বিশেষ নিবন্ধ

বৃহত্তর সর্বনাশের প্রতীক্ষায় বাংলাদেশ!
সন্দীপন বিশ্বাস

বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা দেখে সম্ভবত কবরে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অতর্কিতে একটা দিগভ্রান্ত আন্দোলনের ঢেউ এসে দেশটাকে উথালপাথাল করে দিল। সব দেশেই তো আন্দোলন হয়, বিশেষ করে ছাত্র আন্দোলন। তার একটা লক্ষ্য থাকে। থাকে একটা সৎ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কোনও আলোকোজ্জ্বল অবস্থানে পৌঁছে যাওয়া। সেভাবেই শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন। দাবি ছিল, কোটা সিস্টেম বাতিল করতে হবে। আন্দোলনের ঝাঁঝ দেখে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা তা মেনেও নিয়েছিলেন। তারপরেও কিন্তু আন্দোলন থামেনি। আরও ভয়ঙ্কর রূপে তা ফিরে এসেছিল। এবার অন্য ইস্যু। সেখান থেকেই বোঝা যায়, এই আন্দোলনের নিশ্চিত অভিমুখ মোটেই কোটা প্রত্যাহার ছিল না। তা ছিল একটা উপলক্ষ্য মাত্র, একটা মুখোশ। তাই পরবর্তী আন্দোলনে সেই মুখোশ খুলে গেল। উগ্র হেফাজত-জামাত-বিএনপির হাতে তামাক খেতে শুরু করলেন আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনের স্টিয়ারিং চলে গেল বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তি  হে-জা-বির  হাতে। তারা ছাত্রদের ক্রীড়নকের মতো ব্যবহার করতে থাকল। 
সোফোক্লিসের ‘আন্তিগোনে’ নাটকে আন্তিগোনের একটা সংলাপ ছিল। ‘উন্মত্ত জনতা আসলে একটা ভেড়ার পাল। কোনও শক্তি তাকে যেদিকে পরিচালিত করবে, প্রত্যেকে যুক্তিহীন মানসিকতা নিয়ে সেদিকেই অগ্রসর হবে।’ বারবার দেশে দেশে আন্দোলনে আমরা এমন ছবিই দেখতে পাই। আমাদের দেশেও এমন আন্দোলন অতীতে হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে সেই ছবিই দেখা গেল। আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আরও স্পষ্ট হয়ে গেল শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর সর্বত্র নির্বিচার লুটতরাজ ও গণহত্যা দেখে। ব্যক্তি আক্রমণের মাধ্যমে হিংসা চরিতার্থ করা, সম্পত্তি ধ্বংস করা, নির্বিচারে লুণ্ঠন চালানো— এই ছবিগুলো বারবার বলে দিচ্ছিল, তথাকথিত ছাত্রদের লক্ষ্য কী ছিল। আওয়ামি লিগের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের রাগের বশে তারা জীবন্ত অবস্থায় পাঁচতলা, ছ’তলা বাড়ি থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, কাউকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছে। এই কর্মকাণ্ড দেখে অনেকেরই মনে পড়তে পারে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে ঢাকায় ব্যাপক গণহত্যার কথা। ইতিহাসে যা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচিত। 
আন্দোলনকারীদের তো হাসিনার ওপর রাগ ছিল। সেই হাসিনা দেশ ছেড়েছেন। তাহলে যারা তার পরেও ওভাবে ভাঙচুর, লুটতরাজ, গণহত্যা চালাল, তারা কারা? তারা যদি সত্যিই বিএনপি বা জামাত হয়, তাহলে কি বাংলাদেশ তাদের দেশ নয়? তাহলে কি এতদিন গোপনে গোপনে তারা শত্রুর পতাকা বহন করেছিল? আসলে এটা সত্য যে, সেই একাত্তরের স্বাধীনতার পর দেশ থেকে রাজাকারদের দূর করা যায়নি। তারা ছদ্ম আবরণে নিজেদের ঢেকে প্রতি মুহূর্তে বাংলাদেশের ক্ষতি করে গিয়েছেন। 
আজ বাংলাদেশের এই অগ্নিগর্ভ সময়ে এক বৃদ্ধের মনে পড়ে একাত্তরের দিনগুলির কথা। তখন সে কিশোর। মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনত সে রেডিওয়, পড়ত কাগজে। মাঝেমাঝেই রেডিওয় গান বেজে উঠত, ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রনি— বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।’ গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ও অংশুমান রায়ের গাওয়া সেই গান যেন রক্তে দোলা দিত। কিংবা বঙ্গবন্ধুর জলদ গম্ভীর স্বরের দৃপ্ত বক্তৃতা— ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। ..রক্ত যখন দিয়েছি, তখন রক্ত আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব।’
এমন অনেকদিন হয়েছে, রেডিওয় শুরু হয়েছে রাত পৌনে আটটায় স্থানীয় সংবাদ। ‘আকাশবাণী কলকাতা। খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ মুক্তিযোদ্ধারা সাতক্ষীরা ও রাজশাহীতে খানসেনাদের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই চালিয়েছে।… ভারত নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ঘোষণা করেছে…। সারা বিশ্ব আজ এসে দাঁড়িয়েছে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে।’ রাস্তার ধারের কয়েকটি দোকানে জোরে রেডিও চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। চিৎপুরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেল ট্রাম, বাস। মানুষ বাস ও ট্রাম থেকে নেমে এসে খবর শুনতে লাগলেন। মানুষ তখন আবেগে ভাসছেন। যেদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হল, কলকাতার মানুষও একসঙ্গে উদ্বেলিত হয়েছিলেন স্বাধীনতার আনন্দে। বহু মানুষের মনে পড়েছিল সেই ’৪৭ সালের দিনগুলির কথা। তাড়াতাড়ি পোঁটলা বেঁধে রাতের অন্ধকারে ভিটে ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল। তাঁরাও সেদিন কাঁদলেন, আনন্দে ভাসলেন। মৃত স্ত্রীর উদ্দেশে মনে মনে প্রমোদদাদু বলেছিলেন, ‘সোনা বউ, আমাগো দ্যাশ স্বাধীন হইসে। তুমি দেখতে পাইলা না।’ রাজনৈতিক কাঁটাতারের সীমান্ত তখনও দুই বাংলার মানুষের হৃদয়কে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। তীব্র একটা বন্ধন, সেটা ছিল বাংলা ভাষার বন্ধন।
সেই স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আজকের প্রজন্ম সেই মানুষটারই মূর্তি ভাঙছে। যে মানুষটা প্রমেথিউসের মতো দেশের মানুষের জন্য স্বাধীনতার লড়াই করে, একটা জাতিকে জাগিয়ে তুলে মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে নামিয়ে দিতে পেরেছিলেন, তাকেই কয়েক বছরের মধ্যে গুলি করে মারা হয়েছিল। আসলে এটাই বোধহয় ইতিহাসের অন্ধ বিচার। বিপরীত শক্তির বুদ্ধিভ্রংশ মানসিকতা এভাবেই বোধহয় দেশকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে চায়। আমাদের দেশেও হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। স্বাধীনতার আঁতুড়ে গন্ধ তখনও দেশ থেকে মিলিয়ে যায়নি, তার মধ্যেই গুলি করে মারা হল গান্ধীজিকে। সেদিন গান্ধীকে  হত্যা করতে উগ্র হিন্দুত্বের মন্দবুদ্ধি নাথুরাম গডসেদের হাত এতটুকু কেঁপে ওঠেনি। এটা শুধু নাথুরামদের দোষ নয়, যাঁরা তাঁদের ভুল বুঝিয়ে হাতে বন্দুক তুলে দেন, দোষের দায়ভার তাঁদেরও নিতে হবে। 
গান্ধীজি ছিলেন একজন ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাবাপন্ন  মানুষ। মুজিবুর রহমানও তাই ছিলেন। মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোকে তিনি সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমানের স্বপ্ন ছিল আবার বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাতে হবে। সেই অশুভ স্বপ্ন বহু বাংলাদেশির মনে তিনি গেঁথে দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানের কৌশলে আবার বাংলাদেশে ফিরে এসেছিল জামাতরা। ২০০১ সালেই মৌলবাদীরা ওসামা বিন লাদেনের ছবি নিয়ে মিছিল করেছিল। তাতে স্লোগান ছিল, ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান।’ আজ সত্যি আমরা দেখলাম ‘সোনার বাংলা’কে একদল ধর্মোন্মাদ আফগানিস্তান বানিয়ে তুলেছে। একদিন যেভাবে মোল্লা ওমরের নির্দেশে আফগানিস্তানে বামিয়ানের ঐতিহাসিক বুদ্ধমূর্তি নির্বোধের মতো ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হয়েছিল,  হাসিনার দেশ ছাড়ার পর সেই একই ছবি আমরা দেখেছি। সর্বত্র মূর্তি এবং ভাস্কর্য চুরমার করে ভেঙে দেওয়ার যেন একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সাংবাদিক ও লেখক শাহরিয়ার কবির বেশ কয়েক বছর আগে বলেছিলেন, ‘৩০ লাখ শহিদ এবং বঙ্গবন্ধুর রক্তের সঙ্গে বেইমানি করে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু অনেক শ্রেয়।  রবীন্দ্রনাথের গানের মতো আমার সকল নিয়ে সর্বনাশের আশায় আমরা বসে থাকতে পারি না। বাংলাদেশ থেকে জঙ্গি মৌলবাদী সন্ত্রাস নির্মূল না হলে দেশ ও জাতির জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।’ 
হাসিনা ক্ষমতায় এসে মৌলবাদীদের কোমর ভেঙে দিয়েছিলেন। একটা ধর্মনিরপেক্ষ আবহাওয়া গড়ে তুলতে তিনি বারবার সচেষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর কি অন্য কোনও দোষত্রুটি ছিল না? অবশ্যই ঩ছিল। কিন্তু বিরুদ্ধবাদীদের কাছে তাঁর এই মৌলবাদ বিরোধী নীতিটি দমবন্ধের মতো করে তুলেছিল। তাই দীর্ঘদিন ধরেই ভিতরে ভিতরে চলছিল উস্কানি। কর্মহীন তরুণ যুবকদের খেপিয়ে হে-জা-বি কাজ হাসিল করল। 
আমরা কিন্তু ২০১৩ সালেও বাংলাদেশে উত্তাল আন্দোলন দেখেছি। শাহবাগ আন্দোলন হিসাবেই তা আজও স্মরণে রয়েছে। সেই আন্দোলনেও শরিক হয়েছিলেন তরুণরা। কিন্তু সেই আন্দোলনের অভিমুখ ছিল ঠিক আজকের বিপরীত। সেই সময় তরুণরা চাইছিলেন, এমন একটা বাংলাদেশ, যা শিক্ষিত এবং যুক্তিনির্ভর। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক ভাবনার বিরুদ্ধে সেদিন গর্জে উঠেছিলেন তরুণরা। গত দশ-এগারো বছরে সেই মানসিকতার অনেকটাই বদলে গিয়েছে। আমাদের দেশেও দেখি বহু তরুণের কথায় এবং আদর্শের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে বিচ্ছিন্নতার অভিশাপ।  এটাই কি তবে বেকারত্বের অনিবার্য পরিণতি? এটাই শেষ নয়, আছে আগামী কাল। ডলার বা ইউয়ানের উস্কানিতে দিগভ্রষ্ট হলে পরিণতি আরও ভয়ঙ্কর। শ্রীলঙ্কা থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সংবিধানকে সম্মান জানাতে পারে না যে আন্দোলন, সে একদিন নিজের রোষানলে নিজেই ছাই হয়ে যাবে।
এমনটাই বোধহয় ইতিহাসের লিখন। মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামীদের পরিবার আজ সেখানে মৃত্যুভয়ে কাতর। যে যেখানে পারছেন, আত্মগোপন করছেন। চলছে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড। সেখানে সংখ্যালঘুরাও সন্ত্রস্ত। উগ্র জামাতের হাত থেকে রক্ষা পেতে তাঁরা ইষ্টনাম জপ করছেন। নতুন এবং ‘স্বাধীন’ বাংলার সবক্ষেত্রে আজ ধর্মীয় উন্মাদনার লক্ষণ স্পষ্ট। ‘মাতব্বররা’ও হতচকিত। প্রাণ বাঁচাতে আজ সবাই ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলছেন, সাবাশ। সেখানে মানবিকতা, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সংবিধান এই মুহূর্তে মৃত। ফেরানোর লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। এটাই কি তবে নব্য গণতন্ত্রের স্বরূপ?
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

বহু প্রচেষ্টার পর আটকে থাকা কাজের জটিলতা মুক্তি। কৃষিজ পণ্যের ব্যবসায় বিশেষ উন্নতি। আয় বাড়বে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৫ টাকা৮৪.৮৯ টাকা
পাউন্ড১০৭.৭৯ টাকা১১১.৩৩ টাকা
ইউরো৯০.৯৫ টাকা৯৪.১৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা