প্রথমে হয়ে উঠেছিল নাগরিক আন্দোলন। কথা ছিল পর্যবসিত হবে গণআন্দোলনে। অথচ মাত্র এক মাসের মধ্যে সেই আন্দোলন আবদ্ধ হয়ে গেল নিছক জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি এবং অবস্থানের আবর্তে। কেন? এর উত্তর সন্ধান করতে হবে নাগরিকদের। প্রতিদিন রাস্তা দখলের আহ্বানে সরব অংশগ্রহণ দেখা গিয়েছে সমাজের নাগরিক মহলকে। একটি আশার সঞ্চার হয়েছিল যে অবশেষে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে স্রেফ অন্যায়ের প্রতিবাদে মানুষ একজোট হচ্ছে। কিন্তু দেখা গেল ধীরে ধীরে সিংহভাগ পূর্বঘোষিত আন্দোলনকারী নাগরিক ক্রমেই প্রাত্যহিক রুটিনে ফিরে যাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে হচ্ছে কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন কর্মসূচি। মিছিল, মানববন্ধন। এমনকী কলকাতার কিছু মানুষ ডাক্তারদের ধর্নামঞ্চে যাচ্ছেন। কিন্তু নাগরিকদের নিজেদের আন্দোলনের সেই তীব্রতা আর নেই। এখনও বহু স্থানে নাগরিক আন্দোলনের আগুন জ্বালিয়ে রাখা হলেও সেরকম প্রচার আর পাচ্ছে না সেগুলি। সব প্রচার এসে যেন কেন্দ্রীভূত হয়েছে স্বাস্থ্যভবনের সামনে। চলছে নার্ভের লড়াই। সরকার বনাম জুনিয়র ডাক্তার। নাগরিকরা এখন সংবাদমাধ্যমে দর্শক। কী হয় কী হয় মনোভাব নিয়ে! কেন? তাঁরা নিজেরাই উত্তর খুঁজুন।
প্রকৃত গণআন্দোলনের প্রাবল্য ক্রমেই বেড়ে চলে। শহর থেকে গ্রাম। রাজপথ থেকে গ্রামীণ মেঠো রাস্তায় ছড়িয়ে পড়বে আগুন। অথচ এক্ষেত্রে নাগরিকদের আন্দোলন বিপরীত পথে হাঁটল। ক্রমেই আন্দোলন সংকুচিত হয়ে গেল। বৃহৎ এক রাজ্যজুড়ে হওয়া পদযাত্রা, বিক্ষোভ, মানববন্ধনের উত্তাল হওয়া দৃশ্য আশ্রয় নিল কলকাতার সর্বোচ্চ অভিজাত এলাকা সল্টলেকের রাস্তার একটি অংশে। ছিল নাগরিকদের দাবি। হয়ে গেল জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি। কেন?
নিউজ চ্যানেল অথবা সংবাদমাধ্যমে আজকাল প্রথমেই বাক্যবিন্যাস শুরু হয় যে, ‘ডাক্তারদের আন্দোলনে’ কী কী হয়েছে আজ! ‘নাগরিক আন্দোলন’ শব্দটি হারিয়ে গিয়েছে। কী উদ্দেশ্যে শুরু হয়েছিল আন্দোলন? নির্যাতিতার বিচার চাই। দোষীর দ্রুত শাস্তি চাই। আজ কী দাবিতে মুখর জুনিয়র ডাক্তাররা? প্রথমে কয়েকজন সরকারি আধিকারিকদের সরিয়ে দেওয়ার দাবি। সেই দাবি মানা হল। তারপর তাঁদের দাবি হয়েছিল, হাসপাতাল ও কলেজে থ্রেট কালচার বন্ধ করা। ওয়াশ রুমের সংখ্যা বৃদ্ধি। নিরাপত্তা প্রদান করা। কাউন্সিল নির্বাচন। নাগরিকদের কি এগুলোই প্রধান দাবি?
আজকাল সবথেকে বেশি গুরুত্ব হারিয়েছে ইতিহাসের মাহাত্ম্য। যখন তখন রেফারেন্স হিসেবে উল্লিখিত হয় যে কোনও ঐতিহাসিক অধ্যায়কে। এই নাগরিক আন্দোলনকে কখনও বলা হয়েছে, এটা আসলে বঙ্গভঙ্গ ধাঁচের আন্দোলন। কখনও তকমা দেওয়া হয়েছে ফরাসি বিপ্লব। বলা হয়েছে শীঘ্রই ধ্বংস হবে বাস্তিল দুর্গ। ঠান্ডা মাথায় অবশ্য প্রশ্ন করাই যায় যে, এই রেফারেন্সগুলির প্রয়োজন পড়ছে কেন? প্রতিটি আন্দোলনের নিজস্ব একটি চরিত্র আছে। প্রেক্ষাপট আছে। অভিমুখ আছে। শক্তি আছে। সে যত ক্ষুদ্রই হোক। যত বৃহৎ হোক। নাগরিক আন্দোলনকে তার মতো করেই থাকতে, বাড়তে, ছড়াতে দেওয়ায় স্বাধীনতা দেওয়া উচিত ছিল। সে নিজেই ছিল এক শক্তিশালী আন্দোলন। কিন্তু প্রথমে কয়েকটি রাজনৈতিক দল। তারপর জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থান। ক্রমেই নাগরিকদের আন্দোলন তাঁদের হাত থেকে চলে গেল। মাত্র এক মাসের মধ্যে! কেন?
নাগরিক আন্দোলনের অন্যতম দুর্বলতা লক্ষ করা গিয়েছে, অজ্ঞানতা। যতটা আবেগ এবং রাগ রয়েছে, ততটা আইন অথবা বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে আইডিয়া নেই। যে যা রটিয়েছে সেটাই বিশ্বাস করা হয়েছে।
এখন একমাস অতিক্রান্ত। প্রাথমিক সেই প্রবল ঝাঁঝালো রাগ সামান্য হলেও কমেছে। অতএব এটাই প্রকৃষ্ট সময় আইন ও বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে জেনে নেওয়ার। ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শুরু হয় ঘটনাস্থল থেকে। একদিকে পোস্টমর্টেম থেকে পাওয়া তথ্য। অন্যদিকে ফরেনসিক পরীক্ষার রিপোর্ট। ঘটনাস্থলে যা যা পাওয়া যায়, সেফটিপিন থেকে চুলের অংশ। ফুটপ্রিন্ট অথবা ফিঙ্গারপ্রিন্ট। ধূলিকণা কিংবা ঘাম অথবা লালারস। রক্তের দাগ কিংবা ছেঁড়া সুতো। প্রতিটি তুচ্ছ ক্ষুদ্র বৃহৎ অংশই ফরেনসিক পরীক্ষায় কাজে আসে। তৈরি হয় এভিডেন্স। ডিএনকে ম্যাচিং। পলিগ্রাফ আদালতে কোনও প্রমাণ নয়। তদন্তে সাহায্য করে।
ঘটনাস্থলে তথ্যপ্রমাণ লোপাট হয়ে গেলে এসব অনেকাংশে পাওয়া যাবে না। বহু মানুষ ঘটনাস্থলে ঘোরাফেরা করলে ফুটপ্রিন্ট, ফিঙ্গারপ্রিন্ট সব হারিয়ে যাবে। এসব প্রতিটি তদন্তকারী এজেন্সিরই জানা। তবে এবার সিবিআই মাত্র ৯৬ ঘণ্টার মধ্যে তদন্তভার পেয়ে গিয়েছে। নিছক সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট হয়ে গিয়েছে বলে আমরা কিছই তদন্ত করতে পারলাম না, এসব বললে নাগরিকরা মেনে নেবেন না। কিছু অন্তত ইতিবাচক তদন্ত রিপোর্ট আশা করছে সবাই। নচেৎ এত গ্রেপ্তার, তল্লাশি চলছে কেন? বিচারপতি বলছেন কেন স্ট্যাটাস রিপোর্টে উদ্বেগজনক তথ্য আছে? তার মানে তো কিছু কিছু পাওয়া গিয়েছে?
তদন্ত শুরু হওয়ার পর অভিযুক্ত যদি গ্রেপ্তার হয়ে যায় তাহলে তাকে জেরা করা হয়। ক্রমে অন্যদের সম্পর্কে তথ্য জানা গেলে তাদেরও গ্রেপ্তার করা। জিজ্ঞাসাবাদ। ধর্ষণের ক্ষেত্রে ৬০ দিনের মধ্যে দিতে হবে চার্জশিট। চার্জশিট মানে কী? যাকে বা যাদের সন্দেহভাজন হিসেবে মনে করা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে চার্জ ফ্রেম করা। সেই অনুযায়ী চার্জশিট আদালতে পেশ করা। একে ফাইনাল রিপোর্ট বলা যায়। একটি হতে পারে কোনও অভিযোগই প্রমাণ হয়নি। অর্থাৎ সেটি আদতে ক্লোজার রিপোর্ট। অথবা চার্জ ফ্রেম করে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে রিপোর্ট পেশ। সেটাই চার্জশিট। চার্জশিট সময়মতো না জমা দিলে কী হবে? অভিযুক্তকে জামিনে মুক্ত করে দেওয়া হবে। এখনও সিবিআই কিন্তু আর জি কর কাণ্ডে চার্জশিট দেয়নি। আদালতে তারা বলেছে নির্যাতিতার ধর্ষণ ও হত্যা একজনই করেছে।
চার্জশিট পেয়ে আদালত দু পক্ষকেই ডাকবে। অভিযুক্তকে আবেদন করতে বলা হবে যে, সে কী বলবে এই অভিযোগ সম্পর্কে? চার্জশিটের কপি সেও পাবে। সে বলতে পারে আমি দোষী। তাহলে আর বিশেষ শুনানিপর্ব প্রয়োজন নেই। রায় ঘোষণা করা হবে। আবার সে বলতে পারে, আমি নির্দোষ। নট গিল্টি। তাহলে সে যে দোষী, সেটা প্রমাণ করতে হবে তদন্তকারীদের। প্রসিকিউশন এবং ডিফেন্স, দুই আইনজীবীদের মধ্যে শুরু হবে সওয়াল জবাব।
চার্জশিট এবং শুনানি শুরু হলে প্রসিকিউশন উইটনেসের এভিডেন্স রেকর্ড করা শুরু করবেন বিচারপতি। অর্থাৎ তদন্তকারী সংস্থা যাঁদের সাক্ষী হিসেবে তালিকাভুক্ত করছে তাঁদের কাঠগড়ায় তোলা হবে। এই সাক্ষীদের সংখ্যা কয়েকজন হতে পারে। আবার কয়েকশ হতে পারে। এই সাক্ষীদের বক্তব্যই শেষ কথা নয়। তাঁদের ক্রস এক্সামিনেশন করবেন আসামিপক্ষের উকিল। আসামিপক্ষও আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য নিজেদের সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ করতে পারে। সাক্ষী জোগাড় করতে পারে। অর্থাৎ যাঁরা বলবেন আদৌ অভিযুক্ত এই কাণ্ডে জড়িত নয়। সে অন্য কোথাও ছিল ওই সময় ইত্যাদি। এই অ্যালিবাই প্রতিষ্ঠিত হলে সেটি শক্তিশালী একটি এভিডেন্স অভিযুক্তের পক্ষে। আবার তদন্তকারীকে প্রমাণ দিয়ে সেটি খণ্ডন করতে হবে
এই প্রতিটি সওয়াল জবাবের আগে তদন্তকারীদের আদালতে জমা দিতে হবে এভিডেন্স। পোস্ট মর্টেম, ফরেনসিক রিপোর্ট। প্রাপ্ত পারিপার্শ্বিক এভিডেন্স ইত্যাদি। এই গোটা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর আদালতে কেউ দোষী প্রমাণ হলে সাজা ঘোষণা করা হবে। এরপর সেই অভিযুক্ত উচ্চ আদালতে যেতে পারে। সেখানেও একই রায় থেকে গেলে, সে যেতে পারে সুপ্রিম কোর্টে।
অর্থাৎ গোটা প্রক্রিয়াটি ১৫ দিন, এক মাস, দুই মাসে সম্পন্ন হয়ে যাবে যারা ভেবেছে, তাদের প্রতীক্ষা করতে হবে। কতদিন? কেউ জানে না!
এই যে প্রক্রিয়াটি বলা হল, এটি পূর্ণাঙ্গভাবে হবে শিয়ালদহ কোর্টে। যেখানে নির্যাতিতার মামলাটি চলবে। সুপ্রিম কোর্টে ট্রায়াল হচ্ছে না। সুপ্রিম কোর্ট সিবিআইকে তদন্তের স্ট্যাটাস রিপোর্ট দিতে বলেছে। সেটাই দিচ্ছে সিবিআই। ভালো করে বুঝতে হবে যে, সুপ্রিম কোর্ট ধর্ষণ ও হত্যা মামলার কোনও রায় দেবে না এখন। আগে শিয়ালদহ আদালতে বিচার ও রায় হবে। তারপর প্রয়োজন হলে হাইকোর্টে যাবে মামলা। যদি পরিস্থিতি আসে, তখন আবার আসবে সুপ্রিম কোর্টের পালা।
কাউকে ডেকে পাঠানো। কাউকে গ্রেপ্তার করা। কারও বাড়িতে তল্লাশি চালানো। এসব মানেই সেইসব ব্যক্তি অপরাধী নয়। এগুলো হল তদন্ত প্রক্রিয়া। এদের মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে আছে আসল অপরাধী। আবার নাও হতে পারে। কিন্তু যার বা যাদের বিরুদ্ধে তদন্তকারী সংস্থা চার্জশিট জমা দেয়, সেইসব চার্জ অর্থাৎ অভিযোগকে প্রমাণ করতে হয় আদালতে। নয়তো প্রমাণ, এভিডেন্স কিংবা সাক্ষ্যের অভাবে বহু অভিযুক্ত দীর্ঘসময় বিচারপ্রক্রিয়ার পর মুক্তি পেয়ে গিয়েছে। বহু মামলা খারিজ হয়ে গিয়েছে। অতএব আর জি কর কাণ্ডে সিবিআইয়ের প্রধান চ্যালেঞ্জ হল, নিখুঁত এভিডেন্স ও সাক্ষ্য দিয়ে প্রমাণ করা যে কে বা কারা দোষী। তিনটি তদন্ত চলছে। একটি হল ধর্ষণ ও হত্যা। অন্যটি কারা সেই কাণ্ডকে আড়াল করেছে। তৃতীয়ত আর জি করের দুর্নীতি ও অনিয়ম। প্রতিটি প্রমাণ করতে হবে। গালগল্প দিয়ে নয়। নথিপত্র ও এভিডেন্স দিয়ে। সিবিআইকে চাপ দিতে হবে যাতে একটিও অপরাধী ছাড় না পায়। এই তিন তদন্ত থেকে। সেটা কি হচ্ছে আন্দোলনে? দেখা যাচ্ছে স্পেসিফিক আইনমাফিক দাবিদাওয়া?
আর জি কর কাণ্ডে চার্জশিটের পর বিচারপ্রক্রিয়া হওয়া উচিত ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে। যাতে সাধারণ বিচারের তুলনায় দ্রুততর হয় শুনানি ও সাজাদান। কিন্তু দুর্ভাগ্য হল, ভারতের ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টগুলিতে অন্তহীন মামলা বছরের পর বছর ধরে নিষ্পত্তির অপেক্ষা করছে। অপরাধের বিচার চাই। অন্যায়ের প্রতিকার চাই। একইসঙ্গে ভারতের জুডিশিয়ারির আমূল সংস্কার দরকার। বিপুল নিয়োগ বন্ধ বছরের পর বছর ধরে। বিচারপতিরা অসহায় যথেষ্ট পরিকাঠামো না থাকায়। রয়েছে অন্যান্য অভ্যন্তরীণ সমস্যাও। এই দীর্ঘসূত্রতার কারণে বহু মানুষ বিচার পায় না সময়ে। বিচার বিলম্বিত হওয়ার অর্থ কী? বিচার না পাওয়া!