বিশেষ নিবন্ধ

সংরক্ষণ: সিঁদুরে মেঘ দেখাচ্ছে বাংলাদেশ
শান্তনু দত্তগুপ্ত

রাজপথ জুড়ে বিক্ষোভের স্রোত, স্লোগান, শাসক বাহিনীর বুটের শব্দ। চাপা পড়ল সবকিছু... গুলি ছুটছে। বাংলাদেশের আকাশে তার অনুরণন। প্রতিবাদী স্লোগান ঢাকা পড়ছে তাতে। ছুটছে আন্দোলনকারীরা। ছুটছে মানুষ। সাধারণ মানুষ। তাদের সঙ্গে সংরক্ষণ বিরোধী এই আন্দোলনের কোনও সম্পর্ক নেই। সামাজিক বৈষম্যের বিরোধিতায় শুরু হওয়া ছাত্র বিক্ষোভ কখন রাজনীতির আঙিনায় প্রবেশ করেছে, সেটাও জানা নেই তাদের। বুকের মাঝে বাসা বেঁধে আছে শুধু আতঙ্ক। আর একটাই প্রশ্ন—বেঁচে বাড়ি ফিরতে পারব তো? দৌড়াদৌড়ির মধ্যে সরে যাচ্ছে একজন। ধীরে ধীরে। আরও কয়েকজন এসে তাকে ধরলেন। আস্তে আস্তে বসে পড়ছে সে। বুকে গুলি লেগেছে। শরীর ভেসে যাচ্ছে রক্তে। নাঃ, বাড়ি ফিরতে পারেননি তিনি। পরিচয়? স্রেফ আম আদমি। সমাজের সবচেয়ে উপেক্ষিত একটি জাত বিশেষ। 
সীমান্ত বদলে যায়, বদলায় না এই খাঁটি সত্যিটা। বৈষম্য তাদের রোজকার সঙ্গী। কলেজে বৈষম্য, বিশ্ববিদ্যালয়ে, চাকরিতে, আবার সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পেও। দরখাস্ত দিতে গিয়ে তারা জানতে পারে, আর জায়গা নেই। আসন যে কয়েকটি আছে, সেগুলি সংরক্ষিত। কোটার। সেই আসন যদি ভর্তি না হয়েই পড়ে থাকে? যদি কোনও প্রার্থী পাওয়া না যায়? তখনও হয়তো ডাক পড়বে না জেনারেল 
ক্যাটিগরির সেই ছেলেটির। প্রশাসন থাকবে অপেক্ষায়। সংরক্ষণের স্নো-পাউডার মেখে কেউ যদি আসে। আর ক্ষোভ বাড়বে সেই জেনারেল ক্যাটিগরির ছেলেটির মধ্যে। তাকে বারুদের স্তূপ বললে কি খুব ভুল হবে? শুধু একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গের অপেক্ষা। একটি ডাক। এক আহ্বান। তখনই ঘটে বিস্ফোরণ। ঠিক যেমনটা হয়েছে বাংলাদেশে।
বড় বিচিত্র দেশ ভারত। বড় বিচিত্র এর গণতান্ত্রিক অধিকার। সংরক্ষণের ফর্মুলার দিকে যত নজর পড়ে, ততই অবাক বোধ হয়। কারণ, যে ব্যবস্থা সমাজের পিছিয়ে থাকা শ্রেণিকে সামনে নিয়ে আসার জন্য শুরু হয়েছিল, সেটাই এখন বদলে গিয়েছে ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতিতে। সংবিধান চেয়েছিল, এদেশে কেউ যেন ‘অচ্ছুৎ’ না থাকে। নিচু জাতের হাতে জল খাওয়া যাবে না, তাদের ছায়া মাড়ানো যাবে না, তাদের সঙ্গে স্কুলের এক বেঞ্চে বসে পড়াশোনা করা যাবে না... এমন হাজারো সামাজিক অসুখের ভ্যাকসিন হিসেবে নিয়ে আসা হয়েছিল সংরক্ষণ ব্যবস্থা। লোকসভা-বিধানসভায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কিংবা সরকারি চাকরিতে। সংবিধান আমাদের শিখিয়েছিল, জাতপাতের ভিত্তিতে মানুষকে বিচার করা যাবে না। চলবে না বৈষম্য। কিন্তু সংবিধান আমাদের একবারও বলে দেয়নি যে, এই ব্যবস্থা ততক্ষণ পর্যন্ত কার্যকর থাকবে, যতক্ষণ সংরক্ষিত শ্রেণি জেনারেল ক্যাটিগরির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতে পারবে। বুঝে নিতে পারবে তাদের অধিকার। তাই শ্রেণি উন্নয়ন নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোটা ব্যবস্থা বদলে গিয়েছে জাতপাতের রাজনীতিতে। অমুক জাতের লোকজন আমার ভোটব্যাঙ্ক... নথিভুক্ত করে দাও ওদের সংরক্ষণের আওতায়। ওরা খুশি হবে, আমাদের ভোট দেবে। রাজনীতি কিন্তু এটা দেখছে না যে, সত্যিই তাঁদের সবার সংরক্ষণের সুবিধা প্রয়োজন কি না। আর তাই যে মাতব্বরের বার্ষিক আয় ১৪ লক্ষ টাকা, তাঁর সন্তানও কলেজে ভর্তির সময় সংরক্ষণের সুবিধা পাচ্ছে। মেধাবী পড়ুয়ার ৬৫ শতাংশ নম্বর ফিকে হয়ে যাচ্ছে তার ৪০ শতাংশের কাছে। কারণ, তার হাতে একটি কাস্ট সার্টিফিকেট রয়েছে। আর সেটার ব্যবস্থা করে দিয়েছে সরকারই। 
সমাজকে যদি সত্যিই উন্নত করতে হয়, প্রত্যেক শ্রেণিকে এক আসনে বসাতে হয়, তার জন্য জাতির ভিত্তিতে সংরক্ষণ করা চলে না। কাস্ট রিজার্ভেশন নয়, প্রয়োজন ক্লাস রিজার্ভেশনের। সিস্টেম হবে এমন, যা খুঁজে নেবে অভাবীকে। তেলা মাথায় তেল দেবে না। সেই সময় কিন্তু এসে গিয়েছে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এখনও কি দেশে ছুৎমার্গ নেই? তফসিলি জাতি-উপজাতি কিংবা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিদের সবাই সমাজের প্রথম সারিতে এসে গিয়েছেন? উত্তর হল, না। আসেননি। ৮০ বছর ধরে সংবিধান সংশোধনের পরও তা হয়নি। এবং পরের ৮০ বছরেও হবে না। কারণ, সেই উদ্যোগটাই সরকারের নেই। তারা মন দিয়েছে শুধু মোড়কে। ‘ওই জাতের’ সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিনিধিরাই যে ভোটটা নিশ্চিত করবে! বাকিদের তারা প্রভাবিত করবে নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলকে সমর্থন জোগানোর জন্য। কিন্তু সরকার যদি কখনও আস্তরণটা তুলে দেখত, চোখে আসত ছিন্নবিচ্ছিন্ন এক অন্দরমহল। সেই ভিতরঘর জানে না, মেধাবী ছেলেটা বা মেয়েটাকে কলেজে পড়াতে গেলে কোথায় আবেদন করতে হবে। তারা জানে না, ওই এক সার্টিফিকেটের জন্য আরও কী কী সুবিধা তারা পেতে পারে। কারণ, সরকার সেই সচেতনতা তৈরির প্রয়োজনই বোধ করেনি। তারা ক্লাস্টার তৈরি করে গোটা দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষকে বোঝায়নি। তাদের সামনের সারিতে নিয়ে আসার মতো সচেতন করেনি। শুধু মনে করেছে, কোটার ব্যবস্থা করে দিলেই হল। বাকি যেমন চলছে চলুক। আর ঠিক এই কারণেই আঙুল ওঠে সিস্টেমের দিকে। সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত সংরক্ষণের আওতাধীন শ্রেণির মধ্যে থেকে ‘ক্রিমি লেয়ার’ বা চূড়ান্ত সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও পরিবারকে বাদ রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা মনে করিয়ে দেয়। তারা বলে, সত্যি কাদের জন্য সংরক্ষণ দরকার, তা খুঁজে বের করতে হবে। পরিস্থিতি এই সমীকরণে চললে ভবিষ্যতে বিক্ষোভের আঁচ যে ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়বে, সেটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। সরকার অবশ্য বলবে, আমরা তো ঊর্ধ্বসীমা ঠিক করে দিয়েছি! ৮ লক্ষ টাকার 
উপরে উঠলে ‘ক্রিমি লেয়ার’! সরকার বাহাদুর একবার ভেবে দেখতে পারেন, বছরে ৮ লক্ষ টাকা আয় করলে মাসে কত হাতে আসে? ৬৬ হাজার টাকা। কেন্দ্রেরই রিপোর্ট বলছে, দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষ এই অঙ্ক পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। বছরে ১০ লক্ষ টাকার উপর আয় করেন মাত্র ৬৯ লক্ষ নাগরিক। তাহলে এই সমীকরণে নিশ্চয়ই ’ক্রিমি লেয়ার’ বাছাই সম্ভব নয়! সেক্ষেত্রে অন্য কোনও উপায় খুঁজতে 
হবে। যেতে হবে ঘরে ঘরে। ক্ষমতার জন্য 
মানুষকে ব্যবহার বন্ধ করে মানুষের স্বার্থে ক্ষমতা ব্যবহার করতে হবে। এটাই রাজধর্ম। সংরক্ষণ যার সত্যিই প্রয়োজন, সে আরও গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে 
না তো? কিংবা গরিব ঘরের মেধাবী সন্তান স্রেফ 
টাকা আর সুযোগের অভাবে দিনমজুরে পরিণত হচ্ছে না তো? এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে সরকারকেই।
এ এক অদ্ভুত দাঁড়িপাল্লার উপর বসে আছে সমাজ। লাগাতার পরীক্ষা চলছে মানুষের উপর। এক শ্রেণিকে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি কেড়ে নিচ্ছে আর এক শ্রেণির অধিকার। ক্ষোভ বাড়ছে অন্তঃসলিলা নদীর মতো। বিস্ফোরণের নিরন্তর অপেক্ষা কিন্তু হঠাৎ একদিন শেষ হয়ে যেতে পারে। যেমন হয়েছে বাংলাদেশে। যে বৈষম্য থেকে আন্দোলনের সূচনা, সুপ্রিম কোর্ট তো তা দূর করার চেষ্টা করেছে। সরকারও বলেছে, আমরা সংরক্ষণের পক্ষে নই। তাহলে নতুন করে কেন দানা বাঁধল আন্দোলন? আসলে বাংলাদেশের এই সমাজ এখন হিংসার স্বাদ পেয়ে গিয়েছে। তারা আজ পতন চায় সরকারের। ইন্ধন কি নেই? সব দেশে থাকে। এখানেও আছে। ঘরের ভিতরের... হতে পারে বাইরের। কিন্তু সারমর্ম হল একটা শিরোনাম—অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশ। আর তার জেরেই পদত্যাগ করতে হয়েছে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। বৃদ্ধ, মহিলা, শিশু... হু হু করে বেড়েছে মৃতের সংখ্যা। ছাদে ছিল ওই কিশোর। বন্দুকের একটি হুঙ্কার... থেমে গিয়েছে তার হৃদস্পন্দন। রাস্তায় গণ্ডগোলের শব্দ শুনে শিশুটি গিয়েছিল জানালা বন্ধ করতে। ছিটকে আসা গুলি ফুঁড়ে দিয়েছে তাকে। একটি সংরক্ষণের ইস্যুকে সরকার পতনের মাধ্যম করে তুলেছে বিরোধী শক্তি।
ভারতের নাগরিক অরিত্র মুখোপাধ্যায়। সাধারণ নাগরিক। জেনারেল ক্যাটিগরি। বলছিলেন, ‘আন্দোলন চলছে। এভাবেই। শুরু হয় কিছু স্লোগানে। শান্ত হয় অগুনতি মৃতদেহের উপর দাঁড়িয়ে। ভয় হয়, আমাদের জন্যও এমন কিছু অপেক্ষা করে নেই তো? সেটা হলে দায় নিতে হবে রাজনীতিকেই। যে সংবিধান আমাদের জাতপাতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা বলে, সেখানেই জাতের ভিত্তিতে সংরক্ষণের ধারা যোগ করা হয়। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয় বৈষম্যটাকে। মেনে চলতে বাধ্য করা হয়। একই পরীক্ষায় একদল ২০-৩০ নম্বর হাতে নিয়ে বসে, আর একদল মাইনাস ৫০ থেকে শুরু করে। একেই কি সমান অধিকার বলে?’
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

বহু প্রচেষ্টার পর আটকে থাকা কাজের জটিলতা মুক্তি। কৃষিজ পণ্যের ব্যবসায় বিশেষ উন্নতি। আয় বাড়বে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৫ টাকা৮৪.৮৯ টাকা
পাউন্ড১০৭.৭৯ টাকা১১১.৩৩ টাকা
ইউরো৯০.৯৫ টাকা৯৪.১৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা