বিশেষ নিবন্ধ

আমাদের আরও ‘অ্যানিম্যাল’ চাই!
মৃণালকান্তি দাস

সম্প্রতি সাংবাদিক গীতা পাণ্ডের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল বিবিসিতে। যেখানে লেখিকা প্রশ্ন তুলেছিলেন, বলিউডের সিনেমা আজও কেন ‘পুরুষতান্ত্রিক’। তিনি মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস বা টিআইএসএস-এর একটি গবেষণা তুলে এনেছিলেন। ২১০ কোটি ডলারের ইন্ড্রাস্ট্রিতে ৩৫টি সিনেমার উপর চালানো এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল, হিন্দি সিনেমায় পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা কত গভীরভাবে জেঁকে বসে আছে, তা বিশ্লেষণ করা। গবেষকরা বেছে নিয়েছিলেন ২০১৯ সালের সবচেয়ে বেশি বক্সঅফিস-সফল ২৫টি ছবি, এবং ২০১২ থেকে শুরু করে ২০১৯ পর্যন্ত সময়কালে মুক্তি পাওয়া ১০টি নারী-কেন্দ্রিক ছবিকে। এই সময়টা বেছে নেওয়া হয়েছে এটাই দেখার জন্য যে, ২০১২ সালে দিল্লিতে ‘নির্ভয়া’র গণধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর বলিউডের ছবিতে কোনও পরিবর্তন এসেছে কি না। গবেষকরা কয়েকটি মানদণ্ডের নিরিখে সেইসব সিনেমাকে বিশ্লেষণ করেছেন। যেমন, এই সিনেমাগুলির চরিত্রগুলিকে যৌনতার দিক থেকে কী ধরনের ছকে ফেলা হয়েছে। এবং সম্মতি, ঘনিষ্ঠতা ও হয়রানির বিষয়গুলি কীভাবে উঠে এসেছে। দেখা গিয়েছে, বক্সঅফিস হিট ছবিগুলি এখনও পুরুষতান্ত্রিক ও পশ্চাৎমুখী মূল্যবোধ প্রতিফলিত করছে। যেখানে ৭২ শতাংশ চরিত্রই পুরুষদের আর ২৬ শতাংশ নারীদের। আসলে এ সমাজের গোড়ায় গলদ!
টিআইএসএস-এর গবেষণাদলের প্রধান অধ্যাপক লক্ষ্মী লিঙ্গম সংবাদসংস্থা বিবিসিকে বলেছেন, ‘বলিউডে বড় অঙ্কের টাকা মানেই ক্ষমতাশালী পুরুষ। পরিচালকরা বলেন, খুব বেশি শক্তিশালী নারী চরিত্র নাকি দর্শকদের মন ছুঁতে পারে না। তাই ভিন্ন কিছু করার প্রবণতা খুবই কম। কারণ মানুষের মনে যাবতীয় ধারণা সব সময়ই পুরুষতান্ত্রিক আদর্শ দিয়ে তৈরি। নির্মাতারা বিশ্বাস করেন, এটাই তাদের টাকা-পয়সা এনে দিতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রে একজন উচ্চবর্ণের পুরুষ। আর প্রধান নারী চরিত্রটিকে হতে হবে সুন্দরী। তার মধ্যে থাকতে হবে লাজুক ভাব। তাকে সম্মতি জানাতে হবে কথায় নয়, চোখমুখের ইঙ্গিত দিয়ে। অবশ্যই তাকে শরীর-দেখানো যৌন-উত্তেজক পোশাক পরতে হবে।’
তথাকথিত প্রগতিবাদী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিগুলোতেও অবলীলায় চলতে থাকে পুরুষতন্ত্র আর তার শিকার অবশ্যই মেয়েরা। যখন স্টার নায়িকা ইন্টারভিউ দিতে এসে বলেন, “কাস্টিং কাউচ বলে একটা জিনিস আছে শুনেছি, এর বেশি কিছু জানি না,” তখন বোঝা যায় মেয়েদের স্টারডম বলে আসলে কিছু হয় না, অনেক বড় নক্ষত্র হয়েও সত্য স্বীকার করার মতো উঁচুতে সে উঠতে পারেনি। পুরুষতন্ত্র, পাওয়ার স্ট্রাগ্ল, কাস্টিং কাউচ এবং হিপোক্রেসি এই সব মিলিয়ে মিশিয়েই যে এন্টারটেনমেন্টের মহাজগৎ তা আরও একবার মনে করিয়ে দিয়েছিল বিদ্যা বালনের ‘দ্য ডার্টি পিকচার’। এই ব্যাখ্যায়, বিবরণে পরিচালক মিলন লুথারিয়া অন্তত কোনও হিপোক্রেসি করেননি।
মনস্তত্ত্ববিদরা বলেন, অপ্রিয় ও কদর্যের প্রতি মানুষের একটি গভীর গোপন টান আছে। বহিরঙ্গে ছি-ছি করলেও মনে মনে সে হিংসার নানা রূপ-রূপান্তরের প্রদর্শন-অভিলাষী। অপরাধ সংবলিত ছবির এত জনপ্রিয়তার হয়তো এটা একটা কারণ। ভাবুন একবার, এক মহিলা অন্তঃসত্ত্বা। তার প্রসববেদনা শুরু হয়েছে। এমন সময়ে মাথায় পিস্তল ধরে আছেন এক সুপার হিরো। রণবীর কাপুর ‘অ্যানিম্যাল’ সিনেমার ‘হিরো’! একের পর এক রেকর্ড ভেঙে বলিউডের বক্স অফিস দাপিয়ে বেড়ানো সিনেমা। কী দেখানো হয়েছে সেই সুপার হিট সিনেমায়? স্ত্রীর গলা চেপে ধরা, অকারণ নির্মম ও নৃশংসভাবে মানুষকে হত্যা করা— এই হল হিরোর চরিত্র বিজয়! সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত রাগী, ইচ্ছেমতো যৌনাচারে লিপ্ত, বিধ্বংসী, নারীবিদ্বেষী একটা চরিত্র। এ যেন আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে আদিমকালে ফিরে যাওয়া। অনেকেই ফেসবুকে স্ট্যাটাসে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘এটা কি আদিকাল? আমরা কি জঙ্গলে বাস করি? উগ্র পুরুষতান্ত্রিক পুরুষ দর্শককে খুশি করে জঘন্যভাবে টাকা উপার্জনের সস্তা রাস্তা!’ সত্যিই তো ‘অ্যানিম্যাল’ সিনেমার কি কোনও প্রভাব নেই সমাজে? ‘অ্যানিম্যাল’ সিনেমার মতো পুরুষতান্ত্রিক দুনিয়ার সিনেমা যেভাবে শারীরিকভাবে শক্তিশালী, অত্যন্ত রাগী, হিংস্র, একরোখা, নিয়ন্ত্রণহীন চরিত্রগুলিকে নায়ক হিসেবে তুলে ধরে হাততালি কুড়িয়েছে, তাতে ভয় হয়! এসব ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখতে দেখতে কেউ অজান্তেই হয়তো ‘অ্যানিম্যাল’ হয়ে উঠছেন!
কী সাঙ্ঘাতিক সব দৃশ্য! জ্বলন্ত সিগারেটও হয়ে উঠেছে পৌরুষের প্রতীক! হৃৎপিণ্ডে অস্ত্রোপচারের পরও গির্জার ভিতর নায়কের হাতে সিগারেট! যেন নিয়মকানুন, মানবিকতা, স্বাভাবিকতার কোনও বালাই–ই নেই। যার মধ্যে মানবিকতাবোধ এবং স্বাভাবিক মানুষের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত, সেসবের ছিটেফোঁটাও নেই। চরিত্রটির ব্যক্তিগত যন্ত্রণাদগ্ধ অতীতের জের যৌবনে তার প্রেম-ভালোবাসাতেও প্রভাব ফেলছে। নারীকে সে দেখছে নিতান্ত ও একমাত্র দখলদারির দৃষ্টিতে। তাকে ‘রক্ষা’র মধ্যেও ফুটে বেরিয়েছে প্রবল ও বিষাক্ত পৌরুষ। আদিমকালে মানুষ অনেকটা নগ্ন হয়ে বনজঙ্গলে শিকার করে বেড়াত। তাদের ভিতর পেশিশক্তিতে যে এগিয়ে থাকত, সে হতো ‘আলফা মেল’। নারীরা তাঁর সঙ্গে সন্তান উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিত। এই ধারণায় নৈতিকতা বা মৌলিক মানবিকতার কোনও স্থান নেই। সভ্যতা শুরুর আগের সেই ধারণাই ধার করা হয়েছে বিজয়ের চরিত্রায়নে। দুর্বল স্টোরিটেলিং ঢাকা হয়েছে মাত্রাতিরিক্ত হিংসা, বিরক্তিকর আর প্রাপ্তবয়স্ক সব দৃশ্য দিয়ে। সেটাই হয়েছে এই সমাজের চোখে ‘সুপার হিট’!
আসলে সভ্যতার বয়স বেড়েছে, হিংস্রতা আর বর্বরতার প্রকোপ বিন্দুমাত্র কমেনি। কেন আমাদের ভিতরে এত বিদ্বেষ আর ঘৃণার বিষ? আপাত-শান্ত মানুষের মধ্যেও কোথা থেকে আসে এত বিদ্বেষ-ঘৃণা-হিংস্রতা-আগ্রাসন-নৃশংসতা? একের পর এক বর্বর ধর্ষণের ঘটনার সামাজিক কারণ খুঁজতে গিয়ে এই প্রশ্নটাও সামনে চলে এসেছে যে, যৌন হিংসা উস্কে দেওয়ার পিছনে কি বলিউড আংশিকভাবে দায়ী? বিশেষত চলচ্চিত্রের পর্দায় নারীকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয় এবং যেসব চিত্রকল্প আর আখ্যান তুলে ধরা হয়, সেসব কি যৌন হিংসা উস্কে দিচ্ছে? ‘অ্যানিম্যাল’-এর মতো ছবিগুলি এই দেশ কাল রুচিরই বিস্ফোরণ? যে ছবি এতদিনে হয়তো জন্ম দিয়ে ফেলেছে বাস্তবের কিছু ‘অ্যানিম্যাল’-এর। যথেচ্ছ হত্যালীলা চালিয়ে গেলেও আইন যাকে ছুঁতে পারে না। ‘দিওয়ার’-এর নায়কের মতো তার জন্য মৃত্যু অপেক্ষা করে না। বরং মৃত্যুর মুখ থেকে সে ফিরে আসে বারবার। তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে তার পৌরুষময় প্রতিশোধস্পৃহা। যুব সমাজকে এই ঘোরে বেঁধে ফেলার উদ্দেশ্য কী?
সভ্যতার শুরু থেকে যত মহাকাব্য তার মূল কিন্তু বীরগাথা বা পৌরুষের উপাসনা। মানব থেকে মহামানবের উত্থানের রাস্তাটা পিতৃসত্য রক্ষার সিঁড়ি বেয়ে। সে নিরিখে সব মহাকাব্য যা পুরুষের রচনা, যত বীরগাথা যা পুরুষের ভাবনা— সবেরই মূলে আছে পুরুষতন্ত্রের বীজ। আর আজ— উত্তর-আধুনিক সমাজে পুরুষতন্ত্র যত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে, তত বেশি সে তার জায়গা করে নিচ্ছে বিনোদনে। আর বিনোদন মানে— যৌনতা, খুন, রক্তপাত! অপরাধেই কেন ঝোঁক বেশি দশর্কদের? এর পিছনে কোন মানসিকতা কাজ করে? এতে কি অজান্তেই মানসিক ক্ষতি হয়? নেটফ্লিক্সের মতো বহু ওটিটি-তে আজকাল অপরাধমূলক সিরিজের ছড়াছড়ি। যাতে ধারাবাহিক খুন, যৌনতা বা রক্তাক্ত দৃশ্য ভরপুর। অধ্যাপক লক্ষ্মী লিঙ্গম জানাচ্ছেন, বাস্তব জীবনকেও প্রভাবিত করছে এইসব সিনেমা। বিষাক্ত পুরুষসুলভ আচরণকেও স্বাভাবিক বলে তুলে ধরা হচ্ছে।
পরিচালক মীরা নায়ার যেমন মনে করেন, বলিউডের সিনেমা মানে সেই একঘেয়ে পুরনো গল্প— ‘যখনই কোনও আবেদনময়ী নারী চরিত্রকে দেখানো হয়, তাকে কেবলই শরীর মুচড়ে মুচড়ে নেচে যেতে হয়, তাকে অবশ্যই প্রবল যৌনতা ছড়াতে হয়। নিজেকে তীব্র আকর্ষণের বস্তুতে পরিণত করতে হয়, এমনভাবে এসব করতে হয় যে, তা রীতিমতো অশ্লীল। সিনেমা হলের গণ-পরিবেশে অনেকটাই পুরুষ রাজত্বের মধ্যে, যখন কেউ এসব উত্তেজক আইটেম গান দেখেন, তখন এসব গানে হাজির 
হওয়া বলিউডের নতুন রানিকে নিজেকে দুমড়ে-মুচড়ে প্রবলভাবে তাদের প্রলুব্ধ করতে হয়। এতে কী নারী ও পুরুষের মধ্যে সম্পর্ক কোনও সম্মানজনক জায়গায় থাকে?’
সমাজে যা ঘটছে, এক অর্থে তার প্রতিফলন ঘটে পর্দায়। যুক্তি আর পাল্টা যুক্তির দাপটের মাঝে একটা কথা সকলেই মানবেন, সিনেমা-সিরিজের প্রভাব সাধারণ দর্শকের উপরে অপরিসীম। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত নাবালক ও যুব সমাজের উপরে হয়তো খানিক বেশি। কারণ বাস্তব ও কল্পনার মাঝের সূক্ষ্ম ফারাক বোঝার মতো পরিণত হওয়ার আগেই তারা নানা রকম অ্যাডাল্ট কনটেন্ট দেখে ফেলে। অপরিণত মনে সিনেমা-সিরিজে দেখানো অপরাধ কতটা প্রভাব ফেলে? উত্তরোত্তর বাড়তে থাকা অপরাধীর সংখ্যা এমন প্রশ্ন ভাবতে বাধ্য করছে। ধর্ষণ, খুন, মেয়েদের উপরে যৌন অত্যাচারের মতো ঘটনা বারবার ছবির পর্দায় উঠে এসেছে। কখনও রূঢ় বাস্তব, কখনও বা বাস্তবের অতিরঞ্জন। একইসঙ্গে সিনেমার স্টাইলে বাস্তবে ধর্ষণ, খুনের ঘটনায় ভরে যাচ্ছে সংবাদপত্র। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য জানাচ্ছে, এ দেশে প্রতি ঘণ্টায় ধর্ষিতা হন ৪ জন! ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ৮৬টি ধর্ষণের মামলা রুজু হয়েছে। তার মধ্যে ৮২টি ক্ষেত্রেই ধর্ষক নির্যাতিতার পূর্বপরিচিত।
বারবার মনে হয়, এর পরে কী? পৌরুষের এই উগ্রতা কি আগামীতে উগ্রতর হয়ে উঠবে? ভাবলে আতঙ্ক হতে পারে। তাতে কারও কিছু যায় আসে না। কারণ, এই উদগ্র পৌরুষের বক্স অফিস যে জমজমাট, তা প্রমাণিত। আর ভয় পাওয়া মানে ‘পৌরুষ’ থেকে পিছিয়ে আসা। পিছিয়ে পড়লে তো চলবে না!
অতএব চলুন, অ্যানিম্যাল-এর সিক্যুয়েল ‘অ্যানিম্যাল পার্ক’-এর জন্য অপেক্ষা করি। সেদিন হাততালি দিয়ে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান নয়, হাততালি দিয়ে সেই সব ছবিকে ‘সুপার হিট’ করতেই হবে। কারণ, এ দেশের রাজনীতির প্রয়োজনে আমাদের যে আরও ‘অ্যানিম্যাল’ চাই। অপরাধী চাই। ধর্ষক চাই। খুনি চাই...।
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

বিদ্যা শিক্ষা ও কাজকর্মে দিনটি শুভ। বন্ধুসঙ্গে বিপদ হতে পারে। অধ্যাপনায় অগ্রগতি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৪ টাকা৮৪.৯৮ টাকা
পাউন্ড১০৭.৮৯ টাকা১১১.৮৫ টাকা
ইউরো৮৯.৯১ টাকা৯৩.৪৯ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা