯ আগস্ট বাংলাদেশকে ‘খেলাফত’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে প্রকাশ্যে জনসভার আয়োজন করেছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক শূন্যতার এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা এর আগে কখনও ঘটেনি। তাতে অবশ্য ‘বিপ্লবী’-দের কিছু যায় আসে না। কারণ, ক্ষমতার স্বাদ পেলে বিপ্লবীদের মস্তিষ্কেও দ্রুত পচন ধরে। শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকতে তাঁরা এখন ইসলামিক কট্টরপন্থীদেরও হাত ধরতে রাজি। যার প্রমাণ, নাস্তিক ব্লগারদের হত্যার জন্য দায়ী জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লা বাংলা টিমের প্রধানের কারাগার থেকে মুক্তি।
যতটা ভাবা হয়েছিল, পরিস্থিতি তার চেয়েও অনেক-অনেক খারাপ। তথ্য বলছে, শেখ হাসিনার আমলে দু’শোর বেশি কট্টরপন্থী নেতাকে নানা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এদের অনেকের সঙ্গেই সরাসরি সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। ইতিমধ্যেই সেইসব নেতাকে মুক্তি দেওয়া শুরু করেছে ইউনুসের তদারকি সরকার। তালিকায় এক নম্বর নাম, আনসারুল্লা বাংলা টিমের প্রধান জসিমুদ্দিন রহমানি। ১১ বছর আগে গ্রেপ্তার হওয়ার সময় এই রহমানি ছিল বাংলাদেশে আল-কায়েদার টপ এজেন্ট। রহমানির মতো আরও কয়েকজন কট্টর জঙ্গি মুক্তি পেয়েছে। আর মুক্তি পেয়েই তারা ইসলামিক শাসনের দাবিতে জনমত গঠনে নেমে পড়েছে। এ ব্যাপারে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তদারকি সরকারের তিন সদস্য। খবর আসছে, ইউনুসকে নাকি বলে দেওয়া হয়েছে, এনিয়ে মাথা না ঘামাতে। এবং ইউনুস সেটা মেনেও নিয়েছেন।
বাংলাদেশের সেনার সামনেই ফুলের বৃষ্টিতে বরণ করা হয়েছে মুফতি জসিমউদ্দিনকে। তাকে দেখতে জনতার ঢল। জঙ্গি নেতাকে প্রায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পাহারা দিয়েছে সেনা! ঢাকার রাজপথে এমন দৃশ্য তুলনা করা হচ্ছে পাকিস্তানের লাহোরে মুম্বই হামলার মূল চক্রী হাফিজ সাইদের জনসভার সঙ্গে। ঢাকার কেন্দ্রীয় জেল থেকে মুক্তি পেয়ে জনতার ভিড়ে জঙ্গি নেতার আস্ফালন ‘প্রতিশোধ চাই’। মুফতি জসিমউদ্দিনের এমন ঘোষণার পর জনতার তীব্র চিৎকার ‘প্রতিশোধ, প্রতিশোধ’। কার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ? এই ব্যাখ্যায় মুফতি জসিমউদ্দিন প্রকাশ্যে বলেছে, ‘শেখ হাসিনা দেখুন আপনি যাকে 
জেলে রেখেছিলেন সে আজ বাইরে। আর আপনি দেশের বাইরে।’
মুফতি জসিমউদ্দিন ‘আনসারুল্লা বাংলা টিম’ (এবিটি)-এর আধ্যাত্মিক গুরু ও প্রধান। ইয়েমেনি আল-কায়েদার নেতা আনোয়ার আল-আওলাকির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সে এই জঙ্গি সংগঠনের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল বলে অভিযোগ। ২০১৩ সালের পর থেকে একের পর এক লেখক-ব্লগারসহ প্রগতিশীল ব্যক্তিকে হত্যা এবং হামলার নিশানা করে দেশ-বিদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল সংগঠনটি। যার অভিঘাত ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা বাংলাদেশে। রাজীব হায়দারসহ তিন ব্লগারকে হত্যার দায় স্বীকার করে ভিডিও প্রকাশ করেছিল আল-কায়েদার দক্ষিণ এশিয়া বিভাগ। আসলে এ-সবের হোতা ছিল বাংলাদেশের ভিতরই গজানো নতুন সংগঠন: আনসারুল্লা বাংলা টিম। আল-কায়েদা দক্ষিণ এশিয়ায় ফ্র্যাঞ্চাইজি নেটওয়ার্ক বিস্তারের ডাক দেওয়ার পর বাংলাদেশে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির মধ্যে শুরু ছিল প্রতিযোগিতা। একের পর এক হত্যালীলা চালিয়ে সেক্ষেত্রে এগিয়ে গিয়েছিল আনসারুল্লা বাংলা টিম।
বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীতির ধারা পুরনো। কিন্তু জঙ্গিবাদের প্রকাশ নব্বই দশকের শেষ দিকে। ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচি সংস্কৃতিক গোষ্ঠী ও ২০০১ সালে ঢাকার রমনা বটমূলে নববর্ষের অনুষ্ঠানে হামলার মধ্যে দিয়েই বাংলাদেশে প্রথম তালিবানি ধাঁচের সন্ত্রাসের আমদানি। আবার নতুন সহস্রাব্দে এসে জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড দু’টি পর্বে ভাগ হয়ে যায়: ‘লাদেন’ আর ‘আওলাকি’ পর্ব। লাদেন পর্বের নেতারা দেশজুড়ে সংগঠন তৈরিতে মন দিয়েছিল। তাদের সদস্য ছিল মাদ্রাসা ও গ্রাম থেকে আসা মানুষ। লক্ষ্য ছিল, সন্ত্রাসের পথে অরাজকতা তৈরি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল ও শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা। তাদের মূল কৌশল ছিল বোমাবাজি। এই ‘লাদেন’ ঘরানার পুরোভাগে থাকা প্রধান দু’টি গোষ্ঠী হল হরকাতুল জিহাদ (হুজি) ও জামায়েতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)। দুইয়েরই উত্থান বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে (২০০১-০৬)। বিএনপি একসময় জেএমবির অস্তিত্ব অস্বীকার করত, আন্তর্জাতিক চাপে পরে তাকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হয়। এর কিছু দিন আগে হুজিও নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু জঙ্গি দমনের আসল অধ্যায়ের শুরু বিএনপি আমলের পরে। ২০০৭-০৮-এর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামি লিগ সরকার সেই ধারাকে জোরদার করে। গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি হয় অনেক জঙ্গি নেতা। এই ভাবে এই দশকের শুরুর দিকে অনেকটাই থিতিয়ে যায় লাদেনি সংগঠনগুলি।
লাদেনি পর্বের সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় নতুন ধাঁচের জঙ্গি মতবাদ। যার মূল প্রেরণা আনওয়ার আল-আওলাকি। ইয়েমেনে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হলেও ভিডিও মারফত আওলাকির মন্ত্রণা পৌঁছে যায় নতুন প্রজন্মের কাছে। মার্কিনি বচনে তুখড় বয়ানের সুবাদে দেশে দেশে এই নেতার জুটেছে বহু শিক্ষিত ও শহুরে অনুসারী। বাংলাদেশে অনুসারীদের মধ্যে অন্যতম হিজবুত তাহরির ও আনসারুল্লা বাংলা টিম। গোয়েন্দাদের ধারণা, হিজবুত তাহরির দলছুট সদস্যদেরই সৃষ্টি আনসারুল্লা বাংলা টিম। লাদেনি পর্বের তুলনায় আওলাকি গোষ্ঠীগুলির সদস্য কম। তারা অনেকেই সচ্ছল, শহুরে পরিবারের সন্তান। তাদের মধ্যে মূলধারার পড়ুয়ার সংখ্যা বেশি। তাদের ফেসবুক ও টুইটার বার্তা দেখে আন্দাজ করা যায়, প্রধানত আধুনিক সচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরাই এদের নেতৃত্বে। এদের ইসলামি পড়াশোনা কতটা গভীর তা নিয়ে সন্দেহ আছে। মনস্তাত্ত্বিক ভাবে এরা বিচ্ছিন্ন। যারা প্রচলিত সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বীতশ্রদ্ধ। তারাই হয়তো একঘেয়ে জীবন থেকে বাঁচতে রোমাঞ্চের টানেই এই পথে চলে আসে।
আওলাকি ও ব্লগার, দু’পক্ষই তরুণ। শহুরে ও শিক্ষিত। প্রচলিত সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে যাদের বিস্তর প্রশ্ন। ব্লগাররা তাঁদের লেখার জোরে একটি গণআন্দোলন ঘটিয়ে ফেললেন: শাহবাগ আন্দোলন। একাত্তরের ঘাতক ও তাদের প্রশ্রয়দাতাদের অন্তর কেঁপেছিল যুদ্ধাপরাধ-বিচারের পক্ষে জনজোয়ার দেখে। তাকে বানচাল করতে তখন বেছে নেওয়া হয় এক নোংরা কৌশল। ঢালাও ভাবে নাস্তিক আখ্যা দেওয়া হয় ব্লগারদের। অনেক মসজিদ মাদ্রাসায় চলে এই প্রচার। অনুগত মিডিয়াও নেমে পড়ে এই কাজে। কিছু নেতা ঘোষণা করে, নাস্তিক নিধন মুসলিমের কর্তব্য। সবার আগে সাড়া দেয় আওলাকি মতবাদের দল আনসারুল্লা বাংলা টিম। একাধিক হত্যাকাণ্ড চলার পর ২০১৩ সালের ১২ আগস্ট বরগুনা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় মুফতি জসিমউদ্দিনকে। ২০১৫ সালে সংগঠনটিকেও নিষিদ্ধ করা হয়। আর ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়তে গিয়ে সেই জসিমউদ্দিনকে মুক্তি দিয়েছে ড. ইউনুসের সরকার!
২০১৬ সালে গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলায় বিদেশি ও বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করা হয়েছিল। হোলি আর্টিজান বেকারির সেই হামলায় ১৭ বিদেশি (ন’জন ইতালীয়, সাত জাপানি, এক ভারতীয় নাগরিক)-সহ ২০ জন মারা যান। পাঁচ জঙ্গি ও এক সন্দেহভাজন এবং দুই পুলিস অফিসারেরও মৃত্যু হয়। সব মিলিয়ে ২৮ জন। গোটা হামলার ঘটনা জঙ্গি সংগঠন আইএস-এর তৎকালীন মুখপত্র ‘দাবিক’-এর ওয়েবসাইটে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছিল। এই হামলায় জড়িয়েছিল সেই জেএমবির নামই। গোয়েন্দারা বলেছিলেন, জেএমবি কয়েকটি ধারায় ভাগ হওয়ার পর তার একটি শাখা তখন ‘নিও জেএমবি’ নামে সক্রিয় এবং তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল আনসারুল্লা বাংলা টিম সহ কয়েকটি সংগঠন। 
হাসিনা সরকারের পতনের পর তারাই আবার প্রকাশ্যে। ইঙ্গিত ছিল মুজিবুর রহমানের মূর্তি ভাঙাতে। ইঙ্গিত ছিল শেখ হাসিনার পতনের পর দেশজুড়ে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণে। বোতলের ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়েছে জিন! গুলশান হামলায় জঙ্গিদের গুলিতে নিহত দুই পুলিসের স্মারক ভাস্কর্য ‘দীপ্ত শপথ’ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভাঙা বেদিতে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে হিজবুত তাহরিরের তিনটি পোস্টার। ছাপা পোস্টারগুলিতে আফগানিস্তানের আদলে বাংলাদেশে খিলাফত প্রতিষ্ঠার দাবি। এরপরও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা নীরব। ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিন থেকেই রক্ষণশীল চরম ডানপন্থী মৌলবাদী দলগুলির প্রতি ড. ইউনুসের ব্যাখ্যাতীত প্রীতি বাংলাদেশে ‘ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা’-র মুক্ত পথ বানিয়ে দিচ্ছে। ইতিমধ্যে জামাত ইসলামি ও ইসলামি ছাত্র শিবিরের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে তদারকি সরকার। নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পরই জামাত প্রধান শফিকুর ইসলাম বলেছেন, দেশের সব দলকে নিয়েই আমরা ইসলামিক শাসনের পথে হাঁটতে চাই। এজন্য একসঙ্গে হাঁটতে শুরু করেছে প্রায় আড়াইশো সংগঠন।
তাহলে কি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ‘খেলাফত বাংলা’ করা হবে? নাকি আরও বেশি ইসলামপন্থী রঙের জাতীয় পতাকা এবং ইসলামি মূল্যবোধের জাতীয় সঙ্গীত বেছে নেওয়া হবে? রাষ্ট্রের নীরবতাই জানান দেয়— ধর্ম আগে, নাকি দেশ? জানে না বাংলাদেশ!
11d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

আয় বৃদ্ধি ও গৃহসুখ বৃদ্ধি। কর্মস্থলে সাফল্য ও প্রশংসা লাভের সম্ভাবনা। শরীর-স্বাস্থ্য বুঝে চলুন।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১০ টাকা৮৪.৮৪ টাকা
পাউন্ড১০৮.৬৪ টাকা১১২.১৯ টাকা
ইউরো৯১.৫৩ টাকা৯৪.৭৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
14th     September,   2024
দিন পঞ্জিকা