বিশেষ নিবন্ধ

বাজেটের আগে মোদি মস্কোয় কেন?
হিমাংশু সিংহ

কথায় কথায় বলেন, নেহরু যুগের সব খারাপ। সেই কারণে দেরি না করে দ্রুত কংগ্রেস জমানার যাবতীয় নিশান মুছে ফেলাই যে তাঁর অগ্রাধিকার, তা বারে বারে বুঝিয়ে দিয়েছেন। অথচ তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার একমাসের মধ্যে নেহরু-ইন্দিরা যুগের বিদেশ নীতির পদাঙ্ক অনুসরণ করেই হইচই ফেলে দিলেন তিনি, নরেন্দ্র মোদি। দিল্লির সরকারের বিদেশ নীতির এই নয়া চালে আমেরিকা চটল, ভ্রু কোঁচকাল ন্যাটোর সদস্য দেশগুলি, যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন পাল্টা তোপ দাগল। ভারত কি সত্যি যুদ্ধর শেষ দেখতে চায়, নাকি সবটাই কুমিরের কান্না? সমালোচনা হল বিস্তর। তবু কোনও কিছুতেই আমল না দিয়ে সেই রাশিয়ায় গিয়েই সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ‘অর্ডার অব সেন্ট অ্যান্ড্রু দি অ্যাপসল’ নিয়ে এলেন নরেন্দ্র মোদি। স্বৈরতন্ত্রী পুতিন যখন মোদিজিকে ওই বিরল সম্মান দিচ্ছেন, তখন ইউক্রেনের শিশু হাসপাতালে নতুন করে হত্যালীলা চালিয়েছে মস্কো। মারণ ক্ষেপণাস্ত্র হানায় প্রাণ হারিয়েছে শিশু ও মহিলারা। নিহত ও জখমের সংখ্যা দুশো ছাড়িয়ে। দীর্ঘ আড়াই বছরের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে হার না মানা ইউক্রেনের রাষ্ট্রপ্রধান জেলেনস্কি কটাক্ষ করে বলছেন, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের প্রধানের সঙ্গে যুদ্ধবাজ খুনির কোলাকুলি দেখছে বিশ্ব। বিশ্ব মানবতার পক্ষে এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কী হতে পারে? মোদিজি মুখে বলছেন, ভারত বিশ্বকে যুদ্ধ দেয়নি, উপহার দিয়েছে বুদ্ধ ও তাঁর শান্তির বাণী। কিন্তু প্রশ্ন উঠে গিয়েছে নেতার এই অমৃতবাণী কি স্রেফ কথার কথা, আড়ালে কায়েমি স্বার্থরক্ষাই পাখির চোখ!
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, দশবছর আগে সরকারে এসে আমেরিকার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের অতিরিক্ত ঢলাঢলি বিশ্ব রাজনীতিতে ক্ষমতার নয়া অক্ষরেখার জন্ম দেয়। কার্যত সেই সুযোগটাই খুঁজছিল বেজিং। নয়াদিল্লির অত্যধিক মার্কিন প্রীতিই রাশিয়া, চীন ও পাকিস্তানকে কাছাকাছি এনে রাতারাতি দিল্লির রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। সেই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ মার্কিন রাজনীতিতে দৃষ্টিকটুভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এতটাই জড়িয়ে পড়েছিলেন যে আগাম টেক্সাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনে জয় পর্যন্ত ঘোষণা করে দেন, কার্যত বিজয় উৎসবে মেতে ওঠেন! কিন্তু ট্রাম্পকে হারিয়ে বাইডেন জিতে এলে মোদিজির নজিরবিহীন পদক্ষেপ দিল্লিকে যথেষ্ট অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। আর এই মুহূর্তে মোদির বন্ধু ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনের প্রহর গুনছে আমেরিকা। ভারত এখন কী করবে?
একথা বলতে অসুবিধা নেই, অনেক খাতির যত্ন করেও চীনের স্বৈরতান্ত্রিক প্রধান জি জিনপিংকে তাঁবে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে বিজেপি সরকার। এবং এই মুহূর্তে বিশ্ব রাজনীতিতে প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া হীনবল পাকিস্তান ক্রমাগত তাল ঠুকছে মূলত চীনের সক্রিয় মদতেই। অরুণাচল প্রদেশ ও লাদাখ ঘিরে চীনের সাম্প্রতিক অতিসক্রিয়তা ও লাল ফৌজের দাপাদাপি ১৯৬২ সালের স্মৃতিকেই মনে করাচ্ছে। দিল্লি খুব ভালো করেই জানে, মোদি জমানায় নয়াদিল্লির অত্যধিক মার্কিন প্রীতিই এর জন্য দায়ী। সঙ্গে পুতিনের অসন্তোষ যুক্ত হলে পরিস্থিতি মোটেই খুব সুখকর হবে না। ৬২ বছর আগের চীনা আগ্রাসনের পুনরাবৃত্তি হলে সঙ্ঘ পরিবার ও মোদিজির পক্ষে তা সহ্য করা খুব সহজ হবে না।
সেই অঙ্কেই চীনকে ঠেকাতে মস্কোর সঙ্গে দূরত্ব ঘুচিয়ে, নেহরু জমানার ‘রুশ ভারত ভাই ভাই’ তত্ত্বে ফিরতে চাইছে ভারত সরকার। গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ বাজেট পেশের দু’সপ্তাহ আগে কেন তিনি হঠাৎ মস্কোয় ছুটে গেলেন যুদ্ধবাজ ঠান্ডা চোখের খুনি পুতিনের কাছে? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা চলছে। শুধু খেতাব আর সম্মান কোনওমতেই কারণ হতে পারে না। আসল কারণ রাশিয়া থেকে সস্তায় অশোধিত তেল কেনার পরিমাণ ও পরিধিকে আরও বৃদ্ধি করা এবং বৈদেশিক বাণিজ্যকে ১০০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রায় নিয়ে যাওয়া। এই মুহূর্তে দু’দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ ৬৭ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে। ২০৩০ সালের মধ্যে তা ১০০ বিলিয়ন ডলার হলে ষোলোআনা লাভ দিল্লিরই। সেজন্যই ন’টি চুক্তি করেছে দিল্লি ও মস্কো। তেল, বৈদেশিক বাণিজ্য এবং অস্ত্র কেনা, রুশ-ভারত সম্পর্কের এই তিন পিলারই আমেরিকার মাথাব্যথার কারণ। ওয়াশিংটনের আপত্তি উড়িয়ে রাশিয়ার থেকে অশোধিত তেলই নয়, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র কেনাকাটাতেও এগিয়েছে দিল্লি। এই অস্ত্র সম্ভারের মধ্যে রয়েছে, আধুনিক এস ৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবিলা সিস্টেম, একে ২০৩ রাইফেল এবং যুদ্ধ সরঞ্জাম। ভুললে চলবে না, এই মুহূর্তে ভারতের প্রতিরক্ষা আমদানির ৪৫ শতাংশ আসছে পুতিনের দেশ থেকেই। ইরাক, সৌদি আরবকে পিছনে ফেলে তেল আমদানিও সবচেয়ে বেশি মস্কো থেকেই। কখন থেকে? যেদিন থেকে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়েছে সেইদিন থেকে। তার চেয়েও বড় কথা সস্তায়। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রপ্তানি না বাড়ানো গেলে বাণিজ্যিক ভারসাম্য নষ্ট হলে অর্থনীতির বিপদ। সেই জন্যই মস্কো ছুটে যাওয়া।
এমনিতে ভারতীয় অর্থনীতির অবস্থা যে মোটেই ভালো জায়গায় নেই, তা পরখ করতে পোড়খাওয়া অর্থনীতিবিদ হওয়ার দরকার নেই। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যতই মোদিজির সাফল্যের বেলুন ওড়ানোয় মন দিক এবং বছরে অলীক ৪ কোটি চাকরির পরিসংখ্যান সামনে এনে শাসকের পিঠ চাপড়ানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়ুক, বাস্তবে সরকার যে চাকরি দিতে ব্যর্থ, তা এদেশে অজানা নয় কারও। দশ লক্ষ সরকারি পদ ফাঁকা! তা পূরণ করার সদিচ্ছা যে ‘মঙ্গলসূত্র’ বাঁচানো বিজেপি সরকারের নেই, এই সারসত্যটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে রাস্তার গরিব ফেরিওয়ালা—সবাই এতদিনে জেনে ফেলেছেন। অথচ, বেকারত্ব যত বাড়বে মঙ্গলসূত্র কেন, ঘটিবাটিটাও যে বাঁচবে না, তা ধুরন্ধর শাসককে ভোটার ভোলানো কোটি টাকা খরচের জনসভায় মনে করিয়ে দেবে কে? চারবছর আগের কোভিড ধাক্কা এখনও মাত্র আটআনা কেটেছে। বাকি আটআনা কবে কাটবে তার কোনও ইঙ্গিত কেউ দিতে পারবে কি? নোট বাতিলের পর ছোট ও মাঝারি শিল্পের কোমর সেই যে ভেঙেছে জোড়া  লাগেনি আজও। রেকর্ড বেকারত্বের সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির জোড়া আঘাতে আম নাগরিকের নুন আনতে পান্তা ফুরনোর জোগাড়। দাম, বিশেষত খাদ্যদ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছে তা স্বীকার করে নিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ বণিকসভা থেকে শীর্ষ নীতি নির্ধারকরাও। এই অবস্থায় মধ্যবিত্তের সঞ্চয় মার খাচ্ছে। চাহিদা কম থাকায় মার খাচ্ছে গড় উৎপাদন সূচকও। ক্ষমতায় এসেই  মোদিজি ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ ক্যাম্পেনে ঝাঁপিয়েছিলেন। আর জোর দিয়েছিলেন স্টার্ট আপে যুব সম্প্রদায়কে উৎসাহিত করার কাজে। কিন্তু একটার পর একটা গালভরা নামই দেওয়া হয়েছে, স্বপ্ন ফেরি হয়েছে বিস্তর, আখেরে বাস্তবে মেলেনি কিছুই। বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে অনেক আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখানো হলেও গত দু’বছরে তা ক্রমাগত থমকে গিয়েছে। ধাক্কা খেয়েছে সরকারি সংস্থার বিলগ্নিকরণ অভিযানও।
বরং এই সঙ্কটের মধ্যেও আশার কথা একটাই। অশোধিত তেল আমদানির পরিমাণ বাড়লেও মস্কো সুলভে তা সরবরাহ করায় দেশের খরচ (অয়েল ইমপোর্ট) কিছুটা কমেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে সেই ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে। এই খাতে আমদানি বিলে এ পর্যন্ত সাশ্রয় হয়েছে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার, ভারতীয় মুদ্রায় যা আড়াই লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। অঙ্কটা মোটেই হেলাফেলার নয়। যুদ্ধ শুরু হতেই রাশিয়ার তেল কেনায় ন্যাটোর নিষেধাজ্ঞা ভারত সরকার মানেনি। যুদ্ধ থামানোর কথা বলেও সরাসরি সংঘাতে জড়ায়নি। আমেরিকা ও ন্যাটো সহযোগীরা ক্ষুব্ধ হলেও ভারতের বিদেশনীতির এটাই চ্যালেঞ্জ।
মুখে ‘যুদ্ধ করে করবি কী তা বল?’ কিন্তু আখেরে মস্কোর সস্তার তেলই ভারতীয় অর্থনীতির জিয়নকাঠি। তেলের দাম বাড়লে দিল্লির গদিও যে টলোমলো, তা জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রীর অজানা নয়।
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

ভাইবোনের মধ্যে সম্পত্তিগত অশান্তিতে চিত্তচাঞ্চল্য। কাজকর্মে অগ্রগতি। দাম্পত্যে সুসম্পর্ক থাকবে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১১ টাকা৮৪.৮৫ টাকা
পাউন্ড১০৮.২৮ টাকা১১১.৮২ টাকা
ইউরো৯১.৮৪ টাকা৯৫.০৪ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
24th     August,   2024
দিন পঞ্জিকা