লিভার মানবদেহের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ অঙ্গ। লিভারকে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বলে যকৃৎ। এটি শরীরের সর্ববৃহৎ গ্রন্থি যা পেটের উপরের ডান দিকে, মধ্যচ্ছদা প্রাচীরের নীচে ও পাকস্থলীর উপরের দিকে অবস্থান করে। লিভার প্রধানত ঘন রক্তবর্ণ বা বাদামি বর্ণের হয়। ওজন প্রায় ১৫০০ গ্রাম। এই অঙ্গে দুটি খণ্ড— ডান ও বাম। প্রত্যেক খণ্ডের আটটি করে ভাগ থাকে। এই প্রত্যেক ছোট ভাগগুলো আবার প্রায় এক হাজার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খণ্ড নিয়ে গঠিত, যা পরস্পরে অতি সূক্ষ্ম নালী দিয়ে যুক্ত থাকে। এরা মিলিত হয়ে ডান ও বাম যকৃৎ নালী হিসেবে নির্গত হয় এবং পরবর্তীতে এই দুই নালী মিলিত হয়ে সাধারণ যকৃৎনালী গঠিত হয়। এই সাধারণ যকৃৎনালী সিস্টিক নালীর মাধ্যমে লিভারের নীচে অবস্থিত পিত্তথলি অর্থাৎ গলব্লাডারে যুক্ত থাকে। পিত্তনালী ও যকৃৎনালী পরস্পর মিলিত হয়ে সাধারণ পিত্তনালীর মাধ্যমে ক্ষুদ্রান্ত্রে উন্মুক্ত হয়ে পরিপাক ক্রিয়ায় অংশ নেয়। প্রসঙ্গত, ক্ষুদ্রান্ত্রের দ্বিতীয় ভাগে উন্মুক্ত হওয়ার পথে অগ্ন্যাশয় নালীর সঙ্গে মিলিত হয়ে পরিপাকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে।
লিভার বহিঃক্ষরা গ্রন্থি হিসেবে কাজ করে। এই গ্রন্থি যকৃৎ রস বা পিত্তরস তৈরি করে পিত্তথলিতে জমা রাখে এবং প্রয়োজনে খাদ্য পরিপাকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। পিত্তরস খাদ্যের অম্লভাবকে প্রশমিত করে পরিপাকের অনুকূল মাধ্যম অর্থাৎ ক্ষারীয় ভাব তৈরি করে। ফ্যাট জাতীয় খাদ্যকে ইমালসিফিকেশন পদ্ধতির মাধ্যমে ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানায় রূপান্তরিত করে যা পরবর্তীতে ক্ষুদ্রান্ত্রে ফ্যাট পরিপাককারী উৎসেচকের সহায়তায় পরিপাক হয় অর্থাৎ ফ্যাট জাতীয় খাদ্যের এই ভাঙন না হলে ফ্যাট পরিপাক সম্পূর্ণ হয় না।
লিভার শর্করা বিপাকেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা সঠিক রাখতে সাহায্য করে। রক্তের গ্লুকোজকে গ্লাইকোজেন হিসেবে জমা রাখে। প্রয়োজনে ওই গ্লাইকোজেনকে ভেঙে গ্লুকোজের চাহিদা মেটায়। প্রোটিন বিপাকে ডিঅ্যামিনেশন প্রক্রিয়ায় অ্যামোনিয়া তৈরি হয়। ইউরিয়া তৈরি হয়। অ্যালবুমিন, গ্লোবিউলিন ইত্যাদি প্লাজমা প্রোটিন এবং রক্ত তঞ্চন কারক ফ্যাক্টর সংশ্লেষিত হয়।
লিভার পুরনো, মৃত লোহিত কণিকা ভেঙে বিভিন্ন পিত্ত রঞ্জক-বিলিরুবিন, বিলিভার্ডিন সৃষ্টি করে। শারীরবৃত্তীয় বিভিন্ন কাজে উৎপন্ন ক্ষতিকারক বর্জ্য পদার্থ— ইউরিয়া, অ্যামোনিয়া, ইউরিক অ্যাসিড ইত্যাদি রক্তের মাধ্যমে মল, মূত্রের দ্বারা শরীর থেকে নিঃসরণ করতে সাহায্য করে।
লিভারের অসুখ বলতে প্রথমেই হেপাটাইটিস অর্থাৎ যকৃৎ কোষের প্রদাহ এবং জন্ডিস বুঝি। লিভারের বিকৃত শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপের জন্য রক্তে পিত্তরঞ্জকের (বিলিরুবিন, বিলিভার্ডিন) মাত্রা বৃদ্ধি পায়। আয়ুর্বেদশাস্ত্র মতে এই রোগকে কামলা রোগের সঙ্গে তুলনা করা যায়। মহর্ষি চরক মতে এই কামলা রোগ হল পাণ্ডু রোগের (অ্যানিমিয়া) প্রবর্ধমান অবস্থা। কিন্তু মহর্ষি সুশ্রুত মতে, এটি পাণ্ডু রোগের উপদ্রব হিসেবে বর্ণিত। কামলা একটি পিত্ত প্রধান রক্ত প্রদুষজ ব্যাধি। অর্থাৎ পিত্ত প্রধান এই রোগে রক্ত ও পিত্ত দোষ বিকৃত হয় এবং পরবর্তীতে মাংস ধাতুকেও বিকৃত করে। এই রোগে চোখ, ত্বক, মিউকাস মেমব্রেন হলুদ বর্ণ ধারণ করে। এছাড়া খাদ্যে অরুচি, সব কাজে উৎসাহহীনতা প্রবলভাবে উপস্থিত থাকে।
আধুনিক মত অনুসারে, এই জন্ডিস প্রধানত তিন প্রকার—
হিমোলাইটিক, অবস্ট্রাকটিভ ও হেপাটোসেলুলার জন্ডিস।
আয়ুর্বেদমতে বিভিন্ন ধরনের জন্ডিসের বর্ণনা আছে—
কোষ্ঠাশ্রিত কামলা, শাখাশ্রিত কামলা, কোষ্ঠশাখাশ্রিত কামলা। এ ছাড়াও কুম্ভ কামলা, হলিমক, পানকি ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের কামলা দেখা যায়। কোষ্ঠাশ্রিত কামলাকে প্রিহেপাটিক বা হিমোলাইটিক জন্ডিসের সঙ্গে তুলনা করা যায়। রক্তের লোহিতকণিকা ভেঙে বিলিরুবিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়— যা হাইপার বিলিরুবিনোমিয়া নামে পরিচিত। চোখ, ত্বক, মিউকাস মেমব্রেন, মাড়ি হলুদ হয়ে যায়। খাদ্যে অরুচি, দুর্বলতা দেখা যায়।
শাখাশ্রিত কামলা বায়ু ও কফ দোষের বিকৃতির কারণে রক্ত ধাতুতে পিত্তদোষ বৃদ্ধি পায়। আধুনিক মতানুযায়ী অবস্ট্রাকটিভ জন্ডিসে পিত্তনালীতে বা পিত্তথলিতে পাথর বা প্রদাহজনিত কারণে পিত্তরস ক্ষুদ্রান্ত্রে পৌঁছতে না পারায় লিভারে পিত্তরসের আধিক্যের কারণে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। ফলে চোখ, ত্বক, ঝিল্লি, নখ হলুদবর্ণ হয়। এক্ষেত্রে রোগী তিল পিষ্টবৎ (চায়না ক্লে রঙের) মলত্যাগ করে।
আধুনিক মতানুসারে, হেপাটোসেলুলার জন্ডিস বলতে যকৃৎ কোষের প্রদাহ জনিত কারণে ফুলে ওঠায় যখন লিভারের সমস্ত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নালীগুলোতে (ক্যানালিকুলি) অবরোধজনিত কারণে শাখাশ্রিত কামলার মতো লক্ষণ প্রকাশিত হয় বা এই সূক্ষ্মনালীগুলি সম্পূর্ণভাবে অবরুদ্ধ না হয়ে কোষ্ঠাশ্রিত কামলার মতো লক্ষণ প্রকাশিত হয়। একে হেপাটোসেলুলার জন্ডিসের সঙ্গে তুলনা করা যায়। এই রোগে চোখ, ত্বক, নখ হলুদ বর্ণযুক্ত হয়। লালাভ, সবুজ বর্ণের মূত্র ও মল নির্গত হয়। ত্বক বিবর্ণ হয়ে ব্যাঙের ত্বকের মতো কর্কশ হয়ে ওঠে। সব কাজে উৎসাহহীনতা, জ্বালা বোধ, ক্ষুধামান্দ্য, বদহজম, দুর্বলতা, শরীরে ব্যথা, শরীর রোগা হয়ে যাওয়া, ঝিমুনি ইত্যাদি লক্ষণ প্রকাশ পায়।
কুম্ভ কামলা হল কোষ্ঠাশ্রিত কামলার প্রবর্ধমান অবস্থা। যথা সময়ে চিকিৎসা না করলে রোগের পরিণতি খারাপ হয়। দীর্ঘদিন এই রোগে ভুগলে সারা শরীর ফুলে ওঠে, কৃষ্ণ, পিতবর্ণ মল মূত্র (ডার্ক কালার) হয়। অরুচি, জ্বালা, পেট ফোলা, মূর্ছা ইত্যাদি লক্ষণ প্রকাশ পায়। এক্ষেত্রে রোগের চিকিৎসাও বেশ কষ্টকর।
হলিমক: দীর্ঘদিন কোষ্ঠাশ্রিত কামলা রোগ, পাণ্ডু অর্থাৎ অ্যানিমিয়া রোগী এই রোগাক্রান্ত হলে শরীর সবুজাভ হলুদবর্ণ ধারণ করে। প্রচণ্ড দুর্বলতা গ্রাস করে, কোনও কাজে উৎসাহ পায় না, গায়ে ব্যথা, ঝিমানো, ঘুসঘুসে জ্বর, শ্বাসকষ্ট, তীব্র অরুচি ইত্যাদি লক্ষণ প্রকাশ পায়।
কামলা রোগ অচিকিৎসিত থাকলে জ্বর, আতিসার অর্থাৎ ডায়রিয়া, চোখ ঘন হলুদ বর্ণ ধারণ করে, এই অবস্থাকে পানকি বলে। অনেকে একে হলিমকেরই একটি অবস্থা বলে মনে করেন। দীর্ঘদিন ধরে এই রোগে ভুগলে গ্রহণী রোগ অর্থাৎ অগ্নিমান্দ্য, বদহজম, বার বার পাতলা মলত্যাগ, হাত-পা সহ সারা শরীর ফুলে ওঠা ইত্যাদি লক্ষণ প্রকাশ পায়। এক্ষেত্রে রক্তে অ্যালবুমিন, গ্লোবিউলিন, এদের অনুপাত, টোটাল প্রোটিন পরিবর্তন হয়। যকৃৎ কোষ বা হেপাটোসাইটস নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে (ইন্ট্রা হেপাটিক) সিরোসিস অব লিভার হয়। যার পরিণতিতে অ্যাসাইটিস অর্থাৎ উদরি বা পেটে জল জমার অবস্থা তৈরি হতে পারে। এক্ষেত্রে পোর্টাল হাইপার টেনশন সহ প্রোটিন অ্যালবুমিন কমে যায়। এসজিপিটি, এসজিওটি, এএলপি ইত্যাদি অনেক বেড়ে যায়।
পিত্ত প্রকৃতির মানুষ বা পাণ্ডু রোগী দীর্ঘদিন ধরে অম্ল, লবণ সেবন, বিরুদ্ধ দ্রব্য, ভাজা, মশলা যুক্ত তৈলাক্ত খাদ্য, দূষিত জল পান, অতিরিক্ত মদ্য পান, বিরুদ্ধ ভোজন অর্থাৎ যে খাদ্য ওই রোগীর পক্ষে উপযুক্ত নয় তা খাওয়া বা পাণ্ডু রোগীর পিত্ত দোষ বৃদ্ধি কারক আহারাদি কারণে এই রোগ হতে পারে। এইসব কারণ ছাড়াও নানারকম ভাইরাল সংক্রমণে লিভারের নানান রোগ যেমন, হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি, ই । আবার কিছু ক্ষেত্রে প্যারাসাইট সংক্রমণেও হতে পারে।
অনেক সময় নানা ওষুধের জন্যও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আয়ুর্বেদিক ওষুধ শাস্ত্রীয় পদ্ধতি অনুসারে তৈরি হলে তা অমৃত সমান। কারণ বিভিন্ন হার্বোমিনারেল ওষুধ শাস্ত্রোক্ত পদ্ধতিতে তৈরি করলে তার হানিকর দিকটি নষ্ট হয়। জন্ডিস কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্য কোনও রোগের লক্ষণ হিসেবেও ধরা দেয়। আবার অন্য কিছু বিশেষ অবস্থাও জন্ডিসের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যেমন, অ্যালকোহলিক বা নন অ্যালকোহলিক লিভারের রোগ, গল ব্লাডারের রোগ, অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সার, সিরোসিস অব লিভার ইত্যাদি।
অনেক শিশু জন্ডিস নিয়েই জন্মায় বা জন্মের একদিনের মধ্যেই জন্ডিস ধরা পড়ে। এই অবস্থাকে প্যাথোলজিক্যাল জন্ডিস বলা হয়। সিরাম বিলিরুবিনের মাত্রা (কনজুগেটেড) প্রতি ডেসিলিটার রক্তে প্রতিদিন ৫ মিলিগ্রাম হারে বাড়তে থাকে। ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে বিপদের আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। বাচ্চার প্রস্রাবের কাপড়ে হলুদ বর্ণ ধারণ করে। প্রায় দু’সপ্তাহ এর স্থায়িত্ব হয়। এই রোগের কারণ অনুসন্ধান করা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ আশু কর্তব্য।
আবার জন্মের ২-৪ দিন পরে বাচ্চার ত্বক হলুদ হতে থাকলে তাকে ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস বলা হয়। এক্ষেত্রে, বিলিরুবিনের মাত্রা ১৫ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার সাধারণত হয়। বাচ্চাকে প্রাকৃতিক সূর্যালোকে কিছুক্ষণ করে রাখলে দু’সপ্তাহের মধ্যেই সাধারণত সুস্থ হয়ে যায়। নবজাতকদের লিভারে জমে থাকা পিত্ত রস খুব সহজে নিঃসরিত হতে পারে না। তাই আনকনজুগেটেড বিলিরুবিন বৃদ্ধি পায়। এই রোগে ত্বক হলুদ বর্ণের হয়, সঙ্গে দুধ পানে অনিচ্ছা, উৎসাহহীনতা, ঘ্যানঘ্যান করা, কাঁদা, হলুদ প্রস্রাব ইত্যাদি দেখা যায়। কামলা রোগ সঠিক সময় চিকিৎসা না হলে পরিণতি খারাপ হয়। তাই সব ক্ষেত্রেই রোগ বল ও রোগী বল বিবেচনা করে চিকিৎসা করা উচিত।
শাখাশ্রিত কামলার চিকিৎসা—
প্রথমেই এই রোগীকে স্নেহন করা হয়। এরপর তিক্ত ঔষধি যোগে সম্যক বিরেচনের পর বায়ু ও কফ নাশক ওষুধ, অগ্নির দীপন ও পাচন ওষুধ দেওয়া হয়। এরপর সামান্য পিত্ত বৃদ্ধিকর ওষুধের প্রয়োগ করা হয়। ফলে পিত্তনালীর অবরোধ দুর হয়ে পিত্ত রস স্ব স্থানে চলে আসায় পিত্ত রঞ্জকে মল রঞ্জিত হয় এবং উপদ্রব শান্ত হয়। এরপর সাধারণ কামলা রোগের চিকিৎসা করা হয়। কোষ্ঠ শোধনের জন্য ইচ্ছাভেদি রস বা ত্রিবৃত, ইন্দ্রবারুণি মূল, সুণ্ঠি হিতকর। তবে এই রোগে অনেক সময়ই গলব্লাডারে শল্য চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। চিকিৎসার সীমাবদ্ধতার কারণে আধুনিক শল্য চিকিৎসার সাহায্য নেওয়া উচিত।
সাধারণ অথবা কোষ্ঠশাখাশ্রিত কামলার চিকিৎসা
প্রথমেই রোগের কারণ বা নিদান বর্জন। এরপর মহাতিক্ত ঘৃত, কল্যাণ ঘৃত দিয়ে স্নেহন করিয়ে তিক্ত রসযুক্ত দ্রব্য দিয়ে বিরেচন এবং তারপর দোষ শমন চিকিৎসা করা হয়। বিরেচন করানোর জন্য নিশোথ চূর্ণ, ইচ্ছাভেদী রস, স্বর্ণ ক্ষিরি ইত্যাদি দিয়ে করা হয়। ত্রিফলা, গুরুচি, নিম, দারুহারিদ্রা দিয়ে ক্বাথ বানিয়ে ত্রিফলা চূর্ণের সঙ্গে সকালে সেবন খুব ফলদায়ক।
কামলা রোগে নবায়স লৌহ, পুনর্ণবা, মন্ডুর, ফলত্রিকাদি ক্বাথ, আরোগ্যবর্ধনী বটি, জ্বর থাকলে সুদর্শন চূর্ণ, লোকনাথ রস, যকৃৎ প্লিহারী লৌহ খুব উপকারী।
কুম্ভ কামলার চিকিৎসা—
কোষ্ঠ শাখাশ্রিত কামলার চিকিৎসা দিতে হবে। সঙ্গে স্বর্ণ মাক্ষিক, শুদ্ধ শিলাজিৎ, বিড়ঙ্গাদি লৌহ, আমলকী অবলেহ লাগবে। হলিমক রোগে বাত পিত্ত নাশক, পাণ্ডু তথা কামলা নাশক চিকিৎসা করা হয়। স্নেহন করে বিরেচন করা হয়। পঞ্চকর্ম চিকিৎসায় বস্তি হিতকর। অগ্নি বৃদ্ধিকর ওষুধ, ফলত্রিকাদি ক্বাথ, কুমার্যাসব, আরোগ্য বর্ধনী, নবায়স লৌহ খুব উপকারী।
এছাড়াও লিভারের রোগে খুব কার্যকর—
আমলকী, হরীতকী, বহেড়া, গুরুচী, দারুহরিদ্রা, মুথা, কটকি, শরপুঙ্খা, ভুঁই আমলা, কালমেঘ, চিরতা, ঘৃতকুমারী, বাসক, পুনর্ণবা, ভৃঙ্গরাজ ইত্যাদি। লিভারের রোগে এইসব বিভিন্ন হার্বসের উপকারিতা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের বিভিন্ন গবেষণায় মাণিত ও প্রকাশিত। যদিও হাজার হাজার বছর আগের মূল্যবান দলিলেও সেই একই কথা বলা আছে।
ফিলাডলেফিয়া ক্যান্সার সেন্টারসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাসম্মতভাবে গবেষণা করে দেখেছেন যে ভুঁই আমলার রস হেপাটাইটিস বি রোগে উপকারী। এই রোগে ভাইরাল লোড কমে, সারফেস অ্যান্টিজেন নষ্ট করে।
মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার, কস্তুরবা হেলথ সায়েন্স, মুম্বই— তাদের গবেষণায় দেখিয়েছে নন অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ-এ কটকী একটি গুরুত্বপূর্ণ ওষধি। এটি হেপাটো প্রোটেকটিভ। এই রোগে লিভার কোষে ফ্যাট জমে ফাইব্রোসিস হয় যা পরবর্তীতে লিভার সিরোসিস বা ক্যান্সার হতে পারে। এই রকম রোগের ক্ষেত্রেও কটকী উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা রাখে। আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, লিভার কোষে লিপিড কমাতে কটকী সিলিমারিন-এর থেকেও কার্যকরী।
জার্নাল অব আয়ুর্বেদা অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড মেডিক্যাল সায়েন্সেস-এ প্রকাশিত গবেষণাপত্রে ফলত্রিকাদি ক্বাথ বিভিন্ন জন্ডিস রোগে খুব কার্যকর বলে দাবি করা হয়েছে। ওয়ার্ল্ড জার্নাল অব ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যান্ড মেডিক্যাল রিসার্চ-এও বিভিন্ন জন্ডিসে ফলত্রিকাদি ক্বাথের ক্রিয়াশীলতা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এই গবেষণা পত্রে ফলত্রিকাদি ক্বাথকে হেপাটোসেলুলার জন্ডিস, অ্যানিমিয়া রোগে উপকারী বলা হয়েছে। এই গবেষণার মডার্ন প্যারামিটারে ওষুধের নিম্নোক্ত প্রপার্টিগুলো পাওয়া গিয়েছে— চোলেগুজে, কোলেট্রিক অ্যাকশন, হেপাটো সেলুলার রিজেনারেশন, অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিঅক্সডেন্ট, এনজাইম অ্যান্ড মেটাবলিক কারেকশন, ইমিউনো মডিউলেটিং অ্যাকশন, অ্যান্টিপাইরেটিক অ্যাকশন।
কী করতে হবে?
আমাদের খাদ্যের পরিপাকে উদ্ভূত সারাংশ রক্তের সঙ্গে মিশে লিভারকে প্রভাবিত করতে পারে। আবার লিভার শরীর থেকে বিষাক্ত অপসারণের সঙ্গে সঙ্গে মৃত, ক্ষতিগ্রস্ত রক্তকণিকা পরিষ্কার করে। তাই লিভার সুস্থ রাখতে কিছু বিধি মেনে চলা উচিত, যেমন— বিশুদ্ধ পানীয় জল বেশি মাত্রায় সেবন। তাজা ফল, সব্জি, দানা শস্য প্রতিদিন খেতে হবে। উদ্ভিজ্জ প্রোটিন— বাদাম, মুসুর, ছোলা, মটর খাদ্য তালিকায় থাকবে। রেড মিট, পাকা তৈলাক্ত মাছ নয়, ছোট তাজা মাছ খাওয়া উচিত। এতে জিঙ্ক, ওমেগা-৩ থাকে, যা বিপাকে সাহায্য করে। মদ্যপান, ধূমপান একদম নয়। ময়দা, চিনি, পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট, তৈলাক্ত খাবার, ভাজা, ফাষ্ট ফুড, দুগ্ধজাত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। অতিরিক্ত পরিশ্রম নয়। বিশ্রাম নিতে হবে। সঠিক ঘুমের প্রয়োজন। সুস্থ জীবনযাপনের প্রশ্নে লিভারের ক্রিয়াশীলতা স্বাভাবিক রাখা অবশ্য কর্তব্য। আজ সারা বিশ্ব গুরুত্বের সঙ্গে প্রতি বছর ১৯ এপ্রিল দিনটি ইন্টারন্যাশনাল লিভার ডে হিসেবে পালন করছে। এই অনুষ্ঠানের সার্থকতা সেখানেই।
লেখক আয়ুর্বেদ চিকিত্সক