বিশেষ নিবন্ধ

গণতন্ত্রের খামতিরই চরম মূল্য দিল বাংলাদেশ
পি চিদম্বরম

১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই আমেরিকার তেরোটি রাজ্য তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯-১৭৯৯) পর অতিবাহিত হয়েছে দুই শতকেরও বেশিকাল। ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের শাসন থেকে প্রথম মুক্ত উপনিবেশের নাম অস্ট্রেলিয়া, সেটা ১৯০১ সালের ঘটনা। আর ভারত স্বাধীনতা অর্জন করেছে ১৯৪৭ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়া এখনও স্বাধীন এবং তারা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী শাসক হিসেবে পরিচিত ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, পর্তুগাল প্রভৃতি। তাদের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত সমস্ত দেশ এখনও সেই অর্থে ‘মুক্ত’ নয়। কারণ এই দেশগুলির নাগরিকরা মানবিক স্বাধীনতা উপভোগ করে না এবং সুষ্ঠু ও স্বাধীনভাবে তাদের পছন্দের সরকার নির্বাচন করতেও সক্ষম নয় তারা। একটি হিসেব বলছে, বিশ্বের জনসংখ্যার মাত্র ২০ শতাংশ স্বাধীনতার সঙ্গে বসবাস করে। সুখের কথা এই যে, ভারতবাসীরা রয়েছেন তাদেরই মধ্যে।
গণতন্ত্র দেওয়া হয় না
গণতন্ত্র দেওয়া হয় না। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু অতঃপর কয়েক দফায় দেশটি চলে গিয়েছে সামরিক স্বৈরশাসনের অধীনে। আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশ তৎকালীন পাকিস্তানের একটি প্রদেশ ছিল। সে-দেশের সামরিক একনায়কতন্ত্রেরই পদানত ছিল তখন। একটি গেরিলা আন্দোলন শক্তি সঞ্চয় করে স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপ নেয়। পূর্বব঩ঙ্গের মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা পূরণে হস্তক্ষেপ করেছিল ভারত।  তারই ফলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু ১৯৭৫ থেকে ১৯৯১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ শাসন করেন একাধিক সামরিক শাসক। সামরিক শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সে-দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামি লিগ এবং বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) হাত মিলিয়েছিল। তার ফলে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে একটি অসামরিক সরকার ক্ষমতায় বসতে পেরেছিল।
শেখ হাসিনা প্রথম নির্বাচিত হন ১৯৯৬ সালে। তিনি ২০০৮, ২০১৪, ২০১৯ ও ২০২৪ সালে পুনর্নির্বাচিত হন। বিরোধী দলগুলি গত নির্বাচন বয়কট করেছিল।  ২০২৪ সালের নির্বাচনের ‘নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা’ নিয়ে বিস্তর সন্দেহ ছিল অভিজ্ঞ মহল এবং বিভিন্ন দেশের সরকারের। নীতির প্রশ্নে ভারত মেনেছে সেটাই যেটা রাজনৈতিকভাবে সঠিক (পলিটিক্যালি কারেক্ট)।  
অগ্রগতি মানে সাত খুন মাফ নয়
শেখ হাসিনার জমানায় বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতির রেকর্ড করেছে। দেশটির মাথাপিছু আয় ভারতের চেয়ে বেশি। একই প্রশ্নে টপকে গিয়েছে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান এবং নেপালের মতো দক্ষিণ এশীয় দেশগুলিকেও। মানব উন্নয়ন সূচকে (এইচডিআই) বাংলাদেশের অবস্থান শ্রীলঙ্কার পরেই। হাসিনার বাংলাদেশ এই প্রশ্নে ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানেরও উপরে ছিল। বাংলাদেশ তাদের ইনফ্যান্ট মর্টালিটি রেট বা শিশুমৃত্যুর হার (আইএমআর) কমিয়ে ২১-২২ করে ফেলেছে, সংখ্যাটি ভারতের ক্ষেত্রে ২৭-২৮! শুধুমাত্র শ্রীলঙ্কায় শিশুমৃত্যুর হার ৭-৮-এরও নীচে (সূত্র: দ্য হিন্দু)। কিন্তু ‘ফ্রিডম হাউস’ তারই পাশে নিন্দা করেছে নির্বাচন, গণমাধ্যমের হাল, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং নাগরিকের ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে বাংলাদেশের খারাপ ভূমিকার। শাসকরা ভাবেন, গণতন্ত্রের পতন কিংবা বেকারত্ব, অসমতা ও বৈষম্যের কারণে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ আর্থিক উন্নয়ন দিয়েই ঢেকে দেওয়া যাবে, কিন্তু বাস্তবে তেমনটা হয় না। বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ মনে করত যে, সরকারি চাকরিতে যে সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু ছিল তা পক্ষপাতদুষ্ট ও স্বজনপোষণের কারবার। এই নীতির এমন তীব্র বিরোধিতা তারা করলেন যে বন্যার সময় বাঁধ ভেঙে যাওয়ার মতো একটা ব্যাপার ঘটে গেল!   
ইতিমধ্যে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির গতি কমে এসেছে, বেড়ে গিয়েছে জিনিসপত্রের দাম এবং সংকট সৃষ্টি হয়েছে চাকরির বাজারেও। শেখ হাসিনার সরকার অবশ্য এসব মানতে চায়নি—স্বৈরাচারীদের এটাই হল আসল রোগ। ‘ট্রিগার’ ছিল সংরক্ষণ নীতি। আন্দোলনকারীরা তারই সঙ্গে দ্রুত জুড়ে দেন দুর্নীতি, পুলিসি বর্বরতা এবং বিচার বিভাগের নিষ্ক্রিয়তার মতো অন্যান্য দীর্ঘকালীন সমস্যাগুলি। এ এক চেনা গল্প বইকি।
খামতি বন্ধ করুন
রাস্তার বিক্ষোভ সবসময় সফল হয় না। এই ধরনের প্রতিবাদ বিক্ষোভ থেকে সত্যি সত্যিই সরকারের পতন ঘটায়, যেমনটা হয়েছিল শ্রীলঙ্কায়। এর উল্টো ছবিও দেখেছি আমরা। যেমন হোসনি মোবারক গদি ছাড়তে বাধ্য হওয়ায় ‘আরব বসন্ত’ সফল বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু তা শেষপর্যন্ত ব্যর্থই হয়েছিল যখন অন্য একজন সামরিক শাসক এসে সেখানকার নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। একটি সুষ্ঠু-স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করার সমস্ত আশা-ভরসা অধিকাংশ মানুষ পুরোপুরি হারিয়ে ফেললেই গণঅভ্যুত্থান ঘটে। নির্বাচনের পর নির্বাচনে, সেই স্বাভাবিক পথটি রুদ্ধ হয়ে গেলে জনগণের বিরোধিতার বানই আছড়ে পড়ে। যাই হোক, রাজপথে বিক্ষোভের একটা বিপজ্জনক দিকও আছে। এই ধরনের প্রতিবাদে যে-কেউ যোগ দিতে পারে। তাতে ভিড়ে যেতে পারে মৌলবাদী বা সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর লোকজনও। অনেকের বিশ্বাস, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশি নাগরিকরা বিপন্ন বোধ করতে পারেন।  বিশেষভাবে অরক্ষিত হয়ে পড়তে পারেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিকরা। তাঁদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং উপাসনালয়গুলিতে হামলা হতে পারে। 
এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ব্যতিক্রম ভাবা যাচ্ছে না। অনেক দেশের মানুষই একই দুর্দশায় পড়তে পারে। গণতন্ত্রের খামতি থেকেই জনগণ তাদের ক্ষোভ রাজপথে উগরে দিতে বাধ্য হয়। এর উত্তর একটাই—এই খামতি পূরণ করতে হবে। এই খামতি দূরীকরণকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে এবং তার প্রায় নিখুঁত রূপদান করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের সম্মুখীন হয়েছেন ব্রিটেনের একাধিক প্রধানমন্ত্রী। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে থ্যাচার, জনসন এবং মে পদত্যাগ করেন। অতঃপর নতুন নেতা নির্বাচন করার সুযোগ দেন তাঁরা পার্টিকে। লিন্ডন জনসন এবং জো বাইডেনের মতো মার্কিন প্রেসিডেন্টরা প্রার্থী হিসেবে পুনরায় মনোনয়ন গ্রহণে অস্বীকার করেছেন। জবাবদিহিতার জায়গা থেকে নেতৃত্বের পদত্যাগ নিশ্চিত করা হয়েছে। মেয়াদ সীমা একটা খুব দরকারি জিনিস। সত্যিকারের স্বাধীন ও মুক্ত সংবাদ মাধ্যমই হল সমস্ত ভালোমন্দ প্রকাশের একটা জানালা। সুপ্রিম কোর্টের নির্ভীক ভূমিকা পালনের অবকাশ থাকা দরকার, যাতে শীর্ষ আদালত যেন সদাজাগ্রত প্রহরীর দায়িত্বই পালন করতে পারে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে সময়সূচি মেনে সত্যিকারের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া জরুরি। গরিব, অবহেলিত ও নিপীড়িত মানুষের ক্ষোভ অসন্তোষ প্রশমনের এটি একটি দারুণ উপায়। আমি মনে করি, প্রতিমাসে সংসদের অধিবেশন বসা উচিত। সেখানে অধ্যক্ষের অযাচিত হস্তক্ষেপ ছাড়াই প্রতিদিন চলা উচিত শাসক এবং বিরোধী উভয় পক্ষের বাগ্‌যুদ্ধ। ডেমোক্রেসি ডেফিসিট বা গণতন্ত্রের খামতির চূড়ান্ত জবাব তো এটাই!
গণতন্ত্রের খামতির জন্য বাংলাদেশকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। এই কারণে যাঁদের প্রাণ গিয়েছে তাঁদের জন্য আমি শোক প্রকাশ করছি।
 লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত 
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

বহু প্রচেষ্টার পর আটকে থাকা কাজের জটিলতা মুক্তি। কৃষিজ পণ্যের ব্যবসায় বিশেষ উন্নতি। আয় বাড়বে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৫ টাকা৮৪.৮৯ টাকা
পাউন্ড১০৭.৭৯ টাকা১১১.৩৩ টাকা
ইউরো৯০.৯৫ টাকা৯৪.১৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা