খুব খুশি যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি সম্পূর্ণ ভাষণ আমি ইংরেজিতে পড়তে পেরেছি। এজন্য ইকনমিক টাইমস কাগজকে ধন্যবাদ জানাই। প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিয়েছিলেন হিন্দিতে। আমার ধারণা, ওই কাগজে প্রকাশিত অনুবাদটি যথাযথই ছিল। নরেন্দ্র মোদি তাঁর সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং ওয়ার্ল্ড লিডারস ফোরামকে বলেছেন যে, বিগত দশবছরে ‘আমাদের অর্থনীতির বৃদ্ধি ঘটেছে ৯০ শতাংশের মতো।’ প্রধানমন্ত্রীর দাবি সঠিক হলে এই ঘটনা প্রশংসনীয়। আমার কাছে যেসব প্রাসঙ্গিক সংখ্যা আছে সেগুলি নিম্নরূপ:
অর্থাৎ বৃদ্ধি ঘটেছিল ৭৪ লক্ষ ৮৮ হাজার ৯১১ কোটি টাকা এবং গ্রোথ ফ্যাক্টর কাজ করেছে ১.৭৭৩৪ বা ৭৭.৩৪ শতাংশ ছিল বৃদ্ধির হার। এই ব্যাপারটি একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্যও ভালো। অবশ্য, উদারীকরণ-পরবর্তী—এই সময়কালের পূর্ববর্তী দুই দশকের হারের সঙ্গে, এই হারের তুলনাও করতে হবে। ১৯৯১-৯২ এবং ২০০৩-০৪ সালের মধ্যে, ১৩ বছরে জিডিপির আকার (অর্থনীতির প্রক্সি বা পরোক্ষ হিসেবে) দ্বিগুণ হয়েছে। এরপর ২০০৪-০৫ এবং ২০১৩-১৪ সালের মধ্যে ইউপিএ’র দশবছরে জিডিপির আকার হয়েছে দ্বিগুণ। আমার এস্টিমেট ছিল যে, মোদির দশবছরে জিডিপি দ্বিগুণ হবে না এবং সংসদেও তা বলেছিলাম। এখন প্রধানমন্ত্রীই আমার অনুমানে সিলমোহর দিয়েছেন। ভারতের অর্থনীতি অবশ্যই বেড়েছে, তবে আমরা আরও ভালো করতে পারতাম।
বেকারত্ব—এক হস্তী
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেছিলেন, ‘... ভারতবাসী আজ নতুন আত্মবিশ্বাসে ভরপুর।’ মাত্র কিছুদিন আগে, প্রকাশিত একটি খবরে আমরা দেখেছি যে, হরিয়ানা সরকারে সাফাই (সুইপার) কর্মী পদে চাকরির জন্য ৩ লক্ষ ৯৫ হাজার বেকার যুবক-যুবতী আবেদন করেছিলেন। মাত্র ১৫ হাজার টাকা মাস মাহিনার ওই চুক্তিভিত্তিক চাকরির জন্য আবেদনকারীদের মধ্যে ১ লক্ষ ১৭ হাজার ১৪৪ জন তরুণ-তরুণী ছিলেন দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন। এমনকী ছিলেন ৩৯ হাজার ৯৯০ জন স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীও ৬ হাজার ১১২ জন। এটি কোনোভাবেই ‘নতুন আত্মবিশ্বাস’-এর চিত্র নয়। আমি জানি, এনিয়ে সাফাই গাইবার লোকজনও আছেন। তাঁরা এই গল্পই খাওয়াতে চাইবেন যে, এঁরা আসলে চাকরিবাকরি করেন, তবে একটি সরকারি চাকরির নিরাপত্তার আকাঙ্ক্ষা থেকেই এই পদে আবেদন করেছেন!
তাঁদের এই ঘোর আমি কাটিয়ে দিতে চাই না।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুব ও মহিলারা ধারাবাহিকতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধির পক্ষে ভোট দিয়েছেন।’ তবে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন যে ভোটটা বরং পড়েছে বিরোধীদের পক্ষে। ভোটটি পড়েছিল পরিবর্তন, সাংবিধানিক শাসন এবং সমতারক্ষার জন্য বৃদ্ধির পক্ষে। দু’ধরনের লক্ষ্যের জন্য ছিল দুটি পৃথক বিশ্বাস: ধারাবাহিকতা বনাম পরিবর্তন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বনাম সাংবিধানিক শাসন এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধি বনাম সমতার সঙ্গে বৃদ্ধি। তাঁর তরফে গৃহীত লক্ষ্যগুলির অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রী যেমন একটি যুক্তি সাজাবার চেষ্টা করেছেন, তেমনই বিজেপির শাসনব্যবস্থার প্রতি জনগণের অস্বীকৃতি এবং তাদের লক্ষ্যপূরণে নতুন আকাঙ্ক্ষার পক্ষেও একটি শক্তিশালী যুক্তি খাড়া করা যেতে পারে।
নতুন লক্ষ্য প্রত্যাশিত
এই নিবন্ধটি ‘বেকারত্ব’ নিয়েই লিখতে চাই। বেসরকারি বিশেষজ্ঞ সংস্থা সিএমআইই’র মতে, সর্বভারতীয় বেকারত্বের হার ৯.২ শতাংশ। কংগ্রেসের ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনী ইস্তাহারে বলা হয়েছে যে, উদারীকরণের ৩৩ বছর পর ‘অর্থনৈতিক নীতির পুনর্নির্ধারণের সময় উপস্থিত হয়েছে।’ ‘চাকরি’ বিষয়ে ইস্তাহারে দুটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রাখা হয়েছে:
(এক): অ্যাপ্রেন্টিসশিপ বা শিক্ষানবিশ স্কিমের মাধ্যমে প্রত্যেক স্নাতক এবং ডিপ্লোমাধারী যুবক-যুবতীকে একবছরের শিক্ষানবিশির গ্যারান্টি দেওয়া হবে। এই সুযোগ সৃষ্টি করা হবে যুবদের কর্মদক্ষ ও কর্মসংস্থানের উপযোগী করে তোলার উদ্দেশ্যে। এই পদক্ষেপ সফল হলে লক্ষ লক্ষ যুবক-যুবতী নিয়মিত চাকরিতে বহাল হতে পারবেন।
(দুই): নিয়মিত এবং ভালো মানের চাকরিতে অতিরিক্ত নিয়োগের সুবাদে কর্পোরেটরা এমপ্লয়মেন্ট-লিঙ্কড ইনসেনটিভ স্কিম (ইএলআই) মারফত পাবেন কর সংক্রান্ত (ট্যাক্স ক্রেডিট) কিছু সুবিধা পাবেন।
এই ধার নেওয়া আইডিয়া অর্থমন্ত্রী যখন তাঁর বাজেট বক্তৃতায় যোগ করলেন তখন আমি আনন্দই পেয়েছিলাম। নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর মন্ত্রীরা গত ৯ জুন শপথ গ্রহণ করেন। বিজেপি দাবি করেছিল যে, তৃতীয় মোদি সরকার প্রথম ১০০ দিনের মধ্যেই একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেবে। এই সরকারের ১০০ দিন পূর্ণ হবে আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর। অথচ বেকারত্ব দূরীকরণ নিয়ে বাজেট ঘোষণা দুটির রূপায়ণের ব্যাপারে সরকার এখনও পর্যন্ত কোনও তৎপরতা দেখায়নি। অন্যদিকে ওয়াকফ (সংশোধন) বিল পাস এবং উচ্চতর সরকারি পদে ল্যাটারাল এন্ট্রির সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগী হতে দেখা গিয়েছে। যদিও এই দুটিই ‘স্থগিত’ রাখতে বাধ্য হয়েছে সরকার।
খারাপ খবর বাড়ছে
কর্মসংস্থানের ব্যাপারে ইতিমধ্যেই আমাদের কাছে আরও খারাপ খবর রয়েছে: ভারতীয় কোম্পানিগুলি ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে বহু কর্মীকে ছাঁটাই করেছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলির মধ্যে রয়েছে সুইগি, ওলা, পেটিএম প্রভৃতি। টেক কোম্পানিগুলি ঘোষণা করেছে যে, তাদের কর্মী বাহিনীকে কাঙ্ক্ষিত আকার দেওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে তারা।
গত ৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত টাইমস অফ ইন্ডিয়ার একটি নিবন্ধে দুই শিক্ষাবিদ জানিয়েছেন যে, আইআইটি মুম্বই এবছর তাদের স্নাতক শ্রেণির মাত্র ৭৫ শতাংশের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করতে পেরেছে। টাকার বিনিময় হারকে হিসেবের মধ্যে রাখলে তাঁদের বেতনও থমকে রয়েছে বলে মনে হয়। আইআইটি বাদ দিয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের স্নাতকদের নিয়োগের হার আরও হতাশাজনক—মাত্র ৩০ শতাংশের মতো!
বিশ্বব্যাঙ্কের ইন্ডিয়া ইকনমিক আপডেট (সেপ্টেম্বর, ২০২৪) রিপোর্ট করেছে যে, শহুরে যুবদের বেকারত্বের হার ১৭ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। এর জন্য দায়ী একটি বিভ্রান্তিকর বাণিজ্য নীতি। চামড়া এবং পোশাকের মতো শ্রম-নিবিড় শিল্পক্ষেত্র থেকে ভারত রপ্তানি আয় বাড়াতে পারেনি। বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্টে ভারতের বাণিজ্যপদ্ধতির সমালোচনামূলক পর্যালোচনা রয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পণ্যের শ্রম-নিবিড় উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে চীন সরে যাওয়ার কারণে যে সুবিধা ভারতের সামনে উপস্থিত হয়েছিল সেটা ভারত নিতে পারেনি। রিপোর্টে ভারতের রক্ষণশীল নীতি (প্রোটেকশনিস্ট পলিসি) এবং মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সম্পর্কে বিরূপতার দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
অস্বীকার বা বাগাড়ম্বর কিংবা ভুলভাল পরিসংখ্যান দিয়ে বেকারত্বের সমস্যা দূর করা যাবে না। বেকারত্ব হল একটি মারাত্মক শক্তিশালী টাইম বোমা। সেটি নিষ্ক্রিয় করার জন্য তৃতীয় মোদি সরকার (মোদি ২.১ সরকার) ৯ জুন থেকে এ পর্যন্ত কিছু করেনি—একেবারে কিছুই করেনি।
লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত