গত সপ্তাহে একদিন দুপুরে হাতিবাগানে ঘুরছিলাম। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতেও পুজোর মাত্র একমাস আগে এমন বিবর্ণ বিধান সরণি দেখিনি। কয়েকদিন আগে গড়িয়াহাটেও একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। বড় বড় ঝাঁ-চকচকে দোকানে সেলসম্যানের চেয়ে ক্রেতা কম। তবু তাঁদের পুঁজির জোর আছে সামলে নিতে পারবেন। কিন্তু ফুটপাতে? অধিকাংশ গরিব দোকানিরই দৃষ্টি শূন্য। বৃষ্টি কমতে যদিও বা ক্রেতার খোঁজ মিলল, তখনই পাশ দিয়ে প্রতিবাদ মিছিলের ঠেলায় আবার গাড়িঘোড়া থেমে গেল মুহূর্তে। বিচার প্রার্থীদের গর্জনে থমকে গেল কেনাকাটা। এক হকারকে প্রশ্ন করতেই বলল, ‘এবার আর বেশি কিছু হবে না দাদা, বেশ বুঝে গিয়েছি। গত একমাস বউনি করতেই হিমশিম খাচ্ছি। কুড়ি সালে করোনার পর এমন শুখা বাজার দেখিনি।’ সেবার ছিল প্রাণ বাঁচানোর তাগিদ আর এবার বিচার চাওয়ার হিড়িক। ভাবছিলাম, অন্ধকার বিষণ্ণতায় বাজারের মুখ ঢেকে দেওয়ার নামই কি বিচার? এই বিচার তো আসল দোষীকে ছেড়ে গরিবের পেটে লাথি মারার শামিল। কাকে শাস্তি দিচ্ছি আমরা, উসকোখুসকো চুলের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া শীর্ণ চেহারার মানুষগুলোকে? রাস্তার ধারে পসরা সাজিয়ে বসা এই মানুষগুলোর শেষ ভরসা এখন পুজোর আগের শেষ তিনটে রবিবার।
প্রশ্ন করি, এই শাস্তি কি ওদের প্রাপ্য ছিল? ওরা তো মৃত মানুষকে সচেতনভাবে ৭২ ঘণ্টা আইসিইউতে রেখে নার্সিহোমের বিল বাড়ায়নি, অহেতুক বিল চড়ছে দেখেও মুখে রা না-কাড়ার অন্যায়ে শামিল হয়নি। জাল ওষুধ আর মরা লাশের সিন্ডিকেটও তৈরি করেনি হাসপাতালে হাসপাতালে। পরীক্ষার নম্বর বাড়ায়নি, কমায়নি। প্রশ্নপত্র বিক্রি করেনি। ওষুধ কোম্পানির পয়সায় বিদেশ ভ্রমণ করেনি। ফিরে এসে সেই সংস্থার অনুরোধে দেদার একটি বিশেষ সংস্থার দামি ওষুধ লিখতেও বাধ্য হয়নি। এখনই যে রক্তপরীক্ষার দরকার নেই, তাও করতে চাপ দিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে মোটা কমিশন পকেটস্থ করেনি। বেসরকারি নার্সিংহোমের পকেট কাটা সিন্ডিকেটে নাম লেখায়নি। এক্ষেত্রে কি লক্ষ লক্ষ রোগীকে বিচার পাইয়ে দিতে শিরদাঁড়া সোজা রাখার দাবি উঠবে না। সমাজের জঞ্জাল সাফাই কখনও একমাত্রিক ব্যবস্থা হতে পারে?
দক্ষিণ ভারতের যে কোনও হাসপাতালে কলকাতার ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন দেখান, উল্টো দিকের বিশেষজ্ঞের মোটা কাচের চশমার ফাঁক গলে একটাই তির্যক মন্তব্য ধেয়ে আসবে, ‘কলকাতার ডাক্তাররা অহেতুক বেশি ওষুধ লেখেন।’ নিমেষে বেঙ্গালুরুর নিমহানস কিংবা সিএমসি ভেলোরে কলকাতার ডাক্তারের দেওয়া পাঁচটা ওষুধের ফিরিস্তি কমে হয়ে যায় দু’টো। কেন কে জানে! হাওড়া স্টেশনে দক্ষিণের ট্রেনগুলিতে মুমূর্ষু রোগী যাওয়ার ভিড় দেখেই বোঝা যায় পরিকাঠামো, হাসপাতাল ডাক্তারের কমতি না থাকলেও, ন্যায্য বিচার না পেয়েই তাঁরা ছুটে যাচ্ছেন চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, মুম্বই। আশা একটাই, যদি সুলভে আরোগ্য মেলে! মুমূর্ষুকে এইটুকু বিচার দেবেন না চিকিৎসক সমাজ?
ডাক্তারদের গত প্রায় দেড় মাসের টানা কর্মবিরতিতে ধাক্কা খেয়েছেন কারা? হলফ করে বলতে পারি, কোনও ধনীর এতটুকু অসুবিধা হয়নি। কারণ তাঁদের জন্য মহার্ঘ বেসরকারি হাসপাতালে পরিষেবা দিব্যি চালু আছে। সেখানে ‘পয়সা ফেকো তামাশা দেখো’! তাঁদের খরচেরও পরোয়া নেই, শাঁসালো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, মোটা টাকার স্বাস্থ্যবিমা, এককথায় আয়োজন সম্পূর্ণ। যোগাযোগও বিশাল। শুনছি, মাঝারি মাপের নার্সিংহোমেও পাঁচ লাখের বিল আট লাখ ছাড়াচ্ছে কর্মবিরতির মওকায়। পোয়াবারো ধুরন্ধর ব্যবসায়ীদের। বিচার চাওয়ার এই কানাগলিতে মার খাচ্ছে গরিব মানুষ। হয় তাঁদের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে কিংবা ঘটিবাটি বেচে নার্সিংহোমে ছুটতে হচ্ছে পয়সা খরচের প্রতিযোগিতায় নাম লেখাতে। নার্সিংহোমের অসাধু সিন্ডিকেট ভাঙার দায়িত্বও কিন্তু ডাক্তারদের। নাহলে জঞ্জাল সাফাই অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।
এই মুহূর্তে কলকাতায় সাধারণ থেকে বিশেষ মানের ডাক্তারদের ফিজ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। রোগী দেখার সময় গড়ে ১৫ থেকে ২০ মিনিট। হাসপাতালের ওপিডি বন্ধ থাকলে ক’জন ওই টাকা দিয়ে প্রাইভেট চেম্বারে ডাক্তার দেখাতে আর্থিকভাবে সমর্থ। অথচ অভয়ার উপর পাশবিক অত্যাচারের সঙ্গে কোনও গরিব হকার, দোকানি, ফেরিওয়ালা, প্রান্তিক মানুষ কিন্তু জড়িত নন। শেষ পর্যন্ত সিবিআই তদন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আমরা জানি না। মোমবাতি জ্বেলে বসে থাকলেই দোষী শাস্তি পাবে না। তার জন্য চাই প্রমাণ। তবে এটুকু জানি, অভিযুক্তরা হচ্ছেন এক সিভিক ভলান্টিয়ার, কলেজের দোর্দণ্ডপ্রতাপ অধ্যক্ষ ডাক্তার সন্দীপ ঘোষ ও তাঁর অনুগামী চিকিৎসককুল। তথ্য-প্রমাণ নষ্ট করার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন টালা থানার ওসি অভিজিৎ মণ্ডল। তাহলে আসল দোষীদের ছেড়ে কাকে শিক্ষা দিচ্ছি? এ তো ঝিকে মেরে বউকে শিক্ষা দেওয়ার শামিল। এরই ধাক্কায় রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্যসাথীতে দৈনিক যেখানে ৩ কোটি টাকা খরচ হতো, এই কর্মবিরতির জেরে গত দেড় মাসে তা বেড়ে ৬ কোটি টাকা হয়েছে। সঙ্গে রাজ্যের অর্ধেক জেলা বন্যা কবলিত। তাই দুর্গতদের বিচার দিতে শুধু ইমার্জেন্সি নয়, অবিলম্বে সরকারি হাসপাতালের প্রতিটি বিভাগকে সচল ও স্বাভাবিক করতে হবে। না-হলে রাজ্যের কয়েক কোটি বন্যা দুর্গত মানুষ ন্যায় থেকে বঞ্চিত হবেন। অন্তত দশটি জেলা পুজোর আগে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত। সাপের কামড়, ডায়রিয়া, জ্বর এই বন্যা দুর্গতদের নিত্যসঙ্গী। তাঁরা কোথায় যাবেন। হাসপাতাল শুধু আংশিক চালু রেখে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে? নাকি রোগীর প্রতি নিবেদিত প্রাণ অকুতোভয় অভয়া এভাবে বিচার পেতে পারে? শুধু ইমার্জেন্সি কিংবা জরুরি পরিষেবাই তো হাসপাতালের সব নয়। জরুরি অপারেশন, হাসপাতালে অ্যাডমিশন প্রক্রিয়াসহ যাবতীয় পরিষেবা চালু না-হলে কার লাভ?
আজ এই লেখা যখন লিখছি তখন আর পুজোর আগে তিনটে রবিবার বাকি। উৎসব না হোক, বাজারে কেনাকাটা বাড়ুক। লেনদেন হোক পুরোদমে। না-হলে বাংলার অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। গরিব দিনআনা দিনখাওয়াদের অবস্থা হবে শোচনীয়। তখন এরাও ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বলে রাস্তায় বসে পড়বে কিন্তু। যদিও গরিব মানুষের সেই ধর্নায় থরে থরে বিরিয়ানি, চাউমিন, ফল, জুস, কুকিজ পৌঁছে দেওয়ার স্পনসর পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। নিদেনপক্ষে একগাল মুড়ি। কে না জানে গরিবের ভাঙা আকাশের তলায় বিচার চিরদিনই দূরঅস্ত! আর মুখ্যমন্ত্রী উৎসবে ফিরতে বলেছেন বলে যাঁদের গোঁসা সপ্তমে ওঠে তাঁদের সবিনয়ে বলি, মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে বৈঠক সেরে ফিরে ধর্না মঞ্চের উদ্দাম নাচ কোন সংস্কৃতির প্রতীক? মুখ্যমন্ত্রী উৎসবের আড়ালে পুজোর অর্থনীতিকে সচল করার কথাই বলেছেন। তার বেশি কিছু নয়। মধ্যরাতে ডিস্কো নাচ করতে বলেননি।
ভুললে চলবে না, পশ্চিমবঙ্গের বুকে গত ৪০ দিন কর্মবিরতি করলেও হাউসস্টাফ, ইন্টার্নরা কিন্তু তাঁদের মাসিক ভাতা, স্টাইপেন্ড সব ঠিকঠাকই পেয়ে গিয়েছেন। একদিনের জন্যও তা পেতে অসুবিধা হয়নি। সেই টাকার অঙ্কটা মাথাপিছু ৪০ থেকে ৭২ হাজার টাকার মতো। এই খাতে সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে। ক্যামেরা, আলো, বায়োমেট্রিকাল অ্যাকসেস সবকিছুই হচ্ছে। অথচ ফুটপাতে রাস্তার মোড়ে পসরা সাজিয়ে বসে যে হকার কিছু বিক্রিই করতে পারেনি তাদের সংসার চলবে কী করে? প্রায় দেড় মাসের আন্দোলনের ঠেলায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদের প্রতিদিনের রুজিরোজগার মার খেয়েছে, এই ক্ষতিপূরণ করবে কোন মহানুভব। পুজোর বাজার মার খেলে বাকি বছরটা মাথা কুটলেও আর বিক্রিবাটা জমবে না। ছ’মাস বাদে পয়লা বৈশাখ আছে, তবে পুজোর তুলনায় সেই কেনাকাটা তো নেহাতই নস্যি। তারা কোথায় যাবে? তাদের জন্য বিদেশ থেকে ফুড ডেলিভারি অ্যাপে কেউ বিরিয়ানি বুক করবে না। ফলের রস আসবে না, টেবিলে কুকিজ সাজিয়ে বসবে না কেউ। ব্যবসা মার খেলে অসহায় পরিবার নিয়ে অর্ধাহারে, অনাহারে মরতে হবে। গ্রামে গ্রামে বাড়ির ছেলেমেয়ের পড়াশুনো বন্ধ হয়ে যাবে। এটাই কি বিচার পাওয়ার পথ? বিচার তো দেবে সিবিআই। আর তার মূল্যায়ন করবে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট। তথ্য-প্রমাণ যাঁরা নষ্ট করেছেন তাঁদের গ্রেপ্তার করে দ্রুত জিজ্ঞাসাবাদ করতে বাধা কোথায়? এই প্রশ্নটাই করুন সিবিআইকে। দেশের সর্বোচ্চ তদন্তকারী সংস্থার ঢিলেমি বরদাস্ত করা হবে না। সরকারি হাসপাতালের ওষুধ যদি ঘুরপথে কোনও প্রভাবশালীর নার্সিংহোমে গিয়ে থাকে তা জঘন্য অপরাধ। সিবিআইয়ের উচিত, শুধু শূন্যে সম্ভাবনার কথা না ভাসিয়ে উপযুক্ত প্রমাণ দিয়ে তা আদালতে প্রতিষ্ঠিত করা। না-হলে দুর্বল চার্জশিট বহু অপরাধীকেই বাঁচিয়ে দেয়। গোরুপাচার ও শিক্ষক দুর্নীতির মামলায় কিন্তু অভিযুক্তরা ছাড়া পেতে শুরু করেছেন। অনুব্রত মণ্ডল থেকে মানিক ভট্টাচার্য। অধিকাংশ মামলাতেই সিবিআইয়ের তদন্ত কিন্তু শেষে পরিণতি পায় না। স্মৃতি ফিকে হলেই মানুষও সব ভুলে যায়। অপরাধীরা তা বিলক্ষণ জানে। আর জানে বলেই কিছুদিন চুপ করে থেকে একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি দেখি আমরা।
বিচার জিনিসটা আসলে নিজের নিজের মতো করে সবাই পেতে চায়। ডাক্তাররা তাঁদের মতো, ছাত্ররা ছাত্রদের মতো, হকাররা তাঁদের মতো। আর অসহায় রোগীরা যাঁরা আর্থিক কারণে পাঁচতারা স্বাস্থ্যপরিষেবার অঙ্গ হতে পারেন না, সরকারি হাসপাতালের মুখাপেক্ষী হয়েই জীবনটা কাটিয়ে দেন তাঁরাও সুবিচার চান। গত দেড় মাসে ওপিডিতে প্রায় দশ লাখ রোগী পরিষেবা পাননি। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেই চোখের ছানি কাটানো, গলব্লাডার, হার্নিয়া থেকে হৃদযন্ত্রের গুরুতর সমস্যা নিয়ে হাসপাতালের লাইন রাস্তায় এসে ঘুরপাক খাবে। স্বাস্থ্যভবনের জঞ্জাল সরানো যেমন অগ্রাধিকার, তেমনই একজনও গরিব রোগী যাতে বিনা চিকিৎসায় হাসপাতাল থেকে ফিরতে বাধ্য না হন, এই শপথও নিতে হবে জুনিয়র ডাক্তারদের। একমাত্র তা হলেই অভয়ার আত্মা শান্তি পাবে। চিকিৎসা ব্যবস্থার সামগ্রিক জঞ্জাল সাফাই সম্পূর্ণ হবে। শিরদাঁড়া সোজা করা অদ্ভুত আলোয় উদ্ভাসিত সেই সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারের অপেক্ষায় আমরা।