বিশেষ নিবন্ধ

এবার নতুন চক্রান্ত: বাঙালি খেদাও
তন্ময় মল্লিক

আর জি করের ঘটনায় উত্তাল রাজ্য। মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ ও নৃশংস খুনের ঘটনায় শিউরে উঠেছে বাংলা। ন্যায়বিচারের দাবিতে শুধু চিকিৎসকরাই নন, গোটা রাজ্য এককাট্টা। অপরাধীর সংখ্যা এক না একাধিক, তা  বেরিয়ে আসবে সিবিআই তদন্তে। অপরাধীর সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু, আন্দোলনকারী থেকে মুখ্যমন্ত্রী সকলেই একটা বিষয়ে একমত, এমন জঘন্য অপরাধের একমাত্র শাস্তি, ফাঁসি। এমনই পরিস্থিতির মধ্যে নতুন করে বাংলায় অশান্তির সলতে পাকানো শুরু হয়েছে প্রতিবেশী রাজ্যে। ওড়িশায় গেরুয়া ব্রিগেড দ্রুত মজবুত করছে বিভাজনের ভিত। শুরু হয়েছে বেছে বেছে বাঙালিদের উপর অত্যাচার। তা সহ্য করতে না পেরে রুজিরুটি খুইয়ে শয়ে শয়ে মানুষ ফিরছে বাংলায়। একদা একযোগে উচ্চারিত হতো বাংলা-বিহার-ওড়িশার নাম। সেই ওড়িশাতেই শুরু হয়েছে ‘বাঙালি খেদাও’ অভিযান।
কোটা আন্দোলনের জেরে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছাড়ার পরই এপার বাংলায় ঘণীভূত হয়েছিল আশঙ্কার কালো মেঘ। অনেকেই মনে করেছিলেন, একাত্তরের পুনরাবৃত্তি হবে। বাংলায় আছড়ে পড়বে বাংলাদেশি শরণার্থীর ঢেউ। তাতে বদলে যাবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সমীকরণ। সেই আশাতেই জনগণের ভোটে গোহারা বিজেপি শরণার্থীদের জানিয়েছে আগাম স্বাগত।
বঙ্গ বিজেপি ভেবেছে, বাংলাদেশ ইস্যুতে উত্তপ্ত হবে রাজ্য। তারজন্য সীমান্তবর্তী জেলায় সুড়সুড়ি দেওয়া শুরু করেছে। বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর অত্যাচারের কথা প্রচার করে এখানেও পাল্টা কিছু করার আশায় ছিল। একথা ঠিক, শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশে লাগাতার হিংসার ঘটনা ঘটছে। আক্রান্তদের মধ্যে আছে হিন্দু, আছে মন্দিরও। 
কিন্তু মৃতের লম্বা লিস্টে মুসলিমও প্রচুর। বরং আওয়ামি লিগের সঙ্গে যুক্ত মুসলিম নেতারাই খুন হয়েছেন বেশি।
একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, বাংলাদেশে আক্রান্ত হচ্ছেন আওয়ামি লিগের নেতা ও কর্মীরা। তাঁরা খুন হচ্ছেন, তাঁদের বাণিজ্য কেন্দ্রে লুটপাট চালানো হচ্ছে। বিএনপি এবং জামাতদের রাগ আওয়ামি লিগের উপরই। কারণ তারা অন্য দলের তুলনায় কিছুটা হলেও ধর্মনিরপেক্ষ। হিন্দু সহ অন্য সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেয়। সেই জন্য বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরাও আওয়ামি লিগকেই সরকারে চায়। এই বিষয়টি ক্রমশ পরিষ্কার হচ্ছে। তাতে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এরাজ্যের সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগও কমছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গোড়াতেই জানিয়ে দিয়েছেন, দিল্লির পথেই হাঁটবে রাজ্য। একথা বলায় বাংলাদেশ ইস্যুতে মমতাকে প্যাঁচে ফেলার রাস্তাটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে বিজেপির। দিল্লির সরকার জানে, দরজা হাট করে খুলে দিলে শরণার্থীর ঢেউ শুধু বাংলায় নয়, আছড়ে পড়বে ত্রিপুরা, অসম প্রভৃতি রাজ্যেও। সেখানে ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকার। তাও সেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষমতা ডাবল ইঞ্জিন সরকারের ক্যাপ্টেনদের নেই। তাই দিল্লির সরকার উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গড়ে নিয়েছে ‘ধীরে চলো’ নীতি। তা বলে বাংলাদেশ ইস্যুতে বিজেপির বাংলাকে ব্যতিব্যস্ত করার ষড়যন্ত্র বন্ধ হয়নি।
কী সেই ষড়যন্ত্র? প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশায় শুরু হয়েছে ‘বাঙালি খেদাও’ অভিযান। ওড়িশা প্রতিবেশী রাজ্য। তাই জীবিকা ও চিকিৎসার প্রয়োজনে বাংলা ও ওড়িশার বাসিন্দাদের উভয় রাজ্যেই যাতায়াত আছে। তাছাড়া পুরী এবং জগন্নাথদেবের মন্দির তো বাংলার কোটি কোটি মানুষের কাছে অতি প্রিয় ও পবিত্র স্থান। পুরীর হোটেলগুলি টিকে আছে বাংলার জন্য। আবার ওড়িশার প্রচুর মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে বাংলায় আছে। উভয়েরই উভয়কে প্রয়োজন। তা সত্ত্বেও বিজেপি শাসিত ওড়িশায় পাকানো হচ্ছে বাংলায় অশান্তি সৃষ্টির সলতে। ওড়িশা থেকে তাড়ানোর জন্য পায়ে পা লাগিয়ে ঝামেলা পাকিয়ে বাঙালিদের পেটানো হচ্ছে। 
ওড়িশায় গেরুয়া ব্রিগেড এ রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে কী আচরণ করছে, তা শোনা যাক ভুক্তভোগীদের মুখে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পাঁশকুড়ার সাধুয়াপোতা গ্রামের আসাদুল শাহ পাঁচ বছর ধরে ওড়িশায় ছিলেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ভাঙা লোহা, টিন কিনে মহাজনকে বিক্রি করতেন। কিন্তু মার আর হুমকিতে তিনি বাড়ি চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। আসাদুল বলেন, এর আগে ওড়িশার মানুষ আমাদের সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করেনি। দীর্ঘদিন থাকার সুবাদে চেনাজানা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখন ওরাই আমাদের ‘বাংলাদেশি’ বলে মারধর করছে। আধার কার্ড, ভোটার কার্ড কিছুই মানছে না। 
মুর্শিদাবাদ জেলার রঘুনাথগঞ্জের পানানগর গ্রামের রেজাউল শেখ এখনও ওড়িশায় আছেন। তবে, বাড়ি ফেরার তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে। তাঁর কথায়, আমি রাজমিস্ত্রির কাজ করি। এখানে ১৭ বছর আছি। নবীন পট্টনায়কের সময় ওড়িশার পরিস্থিতি ভালো ছিল। কোনও দিন সমস্যায় পড়তে হয়নি। করোনার সময়েও এখানেই ছিলাম। বাড়ি যাইনি। প্রশাসন প্রতি সপ্তাহে এত খাবার সামগ্রী দিত যে তাতে দু’সপ্তাহ চলে যেত। বিজেপি আসার পর সেই ওড়িশাই কেমন যেন বদলে গেল! এখন বাঙালি দেখলেই মারধর করছে। এই আতঙ্ক নিয়ে থাকা যায়? আমাদের ওখান থেকে আসা ৯০ ভাগ লোকই ফিরে গিয়েছে। আমিও যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি।
আতঙ্কের কথাই বটে। পেটের দায়ে বের হওয়া লোকজনকে কোনও কারণ ছাড়াই দুমদাম পিটিয়ে দিলে ভয় তো হবেই। ওড়িশায় বাংলাভাষী ফেরিওয়ালা দেখলেই পেটানো হচ্ছে। তার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ভোটার কার্ড, আধার কার্ড দেখিয়ে, বাড়ির ঠিকানা বলেও রেহাই পাচ্ছে না। বেধড়ক পিটিয়ে ওড়িশা ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে। বেশিরভাগটাই হচ্ছে বজরং দলের নাম করে। কাজও হচ্ছে হুমকিতে। প্রাণ বাঁচাতে দলে দলে বাংলায় ফিরছে বাঙালি। বাংলায় ফিরে তাঁরা প্রতিবাদে ফেটে পড়ছেন।
আসাদুল আর রেজাউলের নাম শুনে হয়তো অনেকেই দুই আর দু’য়ে চার করতে পারেন। ভাবতে পারেন, কেবল মুসলিমদেরই বিজেপি হেনস্তা করছে। হিন্দুদের কিছু বলবে না। কিন্তু, ভাবনাটা ভুল। ওড়িশার পরিস্থিতিটা একটু অন্যরকম। শুধু মুসলিম নয়, হিন্দুদেরও ওরা পেটাচ্ছে। বাংলায় কথা বললেই হল। বাঙালি বুঝতে পারলেই তাঁদের গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘বাংলাদেশি’ তকমা। তারপর দেওয়া হচ্ছে ওড়িশা ছেড়ে চলে যাওয়ার ফরমান। কেউ ভোটার কার্ড, আধার কার্ডের কথা বললেই জুটছে বেধড়ক মার।
পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ার সুজিত মাইতি বহু বছর ধরে ওড়িশায় মশারি, বেডশিট প্রভৃতি বিক্রি করেছেন। ‘বাংলাদেশি’ দেগে দিয়ে ওড়িশা ছাড়ার ফতোয়া দেওয়ায় তিনি দেখিয়েছিলেন তাঁর আধার কার্ড। সঙ্গে সঙ্গে এসেছে উত্তর, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জাল আধার কার্ড করে এখানে পাঠিয়েছে। এসব দেখিয়ে লাভ নেই। বাঁচতে চাস তো বাংলায় ফিরে যা।’ একথা শোনার পর আর সেখানে থাকার সাহস 
পাননি সুজিতবাবু।
খেজুরির বসুদেব মান্না প্রায় ২৪ বছর ধরে ওড়িশার গ্রামে ঘুরে ঘুরে ভাঙা লোহা, টিন কেনাবেচা করেন। এখনও তিনি ওড়িশায়। তবে ভাড়াঘরে একপ্রকার বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন। মারধর খেয়ে তাঁর সঙ্গীদের অধিকাংশই বাড়ি ফিরেছেন। তিনিও ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বসুদেববাবু ফোনে বলেন, ‘এভাবে ক’দিন আর ভয়ে ভয়ে ঘরে বসে থাকব? মারধরের ভয়ে মাল কিনতে যেতে পারছি না। মালপত্র, টাকা পয়সা কেড়ে নিচ্ছে। বাংলা থেকে আসা বেশিরভাগ লোকই ফিরে গিয়েছে। আমিও দু’চারদিন দেখে চলে যাব। বহুবছর এখানে আছি। কিন্তু ওড়িশা এমনটা ছিল না।’ 
ভারতবর্ষজুড়ে এক রাজ্যের মানুষ অন্য রাজ্যে গিয়ে কাজ করে, এটা দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি। বিভাজনের অস্ত্রে তাকে ভেঙে চুরমার করতে চাইছে বিজেপি। বাংলায় ১০০ দিনের কাজ বন্ধ করে গরিবের পেটে আগেই লাথি মেরেছে বিজেপি। এবার বাঙালি যাতে অন্য রাজ্যে কাজ করতে না পারে, শুরু করেছে সেই চক্রান্ত। বাংলাদেশের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিকে হাতিয়ার করে ওড়িশায় ‘বাঙালি খেদাও’ অভিযান তারই মহড়া। এর পিছনে রয়েছে মস্ত বড় অঙ্ক।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা বঙ্গ বিজেপির মনে জাগিয়েছে ঘুরপথে বাংলা দখলের খোয়াব। ওড়িশার পাল্টা বাংলায় শুরু হলেই ৩৫৬ ধারা লাগুর দাবিতে লম্ফঝম্ফ জুড়ে দেবে বিজেপি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন-/ শক-হুন-দল পাঠান-মোগল এক দেহে হল লীন।’ পড়ে বড় হয়েছে বাঙালি। তাই ঩বিজেপির পাতা ফাঁদে কিছুতেই পা দেবে না বাংলা।
27d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

বহু প্রচেষ্টার পর আটকে থাকা কাজের জটিলতা মুক্তি। কৃষিজ পণ্যের ব্যবসায় বিশেষ উন্নতি। আয় বাড়বে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৫ টাকা৮৪.৮৯ টাকা
পাউন্ড১০৭.৭৯ টাকা১১১.৩৩ টাকা
ইউরো৯০.৯৫ টাকা৯৪.১৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা