আমাদের শরীরের বিভিন্ন তন্ত্র বা সিস্টেম আছে। তার মধ্যে পরিপাকতন্ত্র বা ডায়জেস্টিভ সিস্টেমের অন্যতম গ্রন্থি হল লিভার বা যকৃত্। যেটা পেটের উপর দিকে মধ্যচ্ছদার ঠিক নীচে থাকে। এর রং লালচে বাদামি। লিভার বা যকৃতের কাজ কী? দেহের কী কী কাজ করে।
• ক্ষরণ কাজ: গাঢ় হলদে নীল রঙের পিত্তরস বা পিত্ত (বাইল) মিশ্রিত হয়।
• বিপাক কাজ: কার্বোহাইড্রেটের বিপাক; প্রোটিনের বিপাক, ফ্যাটের বিপাক ও হরমোনের বিপাক ইত্যাদি।
• রেচন কাজ: দেহে উৎপন্ন বিষাক্ত পদার্থ ব্যাকটেরিয়া, ওষুধ, ভারী ধাতু প্রভৃতি পদার্থ যকৃত্ মিশ্রিত পিত্তরসের মাধ্যমে দেহ থেকে নির্গত হয়।
• রক্ত সম্পর্কীয় কাজ: ভ্রূণ অবস্থায় আরবিসি (রেড ব্লাড সেল) লোহিতকণিকার উৎপাদন, পূর্ণবয়স্ক আরবিসি-র বিনাশ, রক্তের সঞ্চয় স্থান, রক্তের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ, রক্ততঞ্চনকারী প্লাজমা প্রোটিনের উৎপাদন, যকৃতের মাস কোষ থেকে রক্ততঞ্চন বিরোধী হেপারিন উৎপাদন ইত্যাদি।
• অন্যান্য কাজ: ভিটামিনের সংশ্লেষণ ও সঞ্চয়, দেহতাপ নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরক্ষা ও প্রশমন ইত্যাদি। বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থকে বিনাশ করা ও দেহকে সুরক্ষিত রাখা।
লিভারের অসুখগুলি
আমরা প্রায়ই শুনি জন্ডিসের কথা। জন্ডিসের তিন ধরনের প্রকারভেদ আছে। হিমোলাইটিক জন্ডিস, হেপাটিক জন্ডিস আর অবস্ট্রাকটিভ জন্ডিস। এছাড়া যে সব অসুখ হয় সেগুলি হল, যকৃতের সিরোসিস, মেদবহুল যকৃত বা ফ্যাটি লিভার। অর্থাৎ যকৃৎ স্বাভাবিক কাজকর্ম করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে!
অল্প কথায় মোটামুটিভাবে লিভারের কাজ ও স্বাভাবিকতা এবং অস্বাভাবিকতা সম্বন্ধে আলোচনা করা হল। এবার বলি লিভারের অস্বাভাবিকতা কমিয়ে বা দূর করে স্বাভাবিকতা বাড়িয়ে সুস্থ, সবল, সতেজ এবং কর্মঠ হয়ে দীর্ঘ জীবন লাভ করতে যোগাভ্যাসের কৌশল।
প্রতিদিন নিয়মিতভাবে যেগুলি অভ্যেস করা উচিত তা বলছি।
(১) ষঠকর্ম: নেতি, ধৌতি, বস্তি, নৌলিক ও কপালভাতি। (২) ভোরে: সহজবস্তি ক্রিয়া, সহজ প্রাণায়াম ১নং, ৩নং এবং ৪নং, অর্ধকূর্মাসন, উড্ডীয়ান, অগ্নিসারধৌতি ১নং, সহজ অগ্নিসার, (৩) বিকেলে বা সন্ধ্যায়: অগ্নিসার ধৌতি ২নং, সহজ অগ্নিসার, শয়ন পশ্চিমোত্তনাশন, হলাসন, সহজ প্রাণায়াম ১ নং, ৩ নং এবং ৪ নং, পবনমুক্তাসন ও ভ্রমণ প্রাণায়াম। (৪) মালিশ বা মাসাজ (৫) পরিমিত আহার, সাত্ত্বিক আহার হলেই ভালো হয়। অর্থাৎ খেতে হবে নিরামিষ আহার। (৬) ফল, শাকসব্জি, দুধ, ঘোল প্রভৃতি ক্ষারধর্মী খাবার। (৭) সাধ্যমতো শারীরিক পরিশ্রম করা ইত্যাদি।
এখন কীভাবে অভ্যাস করব বা করবেন তার দু’একটি পদ্ধতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করছি।
ষঠকর্ম, নেতি : নেতিপটে উষ্ণ লবণ জল নিয়ে একটি নাসাপুটে ঠেকিয়ে সামনের দিকে বেঁকে মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে হবে। ঘাড়টি বাঁকিয়ে, অর্থাৎ নাসাপুটটি উপর দিকে কাত করে রাখতে হবে। দেখা যাবে অন্য নাক দিয়ে জল বেরিয়ে যাচ্ছে। এবার উদঘাত ক্রিয়া করে নেব ৩-৪ বার। পুনরায় অন্য নাক দিয়ে একইভাবে নেতিপটের সাহায্যে জল নেব। দেখব অন্য নাক দিয়ে জল বেরিয়ে যাচ্ছে। এরপর পুনরায় তিন চার বার উদঘাত ক্রিয়া করবেন ব্যস।
ধৌতি-বমনধৌতি অর্থাৎ সকালে খালি পেটে উষ্ণ জল পেট ভর্তি করে খেতে হবে, বাবু হয়ে বসে। জল খাওয়া হয়ে গেলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একটু সামনের দিকে বেঁকে দাঁড়াতে হবে। তারপর গলায় আঙুল দিয়ে আল জিহ্বাকে নাড়ানো। এতে সহজেই পেট থেকে জল মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে। জলের সঙ্গে কফ, পিত্ত ও অন্যান্য দূষিত পদার্থ বেরিয়ে যায় এবং শরীর তত্ক্ষণাত্ সুস্থ বোধ করে।
সহজ প্রাণায়াম– ১) লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ুন। হাত দুটো দেহের সঙ্গে লেগে থাকবে। পা দু’টি পাশাপাশি সংলগ্ন থাকবে। এবার শ্বাস নিতে নিতে হাত দু’টি মাথার পিছন দিকে নিয়ে যেতে হবে। মাথার সঙ্গে হাত দু’টি সমান্তরাল থাকবে। এবার শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে হাত দু’টি আগের জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। এইভাবে ১০-১৫ বার করা যেতে পারে।
২) এরপর হাত দু’টিকে বিশ্রাম দিয়ে শ্বাস নিতে নিতে হাঁটু ভাঁজ না করে ডান পাটিকে যতটা সম্ভব উপর থেকে তুলতে হবে। শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে ডান পা নামাতে হবে। আবার শ্বাস নিতে নিতে বাম পা তুলতে হবে। এইভাবে ১০-১৫ বার অভ্যাস করতে হবে।
আসন
অর্ধকূর্মাসন: বজ্রাসনে বসে হাত দুটি মাথার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, এবার শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে দু’টি হাত লম্বা করে মাথা সমেত নমস্কারের ভঙ্গিতে মাটিতে ঠেকাতে হবে। শ্বাসবন্ধ করে পাঁচ সাত সেকেন্ড রাখতে হবে। অতঃপর শ্বাস নিতে নিতে আগের অবস্থায় ফিরে আসতে হবে। এইভাবে পাঁচ-সাত বার করা যেতে পারে। পরামর্শ হল, এই লেখা পড়ে কেউ নিজে অভ্যেস করতে যাবেন না। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই রাজ্য সরকার স্বীকৃত রেজিস্ট্রেশন নম্বর যুক্ত ব্যক্তির কাছে বা যাঁরা দীর্ঘদিন যোগাচার্য হিসেবে কাজ করছেন, তাঁদের পরামর্শ নিয়ে অভ্যাস করাই সব থেকে নিরাপদ।
লেখক: পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যোগ ও ন্যাচারোপ্যাথি কাউন্সিলের গভর্নমেন্ট বডি মেম্বার