বিশেষ নিবন্ধ

‘বেগমপাড়া’ এক অবৈধ স্বর্গরাজ্য!
মৃণালকান্তি দাস

টরন্টোর পাশে লেক অন্টারিওর তীরের এক ছোট্ট শহর। মিসিসাগা। বছর দশেক আগে শহরের একটি বড় কন্ডোমিনিয়াম (বহুতল ভবন) হঠাৎ করেই কানাডার সংবাদমাধ্যমের নজরে আসে। সেই কন্ডোমিনিয়ামে মূলত থাকেন দক্ষিণ এশিয়া থেকে যাওয়া বহু অভিবাসী পরিবার। এইসব পরিবারের স্বামীরা কাজ করেন আরব দুনিয়ার 
বিভিন্ন দেশে।
স্বামীদের অনুপস্থিতিতে স্ত্রীদের নিঃসঙ্গ জীবন নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করেন ভারতীয় পরিচালক রশ্মি লাম্বা। নাম ‘বেগমপুরা: দ্য ওয়াইভস কলোনি।’ রশ্মি লাম্বা তুলে ধরেন এক অদ্ভুত জীবনকাহিনি। আরব দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে উচ্চ বেতনে কাজ করেন ভারত, বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের যেসব ইঞ্জিনিয়ার, তাঁদের অনেকেই জীবনের একটা সময় সপরিবারে কানাডায় চলে আসেন অভিবাসী হয়ে। কিন্তু তাঁরা কানাডায় তাঁদের পেশাগত যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ খুঁজে না পেয়ে আবার ফিরে যান আরব দুনিয়ায়। পরিবার রেখে যান কানাডায়। খোঁজ মেলে মিসিসাগার কয়েকটি কন্ডোমিনিয়াম, যেখানে থাকতেন এরকম অনেক পরিবার। সেই কন্ডোমিনিয়ামগুলি পরিচিত হয়ে ওঠে ‘বেগমপুরা’ নামে। যেখানে স্বামীর অনুপস্থিতিতে বেগম বা স্ত্রীরাই কীভাবে একা হাতে পরিবারের দায়িত্ব সামলান। সেই সিনেমা নিয়ে আলোচনা শুরু হয় কানাডার সংবাদমাধ্যমে। আর এই ছবির সূত্র ধরে সেখানকার পত্র-পত্রিকাতেও প্রকাশিত হতে থাকে নানা প্রতিবেদন। যেসব প্রতিবেদনে যুক্ত হয়ে যায় বাংলাদেশের নামও।
বেগমপুরার আসল কাহিনি লিখলেন কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক শওগাত আলি সাগর। টরন্টো স্টারে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ওই সাংবাদিক লিখলেন, তৃতীয় কোনও দেশ হয়ে বাংলাদেশ থেকে কানাডায় অর্থ পাচার করা হচ্ছে। শওগাত আলি সাগরই প্রথম ‘বেগমপাড়া’ কথাটি ব্যবহার করেছিলেন। সেই সূত্রেই রশ্মি লাম্বার ‘বেগমপুরা’ বাংলাদেশে একসময় হয়ে গেল ‘বেগমপাড়া’। যার অর্থ একটাই: বাংলাদেশের দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী-আমলা-রাজনীতিকদের কানাডায় পাড়ি জমিয়ে সেখানে দ্বিতীয় ভুবন গড়ে তোলা। শওগাত আলি সাগরের অভিযোগ, ‘বেগমপুরায় যে বেগমদের কথা বলা হয়েছে, তাঁদের সঙ্গে বাংলাদেশের কথিত বেগমপাড়ার বেগমদের অনেক তফাৎ। বেগমপুরার বেগমদের স্বামীরা পেশাজীবী, আরব দুনিয়ার কোনও দেশে কঠোর পরিশ্রম করে সেই অর্থ পরিবারের জন্য কানাডায় পাঠান। আর বেগমপাড়ায় আসলে সপরিবারে দুর্নীতিগ্রস্তদের বাস। যেখানে দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে অর্জিত বিপুল সম্পদ কানাডায় পাচার 
করে সেখানে আয়েশি জীবনযাপন করছে বহু বাংলাদেশি পরিবার।’
একসময় সেই বেগমপাড়ায় বাসস্থান খুঁজে নিয়েছিলেন কানাডায় যাওয়া বাংলাদেশি শ্রমিকরা। তাঁরা কেউ কেউ দেশে ফিরে আসেন। অনেকে সেখান থেকেই পরিবারের জন্য টাকা পাঠাতেন। শিল্পীরা নাকি ভবিষ্যতের আভাস আগেভাগেই পান। নব্বই দশক থেকে সেখানে ভিড় বাড়ে বাংলাদেশের অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক ও সাহিত্যিকদের। এরপর যাওয়া শুরু করেন টাকাওয়ালা মানুষরা। এঁদের কেউ কেউ যাওয়া-আসার মধ্যে থাকলেও এখন বেশিরভাগই অন্য ভুবনের স্থায়ী বাসিন্দা। বাংলাদেশে সম্পদ বানিয়ে নিয়ে গিয়েছেন বিদেশে। সাংবাদিক শওগাত আলি সাগরের কথায়, বাস্তবে কানাডায় আজ এমন কোনও সুনির্দিষ্ট এলাকা নেই, যাকে ‘বেগমপাড়া’ বলা যায়। গোটা দেশেই অভিজাত এলাকাগুলিতে ভিনদেশি দুর্নীতিগ্রস্তদের বাস। হঠাৎ করে তাঁরা কানাডায় এসে উপস্থিত হয়, আর রাতারাতি এক বা দুই মিলিয়ন ডলারের বাড়ি কিনে ফেলেন। 
খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, কানাডার বেগমপাড়াগুলি এখন পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কিছু ধনী ও অতি ধনী পরিবারের দ্বিতীয় ঠিকানা। টাকা কামাতে তাঁরা কষ্ট করে দেশে থাকেন। আর তাঁদের পরিবার সেই টাকায় বিদেশে আলিশান জীবন কাটান। যত দিন টাকা বানানো যাবে, তত দিন সাহেবেরা থাকেন নিজের দেশে আর বেগমরা থাকেন বিদেশে। শেখ হাসিনা সরকারের শেষ কয়েক বছর সেই কোটিপতিরাই দল বেধে দেশ ছেড়েছেন। কেবল ঋণখেলাপি, লুটেরা ব্যবসায়ীরাই নন, অনেক সরকারি অফিসাররাও বেগমপাড়ায় ঠিকানা করে নিয়েছেন। ওয়াশিংটনের গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির হিসেবে, ২০১৫ সালে বাণিজ্যে কারসাজির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গিয়েছে। অনেক বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী তাদের ব্যবসা ও অফিস নিয়ে গিয়েছে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ায়। অনেকে সম্পদ সরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ায়। এটা শুধু বাংলাদেশের ঘটনা নয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল জি-৭৭ ভুক্ত উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এই প্রবণতার বাড়াবাড়ির কথা জানিয়েছে।
২০০৮ হতে ২০১৪ সময়কালে সবচেয়ে বেশি ব্যবসায়ী কানাডায় গিয়েছে। তখন ইনভেস্টমেন্ট ক্যাটাগরিতে একটি ভিসা দেওয়া হতো। কানাডায় একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক বিনিয়োগ করে বা কানাডার সরকারের কাছে অর্থ জমা রেখে ইমিগ্রেশনের সুযোগ ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে কানাডার সরকার তা বন্ধ করে দেয়। এর অন্যতম কারণ নাকি ছিল, এই ক্যাটাগরিতে আসা অভিবাসীদের কর পরিশোধের রেকর্ড। দেখা গিয়েছে, কানাডার একেবারে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ যে পরিমাণ কর দেন, ওই ব্যবসায়ীদের দেওয়া করের পরিমাণ তার চেয়েও কম। বা তারা একেবারেই কর দেয় না। ফলে কানাডা সরকার বাধ্য হয়ে এই স্কিম বন্ধ করে দেয়।
তথ্য বলছে, ব্যাপকহারে কানাডায় অভিবাসন প্রথম শুরু হয় ২০০৭-২০০৮ সালে। যখন বাংলাদেশে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হয়। তখন বাংলাদেশ থেকে ব্যবসায়ীদের একটি দল কানাডায় যায়। টরন্টোর বেলভিউ এলাকায় কিছু হাই রাইজ কন্ডোমিনিয়াম রয়েছে। বেশ বিলাসবহুল। ডাউনটাউন থেকে বেশি দূরে নয়। প্রথম যে ব্যবসায়ীরা এসেছিলেন, তাঁরা ওখানেই উঠেছিলেন। তারপরে ঝাঁক ধরে যাঁরা এসেছেন, তাঁরাও ওখানেই ঘাঁটি গেড়েছেন। টরন্টোর একেবারে প্রাণকেন্দ্র সিএন টাওয়ারের পাশে আরও একটি কন্ডোমিনিয়াম আছে। সেটি অনেক বেশি বিলাসবহুল। সেখানেও অনেক বাংলাদেশি রয়েছে। অনেকে আবাস কিনে রেখে চলে গিয়েছে। তবে এর পরে যাঁরা এভাবে কানাডায় অভিবাসী হয়েছেন, তাঁরা ছড়িয়ে পড়েছেন আরও বিভিন্ন জায়গায়। এঁদের পছন্দ ছিল এমন জায়গা, যেখানে সাধারণ বাংলাদেশিদের সঙ্গে তাঁদের মিশতে হবে না। তাঁরা ছয়, সাত বা আট হাজার স্কোয়ার ফিটের বড় বড় বাড়ি কিনেছেন। অথচ, তাঁদের আয়ের উৎস কী কেউ জানে না। সেজন্য কানাডার বেগমপাড়াগুলি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশি ধনী ব্যক্তিদের বিদেশে ‘অবৈধ স্বর্গ’ বানানোর প্রতীক। বেগমপাড়ার এই মালিকদের অর্থের তাণ্ডবে গত এক দশকে টরন্টো নগরী এবং আশপাশের শহরগুলিতে বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্টের দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়ে গিয়েছে। কানাডায় আজ বাংলাদেশি ‘বেগম’দের আরাম-আয়েশ দেখলে মোগল বেগমরাও হিংসায় জ্বলতেন। তাঁদের অ্যাপার্টমেন্টগুলি বিলাসবৈভবে ভরা। তাঁদের সন্তানরা কানাডার ভালো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে। ‘বেগম’দের একমাত্র কাজ হল, ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করা আর ‘আরাম’ করা। খরচ বেশি নয়। মাত্র দেড় লাখ কানাডীয় ডলার জমা দিলেই কানাডা আপনাকে নাগরিকত্ব দেবে। বেগমদেরও এই পরিমাণ টাকা দিতে হয়েছে। বিনিময়ে তাঁরা পেয়েছেন প্রবাসে নিরাপদ ঘর।
এই ব্যবস্থা চালু করার পিছনে কানাডার নিজস্ব স্বার্থ আছে। সে দেশে যে কাউকে প্রশ্ন করুন, ইউরোপ-আমেরিকার মতো কানাডা অর্থনৈতিক ধসের শিকার হয়নি কেন? উত্তর একটাই— বাংলাদেশিদের ‘রেমিট্যান্স’। সত্যিই বাংলাদেশি সাহেবরা কত শত-হাজার কোটি টাকা কানাডায় পাচার করেছেন, তা অজানাই রয়ে গিয়েছে। মার্কিন প্রতিষ্ঠান ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্ক জানাচ্ছে, ১৯৭৬ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে এক লাখ ৯৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে। ইউএনডিপি জানাচ্ছে, অবৈধ পুঁজি পাচারে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষে। ঠিক কতজন বাংলাদেশি কত শত-হাজার কোটি টাকায় এভাবে নাগরিকত্ব কিনছেন, তার সঠিক কোনও পরিসংখ্যান জানা যায়নি। সম্প্রতি একজন সরকারি অফিসারের বিরুদ্ধে গত ৪০ বছরের আদমশুমারির গোপনীয় ‘র-ডাটা’ বিদেশিদের কাছে বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল। তাঁর মতো অনেকেই রয়েছেন। শেয়ার মার্কেট, হল-মার্ক, ডেসটিনি, সোনালি ব্যাঙ্কের টাকা কোথায় গিয়েছে কেউ জানে না। এভাবে স্বদেশে ঘুষ-দুর্নীতি-দখলবাজি করে অনেকেই বনে গিয়েছেন বিদেশের ‘সম্মানিত’ নাগরিক। বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতনের অন্যতম কারণ বেগমপাড়ার এই দুর্নীতিবাজরাই।
প্রশ্ন হল, কানাডার বেগমপাড়ার সঙ্গে ভারতের কোনও যোগসূত্র রয়েছে? এ দেশেও তো নেতাদের পুকুরচুরি থেকে শিল্পপতিদের ঋণখেলাপি, ছোট-বড় চুরি-ডাকাতি থেকে কেনাবেচায় কর ফাঁকি, হরেক রকম দুর্নীতি ঘটেই চলেছে চার পাশে। কর ফাঁকি দেওয়া, ব্যবসার আইনি কাগজপত্র না থাকা সত্ত্বেও প্রভূত রোজগার করা, ছোট-বড় বিভিন্ন রকমের তোলাবাজি, দেশ-বিদেশের সীমান্ত পার করা চোরা ব্যবসা, সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করা— সবই দুর্নীতি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) -এর বার্ষিক রিপোর্ট জানাচ্ছে, গত এক বছরে দুর্নীতির ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান আরও নিম্নগামী হয়েছে। ২০২২ সালে এই রিপোর্টে ভারতের স্থান ছিল ৮৫। আর ২০২৩ সালের ‘বিশ্ব দুর্নীতি সূচক’ (করাপশন পারসেপশন্স ইনডেক্স বা সিপিআই)-এ ১৮০টি দেশের এই তালিকায় ভারতের স্থান ৯৩। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি বা উইলফুল ডিফল্টারের থেকে বকেয়া অর্থের পরিমাণ মার্চ ২০১৯ থেকে প্রতিদিন বেড়েছে ১০০ কোটি টাকারও বেশি। ট্র্যান্সইউনিয়ন সিবিলের সমীক্ষা রিপোর্টে জানা গিয়েছে, যে অঙ্ক গত চার বছরে আড়েবহরে বেড়ে পৌঁছে গিয়েছে ৩ লাখ কোটি টাকায়।
প্রশ্ন হল, দুর্নীতির এই টাকা যায় কোথায়? কানাডার কোনও ‘বেগমপাড়া’, অস্ট্রেলিয়ার সিডনির ‘ফ্রেটারনিটি’ নাকি মালয়েশিয়ার ‘সেকেন্ড হোম’-এ? কেউ জানে না!
22d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

বহু প্রচেষ্টার পর আটকে থাকা কাজের জটিলতা মুক্তি। কৃষিজ পণ্যের ব্যবসায় বিশেষ উন্নতি। আয় বাড়বে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৫ টাকা৮৪.৮৯ টাকা
পাউন্ড১০৭.৭৯ টাকা১১১.৩৩ টাকা
ইউরো৯০.৯৫ টাকা৯৪.১৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা