বিশেষ নিবন্ধ

রাজনীতি থামিয়ে দ্রুত বিচার চাই
হিমাংশু সিংহ

আর জি কর হাসপাতালে যা ঘটেছে তা বাঙালির কাছে লজ্জার। মানবতার এমন পরাজয়ে মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছে আমাদের সবার। শিউরে উঠেছে বিবেক। রবীন্দ্রনাথের বাংলায় মানুষ কি দিনদিন পশু হয়ে যাচ্ছে? অল্পবয়সি এক ডাক্তারের এমন মর্মান্তিক পরিণতি আমাদের যত্নে লালন করা বাঙালি অস্মিতাকেই সজোরে আঘাত করেছে, রক্তাক্ত হয়েছে যাবতীয় বোধ, বুদ্ধি, অনুভূতি। তার চেয়েও বড় ধাক্কা হাসপাতালজুড়ে ১৪ আগস্ট রাতের পৈশাচিক ভাঙচুর। এই জোড়া ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে ক্রমাগত গুজব ছড়ানোও কম বড় অপরাধ নয়। কিছু একটা ছড়িয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারলেই যেন তৃপ্তি! সামাজিক ব্যাধি ও মানসিক বৈকল্যের বিরুদ্ধে শুরুতে যে আন্দোলন ছিল ষোলোআনা অরাজনৈতিক, তাতে আকস্মিক রাজনীতির রং লাগা মোটেই অভিপ্রেত ছিল না। একের পর এক লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে বিরোধীদের ঘোলা জলে মাছ ধরার প্রবণতা কিছুতেই সমর্থনযোগ্য নয়। হরেক কিসিমের মিথ্যে ছড়িয়ে জনমানসে অবিশ্বাস তৈরি করাও শাস্তিযোগ্য। এই কানাগলিতে সাধারণ ঘরের এক মেয়ের ধর্ষণ ও খুনের ইতিবৃত্ত পথ হারালে তার চেয়ে শোচনীয় পরিণতি আর কিছু হতে পারে না। তখন সুবিচার দেবে কে? দ্রুত বিচার করে ফাঁসি দিতে না পারলে নিষ্পাপ মেয়েটার আত্মা শান্তি পাবে তো! দোষীদেরই বা কী হবে? সিবিআই কিন্তু বোফর্স থেকে শুরু করে কবিগুরুর নোবেল পদক উদ্ধার, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে। কে না জানে, তদন্ত চালিত হয়েছে দিল্লির শাসকের মর্জিতে।
কী অপরাধ ছিল মেয়েটার? সবে তিরিশের কোঠা পেরনো এক মেধাবী ছাত্রী। অনেক স্বপ্ন নিয়ে জেলা থেকে পা রেখেছিল কলকাতার নামী হাসপাতালে। একদিন চেস্টের বড় স্পেশালিস্ট হবে, দিনরাত এক করে রোগী দেখবে, সেই লক্ষ্যকে ছুঁয়ে দেখারই নিরন্তর লড়াই ছেয়েছিল তার নিষ্পাপ দু’চোখ ঘিরে। সোদপুরের মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে কল্যাণীর জেএনএম হাসপাতালে এমবিবিএস শিক্ষা। এই উত্তরণের প্রতিটি সিঁড়িতেই ছিল অজানা বিপদ, অনিশ্চয়তা, পা পিছলে যাওয়ার আশঙ্কা। সামান্য পরিবার। সেই কারণে শুরু থেকেই পথ মসৃণ ছিল না। বাবার সাইকেলের পিছনে বসে এ টিউশন থেকে অন্য টিউশনে। সঙ্গতি অল্প, স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়ার। সেই ‘ফোকাস’ টলে যায়নি শেষদিন পর্যন্ত। মূলধন মেধা, সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম এবং দায়বদ্ধতা। সেই সুবাদেই জয়েন্টে চান্স মিলেছিল ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, দুই বিভাগেই। যাঁরা হালের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ফলাফলের খোঁজ রাখেন তাঁরা জানেন কাজটা মোটেই সহজ নয়। কিন্তু কলকব্জা, যন্ত্রের বাহাদুরিতে নয়, তাঁর মন আগে থেকেই তৈরি হয়ে ছিল ডাক্তার হওয়ার জন্য। ইমার্জেন্সি, আইসিইউয়ের চার দেয়ালের ঘেরাটোপে মুমূর্ষু রোগীদের জীবন বাঁচানোর সেবায় নিজেকে উজাড় করার সঙ্কল্পে। কল্যাণী থেকে ভালো নম্বর পেয়ে সেই লক্ষ্যেই গোল্লাছুট কলকাতার কেতাদুরস্ত সরকারি হাসপাতালে স্নাতকোত্তর শিক্ষার জন্য। এমবিবিএস পাশ করার পর আর জি করের চেস্ট বিভাগ। কাজের প্রতি দায়বদ্ধতার দরুন দ্রুত নজরে পড়ে গিয়েছিল সিনিয়রদের। তাই ডিউটির চাপও বাড়ছিল। শিক্ষক ও সহপাঠীদের বয়ান অনুযায়ী কারও সঙ্গে ঝগড়া কিংবা ঝামেলা দূরঅস্ত, জীবনে কোনওদিন একটা পিঁপড়ের ক্ষতি করতেও দেখা যায়নি তাকে। কারও লেজে পা দেওয়ার প্রশ্নই নেই। একইসঙ্গে অন্যায়ের সঙ্গে আপস করাও যে লেখা নেই রক্তে। স্বপ্নের কয়েকটা সিঁড়ি পার করার পর সঙ্কল্পও হয়ে গিয়েছিল অনেক পরিণত। তবে কি বেশি ভালো হওয়াটাই কাল হল তার। বাজারচলতি দেওয়া নেওয়ার লাভজনক সিস্টেমের অংশ হতে না পারার দরুনই কিংবা হয়তো কোনও ‘মৌচাক’ চিনে ফেলেছিল সে! জেনে ফেলেছিল, কোনও গোপন লেনদেনের অদৃশ্য ঠিকানাও। তাই এমন ভয়ানক পরিণতি তাড়া করল বড় ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নে মশগুল ৩১ বছরের তরুণীকে। সম্ভবত বহু পুরনো সেই আপ্তবাক্য তার মনে ছিল না, ‘ সামনে যা ঘটছে তুমি তার কিচ্ছুটি দেখনি। শোনোওনি।’
কিন্তু এর দায় কার? নিছকই একটা খুন ধর্ষণের ঘটনা নাকি শিকড় আরও গভীরে। হাসপাতালে ওষুধ, যন্ত্রপাতি ও অঙ্গ কেনাবেচার ঘুঘুর বাসা তাকে খতম করল নাকি আরও বড় কোনও চক্র। শুধুই একটা সরকার ও পুলিসের ব্যর্থতা নাকি এই সমাজে আজ দুর্বৃত্তরা যতটা সঙ্ঘবদ্ধ, ভালো মানুষেরা ততটাই একা, অসহায়, তাই এমন পরিণতি! প্রতি সপ্তাহেই লিখতে হয় টাটকা কোনও ইস্যু নিয়ে। সে রাজ্যের হোক কিংবা এখানকার গণ্ডি পেরিয়ে দেশ, বিদেশেরও হতে পারে। রাজনীতির ওঠাপড়া, সামাজিক উত্থান পতন, নেতানেত্রীদের সাফল্য এবং পদস্খলনের খতিয়ান। ক্ষমতার নিরন্তর হাতবদল ও অক্ষরেখা পরিবর্তনের সঙ্গে সব হারানো কুশীলবদের নির্মম ধারাভাষ্য। ক্ষমতার এটাই নিয়ম, একুল ভাঙে আর অন্যকুল গড়ে! কিন্তু এ সপ্তাহে প্রেক্ষিতটা যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন। ৩১ বছরের এক সাহসী কন্যার কথা লিখতে গিয়ে আবেগে থেমে যাচ্ছি বারবার। শব্দ-বাক্য সব অসংলগ্ন হয়ে যাচ্ছে যেন! তার অপরাধ, টানা ৩৬ ঘণ্টা ডিউটির পর ভোররাতে শরীরটা এলিয়ে দিয়েছিল অভিশপ্ত চারতলার সেমিনার রুমে। ক্লান্ত শরীরে দু’চোখ বেয়ে ঘুমও নেমে এসেছিল দ্রুত, যা খুবই স্বাভাবিক। কে জানত সেই ঘুমই শেষ ঘুম হবে। রাত জেগে নরখাদকরা রয়েছে তার অপেক্ষায়। একজন কর্তব্যরত ডাক্তারের উপর খোদ হাসপাতালের ভিতর এমন নৃশংস অপরাধ পূর্বপরিকল্পিত না তাৎক্ষণিক, তা বলবে সিবিআই। প্রাথমিক তদন্তে গাফিলতি ছিল কি না, কেন প্রথমে তার বাড়িতে ফোন করে আত্মহত্যার কথা বলা হল? যিনি ওই ফোন করেছিলেন তিনি কার নির্দেশে ওই কাজ করেছিলেন। হয়তো এসবই জানা যাবে একদিন। চরম শাস্তি শেষ পর্যন্ত হবে কি হবে না, সবই ভবিষ্যতের গর্ভে। শুধু সে আর ফিরবে না কোনওদিন এই পথে। দেখা যাবে না আবার স্টেথো কাঁধে ঝুলিয়ে ধীর পায়ে ইমার্জেন্সির ডিউটিতে। নরখাদকরা একজন ছিল না একাধিক সেই প্রশ্নেরও মীমাংসা হবে কি না জানি না। শুধু জানি এই ঘটনা সভ্যতার লজ্জা। কোনও অজুহাত, কোনও সাফাই, কোনও দুঃখপ্রকাশ এই ঘটনার অভিঘাত ঢেকে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়।
কিন্তু ৩১ বছরের সাধারণ এক মেয়ের এই আত্মত্যাগ কি বিফলে যাবে? এককথায় উত্তর না। স্বাধীনতার আগের রাতে যখন রাত বারোটা নাগাদ অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলাম তখন রাস্তায় শুধু মানুষের ঢল। সেখানেই টের পেয়েছি তার শক্তি। নিত্য ব্রিগেড, শহিদ মিনার, স্ট্রিট কর্নারে ঘোরা নাগরিক সমাজের এমন নিচুতারে বাঁধা বলিষ্ঠ প্রতিবাদ ও ধিক্কারের প্রতিধ্বনির স্বতস্ফূর্ত চেহারা বড় একটা দেখিনি কলকাতার রাজপথে, যার অভিঘাত পৌঁছে গিয়েছে দূর জেলাতেও। মধ্যরাতে একদিনের নোটিসে এমন সঙ্ঘবদ্ধ ধিক্কার নিঃসন্দেহে নাড়া দিয়েছে গোটা সমাজকে। রাজনীতি ও ধর্মের পাঁকে নিমজ্জিত নাগরিক মন এই একটা ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ। এমনকী বিদেশেও গর্জে উঠেছে প্রতিবাদ। নাগরিক আবেগের বাঁধভাঙা বিস্ফোরণ যেন। ওই রাতে যাঁদের রাস্তায় থাকাটা বেমানান সেই ক্রাচে কিংবা অন্যের কাঁধে ভর দেওয়া প্রবীণ প্রবীণাদেরও দেখলাম। নিঃশব্দে হাঁটছেন। কেউ খোঁড়াচ্ছেন। তবে বেশিটাই তরুণ তরুণীদের আবেগ। অনেকেই প্রাপ্তবয়স্ক হননি এখনও। সবার মুখে একটাই স্লোগান, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। যে কোনও মূল্যে বিচার চাই। রাস্তায় নয়, রেল প্ল্যাটফর্মেও নয়, মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার এক তরুণী ডাক্তার নিরাপদ হাসপাতালের চৌহদ্দিতে। এক সময় মনে হচ্ছিল আমরা বুঝি সবাই অপরাধী। একটা স্বপ্নকে কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে ওঠার আগেই হত্যা করার দায় এড়াতে পারি না আমরাও। অন্তত যাঁরা নিজেদের তথাকথিত শিক্ষিত দাবি করি।
কিন্তু নাগরিক সমাজের সেই গগনচুম্বি প্রতিবাদ পেরিয়ে বাড়ি পৌঁছতেই বদলে গেল ফোকাস। 
কোন রাজনীতি চোনা ছড়িয়ে দিল এমন এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদের মধ্যে! আর জি করের ইমার্জেন্সিতে 
পাশবিক ভাঙচুর। লক্ষ লক্ষ টাকার মেশিন, ওষুধ, মনিটর, দুষ্প্রাপ্য পরিকাঠামো সব ভেঙে চুরমার। এ তো গরিব মানুষের জন্য, তাহলে ভাঙচুর চালালো কে? সেদিন রাতে বলা হল দুষ্কৃতী সংখ্যা ৩০, আদালতে সরকার বলল ৭ হাজার। এত লোকের জমায়েত হল, পুলিস কিছুই আঁচ পেল না। আরজি করের এই নয়া ইমার্জেন্সির বয়স কিন্তু বেশি নয়। মাত্র দেড়, দু’বছরের। এত দামি দামি মেশিন ভাঙতে কষ্ট হল না একটুও। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, দুষ্কৃতীরা যারা এসেছিল তাদের চেয়ে পুলিসের সংখ্যা ছিল বেশি। তাহলে আটকানো গেল না কেন? কেনই বা পুলিস প্রাণ বাঁচাতে বাথরুমে পর্যন্ত লুকিয়ে পড়ল। অবিলম্বে দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে। শুধু ধর্ষকদের নয়, যারা মধ্যরাতে ভাঙচুর করেছে তাদেরও। একাজে কোনও রং দেখা চলবে না। আর বিরোধীদেরও কথা দিতে হবে, এমন মানবিক বিপর্যয়ের সময় তারা সস্তা রাজনীতি থেকে বিরত থাকবেন। রাজ্যের বদনাম করে আমি-আপনি কেউ কিন্তু বাঁচতে পারব না। সর্বনাশ হয়ে যাবে। 
একটা কুঁড়ির মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু প্রশ্নগুলোর উত্তর মেলেনি। তথ্য লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। মিথ্যাও ছড়াচ্ছে পাল্লা দিয়ে। সত্যিটাকে সামনে আনার নামে মিথ্যার বেসাতিও কিন্তু কোনও নাগরিক সমাজ মেনে নিতে পারে না। তদন্ত করে সবাইকে বিচার দিতে হবে। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ আজ নাগরিক আন্দোলনের অভিমুখ। তা যেন শুধু কথার কথা না হয়। এই নাগরিক আন্দোলন শুধু এক রাতের দখলে থেমে গেলে সবচেয়ে দুঃখ পাবে ওই নির্যাতিতাই। 
রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর নন্দিনীর মতোই সেই তরুণীও যেন আজ সশব্দে বলছে, ‘আমার সেই মরা তোমাকে মারবে। আমার অস্ত্র নেই, আমার অস্ত্র মৃত্যু।’
26d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

বহু প্রচেষ্টার পর আটকে থাকা কাজের জটিলতা মুক্তি। কৃষিজ পণ্যের ব্যবসায় বিশেষ উন্নতি। আয় বাড়বে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৫ টাকা৮৪.৮৯ টাকা
পাউন্ড১০৭.৭৯ টাকা১১১.৩৩ টাকা
ইউরো৯০.৯৫ টাকা৯৪.১৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা