এটা ছিল স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ, ধারাবাহিকভাবে ১১তম। তাঁর জন্য এটা এক ধরনের রেকর্ডও বটে। মাননীয় নরেন্দ্র মোদি লালকেল্লার প্রাচীর থেকে ৯৮ মিনিটের যে ভাষণ দিয়েছেন, তা তাঁর ক্ষেত্রে দীর্ঘতম। এটা ছিল তাঁর তৃতীয় মেয়াদের প্রথম স্বাধীনতা দিবসের ভাষণ। আশা করা হয়েছিল যে, এর মাধ্যমে সরকারের আগামী পাঁচ বছরের দৃষ্টিভঙ্গি প্রধানমন্ত্রী তুলে ধরবেন।
বিজেপি নেতারা ভাষণটিকে একটি সাহসী নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উন্মোচন হিসেবে দেখছেন। যদি তা’ই হয়ে থাকে, আমি ভয় পাচ্ছি যে এটা এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি যার লক্ষ্য জনগণের একটি শ্রেণি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন,
“আমরা একটি সংকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা যাচ্ছি বহু দূর। কিন্তু আরও একটি সত্য আছে। সেটা হল, ভারতের অগ্রগতি কিছু লোকের হজম হয় না। ভারতের জন্য ভালো জিনিস কল্পনা করতে পারে না কিছু মানুষ। কারণ এই অগ্রগতিতে তাদের নিজ নিজ স্বার্থ পূরণ হয় না। কারও উন্নতি বা অগ্রগতি পছন্দ করে না তারা। দেশে এমন বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন মানুষের অভাব নেই! এই ধরনের লোকদের থেকে জাতিকে সতর্ক থাকতে হবে।”
গণতন্ত্রের অবমাননা
এই যে ‘কিছু মানুষ’-এর কথা প্রধানমন্ত্রী পাড়লেন, তাঁরা কারা? আমি এমন কাউকে জানি না যিনি কৃষি, তথ্য-প্রযুক্তি, পারমাণবিক শক্তি, মহাকাশ গবেষণা প্রভৃতি ক্ষেত্রে ভারতের অগ্রগতি নিয়ে গর্বিত নন। প্রধানমন্ত্রী কি সেই ২৬ কোটি ২০ লক্ষ ভোটারকে ইঙ্গিত করলেন যাঁরা তাঁর এবং এনডিএ’র বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন? নাকি বেকারত্বের জ্বালায় জর্জরিত সেই তরুণ দল প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ্য, যাঁরা তাঁর সমালোচনা করে থাকেন? নাকি প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ্য সেই গিন্নি মায়েরা, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির যন্ত্রণা সইতে না পেরে যাঁরা মুখ খুলতে বাধ্য হন? নাকি লক্ষ্য সেইসব সেনা ও প্রাক্তন সেনা, ভারতীয় ভূখণ্ডে চীনের নির্লজ্জ দখলদারিত্বের মুখে ভারতের চুপচাপ পিছে হটা দেখে যাঁরা হতবাক? দেশের জন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি ঘিরে মানুষের সমাবেশ ঘটাতে যে ভাষণ, তাঁর সরকারের ভুল নীতির কারণে প্রধানমন্ত্রী আসলে তা দিয়ে জনগণের মধ্যে বিভাজন আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর সরকারের বিরোধীদের ‘বিকৃত’ দেগে দেওয়াটা গণতান্ত্রিক রায়ের অবমাননা বইকি!
বিজেপি আসন সংখ্যায় ২৪০-এ নেমে যাওয়ার পরে আমরা যদি ভেবে থাকি যে কিছু সমস্যা দূর হল, তবে আমরা ভুলই করেছি। স্পষ্টতই, প্রধানমন্ত্রী অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (ইউসিসি) এবং এক জাতি এক ভোট (ওয়ান নেশন, ওয়ান ইলেকশন বা ওএনওই) করার সিদ্ধান্তেই অনড় মনোভাব পোষণ করেন। তাঁর স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে এই দুটি বিষয়েরই উল্লেখ করেছেন তিনি। চালু ব্যক্তিগত আইনকে (পার্সোনাল ল কোড) ‘কমিউনাল সিভিল কোড’ আখ্যাসহ তিনি বলেছেন,
‘‘আধুনিক সমাজে এমন আইনের কোনও স্থান নেই যা জাতিকে ধর্মীয় ভিত্তিতে বিভক্ত করে এবং সেটা শ্রেণি বৈষম্যের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। আমার মতে এটাই সময়ের দাবি যে, দেশে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সিভিল কোড বা দেওয়ানি বিধি থাকা উচিত। একটি সাম্প্রদায়িক দেওয়ানি বিধির অধীনে ৭৫ বছর কাটিয়ে ফেলেছি আমরা। এখন আমাদের একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেওয়ানি বিধি বা সেকুলার সিভিল কোড গ্রহণের দিকে এগতে হবে। আইনের কারণে, ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য সৃষ্টির যে ফাটল তৈরি হয়ে আছে তা থেকে তবেই মুক্তি পাব আমরা।’’
প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতিটি ছিল ত্রুটিপূর্ণ, বোঝাপড়ার দিক থেকে দুর্বল এবং পক্ষপাতেরও মিশেল ঘটেছে তাতে। প্রতিটি ব্যক্তিগত আইনের ধারার ভিত্তি হল ধর্ম। হিন্দু ব্যক্তিগত আইনের ধারাগুলিও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এই ব্যবস্থায় আইনটি সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে না। বিবাহের জন্য একটি ধর্মনিরপেক্ষ আইন আছে। তাকে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট বা বিশেষ বিবাহ আইন বলে। তবে এটি ভারতবাসীর মধ্যে তেমন জনপ্রিয় নয়। হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, শিখ, পার্সি প্রতি ধর্মমতের কোনও সাধারণ মানুষ এর ফলে কোনোভাবেই ‘বৈষম্য’ বোধে ভোগেন না। কারণ তাঁর প্রতিবেশীরা অন্য একটি ব্যক্তিগত আইন মতে চলেন। এটা সুন্দরই হবে যদি সমস্ত ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং সম্প্রদায় একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধির ব্যাপারে সহমত হতে পারেন। তবে এটা বলা যতটা সোজা করে দেখানো মোটেই তেমন নয়।
বিভাজনমূলক ভাষণ
ইউসিসি বা ওএনওই’র ধারণাতেই রয়েছে বিপদঘণ্টা। প্রথমেই এই ভয় কমানো প্রয়োজন। ‘বর্তমান’ কাগজে গত ২২ এপ্রিল প্রকাশিত আমার ‘বিশেষ নিবন্ধ’-এ ইউসিসি এবং ওএনওই
নিয়ে সরকারের গোপন এজেন্ডার কথা ব্যাখ্যা করেছিলাম। ইউসিসি’র জন্য সমস্ত ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিশদে আলোচনা করা প্রয়োজন। ওএনওই’র জন্য প্রয়োজন সংবিধানের অনেকগুলি অনুচ্ছেদের সংশোধন। এই সমস্যাগুলি ঘিরে বিতর্কের শুরু কিংবা শেষ—প্রধানমন্ত্রীর একটি ভাষণে হওয়ার নয়। বিপরীতে, এর অর্থ এটাই হবে যে বিভাজনমূলক বিষয়গুলি উত্থাপনের চেষ্টা এবং সংসদের মাধ্যমে আইন তৈরির পদক্ষেপ জনগণকে আরও বিভক্ত করতে পারে।
এবারের লোকসভা নির্বাচন অনেক বিভেদমূলক ভাষণের সাক্ষী ছিল। কংগ্রেসের ইস্তাহার ২০২৪-কে আক্রমণ করে নরেন্দ্র মোদি বলেন যে,
• জনগণের জমিজমা, সোনাদানা এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র মুসলমানদের মধ্যে কংগ্রেস বণ্টন করে দেবে!
• আপনার মঙ্গলসূত্র ও স্ত্রীধন কংগ্রেস কেড়ে নেবে এবং দিয়ে দেবে সেইসব লোকদের যাদের একগাদা ছেলেপুলে রয়েছে!
এছাড়া অমিত শাহ বলেছেন, ‘কংগ্রেস মন্দিরের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবে এবং সেগুলি তাদের মধ্যে বিলিয়ে দেবে।’ ওই ধারা মেনেই রাজনাথ সিং বলেছেন, ‘কংগ্রেস জনগণের সম্পদ কেড় নিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে বাটোয়ারা করে দেবে।’
বিভ্রান্তি ছড়াবার গুরু (হেড-স্পিনার) ছিলেন মোদিজি স্বয়ং। মহিষের উপর উত্তরাধিকার কর আরোপের মতো আজগুবি বিষয়ে জনগণকে হুঁশিয়ার করেছিলেন তিনি! তখন সংবাদ মাধ্যমের কেউই কিন্তু তাঁর এই খ্যাপামি থামাবার জন্য বলেনি।
নির্বাচনের সুচিন্তিত রায় প্রধানমন্ত্রীকে সংযত করতে পারেনি। বরং ক্ষমতা হারানোর ভয় তাঁর সরকারকে কয়েকটি বিষয়ে ‘ব্যাকট্র্যাকে’ ঠেলে দিয়েছে: মূলধনী লাভের প্রেক্ষিতে ‘ইনডেক্সেশন বেনিফিট’ ব্যবস্থা ফেরানো হয়েছে। ওয়াকফ বিল পাঠানো হয়েছে সিলেক্ট কমিটিতে। প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে ব্রডকাস্টিং বিল। কেন্দ্রীয় সরকারি পদগুলিতে ল্যাটারাল এন্ট্রির স্কিমটি তাকে তুলে রাখা হয়েছে। সিএএ, ইউসিসি এবং ওএনওই শেষ পর্যন্ত বাতিল হলেই আরও বিভাজনের ভয়টা দূর হয়।
একটি দৃষ্টিভঙ্গি তখনই ফুটে উঠতে পারে যখন বিজেপির বিভাজনের ‘প্লেবুক’খানা বাতিল হয়ে যায়।
• লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত