বিশেষ নিবন্ধ

প্যারিসের ওলিম্পিক্স ভিলেজ যেন পাশ্চাত্যের বস্তি
সন্দীপন বিশ্বাস

ওলিম্পিক গেমসকে বলা হয় ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’। ক্রীড়াবিদদের চমকে দেওয়া পারফরমেন্স, টান টান লড়াই, রেকর্ড ভাঙার অদম্য ইচ্ছা, পদক জয়ের জন্য নিজেকেও ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা— এসব দেখে মনে হয় ওলিম্পিক গেমস সত্যিই গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ। একটা প্রাথমিক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সদ্য সমাপ্ত ওলিম্পিক গেমসে যোগদান করেছিলেন ১৮৪টি দেশের চোদ্দো হাজারের বেশি প্রতিযোগী। তাঁরা সকলে লড়াই করেছিলেন ৩২৯টি ইভেন্টে পদক জয়ের জন্য। কেউ গ্যালারিতে বসে আবার কেউবা টিভিতে এই লড়াই উপভোগ করেছেন। জয়ের কিংবা পরাজয়ের পর প্রতিযোগীদের আনন্দ বা ব্যথার অশ্রুতে ভিজে গিয়েছে ওলিম্পিক গেমসের মাটি। ওলিম্পিক গেমস তাই সব সময় এক বীরত্বের কথা বলে। জয়ীকে যেমন তাঁর সম্মান ধরে রাখতে প্রেরণা দেয়, তেমনই বিজেতাকেও নতুন শপথে ফিরে আসার প্রতিজ্ঞায় ঋদ্ধ করে। 
কিন্তু এই উজ্জ্বল আলো, ক্যামেরার ফোকাসের বাইরে ছিল ওলিম্পিক্সের আরও একটা গল্প। সেই গল্প মোটেও সুখকর নয়। সেই গল্পের মধ্যে মিশে আছে অবহেলা আর দায়িত্বজ্ঞানহীনতার ছোঁয়া। যেন প্রদীপের নীচে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘন অন্ধকার। বিশ্বের সমস্ত প্রতিযোগী থাকেন ওলিম্পিক্স ভিলেজে। প্রতিযোগীদের স্বাচ্ছন্দ্য দান, তাঁদের খাওয়া দাওয়া ইত্যাদি ব্যাপারে দায়িত্ব থাকে আয়োজক দেশের। এবার প্যারিসের সেই ভিলেজকে কেন্দ্র করে অসংখ্য নিন্দাজনক ঘটনা ঘটেছে। সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছিলেন প্রতিযোগীরা।
সারাদিনের অনুশীলন শেষে কিংবা প্রতিযোগিতার শেষে ক্রীড়াবিদরা যখন ক্লান্ত দেহে বিছানায় শুতে যাচ্ছেন, তাঁরা তো অবাক। সেই বিছানা কাঠ, প্লাই কিংবা লোহা দিয়ে তৈরি নয়। সেগুলি ছিল কার্ডবোর্ড দিয়ে তৈরি। কোনওরকমে একজন শুতে পারবেন। এক বিছানায় দু’জন শোয়ার চেষ্টা করলেই সেই বিছানা ভেঙে পড়বে। শয্যাসামগ্রীও যথেষ্ট উপযুক্ত মানের ছিল না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন ভিলেজে থাকা প্রতিযোগীরা। না, এখানেই শেষ নয়। সকালবেলা ব্রাশ করা থেকে শুরু হয়ে যেত জলের সঙ্কট। বাথরুম ব্যবহার করতে গিয়েও লাইন দিতে হয়েছে প্রতিযোগীদের। বহুক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে দশজনের জন্য বরাদ্দ পাশাপাশি দু’টি বাথরুম। ফলে সকাল হলেই সেখানে পড়েছে লাইন। স্নান কিংবা পানীয় জল পর্যাপ্ত মিলত না। ফুড কোর্টেও একই অবস্থা। সেখানেও বিশাল লাইন। প্রতিটি প্রতিযোগী বিভিন্ন ধরনের খাদ্য গ্রহণ করেন। কতটা পুষ্টি, কতটা ফ্যাট দরকার, সেই অনুযায়ী তাঁদের খাদ্যতালিকা তৈরি হয়। কিন্তু সেখানেও নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। যাঁরা শেষের দিকে লাইনে দাঁড়িয়েছেন, তাঁরা বহুক্ষেত্রে খাবার পাননি। অথবা বলা হয়েছে, ‘একটু অপেক্ষা করুন, খাবার আসছে।’ কখনও কখনও সেই খাবার আসতে আধঘণ্টাও হয়ে যেত। সবসময় সমস্যা দেখা দিত ডিম এবং মাংসের ক্ষেত্রে। এই কারণে কর্তৃপক্ষ ডিম এবং মাংসের ক্ষেত্রে মাথাপিছু বরাদ্দ করেছিল। অর্থাৎ রেশনিং সিস্টেম চালু হয়েছিল। সেক্ষেত্রে ক্রীড়াবিদদের পুষ্টির সঙ্গে আপস করতে হতো। অস্ট্রেলিয়ার সাঁতারু অ্যারিয়েন তিতমাস বলেছেন, ‘ঠিকমতো খাবার না পাওয়ার প্রভাব পড়েছে আমার পারফরমেন্সে।’ ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখা যাক। এবছরই অস্ট্রেলিয়ায় সুইমিং ট্রায়ালে তিনি দুশো মিটার ফ্রি স্টাইলে রেকর্ড করেন। গতবারের ওলিম্পিক্সে তিনি দুশো মিটার ফ্রি স্টাইলে ওলিম্পিক্স রেকর্ড করেছিলেন। মোট ছয়টি বিশ্ব রেকর্ড এই মহিলা সাঁতারুর ব্যাগে। এবারের ওলিম্পিক্সে তিনি দু’টি সোনা এবং দু’টি রুপো পেয়েছেন। গেম শেষে দেশে ফিরে টিভি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘প্রথম দিকে একদিন আমাদের বিছানার চাদর বদল করা হয়েছিল। তারপর যতদিন থেকেছি, একদিনও তা বদল করা হয়নি। বিছানায় শুতে গা ঘিন ঘিন করত। একটা অ্যাপার্টমেন্টে যতজন থাকতেন, তাঁদের সকলের জন্য দেওয়া হতো মাত্র একটা টয়লেট রোল। সেটা চারদিন ব্যবহার করতে হতো।’ সাঁতারে ইতালির সোনাজয়ী টমাস চেকনও ভিলেজ নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এসি না থাকার জন্য আমাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। সেই সঙ্গে খাবার দাবারও ছিল অখাদ্য।’ 
ফ্রান্সের মতো এক উন্নত দেশে প্যারিসের মতো এক হাইটেক তথা শিল্পের তীর্থভূমিতে এই ধরনের ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা, ভাবতেও কষ্ট হয়। কিন্তু বাস্তব ঘটনা বলছে, এত খারাপ ব্যবস্থাপনা এর আগে কোনও ওলিম্পিক্সে দেখা যায়নি। আয়োজক দেশ অবশ্য বলছে, ‘আমরা নানাভাবে চেষ্টা করেছি। থার্মাল কুলিং সিস্টেম ব্যবহার করে প্রাকৃতিক উপায়ে বিভিন্ন রুমকে ঠান্ডা করার চেষ্টা হয়েছে।’ কিন্তু ৫২ হেক্টর জমির উপর তৈরি ভিলেজকে ঠান্ডা করা যায়নি। আয়োজকদের বক্তব্য, ‘ঘরগুলি এমনভাবে তৈরি যে, বাইরের থেকে ঘরের তাপমাত্রা অন্তত ছয় ডিগ্রি কম হবে।’ রোমানিয়ার টেবিল টেনিস খেলোয়াড় ওসব সিস্টেমের কথা উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘কম হলেই বা কী! ঘরের তাপমাত্রাকে কি শুধু পাখা চালিয়ে জব্দ করা যায়?’ হাঁটা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী অস্ট্রেলিয়ার রিডিয়ান কাউলি বলেছেন, ‘এই ধরনের তাপমাত্রায় যে কোনও অ্যাথলিট বিপদের মুখে পড়তে পারতেন। জীবন সংশয়ের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
ওলিম্পিক গেমস চলাকালীন প্যারিসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠেছিল। ফিল লাইক বা গরমের অনুভূতি ছিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। বিশেষষজ্ঞরা এই উষ্ণতাকে ‘রিংস অব ফায়ার’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তা সত্ত্বেও ভিলেজে ছিল না কোনও শীততাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। কেন? কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, ‘এতগুলি এসি চললে তা পরিবেশের পক্ষে খারাপ হবে।’ সুতরাং হে প্রতিযোগীগণ, এসি ব্যবহার  না করে পরিবেশ রক্ষা করুন। তাই কানাডা, আমেরিকা, রাশিয়া, ইতালি কিংবা ডেনমার্কে সহ বহু দেশের প্রতিযোগীরা নিজেদের ব্যবস্থাপনায় পোর্টেবল এসি ব্যবহার করেছেন। ভিলেজে অবশ্য প্রচুর গাছপালা ছিল। অনেককেই দেখা গিয়েছে দুপুরে ঘর থেকে বাইরে এসে গাছতলায় শুয়ে ঘুমোচ্ছেন। সত্যিই কি এমন দৃশ্য কল্পনাতে আনা যায়!  
এরপরও ছিল পরিবহণ সমস্যা। কোনও প্রতিযোগীকে ভিলেজ থেকে হয়তো দশ-পনেরো কিলোমিটার দূরে যেতে হবে। সেখানে কোনও স্টেডিয়ামে তাঁর ইভেন্টে। তার জন্য পরিবহণের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু দেখা গিয়েছে, বহুক্ষেত্রেই বাস এসেছে নির্দিষ্ট সময়ের আধঘণ্টা পরে। কী করা উচিত বুঝতে পারেননি প্রতিযোগীরা। ভিলেজে থাকা স্বেচ্ছসেবকরা পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, ‘স্যার বাসের জন্য অপেক্ষা না করে ট্রেনে চলে যান, নাহলে সময়ে পৌঁছতে পারবেন না।’ সেই মুহূর্তে প্রতিযোগী, ম্যানেজার সহ টিমকে পড়িমড়ি করে স্টেশনের দিকে ছুটতে হয়েছে। যেসব বাসে প্রতিযোগীদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেগুলিতেও কোনও এসি ছিল না।     
ট্রায়াথেলন প্রতিযোগিতার একটি অংশ হল সাঁতার। সেই সাঁতারের অংশটুকু হয়েছিল শ্যেন নদীতে। প্রতিযোগীদের অভিযোগ, ‘নদীর জল যথেষ্ট দূষিত ছিল।’  এইসব দেখে বহু প্রতিযোগী প্রেসের কাছে সরাসরি বলেছেন, ‘এই রকম জঘন্য ব্যবস্থায় ভালো পারফর্ম করা খুবই কষ্টসাধ্য।’ তাই ওলিম্পিক্স চলাকালীন বহু প্রতিযোগী ভিলেজের বাইরে নিজেদের উদ্যোগে এবং নিজেদের ব্যয়ে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু প্যারিসের মতো শহরে সব প্রতিযোগীর তো আর বাইরে নিজের উদ্যোগে থাকার মতো ট্যাঁকের জোর নেই, তাই অনেককেই গজগজ করতে করতে সেই খাবারই খেতে হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়, আধুনিক ওলিম্পিক্সের জনক পিয়ের দ্য কুবার্তিনের জন্ম প্যারিসেই। তিনি আজ এই ব্যবস্থা দেখলে খুবই রুষ্ট হতেন।        
আমাদের দেশের প্রতিযোগীরাও গরমের মধ্যে এসি না থাকায় অভিযোগ জানিয়েছিলেন। আমাদের দেশ থেকেও পোর্টেবল এসি পাঠানো হয়েছিল প্রতিযোগীদের জন্য। ওলিম্পিক্স শেষে দেশে ফিরে পদকজয়ীরা যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করতে যান, তখন তিনি বলেন, ‘এসি না থাকায় তোমাদের খুব কষ্ট হয়েছিল তো?’ এরপর তিনি তাঁদের সঙ্গে রসিকতা করে বলেন, ‘কারা এসব রটায় যে, মোদি শুধু কথাই বলেন, কোনও কাজ করেন না!’
শুধু কি খেলোয়াড়রাই সমস্যায় পড়েছিলেন? না, দর্শকরাও খুব সমস্যায় পড়েছিলেন। গরমে শরীর শীতল করতে যে জল খাবেন, তারও উপায় নেই। গরম জল খেতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে কোথাও কোথাও দর্শকদের জন্য হাল্কা শাওয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখানে দর্শকরা মনের আনন্দে নিজেদের একটু ভিজিয়ে নিয়েছেন। গরম জেনেও কেন এত কষ্ট করতে এসেছেন? এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে ব্রাজিল থেকে আসা এক দর্শক মজা করে বলেছিলেন, ‘ওলিম্পিক গেমসের মাহাত্ম্যই আলাদা। সেই গেমস দর্শন করলে পুণ্যলাভ হয়।’ 
ঠিক তাই, এই গেমস যেন এক রূপকথার মতো। সেখানে পদক জয় বড় কথা নয়, অংশগ্রহণই বড় কথা। সবার রঙে রং মিলিয়ে পাঁচটি বৃত্তের বন্ধনে বেঁধে ফেলা যায় সবক’টি মহাদেশকে। তাই তো ওলিম্পিক গেমস গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ।
23d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

বহু প্রচেষ্টার পর আটকে থাকা কাজের জটিলতা মুক্তি। কৃষিজ পণ্যের ব্যবসায় বিশেষ উন্নতি। আয় বাড়বে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৫ টাকা৮৪.৮৯ টাকা
পাউন্ড১০৭.৭৯ টাকা১১১.৩৩ টাকা
ইউরো৯০.৯৫ টাকা৯৪.১৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা