শরীর ও স্বাস্থ্য

তেল-ঝাল-মশলায় বাঙালি
শম্পা চক্রবর্তী

তেল-ঝাল-মশলার সঙ্গে বাঙালির যেন জন্মজন্মান্তরের প্রেম। রোজকার সাদামাটা রান্না থেকে শুরু করে উৎসব অনুষ্ঠানের খানদানি মেজাজের বিরিয়ানি, কোর্মা, কোপ্তা, কালিয়া, পোলাওয়ের মতো বহু ব্যাঞ্জন এই তেল-ঝাল-মশলার অনবদ্য রসায়নে হয়ে ওঠে রসনাবিলাসীদের প্রাণের সুখ, আত্মার তৃপ্তি। ভারতীয় উপমহাদেশের এই মশলার আকর্ষণেই যেমন কলম্বাস ভারত খুঁজতে বেরিয়েছিলেন তেমনই ক্রমে ক্রমে পর্তুগিজসহ ইউরোপীয় বণিক ও ব্রিটিশও এদেশে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল এই মশলার গুণেই।
এখন প্রশ্ন হল, তেল-ঝাল-মশলার কি সবটাই খারাপ? মোটেই নয়। রান্নাকে সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর করে তোলার জন্যে তেল-ঝাল-মশলা এক অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের অসুখ-বিসুখের প্রতিরোধ ও প্রতিকার করে আমাদের সুস্থ ও নিরাপদ রাখতেও তেল, লঙ্কা ও বিভিন্ন ধরনের মশলার বিশেষ ওষুধি গুণাগুণ আছে।
তবে তেল-ঝাল-মশলায় গরগরে রান্না শুধু যে বাংলার প্রায় প্রতিটি হেঁশেলেই অত্যন্ত জনপ্রিয়— তাই-ই নয়, এশিয়ার বিভিন্ন কুইজিন, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপ অঞ্চলেও এই ধরনের রান্নার বেশ প্রচলন আছে।
রান্নায় যেমন কোন তেল খাবেন বা ঝাল হিসেবে কাঁচালঙ্কা, শুকনো লঙ্কা, গোলমরিচ বা লঙ্কারগুঁড়ো কোনটা, কতটা পরিমাণ ব্যবহার করবেন, তেমনই কোন রান্নায় কোন মশলা কীভাবে দেবেন অর্থাৎ গোটা, কাঁচা, শুকনো, ভাজা না গুঁড়ো তা বিভিন্ন ধরনের রেসিপিতে নানা ধরনের রন্ধনশৈলীর ওপরে সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। এবার আসা যাক স্বাস্থ্যের কথায়। আগেকার দিনে জন্ডিস, জ্বরজারি, গ্যাসট্রাইটিস ইত্যাদি অসুখ হলে রান্নায় তেল-ঝাল-মশলার ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে ব্ল্যান্ড ডায়েটের পরামর্শ দেওয়া হতো। কিন্তু এখন বিশেষজ্ঞদের মতে রোগীকে দীর্ঘদিন এই ধরনের সম্পূর্ণ তেল-বর্জিত খাবার খাওয়ানোর ফলে রোগীর স্বাভাবিক রুচি ও খিদে নষ্ট হয়। ফলে রোগী ঠিকমতো খেতে চায় না, স্বভাবতই টান পড়ে পুষ্টির ভাঁড়ারে এবং রোগ দীর্ঘমেয়াদি হয়ে পড়ে।
সবচেয়ে বড় কথা ব্যক্তি বিশেষে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার কথা বিবেচনা করে তেল ঝাল-মশলার মতো রান্নার তিন অপরিহার্য উপাদান কতটা খাবেন, কোনটা খাবেন বা খাবেন না এবং কীভাবে খাবেন তা নির্ধারণ করা উচিত।
যেমন যাঁদের মুখ, খাদ্যনালী বা পাকস্থলীতে ঘা আছে তাঁরা লঙ্কা বা গোলমরিচ কোনওরকম ঝালই খাবেন না।
আবার যাঁরা প্রায়ই সর্দিকাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জা, অ্যাজমা বা আর্থ্রাইটিসের সমস্যায় ভোগেন তাঁরা অবশ্যই রান্নায় হলুদ, মৌরি, মেথি, জিরে, ধনে ইত্যাদি ব্যবহার করবেন।
ডায়াবেটিস বা কোলেস্টেরলের সমস্যা থাকলে দারচিনি, মেথি, মৌরি ইত্যাদি মশলা রোজই নানাভাবে খাবেন।
আবার রান্নায় পরিমিত মাত্রায় তেল খেলে বিভিন্ন ফ্যাট সল্যুবল ভিটামিনস ও ক্যারোটিনয়েডস জাতীয় অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট দেহে শোষণ মাত্রা ও কার্যকারিতা বাড়ায়।

ভালো তেলের গোড়ার কথা
সুস্থ থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সুষম আহারের এক অন্যতম উপাদান রান্নার তেল। কথাতেই আছে তেলে-জলে বাঙালি। বিভিন্ন ধরনের আমিষ নিরামিষ ভারতীয় প্রায় সবরকমের রান্নাতেই তেল চাই-ই-চাই। ‘Oil is the fuel of life’—অর্থাৎ বেঁচে থাকার জন্য তেল অত্যন্ত জরুরি হলেও কোন তেল কতটা এশেনশিয়াল, তা নির্ভর করে তেলে উপস্থিত এশেনশিয়াল ফ্যাটি অ্যাসিডের ওপর। এই এশেনশিয়াল ফ্যাটি অ্যাসিড আমাদের সুস্থ থাকার জন্য অত্যন্ত অত্যাবশ্যক হলেও, তা মানবদেহে আপনা আপনি তৈরি হয় না। ফলে তা পেতে হলে বিভিন্ন খাদ্য উৎস বা রান্নায় ব্যবহৃত ভোজ্য তেলের ওপর নির্ভর করতেই হবে।
ভাজা, ভাপা, সেদ্ধ, পাতুরি, ঝাল, ঝোল, চচ্চড়ি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের আমিষ-নিরামিষ ভারতীয় প্রায় সবরকম রান্নাতেই তেল চাই-ই-চাই। তবে কোন রান্নায় কোন তেল ব্যবহার করা হয় তা সাধারণত আঞ্চলিক খাদ্যাভ্যাস ও সহজলভ্যতার ওপরে নির্ভর করে।
কেউ কেউ ওজন কমানোর জন্য বা হার্টের রোগ, হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস ইত্যাদি বিভিন্ন অসুখ-বিসুখের ঝুঁকি এড়াবার জন্যে রান্না থেকে তেলকে প্রায় বাতিল করে দিয়েছেন। আবার কিছু মানুষ শুধু রসনার বশে প্রায় সবরকম রান্নাতেই অতিরিক্ত তেল খেয়ে থাকেন। কোন মানুষের জন্য কতটা তেল প্রয়োজন, তা নির্ভর করে ব্যক্তি বিশেষের বয়স, ওজন, উচ্চতা, শারীরিক অবস্থা, সক্ষমতা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর। সোজা কথায় চাই ব্যালান্স বা পরিমিতি বোধ। বিভিন্ন ধরনের তেল থেকে বিভিন্ন উপকার পাওয়া যায়। প্রথমত বলে রাখা ভালো যে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিজ্জ তেল যা আমরা সাধারণত রান্নায় ব্যবহার করি তা কোলেস্টেরল মুক্ত। আদর্শ রান্নার তেলে স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (SFA): মোনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (MUFA): পলি আনস্যাচুরেডেট ফ্যাটি অ্যাসিড (PUFA)= ১: ২: ২ থাকা উচিত। কিন্তু বাস্তবিক এই অনুপাতের ভোজ্য তেল বাজারে না থাকায় বিভিন্ন ধরনের তেল থেকে আমাদের বিভিন্ন উপকার সংগ্রহ করতে হয়। অন্যদিকে আবার পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (PUFA)-তে ওমেগা সিক্স: ওমেগা থ্রি= ৪: ১ এই অনুপাতের যত কাছাকাছি ততই আদর্শ বলে গণ্য হয় এর হেলথ বেনিফিটের জন্য।
তাই আদর্শ অনুপাতের কাছাকাছি থাকার জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় পুফা ও মুফা সমৃদ্ধ বিভিন্ন উৎসের তিনরকম তেল থেকে সমপরিমাণ তেল আলাদা আলাদাভাবে বিভিন্ন রান্নায় ব্যবহার করা।
অর্থাৎ দৈনন্দিন ক্যালোরি চাহিদার মোট ২৫ শতাংশ যদি ফ্যাট থেকে আসে তবে ১০ শতাংশ মুফা, ১০ শতাংশ পুফা এবং ৫ শতাংশ এসএফএ হওয়া উচিত। স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডের মাত্রা যেন কোনওভাবেই ৫ শতাংশের বেশি না হয়।

সর্ষের তেলের উপকারিতা
সর্ষের তেলে মুফা এবং পুফা-এর পরিমাণ উল্লেখযোগ্য এবং হার্ট স্মার্ট ওমেগা-থ্রি জাতীয় আলফা লিনোলেনিক অ্যাসিডের পরিমাণ প্রায় ১২ শতাংশ। এছাড়াও সর্ষের তেলে ওমেগা-৬ ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের অনুপাত আদর্শ মাত্রার অনেক কাছাকাছি হওয়ায় স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো।

কোন কোন রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে সর্ষের তেল?
কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ, হাইপার লিপিডেমিয়া, আর্থ্রাইটিস, অ্যাজমা, ক্যান্সার, সর্দি-কাশি, ত্বকের ইনফেকশন ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে সাহায্যকারী সর্ষের তেল।

ক্ষতিকর দিক
সর্ষের তেলে ইরিউসিক অ্যাসিড নামে এক ধরনের ওমেগা-৯ জাতীয় ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, যা অতিরিক্ত পরিমাণে শরীরে ঢুকলে বিভিন্ন প্রদাহজনিত সমস্যা এবং মায়োকার্ডিয়াল লিপিডোসিস-এর মতো হার্টে ফ্যাট জমার সমস্যা হতে পারে।

সূর্যমুখীর তেল
ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ জাতীয় পুফা এবং ওলেইক অ্যাসিড জাতীয় মুফা সমৃদ্ধ। সূর্যমুখীর তেল রক্তে টোটাল কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং রক্তে ভালো কোলেস্টেরল মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। হাই ব্লাডপ্রেশার, হাইপার লিপিডেমিয়া, হজমের সমস্যা, ক্লান্তি দুর্বলতা, মাইগ্রেইন, অ্যালঝেইমার্স, ডিমেনশিয়া, অ্যাজমা ইত্যাদি সমস্যা থাকলে সারাদিনে রান্নায় মোট ব্যবহৃত তেলের ১/৩ ভাগ সূর্যমুখীর তেল রাখতে পারেন।

সাবধানতা
সূর্যমুখীর তেলে ওমেগা-৬ : ওমেগা-৩= ৪০:১ যা আদর্শ মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি হওয়ায় প্রতিদিন অতিরিক্ত মাত্রায় খাওয়ার ফলে রক্তনালীর মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া। স্ট্রোকের ঝুঁকি ও সন্ধিস্থলে প্রদাহ জনিত যন্ত্রণা বেড়ে যেতে পারে।
উপরন্তু সূর্যমুখীর তেলের স্মোকিং পয়েন্ট বেশ কম মাত্র ১০৭° সেন্টিগ্রেড হওয়ায় ছাঁকা তেলে ভাজাভুজির জন্য মোটেই আদর্শ নয়।

সয়াবিন তেলের উপকারিতা
পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ সয়াবিন তেলে ওমেগা-৬ ও ওমেগা-৩ রেসিও আদর্শমাত্রার অনেক কাছাকাছি এবং স্মোকিং পয়েন্ট বেশ বেশি, প্রায় ২৩০° সেন্টিগ্রেড হওয়ায় ভারতীয় বিভিন্ন রান্নার জন্যে উপযুক্ত।

উপকারিতা
উচ্চরক্তচাপ, হাইপারলিপিডেমিয়া, অস্টিওপোরোসিস, ডিমেনশিয়া, অ্যালঝাইমার্স, ম্যাকুলার ডিজেনারেশন ও অকালবার্ধক্য প্রতিরোধে সয়াবিন তেল বেশ উপকারী।

সাবধানতা
জেনেটিকালি মডিফায়েড সয়াবিন থেকে উৎপন্ন তেল দীর্ঘদিন ধরে বেশি পরিমাণে ব্যবহারের ফলে পেটব্যথা, লিভারের সমস্যা ও হজম সংক্রান্ত সমস্যা হতে পারে। যাদের থাইরয়েডের সমস্যা আছে তাঁরাও নিয়মিত এই তেল খাবেন না।

গ্রাউন্ডনাট অয়েল বা বাদাম তেলের উপকারিতা
অত্যন্ত উচ্চমাত্রায় মোনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড এবং পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ এই তেলের স্মোকিং পয়েন্ট প্রায় ২৩২° সেন্টিগ্রেড হওয়ায় একদিকে যেমন রান্নার উচ্চতাপ সহ্য করতে পারে, তেমনই অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর।

উপকারিতা
ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ডিপ্রেশন, হাইপারলিপিডেমিয়া, হাইপ্রেশার, নিউরোডিজেনারেটিভ ডিজিজের মতো বহু সমস্যার মোকাবিলায় সাহায্য করে এই তেল।

সাবধানতা
গ্রাউন্ডনাট অয়েলে ওমেগা-৬ এর পরিমাণ অত্যন্ত বেশি হওয়ায় প্রদাহজনিত সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। চিনাবাদামে অ্যালার্জি থাকলেও চলবে না এই তেল। সর্বোপরি দিনে ১-২ চামচের বেশি কখনওই নয় এই তেল।

তিল তেলের উপকারিতা
বহু প্রাচীনকাল থেকেই ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মানুষজন তেল বিভিন্ন প্রয়োজনে এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার তিল নামক তৈলবীজের ব্যবহার করত। তিল তেলে প্রায় ৪০ শতাংশ MUFA এবং ৪২ শতাংশ PUFA থাকায় অত্যন্ত উপকারী এবং হার্টহেলদি। তিল তেলের সিসেমল ও সিসামিনল জাতীয় শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট ও ভিটামিন-ই বিভিন্ন রোগবালাই এর মোকাবিলায় সাহায্য করে।
উপকারিতা: হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, আর্থ্রাইটিস, অ্যাথেরস্ক্লোরোসিস, ডায়াবেটিস, কনস্টিপেশন, ডিপ্রেশন, ইনসমনিয়া, স্ট্রেস, ডিমেনশিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যার বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয় তিল থেকে তৈরি কোল্ডপ্রেসড তেল। অর্গানিক্যালি গ্রোন হলে আরও ভালো হয়।

রাইস ব্র্যান অয়েল
ধানের তুষ থেকে তৈরি এই তেলে স্যাচুরেটেড ফ্যাট, মুফা এবং পুফা-র পরিমাণ যথাক্রমে ২৫ শতাংশ, ৩৮ শতাংশ এবং ৩৭ শতাংশ এবং ওমেগা-৬ : ওমেগা-৩= ২০:১, ফলে মাত্রামতো খেলে যেমন উপকার পাওয়া যেতে পারে, তেমনই মাত্রাতিরিক্ত হলে বিপদ। দিনে ২ চামচের বেশি নয় মোটেই।
এই তেলের স্মোকিং পয়েন্ট ২৩২° সেন্টিগ্রেড হওয়ায় ভাজাভুজি জন্য উপযুক্ত। রাইসব্র্যান অয়েলে থাকে ভিটামিন-ই এবং ওরাইজোনাল, টোকোট্রাইএনান ইত্যাদি বিভিন্ন জৈব উপাদান যা অসুখ-বিসুখ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল মাত্রা কমিয়ে হার্টকে সুরক্ষিত রাখা, বাতের ব্যথা, সর্দিকাশি, অ্যাজমা, বদহজম, অস্টিওপোরোসিস, ক্যান্সার সহ বিভিন্ন ভাইরাল, ফাঙ্গাল ও মাইক্রোনায়াল ইনফেকশন প্রতিরোধে কার্যকরী এই তেল।

অলিভ অয়েলের উপকারিতা
সম্ভবত সারা বিশ্ববাসীই প্রায় ৭০.৭৫ শতাংশ হার্টহেলদি মোনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (ওলেয়িক অ্যাসিড ৭০ শতাংশ+ পামিটোয়িক অ্যাসিড ০. ৩-৩. ৫ শতাংশ) সমৃদ্ধ এই তেল তালিকার প্রথম সারিতে রাখতে আগ্রহ প্রকাশ করবেন। অলিভ অয়েলে প্রায় ১১-১৫ শতাংশ পুফা এবং টোটাল স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ মাত্র ১৩-১৪ শতাংশ হওয়ায় অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর। এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েলের স্মোকিং পয়েন্ট ১৭৫° সেন্টিগ্রেড হওয়ায় খুব উচ্চতাপে ভাজাভুজি বা সাঁতলানো উচিত নয়।

উপকারিতা
এই তেল রক্তের খারাপ কোলেস্টেরলের (LDL) মাত্রা কমিয়ে রক্তনালীর অভ্যন্তরে রক্তজমাট বাঁধার প্রবণতা কম রাখে ও হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে সাহায্য করে। এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েলে থাকে ওলিওক্যানথাল যা টাইপ-টু ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, অ্যাজমা, অ্যালঝেইমার্স ও অটো-ইমিউন ডিজিজের প্রবণতা কমায়। MUFA এবং ভিটামিন ই, এ ইত্যাদি অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট সমৃদ্ধ এই তেল ব্রেস্ট, ওভারি ও কোলোরেকটাল ক্যান্সার প্রতিরোধ করে, অম্বল, গ্যাস, বদহজম, আই.বি.এস, একজিমা, সোরিয়াসিস, প্রিম্যাচিওর এজিং ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যার প্রতিকারে সাহায্য করে।

ঝাল
তেল, ঝাল, মশলায় রসনা তৃপ্ত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অত্যাবশ্যক উপাদান হচ্ছে লঙ্কা। কাঁচা লঙ্কা, শুকনো লঙ্কা, লঙ্কারগুঁড়ো, কাশ্মীরি লাল লঙ্কা, পাপরিকা ইত্যাদি নিত্য ব্যবহার্য বিভিন্ন রকমের লঙ্কা ছাড়াও আছে নানা মরিচ, থাইচিলি, ভূত-জলেকিয়ার মতো লঙ্কার প্রজাতি—যা ঝালের জন্যে পৃথিবী বিখ্যাত। ভারতীয় রান্না ঝাল ছাড়া অচল হলেও জানলে অবাক হবেন যে এই লঙ্কার আদি বাসভূমি ভারত নয়, ‘মেক্সিকো’। স্পেনীয় ব্যবসায়ীদের হাত ধরে এই লঙ্কা ভারত সহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রবেশ করে, মরিচ হল সোলানসি পরিবারের ক্যাপসিকামগণের অন্তর্গত এক ধরনের ঝাল ফল।
অনেকেই হয়তো ঝালের ভয়ে লঙ্কা খান না, কিন্তু দিনে মাত্র ১ বা ২টো কাঁচা লঙ্কা বা এক চিমটি বিশুদ্ধ শুকনো লাল লঙ্কার গুঁড়ো শুধু যে খাবারের স্বাদ ও গন্ধ বাড়াবে তাইই নয়, কাছে ঘেঁষতে দেবে না অনেক অসুখ বিসুখও।

লঙ্কার পুষ্টিগুণ
ভিটামিন সি এর অতি উৎকৃষ্ট উৎস কাঁচালঙ্কা— ১০০ গ্রাম কাঁচালঙ্কায় প্রায় ১৪৩.৭ মিগ্রা ভিটামিন সি থাকে। এছাড়াও আলফা ও বিটা ক্যারোটিন, লাইকোপিন, লিউটিন, জি-জ্যানথিন, আয়রন, কপার, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, বি-ভিটামিনস সহ বিশেষ কিছু ফাইটোকেমিক্যালস-এর উপস্থিতির কারণে লঙ্কার বিশেষ রোগনিরাময়ী ভূমিকা আছে। ১০০ গ্রাম কাঁচালঙ্কা মোটামুটি ৪১ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি, ৮-৯ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট এবং ১.৫-২.৫ গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার পাওয়া যায়।
অন্যদিকে পাকা লাল লঙ্কার ক্যারোটিনয়েডস এর পরিমাণ কাঁচা লঙ্কার চেয়ে অনেক বেশি। যেমন ১০০ গ্রাম পাকা লঙ্কার প্রায় ৩৪৫ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিনয়েডেস থাকে, কাঁচা লঙ্কায় যার পরিমাণ মাত্র ১৭৫ মাইক্রোগ্রাম। আবার শুকনো লঙ্কায় পটাশিয়াম, ফসফরাস ইত্যাদির পরিমাণও যথেষ্ট বেশি।
লঙ্কার তীব্র ঝাঁঝালো অনুভূতির কারণ ক্যাপসাইসিন নামক এক বিশেষ ধরনের অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট ধর্মী অ্যালকালয়েডের উপস্থিতি। মজার ব্যাপার, লঙ্কা খেয়ে ঝাল লাগলেও ঝাল কোনও বিশেষ স্বাদ নয়, এক ধরনের অনুভূতি মাত্র।
সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা যাচ্ছে যে বিভিন্ন মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট-এর পাশাপাশি লঙ্কায় উপস্থিত ক্যাপসাইসিন যৌগের বিশেষ রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা আছে।

রোগ নিরাময়ী লঙ্কা
 শরীর শীতল রাখে। এই তীব্র গরমে শরীরকে শীতল রাখার জন্যে লঙ্কার মতো হট-ঝাল, স্পাইস আশ্চর্যরকম উপকারী। অবাক হওয়ার কথা হলেও এটাই সত্যি। লঙ্কার ক্যাপসাইসিন মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসের কুলিং সেন্টারকে উদ্দীপিত করে ঘাম নিষ্ক্রমণের হার বাড়িয়ে দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। তাই শরীর ঠান্ডা রাখতে হলে প্রতিদিন রান্নায় বা পাতে একটু লঙ্কা খান।
 ক্যান্সার: ক্যারোটিনয়েডস, ভিটামিন-সি, ফলিক অ্যাসিড, লাইকোপিন ইত্যাদি বিভিন্ন অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টসের গুণে ভরপুর কাঁচালঙ্কা ও লাল লঙ্কারগুঁড়ো প্রস্টেট, কোলন ও ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
 অ্যানেমিয়া: রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়িয়ে রক্তাল্পতার সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে ভিটামিন-সি, আয়রন এবং কপার যুক্ত কাঁচালঙ্কা।
 ডায়াবেটিস: রক্ত শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা বাড়াতে কাঁচালঙ্কা বা সামান্য শুকনো লঙ্কা দারুণ সাহায্য করে। লঙ্কায় উপস্থিত বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টস ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস রক্তে শর্করা মাত্রা কন্ট্রোলে রাখে।
 পেইন রিলিভার: বিভিন্ন ধরনের বাত-ব্যথা ও মাসল পেইনের প্রকোপ কমাতে ক্যাপসাইসিনের গুণে সমৃদ্ধ কাঁচা লঙ্কা, পাকা লঙ্কা বা লঙ্কারগুঁড়ো বেশ উপকারী। লঙ্কা খাওয়ার ফলে ন্যাচারাল পেনকিলার এনডোরফিনের ক্ষরণমাত্রা উদ্দীপিত হয়, যার ফলে ব্যথার উপশম ঘটে।
 ওবেসিটি: দেহের ওজন যদি ক্রমশই বাড়তে থাকে, তাহলে প্রতিদিন কম ক্যালোরিযুক্ত নিয়ন্ত্রিত খাদ্য তালিকা অনুসরণ করার পাশাপাশি অন্তত ২-৩টে কাঁচালঙ্কা বা কিছু পরিমাণ লঙ্কারগুঁড়ো রান্নায় ব্যবহার করুন। লঙ্কার ক্যাপসাইসিন লালারসের ক্ষরণ বাড়িয়ে হজমে সাহায্য করে এবং বিপাকক্রিয়ার হার বাড়িয়ে দেহের বাড়তি ফ্যাট ঝরায় তাড়াতাড়ি।
 ফুসফুসের প্রদাহ: সর্দিকাশি, বন্ধ নাক, সাইনুসাইটিস, অ্যাজমা ও সাধারণ জ্বরজারির উপশমেও লঙ্কা অত্যন্ত কার্যকরী। এমনকী ধূমপানীয়রাও রোজ ২-৩টে লঙ্কা খেতে পারলে ক্ষতির প্রবণতা কিছুটা কমানো যাবে।
 অ্যালঝেইমার্স ও ডিমেনশিয়া: ভুলে যাওয়া রোগের সমস্যা থাকলে নিয়মিত পাতে একটা করে কাঁচালঙ্কা খান। এমনকী বাড়ির খুদে সদস্যদের মধ্যে স্মৃতিশক্তি ও পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়ানোর জন্য অল্প বয়স থেকেই রয়ে-সয়ে একটু-আধটু লঙ্কা খাওয়ানোর অভ্যাস করতে পারেন।
 উজ্জ্বল দৃষ্টিশক্তি ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা: ভিটামিন সি, বিটা-ক্যারোটিনয়েডস এবং ক্যাপসাইসিন সমৃদ্ধ লঙ্কা তা সে কাঁচা, পাকা, শুকনো বা গুঁড়ো যেভাবেই খান না কেন উপকার হবেই।
 কার্ডিও ভাস্কুলার ডিজিজ: রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল LDL এর মাত্রা কমাতে এবং প্লেটলেট এগ্রিগেশনের হার কমিয়ে রক্তনালীর মধ্যে জমাট বাঁধার প্রবণতা কমাতে লঙ্কা নানাভাবে সাহায্য করে। ফলে স্ট্রোক, অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস এবং হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা কম থাকে।
সাবধানতা: ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম, গলাবুক জ্বালা, পেপটিক আলসার থাকলে লঙ্কা খাবেন না। মুখে, জিভে ঘা থাকলে অথবা কেমোথেরাপি চলছে এমন মানুষজনও লঙ্কা বর্জন করুন।

মশলা
হলুদ মাহাত্ম্য
হলুদ ছাড়া ফ্যাকাসে তরকারি বা মাছ-মাংসের কথা ভাবা যায় না। আবার হলুদ ছাড়া গায়ে হলুদ, হোলি, সরস্বতী পুজো, বিয়ে বা অন্নপ্রাশনের কথা শুনেছেন? রোজকার রান্না ছাড়াও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং খাদ্য সংরক্ষণের শিল্পে হলুদ অপরিহার্য। প্রসাধনীর জগতেও বিভিন্ন স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট যেমন সাবান, ফেসওয়াশ, ক্রিম, ফেসমাস্ক ইত্যাদিতেও হলুদ নানাভাবে ব্যবহৃত হয়।
রান্নায় বিশেষ স্বাদ গন্ধ ও উজ্জ্বল সোনালি বর্ণের জন্য মিডল ইস্ট ও সাউথ ইস্ট এশিয়ার প্রায় প্রতিটি রান্নাঘরেই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে হলুদের ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে মশলা হিসেবে রান্নায় ব্যবহারের বহু আগে থেকেই বিভিন্ন ভেষজ চিকিৎসা ও রঞ্জন শিল্পে হলুদের ব্যবহারের কথা জানা গেছে। প্রাচীন চীন ও ভারতের আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার অন্যতম উপাদান হলুদ। প্রায় হাজার বছর আগে আরবিয়ানদের হাত ধরে ইউরোপে হলুদের প্রবেশ ঘটে বলে মনে করা হয়।

প্ল্যানটেক গোত্র 
এই হলুদের বৈজ্ঞানিক নাম ‘কুরকিউমা লঙ্গা’। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জানা গেছে হলুদের বিশেষ অ্যান্টি ক্যান্সার, অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি, অ্যান্টি ইস্কেমিক, অ্যান্টি অ্যালার্জিক ও অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট প্রপার্টি আছে।
হলুদের হলুদ রং মূলত ‘কারকুমিন’ নামক এক ধরনের তীব্র অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট ক্ষমতা সম্পন্ন জৈব রঞ্জক জাতীয় পলিফেনলিক যৌগের উপস্থিতির কারণে। ভিটামিন সি, ভিটামিন ই ও অন্যান্য বিভিন্ন এসেনশিয়াল নিউট্রিয়েন্টস-এর পাশাপাশি হলুদে থাকে বিভিন্ন এসেনশিয়াল অয়েল যেমন টার্মেরোন, কার্লোন, কুরকুমিন, সিনোলে, বিটা-সিমিনে ইত্যাদি যা বিভিন্ন অসুখ-বিসুখের মোকাবিলায় সাহায্য করে।
সম্ভবত ভারত, পাকিস্তান ইন্দোনেশিয়ার মাটিতে কয়েক হাজার বছর আগে এই কন্দজাতীয় হলুদ রঙা মূলটির জন্ম বলে মনে করা হয়।
১০০ গ্রাম কন্দজাতীয় হলুদের পুষ্টিমাত্রা:
শক্তিমাত্রা- ৩৫৪ কিলোক্যালরি, কার্বোহাইড্রেট- ৬৪.৯ গ্রাম, প্রোটিন- ৭.৮৩ গ্রাম, ফ্যাট- ৯.৮৮ গ্রাম, ডায়েটারি ফাইবার- ২১ গ্রাম, ফোলেট- ৩৯ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন সি- ২৫.৯ মিগ্রা, ভিটামিন ই- ৩.১০ মিগ্রা, ভিটামিন কে- ১৩.৪ মাইক্রোগ্রাম, সোডিয়াম- ৩৮ মিগ্রা, ক্যালশিয়াম- ১৮৩ মিগ্রা, আয়রন- ৪১.৪২ মিগ্রা, ম্যাগনেশিয়াম- ১৯৩ মিগ্রা, ফসফরাস- ২৬৮ মিগ্রা, জিঙ্ক- ৪.৩৫ মিগ্রা এবং কপার- ৬০৩ আই.ইউ।

হলুদের বিশেষ রোগ নিরাময়ী ক্ষমতা
ক্যান্সার: বিভিন্ন কারসিনোজেনিক ফ্রি-র‌্যাডিক্যালস এবং মিউটেটেড ক্যান্সার সেলকে আক্রমণ করে ধ্বংস করতে সাহায্য করে হলুদের কুরকুমিন জাতীয় অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট ধর্মী পলিফেনলিক যৌগ। ফলে টিউমার গ্রোথ এবং মেটাস্ট্যাসিস প্রতিরোধে হলুদের সক্রিয় ভূমিকা আছে। আক্রাম্ত ক্যান্সার কোষকেও ‘অ্যাপপটোসিস’ পদ্ধতিতে ধ্বংস করতে সাহায্য করে হলুদের কুরকুমিন। প্রতিদিন রান্নায় হলুদ গুঁড়ো ব্যবহারের পাশাপাশি এক ইঞ্চি পরিমাণ কাঁচা হলুদ খাওয়া গেলে ব্রেস্ট, কোলন, প্যাংক্রিয়াস, প্রস্টেট, লাং, স্টমাক, লিভার ও ইসোফেগার ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকটাই এড়ানো সম্ভব হয়।
 ডায়াবেটিস: ইনসুলিন রেসিস্ট্যান্স-এর মাত্রা কমিয়ে কার্বোহাইড্রেট বিপাকে সাহায্য করে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে হলুদ।
 হাইপারটেনশন: হলুদের কুরকুমিন ও পটাশিয়াম হাইপ্রেশার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
 লিভারের অসুখ: হলুদের কুরকুমিন নামক অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট প্রদাহ সৃষ্টিকারী সাইক্লোক্সিজেনার-২ (সিওএক্স-২) নামক রাসায়নিক পদার্থের সংশ্লেষে বাধা দিয়ে লিভার ডিটক্সিফাইং এনজাইম গ্লুটাথায়োন এস ট্রান্সফারেজ (জিএসটি) তৈরিতে সাহায্য করে। অতএব লিভারকে সুস্থ সবল ও কর্মক্ষম রাখার জন্য রান্নায় যেমন হলুদের ব্যবহার জরুরি, তেমনই সকালে খেতে পারেন এক ইঞ্চি কাঁচা হলুদ।
 অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস ও হার্টের অসুখ: রক্তের টোটাল কোলেস্টেরল, ক্ষতিকর লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (LDL) এবং প্লেটলেট এগ্রিগেশনের মাত্রা কমিয়ে রক্তনালীর মধ্যে রক্তজমাট বাঁধা প্রতিরোধ করে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের আশঙ্কা কমাতে সাহায্য করে হলুদ।
 অ্যালঝেইমার্স ডিজিজ: ৭০-৭৯ বছর বয়সি ভারতীয়দের মধ্যে অ্যালঝেইমার্স বা ভুলে যাওয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা গড়পড়তা আমেরিকানদের তুলনায় মাত্র  অংশ। কেন জানেন? ভারতীয়রা রান্নায় অনেক হলুদ ব্যবহার করে।
 বদহজম, পেটে গ্যাস, কনস্টিপেশন: যাঁরা প্রায়ই হজম সংক্রান্ত সমস্যায় ভোগেন তাঁরা প্রতিদিন রান্নায় হলুদ ব্যবহারের পাশাপাশি  চা চামচ কাঁচা হলুদ বাটা আর ১ চিমটি গোলমরিচ, ১ কাপ জলে গুলে খান। সেই সঙ্গে অবশ্যই হজম সহায়ক সহজপাচ্য পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।
 ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম: আলসারেটিভ কোলাইটিস ও বোন ডিজিজের মতো সমস্যার মোকাবিলায় প্রতিদিন ফ্যাটবিহীন দুধের তৈরি দইয়ের সঙ্গে মধু ও কাঁচা হলুদ বাটা মিশিয়ে খেলে উপকার হতে পারে। পাশাপাশি কী খাবেন বা কী খাবেন না জেনে নিন আপনার ডায়েটিশিয়ানের কাছ থেকে।
 ইনফ্ল্যামেটারি ডিজিজ: অস্টিও আর্থ্রাইটিস, রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, গাউট, ব্রঙ্কাল অ্যাজমা ইত্যাদি প্রদাহজনিত অসুস্থতায় প্রদাহ সৃষ্টিকারী এনজাইমের উৎপাদন ও ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে হলুদের বিশেষ অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটারি প্রপার্টি।
 মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস: এই বিশেষ ধরনের অটোইমিউন ডিজিজে নিজের ইমিউন সিস্টেমই মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের মায়োলিন আবরণীকে আক্রমণ করে ধ্বংস করতে চায়, যার ফলে বিবিধ সমস্যা যেমন দুর্বলতা, হাত পায়ের শিথিলতা, ব্যালান্সের অভাব, কথায় জড়তা, দৃষ্টি শক্তির অভাব ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। সম্ভবত আইএল-১২ নামক এক বিশেষ ধরনের প্রোটিন যা স্নায়ুকোষের ধ্বংসের কারণ, তার উৎপাদনের হার কমিয়ে দেয় হলুদের কুরকুমিন।
 ডিপ্রেশন: দীর্ঘদিন ধরে মানসিক অবসাদে ভুগতে থাকলে মনোবিদের পরামর্শ নেওয়া ছাড়া রান্নায় হলুদ ও গোলমরিচ একসঙ্গে ব্যবহার করে দেখুন।
 ত্বকের সৌন্দর্য রক্ষা: ত্বকের কালচে ভাব, সানবার্ন, চুলকানি, র‌্যাশ, ব্রণ, ফোড়া ফুসকুড়ি, এমনকী একজিমা বা সোরিয়াসিসের সমস্যা মোকাবিলাতেও হলুদ খুবই কার্যকরী।

জিরা
ভারতীয় রান্নায় জিরার ব্যবহার ব্যাপক। মাছ, মাংস, ডিম থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের নিরামিষ রান্নায় ফোড়ন হিসেবে বা জিরা বাটা হিসেবে এই মশলার ব্যবহার অত্যন্ত জনপ্রিয়। রায়তা, দইয়ের ঘোল বা জিরে আলু এককথায় জিরে ছাড়া ভাবাই যায় না। খ্রিস্টের জন্মের কয়েক হাজার বছর আগেও পারস্য ও মিশরীয় সভ্যতায় জিরার ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া গেছে।
অ্যাপিয়াসিয়া পরিবারভুক্ত এই মশলার বৈজ্ঞানিক নাম কুমিনম সাইমিনাম।
কিউমিনাল ডিহাইড, জিরা ডিহাইড, পি-সাইমেন, টেরপেনয়েড ইত্যাদি ভেষজ গুণসম্পন্ন উদ্বায়ী তেলের পাশাপাশি জিরাতে প্রোটিন, ডায়েটারি ফাইবার, মোনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন ই, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম ও বি-ভিটামিনস-এর মতো বিভিন্ন অত্যাবশ্যক পুষ্টি উপাদান থাকে।
এককথায় জিরাকে বলা যায় অর্গানিক হোলি ফুড।

১০০ গ্রাম জিরার পুষ্টিগুণ
শক্তিমাত্রা ৩৭৫ কিলোক্যালরি, প্রোটিন ১৭.৮ গ্রাম, ফ্যাট ২২.৩ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ৪৪.২ গ্রাম, ডায়েটারি ফাইবার ১০.৫ গ্রাম, ক্যালশিয়াম ৯৩১ মিগ্রা।

রোগ নিরাময়ে জিরার জাদুকরী গুণাগুণ
জিরার বিশেষ অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটারি, অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট ও অ্যান্টিসেপটিক প্রপার্টি থাকায় জিরাকে অর্গানিক হোলি ফুডের অন্তর্গত করা যায়।
হজম সংক্রান্ত সমস্যা: বদহজম, পেট ভার, বমি-বমিভাব, পেট ব্যথা, কনস্টিপেশন, অরুচি ইত্যাদি সমস্যায় সাদা জিরা অত্যন্ত উপকারী। এক্ষেত্রে  চা চামচ জিরে ভাজার গুঁড়ো ১ গ্লাস ইষদুষ্ণ জলে মিশিয়ে খেয়ে দেখতে পারেন।
 অ্যাজমা: ২ চা চামচ গোটা জিরা আদার কুচি সহ ২ গ্লাস জলে ফুটিয়ে ১ গ্লাস থাকতে নামিয়ে ছেঁকে অল্প মধু সহ দিনে ৩ বার খেতে হবে বেশ কিছুদিন। তাতে অ্যাজমার প্রকোপ কমতে পারে। জিরার বিশেষ অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটারি প্রপার্টির জন্য।
 হাইপারলিপিডেমিয়া: দেখা গেছে যাঁরা নিয়মিত রান্নায় জিরার ব্যবহার করেন অথবা নিয়মিত গোটা জিরা ভেজানো জল খান, তাঁদের রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল ও টোটাল কোলেস্টেরলের মাত্রা ১-২ মাসের মধ্যেই উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।
 অ্যানেমিয়া: মাত্র ১ চা চামচ জিরা গুঁড়োতে প্রায় ১.৪ মিগ্রা আয়রন থাকে। যা রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ায় এবং রক্তে অক্সিজেনের ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
 রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা: জিরাতে থাকা ভিটামিন সি এবং বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টের উপস্থিতির কারণে জিরা দেহের সামগ্রিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে মরশুমি বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ, বিশেষত সর্দি-কাশি জ্বর বা ফ্লু-এর আক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
 ডায়াবেটিস: রক্তশর্করা মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে নিয়মিত রান্নায় যেমন কিছু পরিমাণ জিরার ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়, তেমনই জিরা ভেজানো জলও অত্যন্ত উপকারী। তবে এর পাশাপাশি ডায়াবেটিক ডায়েট ফলো করা অবশ্য প্রয়োজনীয়।
 আর্থ্রাইটিস: বিভিন্ন প্রদাহজনিত ব্যথার মোকাবিলায় এই মশলা দারুণ উপকারী।
 উচ্চরক্তচাপ: জিরা ডায়েটারি ফাইবার এবং পটাশিয়াম সমৃদ্ধ হওয়ায় রক্তের উচ্চ রক্তচাপকে বশে রাখতে সাহায্য করে।
 ওবেসিটি: যাঁরা ওবেসিটির সমস্যায় ভুগছেন তাঁরা সকালে উঠে খালি পেটে জিরাসহ জিরা ভেজানো জল বেশ কিছুদিন খেয়ে দেখুন। উপকার হতে পারে। সেই সঙ্গে ডায়েট কন্ট্রোল এবং লাইফস্টাইল মডিফিকেশন জরুরি।
 ডিটক্সিফিকেশন: ডিটক্স ওয়াটার হিসেবে জিরা জলের ব্যবহার অত্যন্ত জনপ্রিয়। জিরার কিউমিনাল ডিহাইড, থায়োমন ইত্যাদি দেহকে পরিশ্রুত রাখতে সাহায্য করে।
 অস্টিওপোরোসিস: হাড়ের ক্ষয়জনিত সমস্যার মোকাবিলায় সাহায্যকারী ক্যালশিয়াম সমৃদ্ধ জিরা।

ধনে বীজ
আমিষ-নিরামিষ সহ অগণিত ভারতীয় রান্নার স্বাদ ও গন্ধকে অতুলনীয় করে তুলতে ধনে বীজের মতো মশলা এককথায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তা সে মাছ, মাংস থেকে শুরু করে ডাল, তরকারি, মুড়িমাখা বা ফুচকা সবেতেই এই মশলার সামান্য ছোঁয়াতেই যেন জাদু আছে।

ধনে বীজের পুষ্টি কথা
ক্যালশিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ডায়েটারি ফাইবার, ফ্ল্যাভোনয়েডস, বিটা-ক্যারোটিন এবং বিভিন্ন পলিফেনল যৌগের গুণে সমৃদ্ধ এই ধনে বীজ শুধু যে মশলা হিসেবেই রান্নায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তাই নয়, বিভিন্ন অসুখ-বিসুখের প্রতিরোধ ও প্রতিকারেও এই মশলা বেশ উপকারী। অ্যাপিয়াসিয়া পরিবারভুক্ত এই ধনের বৈজ্ঞানিক নাম: কোরিয়েন্ডার সাটিভাম।

রোগ প্রতিরোধে ধনের ভূমিকা
 হজমের সমস্যা: অম্বল, গ্যাস, বদহজম, অরুচি, বমি ভাব ইত্যাদি সমস্যার সমাধানে ধনে ভেজানো জল অত্যন্ত উপকারী। এক্ষেত্রে ২ চা চামচ ধনে ২ কাপ জলে ফুটিয়ে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে ঠান্ডা করে খেতে হবে। তবে বয়স ও প্রয়োজন অনুযায়ী ডোজের তারতম্য হতে পারে।
 ওবেসিটি: ডায়েটাররা মেটাবলিজম বুস্ট আপ করে ওজন কমানোর জন্য সকালে খালিপেটে ধনে ভেজানো জল খেলে উপকার পাবেন।
 ডায়াবেটিস: এক্ষেত্রেও ধনে অত্যন্ত উপকারী।
 ফ্যাটি লিভার: ফ্যাটি লিভারের সমস্যা থাকলে ধনে ভেজানো জল ছাড়াও রান্নায় সামান্য ধনের গুঁড়ো বা ধনে বাটার ব্যবহার উপকার দেয়।
 আর্থ্রাইটিস: ধনের বিশেষ অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটারি প্রপার্টি আছে যা আর্থ্রাইটিস বা মাসল পেইনের মতো প্রদাহজনিত অসুস্থতার মোকাবিলায় সাহায্য করে।
 কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ: রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল মাত্রা কমিয়ে হৃদযন্ত্রকে স্বাভাবিক সক্ষম রাখতে ধনে অত্যন্ত উপকারী।
 হাইপোথাইরয়েড: যাঁদের থাইরয়েডের সমস্যা আছে তাঁরা উপযুক্ত ডায়েটের পাশাপাশি প্রতিদিন সামান্য পরিমাণ ধনে ভেজানো জল খেয়ে দেখুন।
 মেনস্ট্রুয়েশনের সমস্যা: এই ধরনের সমস্যাতেও ধনে  উপকারী।

সর্ষে দানা
সর্ষে বাটা দিয়ে ইলিশ মাছ ভাপা বা ভেটকি, পাবদা, পার্সে, মৌরলা থেকে শুরু করে নানাবিধ পাতুরি বা চচ্চড়ি, তরকারি, ছ্যাঁচড়া, ছেঁচকি থেকে ফিশফ্রাই-এর সঙ্গে একটু কাসুন্দির ছোঁয়ায় আমাদের রসনা হয়ে ওঠে রসস্থ। গরমের দিনে সর্ষে ফোড়ন দিয়ে কাঁচা আমের ডাল বা টক বা আলুভর্তা যেন অমৃতসম। এহেন সর্ষে শুধু যে রান্নায় অবশ্য প্রয়োজনীয় তাই-ই নয়, ক্যালশিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, সেলেনিয়াম, গ্লুকোসিনোলেটস, বিভিন্ন ফেনলিক কম্পাউন্ড ও ওমেগা থ্রি জাতীয় এসেনশিয়াল ফ্যাটি অ্যাসিডে সমৃদ্ধ এই তৈল বীজ বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ প্রতিরোধে সাহায্য করে।

সর্ষের স্বাস্থ্যকর দিক
সর্ষে দানার বিশেষ অ্যান্টিসেপ্টিক, অ্যান্টিবায়োটিক ও অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল প্রপার্টি থাকায় সংক্রমণজনিত বিভিন্ন রোগ বালাই দূরে রাখতে সাহায্য করে।
সর্ষের গ্লুকোসিনোলেট, সেলেনিয়াম, ওমেগ
10d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

কর্মের প্রসার ও উপার্জন বৃদ্ধির যোগ। গৃহ পরিবেশে চাপা উত্তেজনা। পেশার প্রসার।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.০৭ টাকা৮৪.৮১ টাকা
পাউন্ড১০৮.৬৫ টাকা১১২.২০ টাকা
ইউরো৯১.৫৭ টাকা৯৪.৭৬ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
17th     September,   2024
দিন পঞ্জিকা