‘এই পরিস্থিতিতে রাজনীতি করবেন না। সব দলকে একথা বুঝতে হবে। আইনকে আইনের পথে চলতে দিন।’ এই সতর্কবার্তা আমার নয়, রাজ্য প্রশাসন কিংবা পুলিসেরও নয়। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের। সুপ্রিম কোর্ট যেমন একটা দুঃখজনক ঘটনার পর প্রাথমিক তদন্তের ফাঁকফোকর নিয়ে বিচলিত, তেমনি উদ্বিগ্ন গোটা ঘটনাকে মাত্রাতিরিক্ত রাজনৈতিক রং দেওয়ার নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতা দেখেও। সেই লক্ষ্যেই সমাজমাধ্যমে সুচতুরভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে হাজারো ফেক নিউজ। সেই গুজবের কারখানা যাঁরা চালাচ্ছেন তাঁদের দায় কি অভিযুক্ত সঞ্জয়ের থেকে কোনও অংশে কম? এ নিয়েও বিচারপতিরা যারপরনাই ক্ষুব্ধ। সুবিচার চাওয়ার আড়ালে নাগরিক সমাজকে ঢাল করে কারা পিছন থেকে কলকাঠি নাড়ছেন তা বোধকরি শীর্ষ আদালতের অজানা নেই। মায় আগামী মঙ্গলবারের নবান্ন অভিযান পর্যন্ত। সুধী নাগরিকবৃন্দও তা বিলক্ষণ জানেন। মিথ্যা ছড়িয়ে আইনকে বিপথে চালিত করার চেষ্টা ও শান্তি বিঘ্নিত করা ধর্ষণ ও খুনের চেয়ে কম বড় অপরাধ নয়। তাও আইনের চোখে সমান শাস্তিযোগ্য। তারও উচ্চপর্যায়ের তদন্ত হওয়া উচিত।
গুজব ১: মহিলার শরীরে ১৫০ গ্রাম সিমেন মিলেছে। সেমিনার রুমে দাঁড়িয়ে কে ওজন করেছিল দাঁড়িপাল্লায়! তা থেকেই সরল উপসংহার টানা হল, একজন নয়, দু’জনও নয়, সেই রাতে পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে অনেকে মিলে। কিন্তু মিথ্যে ছড়াবার আগে তাঁরা ভেবে দেখলেন না ওই পরিমাণ সিমেন যদি সত্যি পেতে হয় তাহলে অন্তত ৪০-৫০ জন কিংবা তারও বেশি অপরাধী উপস্থিত ছিল ওই অভিশপ্ত রাতে, আর জি করের চারতলার সেই অভিশপ্ত ঘরটার অন্দরে। বলুন দেখি, সিবিআই আড়াইশো ঘণ্টা টানা তদন্তের পর তাদের ক’জনের সন্ধান পেয়েছে। পেলে ধরল না কেন? প্রথম স্টেটাস রিপোর্টে কার কার নাম আছে? বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টও সমাজমাধ্যমের ছড়িয়ে দেওয়া ছেঁদো তত্ত্ব উড়িয়ে দিয়ে সওয়াল জবাবে কার্যত উষ্মা প্রকাশ করেছে। অথচ বহু প্রখ্যাত ডাক্তারের ফেসবুকে ওইসব আজগুবি তথ্য দিব্যি ঘুরছে। জেনে বুঝে ঘটনাটাকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করার তাগিদে। সোজা কথায় উস্কানি দিতে। কিন্তু সত্যিটা এই, একসপ্তাহ তদন্ত করার পর সিবিআই গণধর্ষণ তত্ত্ব থেকে ক্রমেই পিছু হটতে শুরু করেছে। এই লেখা পর্যন্ত কলকাতা পুলিসের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া সঞ্জয় রায় ছাড়া আর কেউ ধরা পড়েননি। এবার কী বলবেন, সিবিআই ব্যর্থ না সফল?
গুজব ২: কলার থেকে পেলভিক বোন সহ শরীরের অধিকাংশ হাড় ভাঙা। আমি বিশেষজ্ঞ নই, শুধু জানি মানবশরীরে ২০৬টি হাড় থাকে। ছ’শোর উপর পেশি। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট সব হাড় ভাঙার সেই তত্ত্বকেও খারিজ করে দিয়েছে। শীর্ষ আদালতে দাঁড়িয়ে কেস ডায়েরি ও ময়নাতদন্ত রিপোর্ট উদ্ধৃত করে প্রখ্যাত আইনজীবী কপিল সিবাল সেকথা বারবার বলেছেন। সেখানেই একাধিক দুর্বৃত্তের উপস্থিত থাকার তত্ত্ব পিছু হটছে। কিন্তু ফেক নিউজ ছড়ানো থামেনি।
গুজব ৩: পরিবারের অজ্ঞাতসারে, কোনওকিছু না জানিয়ে ময়নাতদন্ত হয়েছে বলে ঢালাও প্রচার হয়েছে। জোর করে নাকি নিহতের দেহ ময়নাতদন্তে পাঠিয়ে দেয় পুলিস। ময়নাতদন্ত রিপোর্টও পরিবারকে দেখানো হয়নি। কিন্তু তার ভিডিওগ্রাফি তো রয়েছে। কাউকে কিছু না জানিয়েই, শাসক দলের চাপে অতিদ্রুত সারা হয়েছে শেষকৃত্য। এই তথ্যও যে ডাহা ভুল তা জানিয়েছেন স্বয়ং ‘অভয়া’র মা-বাবাই। নিহত ডাক্তারের মুখাগ্নি করেছেন তাঁর পরিজনরা ৯ আগস্ট রাতে পানিহাটি শ্মশানে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই প্রধান অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার ফাঁসির পক্ষেও সওয়াল করেছে রাজ্য প্রশাসন এবং স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। প্রশ্ন থাকতেই পারে। সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজের সেটাই প্রধান উপজীব্য। কিন্তু তা বলে পদে পদে বিভ্রান্তি ছড়ানো? উস্কানি দেওয়া?
গুজব ৪: শাসক দলের ঘনিষ্ঠ এক প্রাক্তন মন্ত্রী-পুত্র এই ঘটনায় জড়িত। সরকার তাঁকে নাকি আড়াল করছে। সব জেনেও পুলিস গ্রেপ্তার করছে না তাঁকে। জেলায় জেলায় যাঁরা এত মিছিল আন্দোলন করছেন, এত তথ্য-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা সেসব সামনে আনছেন না কেন? নাকি সমাজমাধ্যমে যা খুশি তাই ছড়িয়ে দিলেই তা সত্যি হয়ে যায়! কারণ ওখানে কোনও প্রমাণ দিতে হয় না। এ কোন দিকে চলেছি আমরা?
গুজব ৫: ‘ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করছে, দুর্গাপুজোর জন্য। ভাবছে উৎসবের আনন্দে মানুষ সব ভুলে যাবে! কার্নিভাল তো আছেই! তাই পুজোর সময়ও বিচার চেয়ে রাস্তায় থাকুন।’ এক বাম ঘেঁষা নামকরা ডাক্তারের ফেসবুকে এখনও এই পোস্টটা জ্বলজ্বল করছে। কী বলতে চাইছেন তিনি? প্রতিবাদের নামে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবকে কলুষিত করা কি সুস্থ নাগরিক সত্তার লক্ষণ?
আমার প্রশ্ন একটাই, উপরের সবকিছু অকাট্য প্রমাণ নিয়েই প্রচার হয়েছে তো? নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ করুন, আন্দোলন করুন। কোনও অসুবিধা নেই। এই পৈশাচিক ঘটনার জন্য কোনও নিন্দাই যথেষ্ট নয়। যে সমাজে মহিলারা বিপন্ন সেখানে লক্ষ্মী বাস করতে পারে না। তার জন্য চাই কঠোর আইন। ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট। তার ব্যবস্থা না করে দু’শো মিথ্যা ছড়িয়ে উস্কানি দেওয়াও কম বড় অপরাধ নয়। গুজব ছড়িয়ে কোনও সুস্থ সমাজকে অশান্ত করা কি নাগরিকের পবিত্র কর্তব্য হতে পারে?
আসলে অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত আড়ালটা আর রাখতে ব্যর্থ রাজ্যের তথাকথিত বিরোধী দলগুলি। এক দল আড়াল থেকে ঘোমটা টেনে ছাত্র-যুবদের নামিয়ে দিয়েছে। পক্বকেশরা আসতে লজ্জা পাচ্ছে। পাছে তাঁদের মুখ দেখে জনগণ আবার না পিছিয়ে যায়। তাই রিমোট থেকে। আর অন্য দল (পড়ুন দলবদলুরা!) খোলাখুলি বুক ফুলিয়ে, আস্তিন গুটিয়ে। ঝুলি থেকে বেড়ালটা বেরিয়ে পড়তেই গোটা প্ল্যানটা প্রকাশ হল অত্যন্ত কদর্যভাবে। এক তরুণী ডাক্তারের শরীর ও স্বপ্নকে আদিম প্রবৃত্তির নাগপাশে জড়িয়ে খুন করার প্রতিবাদে আবেগে ভাসা স্বতঃস্ফূর্ত নাগরিক আন্দোলনকে হাইজ্যাক! প্রাণপণ চেষ্টা শুরু হতেই কালিমালিপ্ত হল আন্দোলন। কোনও সন্দেহ নেই যে, গোটা সমাজ আবেগবিহ্বল। এই বিহ্বলতাকেই ‘ফেক নিউজ’ চাষের আদর্শ মাটি হিসেবে বেছে নিয়েছে বিরোধীরা। হচ্ছেও তাই। ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে দ্রুত বিচার করে ফাঁসির দাবি উঠেছে সব মহল থেকে। বাদ যায়নি শাসকও। দোষীর কঠোরতম শাস্তির দাবি জানিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা আড়াই সপ্তাহ পর বারবার নির্বাচনে হেরে যাওয়া বিরোধীদের জিয়নকাঠিতে পরিণত। তাদের মতলবটা বেআব্রু হতেই তালটা কোথায় যেন কেটে গেল। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ কোন রসায়নে রাতারাতি বদলে গেল ‘দফা এক, দাবি এক, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই’ স্লোগানে। তাহলে মতলবটা কি? বিচার চাই না গদি চাই?
পিছন থেকে ছাত্র-যুবদের নামিয়ে দিলেও সিপিএম এখনও ফ্ল্যাগ নিয়ে আন্দোলেনে শামিল হতে ভয় পাচ্ছে। কারণ, লাল পতাকা দেখলেই বাংলার মানুষ আবার জামানত জব্দ করে ঘরে পুরে দেবে, এই অজানা আতঙ্ক তাড়া করছে আলিমুদ্দিনের কর্তাদের। কিন্তু পতাকা নিয়ে ফায়দা লুটতে নেমে পড়েছে গেরুয়া শিবির। ফলে আন্দোলনটা আর ষোলোআনা অরাজনৈতিক নেই, একটা দুঃখজনক মৃত্যু নিয়ে নোংরা রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। বাংলার ভোট রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা হারানো রাম আর বামের এই যুগলবন্দি শিক্ষিত বিদগ্ধ সমাজ মেনে নেবেন তো?
রাজ্যের তথাকথিত বিরোধীরা কেন ভুলে গেলেন, আর জি কর হাসপাতালের চারতলার সেমিনার রুমের অন্দরে ৮ আগস্ট মধ্যরাতে ‘অভয়া’র লড়াইটা মোটেই গেরুয়া বনাম সবুজের ছিল না। কাস্তে বনাম হাতের কিংবা নারী বনাম পুরুষেরও নয়—স্রেফ মানুষ বনাম অমানুষের, সভ্যতা বনাম জঙ্গলের আদিম অসভ্য প্রবৃত্তির। লড়াইটা এক ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে, যা আমাদের চারপাশটাকে প্রতিমুহূর্তে ধ্বংস করতে উদ্যত। এই লড়াই ইতিহাসে মোটেই প্রথম নয়, শেষও নয়। বরং বলা বাহুল্য, রাতের পর রাত ইমার্জেন্সির ঘেরাটোপে দাঁড়িয়ে ডাক্তারদের জীবন বাজি রাখা যুদ্ধকে কোনও দল, কোনও ধান্দাবাজ সংগঠন যদি শূন্য থেকে জেগে ওঠার মৃতসঞ্জীবনী সুধা হিসেবে ব্যবহার করেন, তাহলে তা কি কম বড় অপরাধ? সুধী ডাক্তাররা কী বলেন? তাঁরা এই অনাচার মেনে নেবেন তো? কিংবা সোদপুরের সেই পরিবার, যাঁরা সামনে থেকে ঘরের মেয়ের স্বপ্নটাকে খুন হতে দেখলেন, তাঁরা এক ডাক্তারের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাকে ব্যবহার করে বিরোধীদের নোংরা রাজনীতি বরদাস্ত করবেন তো?
খুব আশ্চর্য লাগছিল যখন স্রেফ সমাজ মাধ্যমের ভুয়ো প্রচারগুলিকেও অনেক প্রাজ্ঞজন ‘সত্যি’ বলে চালাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তাঁদের বিনম্র প্রণাম জানিয়ে বলি, হ্যাঁ, গাফিলতি থাকলে বলুন। সমালোচনা করুন। কিন্তু কোনও দলবদলু, কোনও বিদগ্ধ আগমার্কা বামপন্থী যদি ২০২১ ও ২০২৪ সালের হারের হতাশা ঢাকতে এই মওকায় গা ঝাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেন, নাগরিক আন্দোলনের অভিমুখকে নিজেদের পক্ষে ঘোরানোর চেষ্টা করেন, তাও সমান নিন্দাযোগ্য। সেই অপচেষ্টাকেও ব্যর্থ করতে হবে। স্পষ্ট করে দিতে হবে, নাগরিক সমাজ আপনাদের ক্ষমতা দখলের মাধ্যম হতে চায় না। বাঙালি বিচার চায়, মিথ্যে বদনামের বিপণন চায় না। বিশেষ করে গোটা মতলবটা যদি হয় হারের আক্রোশ থেকে, কায়েমি স্বার্থরক্ষা করতে, তাহলে বলতেই হয় চক্রান্তটা আজ নয় কাল পরাজিত হবেই।
বিচার চাই, কঠোর বিচার চাই। কিন্তু বাংলার বিরুদ্ধে চক্রান্ত চাই না।