শরীর ও স্বাস্থ্য

তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়!

প্রতিটি সমস্যাই আসলে জীবনের শিক্ষা!’— একথা আমরা পড়েছি পাঠ্যবইয়ে। সোমা বন্দ্যোপাধ্যায় সেকথা উপলব্ধি করেছেন নিজের জীবন দিয়ে। একদা চলচ্ছক্তিহীন মেয়েটি মেরুদণ্ড শক্ত করে উঠে দাঁড়িয়েছেন নিজের পায়ে। দাঁড় করিয়েছেন ব্যবসা। আরও এক লড়াকু মেয়ের সঙ্গে পরিচয় করালেন স্বরলিপি ভট্টাচার্য। 

‘আমি যে ঘরে থাকি, তার লাগোয়া কলঘর। বিছানা থেকে উঠে সেখানে যাওয়া আসা করতে চার ঘণ্টা লেগে যেত। কত বছর যে সেই সময় বাড়ি থেকে বেরইনি। পুজোয় ঠাকুর দেখতে যাইনি। নতুন জামা দিত সকলে। সেসব ভাঁজ করে রাখা থাকত। পরতে পারতাম না। মা, ভাই, বন্ধুরা মনের জোর হারাতে দেয়নি। ওরা পাশে ছিল বলেই আজ অনেকটাই ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছি’— একটানা বললেন সোমা। অ্যাঙ্কালাইজিং স্পন্ডিলাইটিস-এ আক্রান্ত তিনি। ২০০৬ থেকে চিকিৎসা চলছে। কিন্তু এখনও সুস্থ হতে পারেননি।
সমস্যার শুরু কবে? পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ার বাড়িতে বসে ফোনে সোমা বললেন, ‘তখন আমি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেব। ২০০৬ সাল। হঠাৎ করে কোমরে ব্যথা শুরু হয়। এমন অবস্থা হয়েছিল যে পা ফেলতে পারছিলাম না। ভেলোর, বেঙ্গালুরু সব জায়গায় আমাকে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করিয়েছে বাবা, মা। রোগ ধরা পড়ার পর হিপ জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্টের কথা বলেন চিকিৎসকরা। সেসময় অন্তত ১০ লক্ষ টাকা খরচের কথা বলেছিলেন তাঁরা। মধ্যবিত্ত পরিবারে হঠাৎ করে ১০ লক্ষ টাকা খরচ করা তো সম্ভব নয়। ফলে ফিজিওথেরাপি করেই চলছে।’
কাটোয়াতেই বড় হয়েছেন সোমা। মা, বাবা, ভাইকে নিয়ে ছিল তাঁর জগৎ। স্নাতক হওয়ার পর লাইব্রেরি সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেন। চাকরি করার খুব ইচ্ছে ছিল তাঁর। কিন্তু শারীরিক পরিস্থিতি যেমন, তাতে বাড়ির বাইরে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ থেকে চাকরি করা সম্ভব নয়। এমনকী যাতায়াতেরও সমস্যা রয়েছে। কিন্তু মাথা উঁচু করে স্বনির্ভর হয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন সোমা। তাই কখনও পুতুল, কখনও বা ফুলদানি বানিয়ে বাড়ি বসেই তা বিক্রি করতেন। বাড়িতে আগত অতিথি অভ্যাগতরা ছিলেন তাঁর ক্রেতা। সময় গড়ালে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনলাইনে শাড়ির ব্যবসাও শুরু করেন। কিন্তু সেটাও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অবশেষে সোমা ফিরেছেন পুরনো ভালোবাসার কাছে। বাড়িতে মা, কাকিমাদের রান্না করতে দেখেছেন ছোট থেকে। সেখান থেকেই রান্নার প্রতি একটা সুপ্ত ভালোবাসা ছিল। তা মাথায় রেখেই সোমা বছর চারেক আগে বেকিং করতে শুরু করেন। প্রথমে পরিচিতরা তাঁর থেকে কেক নিতেন। এখন সেই ব্যবসা বেশ বড় আকার নিয়েছে।
নিজের জার্নি ভাগ করে নিয়ে সোমা বললেন, ‘রান্নায় আমার আগ্রহ ছোট থেকেই ছিল। মা এবং বাড়ির বড়দের দেখে এই আগ্রহ তৈরি হয়। একসময় হোটেল ম্যানেজমেন্ট নিয়েও পড়ার ইচ্ছে ছিল। সেটা আর হয়নি। তবে যখনই যা করতে চেয়েছি বিশেষ করে মা এবং বাড়ির সকলে সব সময়ই উৎসাহ দিয়েছে। আমি গত চার বছর ধরে বেকিং করি। বেকিং করে বহু মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। হয়তো আমি আর পাঁচজনের মতো বাইরে গিয়ে দৌড়োদৌড়ি করে কাজ করতে পারি না। বাড়িতে থেকে যতটুকু সম্ভব কাজ করার চেষ্টা করি। বেকিং আমার রোজগারের জায়গা। এই ব্যবসাটা আরও বাড়াতে চাই। নিজের একটা দোকান করতে চাই। আসলে এখনও আমার মায়ের উপর আমি পুরোপুরি নির্ভরশীল। বেকিংয়ের প্রয়োজনে চিনি, ময়দা আনতে গেলেও মাকে আনতে হয়। মায়ের উপর চাপ পড়ে যায়।’
কথায় কথায় নিজের শারীরিক সমস্যার চিকিৎসাগত পরিভাষা বুঝিয়ে দিলেন সোমা। অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস তাঁকে কীভাবে কাবু করেছে? এর কারণই বা কী? চিকিৎসকদের কাছ থেকে সোমা জেনেছেন, এই সমস্যা জিনঘটিত। তিনি বললেন, ‘হয়তো আমার পূর্বপুরুষের কারও এই রোগ ছিল। বাবা বা মায়ের পরিবারে কারও এই সমস্যা অতীতে থাকলেও আমাদের জানা নেই। ডাক্তার বলেছেন হিপ জয়েন্টের যে লিক্যুইড থাকে, তা শুকিয়ে গিয়েছে। অপারেশন করালে তারপর হাঁটা, চলা, বসা হয়তো ঠিক হবে। কিন্তু ঘাড়ের ব্যায়াম আর ফিজিওথেরাপি আজীবন করতে হবে। নাহলে ঘাড় বেঁকে যাবে। ভেলোরে যাওয়ার পর এইচএলএ বি ২৭ টেস্ট হয়েছিল আমার। তারপর এই রোগ ধরা পড়ে।’ 
অসুস্থতার পর থেকে বাড়ি থেকে বেরনো বন্ধ করে দিয়েছিলেন সোমা। কোমরের সমস্যার কারণে ছুটে গিয়ে কোনও কাজ করতে পারেন না আজও। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। পা ফুলে যায়। রিকশায় বসতে অসুবিধে হতো। কারণ হিপ জয়েন্ট মুভমেন্ট না হলে কিছুটা হেলে বসতে হতো। প্রাথমিকভাবে সত্যিই ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু মা, ভাই এবং বন্ধুরা তাঁকে আগলে রেখেছেন। কখনও মনের জোর হারাতে দেননি। সোমা স্পষ্ট বললেন, ‘শরীর একটা যন্ত্র। সেভাবে ভাবতে পারলে সমস্যা অনেক কম। আসলে এটা বড় মানসিক লড়াই। জীবনের যাই পরিস্থিতি হোক, কখনও হেরে গেলে হবে না। পারছি না শব্দটা বলা যাবে না। সব সমস্যার সমাধান আছে।’
জীবন এগিয়েছে নিজের গতিতে। কিন্তু বিয়ের কথা ভাবেননি সোমা। ভবিষ্যতেও এই অধ্যায় বন্ধই রাখতে চান। বিয়ের প্রসঙ্গ উঠতেই হালকা হেসে বললেন, ‘আমার বিয়ে করার কোনও ইচ্ছে নেই। শারীরিক সমস্যা তো একটা নিশ্চয়ই কারণ। নিজে ঠিক না হলে ওই দিকে এগনো উচিত নয়। বিয়ে অনেক বড় দায়িত্ব। তাই এখন বিয়ের অধ্যায়টা বন্ধ রেখেছি।’
সোমা জানালেন, তাঁর ভাই কর্মসূত্রে দিল্লি প্রবাসী। দীর্ঘ চিকিৎসার পর এবার তাঁর অস্ত্রোপচারের জন্য দিল্লিতেই চেষ্টা করছেন পরিবারের সদস্যরা। এত কিছুর মধ্যে মাকে কিছুটা স্বস্তি দিতে চান সোমা। বেকিংয়ের কাজটুকু অন্তত নিজে পুরোটা সামলানোর মতো শারীরিক দক্ষতা তৈরি করতে চান। আসলে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত মেয়েটির জীবন একধারায় চলেছে। সুস্থ, সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্নও ছিল চোখে। হঠাৎই পটপরিবর্তন মেনে নিতে কষ্ট হয়। আত্মবিশ্বাসী সোমা যখন বলে ওঠেন, ‘যার কিছু নেই তাঁর দুঃখ তো থাকেই। কিন্তু পেয়ে হারানোর দুঃখ অনেক বেশি। জীবন শিখিয়েছে কারও সামনে ভেঙে পরলে চলবে না। মুখে হাসি নিয়ে নিজের যুদ্ধ নিজেকেই করতে হবে।’ তখন জীবনের মানেই রঙিন হয়ে যায়। জীবন সোমাকে শিখিয়েছে অনেক কিছু। তাই হেরে না যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নিজেকেই। ‘আগে ভাবতাম, আমার সঙ্গেই কেন এমন হল। এখন ভাবি, এটা না হলে তো জীবনের আসল মানেটাই বুঝতাম না।’ হেসে ওঠেন শক্তিরূপেণ নারী।

 সোমা এই মুহূর্তে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ডাঃ উজ্জ্বল ভট্টাচার্যের চিকিৎসাধীন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই রোগে ঘাড়, কোমর একেবারে শক্ত হয়ে যায়। ওই অংশের মুভমেন্ট কমে যায়। বাঁশ যেমন হয়, তেমন শক্ত হয়ে যায় দেহের নির্দিষ্ট অংশ।’ রোগটি কি জিনবাহিত? চিকিৎসকের উত্তর, ‘কোনও কোনও ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে এটা জিনঘটিত রোগ। আবার তা নয় বললেও ভুল বলা হবে না। কারও ক্ষেত্রে ফার্স্ট জেনারেশনের হয়েছে, সেটাও দেখা গিয়েছে। বাবা, মায়ের এই সমস্যা রয়েছে, অথচ সন্তানদের নেই তেমনও দেখা গিয়েছে। আবার বাবা, মায়ের রোগ নেই, অথচ সন্তানের হয়েছে, তেমন উদাহরণও রয়েছে। সোমার ক্ষেত্রেই তা ঘটেছে।’ এর চিকিৎসাপদ্ধতি কী? উজ্জ্বল বলেন, ‘এই রোগের ভালো আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা রয়েছে। পঞ্চকর্ম থেরাপি করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। নন মোবিলিটি পরিস্থিতি থেকে রোগী মোবিলিটি স্তরে চলে আসতে পারে। পাশাপাশি সঠিক খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ, ঠিক সময়ে ঘুম থেকে ওঠা, ঋতু অনুযায়ী লাইফস্টাইল মেনটেন করতে হবে। নাহলে রোগটা আবার ফিরে এলে বাড়াবাড়ি হতে পারে।’
 
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

ধর্মকর্মে সক্রিয় অংশগ্রহণে মানসিক তৃপ্তি ও সামাজিক সুনাম। পেশাদার শিল্পীদের শুভ সময়।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৫ টাকা৮৪.৮৯ টাকা
পাউন্ড১০৮.২৫ টাকা১১১.৮০ টাকা
ইউরো৯০.৭১ টাকা৯৩.৮৮ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা