বিশেষ নিবন্ধ

বাজেট নিয়ে অর্থমন্ত্রীর ছেঁদো যুক্তি
পি চিদম্বরম

গত ২৩ জুলাই অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের বাজেট পেশ করেছেন। পরদিন সংসদের উভয় কক্ষে শুরু হয় বাজেট নিয়ে আলোচনা। অর্থমন্ত্রী ৩০ জুলাই লোকসভায় এবং ৩১ জুলাই রাজ্যসভায় এই সংক্রান্ত বিতর্কের ‘জবাব’ দেন।  
অর্থমন্ত্রীর জবাব নির্দিষ্ট ছিল তিনটি বিষয় ভিত্তিক:
১. খরচের প্রতিটি খাতের অধীনে সরকার আরও বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে।
অর্থমন্ত্রীর মতে, সরকারের তরফে ব্যয় হল সুশাসনের একটি পরিমাপ। এই অর্থে সরকার যে ‘উন্নয়ন’ ও ‘কল্যাণ’ সাধন করেছে তাতে সকল শ্রেণির জনগণ উপকৃত হয়েছেন। অর্থমন্ত্রী কিছু পরিসংখ্যানসহ তাঁর যুক্তি সাজিয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে—ইউপিএ সরকারের শেষ বছরে, অর্থাৎ ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছিল; এনডিএ-২ সরকারের প্রথম ও শেষ বছরে বা ২০১৯-২০ ও ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে অর্থ খরচের পরিমাণ কত ছিল; এবং চলতি অর্থবর্ষে (২০২৪-২৫) এই সরকার কী পরিমাণ খরচ করতে চলেছে। সংখ্যাগুলি থেকে পরিষ্কার, খরচের পরিমাণ স্বাভাবিক নিয়মেই প্রতিবছর শেষমেশ বেড়েছে। অর্থমন্ত্রী উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘২০১৩-১৪ অর্থবর্ষে কৃষি ও সংশ্লিষ্ট খাতে মাত্র ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। একই খাতে আজকের ব্যয় বরাদ্দের পরিমাণ ১ লক্ষ ৫২ হাজার কোটি টাকা। বরাদ্দের এই পরমিাণ গত অর্থবর্ষের (২০২৩-২৪) চেয়েও ৮ হাজার কোটি টাকা বেশি। তাহলে এটাই সত্য যে, বিগত বছরগুলিতে কৃষি খাতে খরচের পরিমাণ আমরা বাড়িয়েছি, কোনোভাবেই কমাইনি।’ ধরে নিচ্ছি, সংখ্যাগুলি ‘কারেন্ট প্রাইসে’, ‘কনস্ট্যান্ট প্রাইসে’ নয়।  তবে বর্ধিত ব্যয়ের দাবিটি শুধুমাত্র তখনই প্রাসঙ্গিক হবে যদি তা মোট ব্যয় বা জিডিপির অনুপাত হিসেবে প্রকাশ করা হয়।
এছাড়া উল্লেখযোগ্য যে, এমন একাধিক হেড বা খাত রয়েছে যেগুলির অধীনে ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে বরাদ্দ অর্থ খরচই করা হয়নি। এই ব্যয় কেন সম্ভব হয়নি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি তারও:
খাত    বাজেট এস্টিমেট    রিভাইজড এস্টিমেট
কৃষি ও আনুষঙ্গিক    ১,৪৪,২১৪    ১,৪০,৫৩৩
শিক্ষা    ১,১৬,৪১৭    ১,০৮,৮৭৮
স্বাস্থ্য    ৮৮,৯৫৬    ৭৯,২২১
সমাজ কল্যাণ    ৫৫,০৮০    ৪৬,৭৪১
বৈজ্ঞানিক দপ্তরগুলি    ৩২,২২৫    ২৬,৬৫১

২. বেকারত্বের সমস্যা বলে কিছু নেই।
অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন যে, সরকার ‘সক্ষম, স্বতন্ত্র এবং সমর্থ’ (অর্থাৎ—যোগ্য, স্বাধীন এবং সক্ষম) নীতি নিয়ে চলেছে। তিনি পরিচিত পরিসংখ্যানই পেশ করেছেন। পিরয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভেতে দাবি করা হয়েছে যে, বেকারত্ব ৩.২ শতাংশে নেমে এসেছে। ওইসঙ্গে, এসবিআই রিসার্চ রিপোর্ট বলছে যে, ২০১৪ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশে সাড়ে ১২ কোটি চাকরির সৃষ্টি হয়েছে। দুটিই সরকারি রিপোর্ট। এই ব্যাপারে সিএমআইই যে তথ্য দিয়েছে তার বিরোধিতা করেছে তারা। সিএমআইই’র এস্টিমেট অনুসারে, দেশে বর্তমানে বেকারত্বের হার ৯.২ শতাংশ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন বা আইএলও’র তরফে প্রকাশিত রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ভারতে বেকারদের মধ্যে ৮৩  শতাংশই যুব! অর্থমন্ত্রী এই প্রশ্নের জবাব দেননি যে, মাত্র কয়েকশো বা কয়েক হাজার চাকরির জন্য প্রার্থীর সংখ্যা কয়েক হাজার বা কয়েক লক্ষ কেন?  
উদারহণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়—
• উত্তরপ্রদেশ পুলিসে ৬০,২৪৪টি পদে কনস্টেবল নিয়োগের জন্য পরীক্ষা নেওয়া হয়। তাতে অংশ নিয়েছিলেন ৪৮ লক্ষাধিক প্রার্থী। তাঁদের মধ্যে মহিলার সংখ্যা ছিল প্রায় ১৬ লক্ষ। 
• উত্তরপ্রদেশ স্টাফ সিলেকশন কমিশনের একটি পরীক্ষায় শূন্যপদ পদ পূরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাড়ে সাত হাজারের মতো মাত্র। কিন্তু ওই পরীক্ষায় বসার জন্য আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল ভিরমি খাওয়ার মতোই—২৪ লক্ষ ৭৪ হাজার ৩০! 
বেকারত্ব যদি এতই দ্রুত কমে গিয়ে থাকবে তাহলে এক-একটি চাকরির পরীক্ষার ক্ষেত্রে আবেদনকারী বা প্রার্থীর অনুপাত এত ভয়াবহ রকমে অসম কেন?  উপরে উত্তরপ্রদেশে গৃহীত দুটি চাকরির পরীক্ষার যে উদাহরণ দেওয়া হয়েছে সেখানে এই অনুপাতটি যথাক্রমে ছিল এইরকম—১:৮০ এবং ১:৩২৯। কেন ইঞ্জিনিয়ার, ম্যানেজমেন্ট গ্র্যাজুয়েট, আইনজীবী এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা সামান্য কনস্টেবল বা ক্লার্কের চাকরির জন্য আবেদন করছেন? বেকারত্বের সত্যতা খুঁজে পেতে, আমার পরামর্শ, প্রধানমন্ত্রী এবং অন্য মন্ত্রীদের উচিত ভারতের ছোট বড় শহরগুলির রাস্তায় একটু হেঁটে আসুন। বেশ, অর্থমন্ত্রী না-হয় মাদুরাই দিয়েই তার হাঁটা শুরু করতে পারেন।  তাঁর জন্ম তো ওই শহরেই। তারপর তিনি যেতে পারেন বিল্লুপুরমে, যেখানে তাঁর স্কুলশিক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। সবশেষে অর্থমন্ত্রী ঘুরে আসুন তিরুচিরাপল্লি থেকে। আমরা জানি, নির্মলা সীতারামন ওই শহরের কলেজে পড়েছিলেন। 
৩. আমাদের মুদ্রাস্ফীতির হার আগের 
জমানার চেয়ে ভালো। 
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘অর্থনীতি সামলানোর জন্য ইউপিএ সরকার হার্ভার্ড এবং অক্সফোর্ডে শিক্ষিত নেতাদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা জানতেন না কখন এবং কীভাবে ‘স্টিমুলাস’ প্রত্যাহার করতে হবে। আর ওই কারণেই ২০০৯ এবং ২০১৩ সালের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি হয়েছিল দুই সংখ্যার, যেটা যথেষ্ট বেশি।’ অর্থমন্ত্রী অবশ্য বুদ্ধিমতীর মতোই এই ব্যাপারে নামগুলি এড়িয়ে গিয়েছেন, কেননা তাতে তাঁর সরকারই বিব্রত হতে পারত। অর্থমন্ত্রী ‘টেকনিক্যালি কারেক্ট’ হলেও তাঁর এই বক্তব্য কিন্তু প্রাসঙ্গিক নয়। দেশবাসী কিন্তু ইউপিএ আমলে বসবাস করছেন না, তাঁরা বসবাস করছেন মোদির তৃতীয় বা ২.১ জমানায়। তাঁরা এমন এক সময়ে বসবাস করেন যখন টোম্যাটো, পেঁয়াজ এবং আলুর দাম প্রতিবছর যথাক্রমে ৩০ শতাংশ, ৪৬ শতাংশ এবং ৫৯ শতাংশ বেড়েছে (সূত্র: ক্রিসিল)। তাঁরা এমন এক সময়ে বসবাস করেন যখন পাইকারি মূল্য সূচক ভিত্তিক ডব্লুপিআই মূল্যস্ফীতির হার ৩.৪ শতাংশ। যখন ভোগ্যপণ্যের বা সিপিআই মূল্যস্ফীতি ৫.১ শতাংশ এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৯.৪ শতাংশ। ভারতের মানুষ এমন এক সময়ে বসবাস করেন যখন সব শ্রেণির শ্রমিকের মজুরি ছ’বছর যাবৎ থমকে রয়েছে। ২০২৪ সালের এপ্রিল-মে মাসে মানুষ ভোট দিয়েছেন মোদি জমানায় মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে, তাঁরা কেউ ইউপিএ আমলের মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে কিন্তু মত দেননি। মূল্যস্ফীতির বোঝা কমাবার কোনও আইডিয়া অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে আমরা পাইনি। নিয়ন্ত্রিত মূল্য (অ্যাডমিনিস্টার্ড প্রাইস) কমানো হয়নি। কমানো হয়নি কর বা সেস। ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো হয়নি। জোগান বৃদ্ধির উপযোগী কোনও ব্যবস্থাও নেওয়া হল না। প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টার মুদ্রাস্ফীতি সম্পর্কিত কয়েকটি শব্দ উদ্ধৃত করেছেন তিনি, ‘ভারতের মুদ্রাস্ফীতি কম ও স্থিতিশীল থাকবে এবং এগচ্ছে ৪ শতাংশ লক্ষ্যের দিকে।’ এবং, তার জোরেই বিরূপ প্রশ্নগুলি অর্থমন্ত্রী নস্যাৎ করতে চেয়েছেন। তিনি একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর দেননি। প্রশ্নটি হল—এই সরকারের মুদ্রাস্ফীতি ব্যবস্থাপনা যদি এতই প্রশংসনীয় হয়, তাহলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক (আরবিআই) ১৩ মাস যাবৎ ব্যাঙ্ক রেট ৬.৫ শতাংশই রেখে দিল কেন? এই হার ২০২৪ সালে কমাবার কোনও সম্ভাবনাও তো নেই! 
এই বাজেটকে সাধারণ নাগরিকরা খুশি মনে গ্রহণ করতে পারেননি। এমনকী, সরকারের তরফে গাইয়ে-বাজিয়েরাও সংশয়ে, তাই প্রতিক্রিয়া জানাবার প্রশ্নে তাঁরা সতর্কই ছিলেন। এই ব্যাপারে একমাত্র অর্থমন্ত্রীর একারই কোনও সংশয় নেই বলে মনে হয়। অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ করার সময় জ্ঞানের যে উচ্চমার্গে পৌঁছে গিয়েছিলাম, তাঁর জবাব শেষে, অন্য অনেকের সঙ্গে আমিও রয়ে গিয়েছি একই অবস্থায়।
• লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

বহু প্রচেষ্টার পর আটকে থাকা কাজের জটিলতা মুক্তি। কৃষিজ পণ্যের ব্যবসায় বিশেষ উন্নতি। আয় বাড়বে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৫ টাকা৮৪.৮৯ টাকা
পাউন্ড১০৭.৭৯ টাকা১১১.৩৩ টাকা
ইউরো৯০.৯৫ টাকা৯৪.১৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা